মরুঝড় by মোহিত কামাল
দেখি, কল লিস্ট দেখার জন্য মিসকল অপশনে
গিয়ে কলি দেখল, কোনো কল আসেনি আজ। ভালো করে যাচাই করে আবার বলল, না। কোনো
কল বা মিসকলের প্রমাণ নেই।
সেট হাতে ফিরিয়ে নিয়ে অবাক হয়ে
গেল রুস্তম। সত্যি সত্যি কল লিস্টে কোনো কলই আসেনি আজকের তারিখে! দেখে ভয়
পেয়ে গেল। অদৃশ্য কোনো ক্ষমতা কি আছে বধূকলির? অতিপ্রাকৃত বা অতিন্দ্রীয়
কোনো ক্ষমতার বলে কি দেশের কলি টের পেয়ে যায় দুবাই-কলির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ
বা কথোপকথনের খবর! কোত্থেকে আসে এমন সিগন্যাল!
দুবাই কলি বলল, বাংলাদেশের রুস্তম! আপনি ভয় পাচ্ছেন। ভয় পেয়ে বিভ্রমে গেছেন। কেউ আপনাকে শাস্তি দেবে না, আপনার নামে বদনাম গাইবারও কোনো লোক নেই অন্দরমহলে। কর্তৃত্বপ্রবল পুরুষ গার্জিয়ানের কাছ থেকে এ বাড়িতে ঢোকার আইনগত অনুমোদন পেয়েছেন, এখন আমার নিয়ন্ত্রণে আপনি। বুঝেছেন? ভেতরে ঢুকুন। আমার বাথরুমে ঢুকতে হলে বেডরুম পার হতে হবে। ঢুকুন ভেতরে । গলায় ন্যাচারাল কমান্ডিং ভয়েস থাকলেও কমান্ডের মধ্যে অন্যরকম একটা সুর টের পেল রুস্তম। সাধারণত দুবাই এসে এ ধরনের সুর পাওয়া যায় না। এই সুরের মধ্যে ভালো লাগার একটা বিষয় জড়িত আছে এসব ব্যাপারে অনভিজ্ঞ হলেও সহজে বুঝতে পারল, মেয়েটি নির্মম ও সাহসী টোনের মধ্যে লুকিয়ে আছে কৌতূহলী আরেকটি কলি। সেই কলিকে আবিষ্কার করে অন্দরমহলের ভেতর চোখ বোলাতে লাগল। এর পূর্বে মসজিদের কাজে ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের ফিনিশিং টাচের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। তাই অনেকগুলো টার্মের সঙ্গে পরিচিতি রয়েছে।
ভিজ্যুয়াল রেফারেন্স কাকে বলে টের পেল রুস্তম। স্টোন ফিনিশড টাইল ও পলিশড উডের ব্যবহারের কারণে ফ্লোর থেকে পাওয়া যাচ্ছে ওল্ড ওয়ার্ল্ড এবং রাস্টিক ফিল। ওয়াল পেন্ট হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে ওল্ডফিল। টেক্সচারড ওয়াল পেন্টে ডান পাশটায় রয়েছে মাটিলেপা দেয়ালের অনুভব। মাটিলেপা দেয়ালজুড়ে রয়েছে ওয়াল আর্ট। দুবাই কলিকে ভুলে মুগ্ধ হয়ে দেয়ালের আর্ট দেখতে থাকল রুস্তম।
দুবাই কলি বলল, পরিবারের সবাই বলে, আমি হচ্ছি স্বর্গ থেকে নেমে আসা অতি মানবী অপ্সরী। সবাই আমায় দেখে চোখ ফেরাতে পারে না। আপনি পারছেন!
রুস্তম বুঝল, মিথ্যা বলেনি মেয়েটি। স্বর্গের পরী কেমন দেখতে, জানা নেই। তবে অনুভব করল, স্বর্গে যদি এমন পরী থাকে, তবে স্বর্গে তাকে পাওয়ার জন্যই নৈতিকশক্তিতে বলবান হতে হবে। নিয়ন্ত্রণ হারালে চলবে না। ভেবে বলল, না। স্বর্গের পরীর চেয়েও সুন্দর আপনি!
বাহ! মুখে তো দেখছি কথা ফুটছে! স্বর্গের পরী দেখেননি, তবুও তুলনা করলেন! ভালো লাগল কথাটি শুনে।
রুস্তম জবাব দিল না। বেডরুমের প্রতিটি অনুষঙ্গে চোখ বোলাতে লাগলÑবিশেষ করে ওয়াল আর্ট থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। সঙ্গে উডেন ফার্নিচার ও আপহোলস্ট্রির ফ্যাব্রিকে ন্যাচারাল টাচ দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।
শুনুন, মাটির মানুষ! স্বর্গে যাওয়ার পূর্বে যেতে হবে সাড়ে তিন হাত ভূমির বাসঘরে। জানেন?
জানি। নির্লিপ্তভাবে জবাব দিল রুস্তম।
এ ঘরের আয়তন সাড়ে তিন হাত নয়, বিশাল। তবে দেয়ালে মাটির অনুভব জুড়ে দেওয়ার কারণে সব সময় মনে করার সুযোগ রয়েছে, সাড়ে তিন হাত ভূমিতেই আমার বাস। মানেন?
