আমরা শপথ রাখতে পারিনি
কী ঘটেছিল সেদিন? যে ঘটনার পর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার? যে ঘটনার পর পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতির আশ্বাস দিয়েছিলেন? মামলার প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতির জন্য তদন্তের ভার গোয়েন্দা বিভাগের কাছ থেকে সরিয়ে র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। র্যাবের দায়িত্ব গ্রহণের পর কবর থেকে ঘটা করে লাশ ওঠানো হয়, ডিএনএ সংগ্রহের নামে বয়ে গেল দুটি বছর। লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান তদন্ত কর্মকর্তারা। আরও একজন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, যিনি সেই ঘটনা উদ্ঘাটন করতে না পারলেও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করতে পিছপা হননি। সচিবালয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেছিলেন একজন সাংবাদিক নেতা। শেষ ভরসা ছিল সরকারপ্রধানের কাছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই সেই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে বলেছিলেন, সবার বেডরুমে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। তাহলে কি বিচারের বাণী নিভৃতেই কেঁদে যাবে? যে ঘটনা নিয়ে এত নাটকীয়তা, আসলে কী ঘটেছিল সেদিন?
আজও জানা হলো না। প্রতিদিন কত ঘটনাই তো ঘটে, সব খবর কি আমরা জানতে পারি? তবে সাংবাদিক হিসেবে সহকর্মীর এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর অন্তরালে লুকিয়ে আছে কোন রহস্য, তা জানতে আজও উদ্গ্রীব আমরা। মনের মধ্যে একটি প্রশ্ন সব সময় ঘুরপাক খায়, সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ দম্পতি, ফটোসাংবাদিক আফতাব হত্যা, পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজ দম্পতির মতো অনেক হত্যার জট খুলতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কারণ, এসব হত্যার পেছনে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত ছিল না। তাহলে কি ১১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার-মেহেরুন রুনি হত্যার পেছনে কোনো স্বার্থ লুকিয়ে আছে? সাগর-রুনি হত্যার পর সাংবাদিকেরা এক হয়ে লাগাতার আন্দোলনে রাস্তায় নামেন। একের পর এক কর্মসূচি দেওয়া হয় হত্যার নেপথ্য কারণ উদ্ঘাটনে, যেসব কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নিয়েছেন সাধারণ সংবাদকর্মীরা। প্রেসক্লাবের সামনে বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন মতাদর্শের সাংবাদিকেরা বিক্ষোভ কর্মসূচিতে হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সাগর-রুনি, তোমাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। এই ঐক্য অটুট থাকবে। তখনকার একটি শপথের কথা খুব বেশি কানে বাজে আজও—যারা সাংবাদিকদের এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করবে, ফাটল ধরানোর চেষ্টা করবে, তারা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
কিন্তু সেই সাগর-রুনির রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে নেওয়া ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ ভঙ্গ করেছেন নেতৃত্বে থাকা সাংবাদিকেরা। খোলস পাল্টিয়েই ক্ষান্ত হননি, সেই সঙ্গে বোল পাল্টাতেও দেরি করেননি। নিঃস্বার্থভাবে আমরা যারা সাগর-রুনিসহ সব সাংবাদিক হত্যার বিচার চেয়েছি, একই দাবিতে অটল রয়েছি। নিজেদের অধিকার আদায়ে আমরা এক থাকতে পারি না, নিজেদের গুণের প্রকট অভাব থাকলেও দোষের ছড়াছড়ি, তাহলে অন্যের কথা তুলে ধরব কীভাবে আমরা? সাগর-রুনির একমাত্র বংশধর ‘মেঘ’ আজ সবার মধ্যেও একা। আলোচিত এই সাংবাদিক দম্পতির হত্যার নেপথ্য নায়কদের পর্দার আড়াল থেকে বের করে আনা হবে কি না, জানি না মেঘ মা-বাবার হত্যার বিচার পাবে কি পাবে না। তাতে কারও কোনো ক্ষতি না হলেও সাংবাদিকতার জগতে যে এক বিশাল ক্ষতি হলো, তা নিশ্চিত। সাংবাদিকদের জীবনের নিরাপত্তা নেই, এটা সাধারণ মানুষের কাছে পরিষ্কার। শুধু মেঘের জন্য বলতে চাই, অনিশ্চিত এই পেশা থেকে শত মাইল দূরে থাকো। ঝড়ের আকাশে কালো মেঘ নয়, তুমি এক ফালি সাদা মেঘ হয়ে ভেসে থেকো বিশাল আকাশে।
দিপন দেওয়ান: স্টাফ রিপোর্টার, বাংলাভিশন।
দিপন দেওয়ান: স্টাফ রিপোর্টার, বাংলাভিশন।
No comments