শ্রদ্ধাঞ্জলি- ফজল শাহাবুদ্দীন: অকালে হঠাৎ by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
কবি ও সাংবাদিক ফজল শাহাবুদ্দীন চলে গেলেন পরপারে। অকালমৃত্যু বলা যাবে না, তবে কিছুদিন আগে পর্যন্ত বেশ সক্রিয় ছিলেন। আরও কিছু অবদান রাখার সুযোগ ছিল তাঁর। যেটুকু অবদান রেখে গেছেন, তাও অমূল্য।
বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে যাঁরা পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকে অবদান রেখে যাচ্ছেন, ফজল শাহাবুদ্দীন তাঁদের অন্যতম। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হকদের সাহিত্যসঙ্গী ফজল শাহাবুদ্দীন তাঁর অনবদ্য কবিতা দিয়ে সাহিত্য অঙ্গনে একটি আসন করে নিতে পেরেছিলেন ষাটের দশকেই। ফজল শাহাবুদ্দীন শুধু কবি ছিলেন না, একজন সাহিত্যকর্মীও ছিলেন। তাই দেখি কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় কবিতা পত্রিকা কবিকণ্ঠ প্রকাশ করেছিলেন। পত্রিকাটি নিয়মিত হয়নি। কয়েকটি সংখ্যা মাত্র প্রকাশিত হয়েছে। কবি ও কবিতা নিয়ে নানা সংগঠন, অনুষ্ঠান, সম্মেলন আয়োজন করেছিলেন। পতিত শাসক রাষ্ট্রপতি এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে ‘এশীয় কবিতা উৎসবের’ আয়োজন করে বিতর্কিত হয়েছিলেন। এখন এরশাদ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র। ইতিহাস ও ব্যাখ্যা কত দ্রুত বদলে যায়।
ফজল শাহাবুদ্দীন বিশ্বাস করতেন, কবিতা পাঠ বা কবিদের অনুষ্ঠান গরিবি হালে হবে না। তাই তিনি তাঁর সব সাহিত্য অনুষ্ঠান তিন বা পাঁচতারকা হোটেলে জাঁকজমকভাবে আয়োজন করতেন। তাঁর সাহিত্য বা সংগঠন-ভাবনা অন্যদের চেয়ে পৃথক ছিল। এরশাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল, কিন্তু কখনো রাষ্ট্রীয় অনুগ্রহ নেননি। কবিতা রচনা, আড্ডা ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গলাভেই ছিল তাঁর অপার আনন্দ। দিলখোলা মজলিসি মানুষ। কৌতুকপ্রিয়তা তাঁর স্বভাবের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। আড্ডাতে তিনিই থাকতেন মধ্যমণি হয়ে। মজার মজার কথা বলে আড্ডা জমিয়ে রাখতেন।
ফজল শাহাবুদ্দীনের জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে সক্রিয় বিনোদন সাংবাদিকতায়। দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক চিত্রালীতে তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক বাংলায় (পরে পরিবর্তিত নাম) তিনি দীর্ঘদিন ‘ছায়ামঞ্চ’ ফিচার পাতার সম্পাদক ছিলেন। তাঁর সম্পাদনায় প্রতি সপ্তাহে দুই পৃষ্ঠার ‘ছায়ামঞ্চে’ চলচ্চিত্র, টিভি, তারকা ইত্যাদি বিষয়ে বৈচিত্র্যময় লেখা প্রকাশিত হতো। সেকালে (১৯৭০-১৯৮০) ঢাকায় সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক ছিল দৈনিক বাংলা। আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, তোয়াব খান, আহমেদ হুমায়ুন, নির্মল সেন, ফওজুল করিম, ফজল শাহাবুদ্দীন, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, আফলাতুন, কালাম মাহমুদ ও আরও অনেক প্রতিভাবান সাংবাদিক, শিল্পী ও সাহিত্যিকের যৌথ সৃষ্টিতে দৈনিক বাংলা একটি পাঠকনন্দিত পত্রিকা হয়ে উঠেছিল। এখনকার বহু প্রতিষ্ঠিত কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক তখন দৈনিক বাংলাকে ঘিরে তাঁদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পেয়েছিলেন। ফজল শাহাবুদ্দীনও অনেক তরুণকে সাংবাদিকতা ও কবিতা রচনায় নানাভাবে সহায়তা করেছিলেন। তাঁর সম্পাদনায় ‘ছায়ামঞ্চ’ পাতাটি বিনোদন সাংবাদিকতার উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে থাকবে।