মানি। জবাব দিল রুস্তম।
গুড। তাহলে ভয়ের কিছু নেই। মাটির মানুষ মাটির ঘরেই ঢুকেছেন, ভেবে নিন।
ভেবে নিলাম। আবারও সহজ উত্তর দিল রুস্তম।
কখনো কোনো পুরুষ মানুষ আমার বেডরুমে ঢোকেনি। আপনিই প্রথম ঢুকলেন।
সাহসের সঙ্গে রুস্তম জবাব দিল, কথাটা ঠিক বলেননি। পুরুষ মানুষ অবশ্যই ঢুকেছে।
এ ধরনের বাধা সাধারণত পায় না দুবাই কলি। সে যা বলে, চারপাশের সবাই মেনে নেয় তার কথা। অথচ রুস্তমই এর ব্যতিক্রম। দপ করে ফুলে উঠল কপালের শিরা। উদ্যত চোখ তুলে প্রশ্ন করল, কী বলছেন? ভুল কোথায় পেলেন আমার কথায়?
ভুল বলেছেন, কারণ শুধু নির্মাণই করেনি, ইন্টেরিয়র ডিজাইন কিংবা ঘরের ফিনিশিং কাজও করেছে আমার মতো কোনো পুরুষ শ্রমিক। ফিনিশিং কাজ পরিদর্শন করেছেন এ বাড়ির সর্বোচ্চ কর্তৃত্ববান পুরুষ। তার পরই কন্ট্রাক্টর বিল পেয়েছেন, ঠিক না?
না। ঠিক না। আমার কথাই ঠিক । নির্মাণ শ্রমিকরা পুরুষ নয় কেবল, তারা শ্রমিক। শ্রমিকরা তার দায়িত্ব পালন করেছেন। আমার সর্বোচ্চ কর্তৃত্ববান পুরুষ হচ্ছেন বাবা। পুরুষ চরিত্র এখানে অনুপস্থিত। বাবাসত্তায় পুরুষসত্তার আগমন ঘটে না। শ্রমিক কিংবা ইঞ্জিনিয়াররাও পুরুষ নয়। নির্মাতা। পুরুষসত্তা আলাদা, জানেন না আপনি?
মানে?
মানে সহজ। আপনিই একজন আলাদা পুরুষ। ইচ্ছা করলে এই নিভৃত ঘরে আক্রমণ করতে পারেন নারীসত্তায়। তুলে নিতে পারেন পুরুষসত্তার গৌরব। কথাটা বলেই খলবল করে হাসতে হাসতে কোমরের ওপর শরীরের উপরের অংশ বাঁকিয়ে প্রায় নব্বই ডিগ্রি অবস্থানে এনে পাক দিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল দুবাই-কলি।
নিভে গেল রুস্তমের চোখের আলো। অনুভব করল ঘুটঘুটে আঁধারে যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ত্রয়দশী এক জল্লাদ। হাতে তুলে ধরেছে নাঙ্গা তলোয়ার। মাথা-ঘাড়ে কালো কাপড় মোড়ানো, হাত পেছনে বাঁধা, গোড়ালিও শক্ত শেকলে মোড়ানোÑ হাঁটু গেড়ে বসা রুস্তমের মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে ঘাড়ে কোপ এসে পড়বে, ধড় থেকে আলাদা হয়ে যাবে মাথা। শেষ মুহূর্তের জন্য কল্পচোখে ভেসে উঠল মায়ের মুখ। দেশের কলির মুখ স্মরণ করতে চাইল। স্মরণ করতে পারল না। মনে হলো চাচাত ভাই শৌর্যের দেহের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে নববধূ কলি। বুকের ব্যথাটা বেড়ে গেল। চিনচিন ব্যথা খুলে দিল বাস্তবের চোখ। কল্পলোক থেকে ফিরে দেখল দুবাই কলি এখনো হাসছে। অট্টহাসি নয়। মৃদু হাসিতে ভরে আছে তার দেহভঙ্গিমা, দেহের ভাষায় ধেয়ে এসেছে আদিম জোয়ার। জোয়ার কি সামাল দিতে পারছে না দুবাই কলি? প্রশ্নের সঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন এসে বাড়ি খেল, কোনো বিভ্রমে ডুবে যায়নি তো সে আবার? বড় করে শ্বাস টেনে বুক ফুলিয়ে বাতাস ছেড়ে নিজেকে দৃঢ় করে রুস্তম প্রশ্ন করল, এত ছোট মেয়ে আপনি, এতসব ভারি ভারি কথা শিখলেন কীভাবে?