১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলা গ্রুপ থেকে সাপ্তাহিক বিচিত্রা প্রকাশনা শুরু হলে ফজল শাহাবুদ্দীনকে তার সম্পাদক করা হয়। কিন্তু বেশি দিন তিনি সেই পদে থাকেননি। শাহাদত চৌধুরী সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। শাহাদত চৌধুরীর সম্পাদনায় বিচিত্রা এ দেশে সংবাদ ম্যাগাজিনের একটি সার্থক মডেল হয়ে ওঠে। বিচিত্রা একটি ইতিহাস।
জীবনের বিভিন্ন সময়ে ফজল শাহাবুদ্দীন নানা ধরনের বিনোদন ম্যাগাজিন পরিকল্পনা ও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখ্য: পাক্ষিক চিত্রিতা, মাসিক বিনোদন, নান্দনিক ইত্যাদি। এসব বিনোদন পত্রিকা সত্তর দশকে এক বর্ণাঢ্য ও উজ্জ্বল সাংবাদিকতা উপহার দিয়েছে। তখন এ দেশের সাংবাদিকতা, মুদ্রণ প্রযুক্তি এখনকার মতো এত আধুনিক ছিল না। কিন্তু ফজল শাহাবুদ্দীন ছিলেন সময়ের তুলনায় অগ্রসর মানুষ। তাই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল সেকালেই এত উন্নত মানের মননশীল বিনোদন পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করা। তিনি বিনোদন সাংবাদিকতায় কখনো গ্রাম্যতা, স্থূলতা ও সস্তা বিষয়কে স্থান দেননি (যা অনেকেই করেন)। তাঁর প্রতিটি বিনোদন পত্রিকা ছিল আধুনিক ও অভিজাত। আমার ধারণা, পাক্ষিক চিত্রিতা এ দেশের বিনোদন পত্রিকায় শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দাবি করতে পারবে। সেই মানের বিনোদন পত্রিকা আজ অবধি আর প্রকাশিত হয়নি।
ফজল শাহাবুদ্দীন তাঁর সময়ের একজন সফল মানুষ ছিলেন। কবিতা রচনায়, সাংবাদিকতাধর্মী রচনায় (দৈনিক বাংলায় কলাম লিখতেন), বিনোদন সাংবাদিকতায়, সম্পাদনা ও প্রকাশনায় তিনি সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। ব্যর্থ হয়েছেন শুধু একটা জায়গায়। কবিদের নিয়ে নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ ও নিয়মিত নানা অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিলেন। নানা অসহযোগিতায় তা পারেননি। এই নিয়ে তাঁর মনে হয়তো দুঃখ ছিল। কিন্তু তাঁর সাফল্যের মূল্যও কম নয়।
এ দেশের কাব্যজগৎ ও বিনোদন সাংবাদিকতা জগৎ তাঁকে মনে রাখবে। এই দুটি ক্ষেত্রে তিনি জীবনের একটা বড় সময় দান করেছেন। তবে জীবিতকালে ফজল শাহাবুদ্দীনের যতটা স্বীকৃতি ও সম্মান পাওয়া উচিত ছিল, তা পাননি। এটা আমাদের দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির ফল। ষাট ও সত্তরের দশক থেকে অনেক তরুণ কবি ও সাংবাদিক তাঁকে ঘিরে বিকশিত হয়েছেন। তিনি অনেকের কাছে অভিভাবক ও শিক্ষকতুল্য ছিলেন। তাঁরা আজ শোকার্ত। দৈনিক পাকিস্তানে সাংবাদিকতা সূত্রে আমিও তাঁর স্নেহ ও সাহচর্য লাভ করেছি ১৯৭০ সাল থেকে। সাংবাদিকতা, সম্পাদনা ও মেকআপের অনেক কিছু শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। দৈনিক বাংলায় ‘ছায়ামঞ্চ’ সম্পাদনাকালে একজন নবীন রিপোর্টার হিসেবে তাঁর কাজ দেখেছি ঘনিষ্ঠভাবে। নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে গল্প করে অনেক কিছু জেনেছি। আমৃত্যু তাঁর স্নেহধন্য ছিলাম। রয়েছে ব্যক্তিগত অনেক স্মৃতি। তা পত্রিকার পাতার জন্য নয়।
ফজল শাহাবুদ্দীনের প্রতি আমাদের অনেকের অনেক ঋণ। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। তাঁর আত্মা শান্তিলাভ করুক।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
No comments