শিখতে হয় না, প্রকৃতিই শিখিয়ে দেয় সব। যেমন আমার মিনস শুরু হয়ে গেছে, প্রায় ৬ মাস হতে চলল। অথচ এ বাড়ির কর্তৃত্ববান পুরুষরা সে খবর জানে না। জানলে ভাববে, বিয়ে দেওয়ার উপযুক্ত হয়ে গেছি আমি। বিয়ের ব্যবস্থা হবে কোনো ধনবান আমিরের সঙ্গে। আমিরের বয়স কত, আমার পছন্দ হলো কি হলো না, আমিরের পূর্বের কয়টা বৌ আছে, সে সব ভাববেন না তারা। আমাকে যত দ্রুত সম্ভব ঘর থেকে বিদেয় করবেন! এই ট্রাডিশনের জন্য আমার কাজিন ভেগে গেছে বাংলাদেশের এক রুস্তমের সঙ্গে। আমার কাছে এসেছেন আপনি। এখন নিশ্চয় কড়া নজরে রাখবে আপনাকে। ওরা ভাববে, একই কাণ্ড ঘটাতে পারি আমিও। কী বলেন, পারি? তেমন মনে হয় আমাকে?
সে সাহস আছে আপনার। তবে নিশ্চিত আমার মতো ছা-পোষা কাউকে নিয়ে পালানোর ইচ্ছা হবে না, রুচিতে বাধবে আপনার।
ছুঃ! এ কারণেই তো আপনাদেরকে আমরা মিসকিন বলি, বলতে বাধ্য হই। এত হীনম্মন্য ভাববেন কেন নিজেকে। ঠিকই ধরেছেন, আপনাকে নিয়ে ভাগব না আমি। ভাগার পরিকল্পনা নেই। তবে আপনাকে প্রয়োজন রয়েছে আমার। বুঝেছেন?
কী প্রয়োজন? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল রুস্তম।
সেটা পরে টের পাবেন। তবে আমার অবাধ্য হবেন না। যা বলি সেটা পালন করবেন, শুনবেন। বুঝেছেন?
উত্তর দিল না রুস্তম। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল কেবল।
চুপ করে থাকলে চলবে না। কথার নড়চড় হতে দেব না আমি। আমার অবাধ্য হলে বিপদে কেবল আপনিই পড়বেন না। আমারও শাস্তি হবে। শাস্তি হিসেবে জানালা-দরজাবিহীন ওমেন্সরুমে সিলগালা করে মৃত্যু পর্যন্ত আটকে রাখা হবে আমাকে। চিৎকার কিংবা কান্না যেন বাইরে যেতে না পারে, তেমন একটি রুমে বিশেষ ফুটোর মধ্যে দিয়ে খাবার দেওয়া হবে, বিশেষ সময়ে। তারপর ফুটো বন্ধ করে দেবে। ফ্লোরে বিশেষ ফুটো তৈরি করবে মলমূত্র ত্যাগের জন্য। এমন নির্মম-পাষাণ দেয়ালের মধ্যে আটকে রেখে শেষ করে দেওয়া হয় ব্যভিচারিণী নারীদের, জানা আছে আপনার? জানা নেই। সহস্র নারী নিজেদের ভুল কিংবা পাপের শাস্তি পেয়ে যান ইহজগতে। এমন নির্মম শেকলে কেন আপনাকে আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছি, শোনার চেষ্টা করবেন না। শুনবেন না আমার দ্বিতীয় শর্তটি কী?
এক সপ্তাহ পর আবার কল পাবেন আপনি। অনুমোদনও পেয়ে যাবেন ভেতরে ঢোকার। ওই দিন আপনার পাসপোর্টটা নিয়ে আসবেন। বিশেষ প্রয়োজন আছে। আনবেন না? এটা হচ্ছে আমার দ্বিতীয় শর্ত।
ঝড়ো কথাগুলোর মধ্যে আছে বিষাদের ঘনঘটা। কালো মেঘের শরীর ভেঙে উষ্ণ বৃষ্টি এসে যেন আচ্ছন্ন করে দিল রুস্তমকে। পাসপোর্টে কী দেখতে চায় এই অপ্সরী, মনে প্রশ্ন এলেও মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। হ্যাঁ-বোধক সায় দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কেবল।
(চলবে)
দুবাই কলি বলল, বাংলাদেশের রুস্তম! আপনি ভয় পাচ্ছেন। ভয় পেয়ে বিভ্রমে গেছেন। কেউ আপনাকে শাস্তি দেবে না, আপনার নামে বদনাম গাইবারও কোনো লোক নেই অন্দরমহলে। কর্তৃত্বপ্রবল পুরুষ গার্জিয়ানের কাছ থেকে এ বাড়িতে ঢোকার আইনগত অনুমোদন পেয়েছেন, এখন আমার নিয়ন্ত্রণে আপনি। বুঝেছেন? ভেতরে ঢুকুন। আমার বাথরুমে ঢুকতে হলে বেডরুম পার হতে হবে। ঢুকুন ভেতরে । গলায় ন্যাচারাল কমান্ডিং ভয়েস থাকলেও কমান্ডের মধ্যে অন্যরকম একটা সুর টের পেল রুস্তম। সাধারণত দুবাই এসে এ ধরনের সুর পাওয়া যায় না। এই সুরের মধ্যে ভালো লাগার একটা বিষয় জড়িত আছে এসব ব্যাপারে অনভিজ্ঞ হলেও সহজে বুঝতে পারল, মেয়েটি নির্মম ও সাহসী টোনের মধ্যে লুকিয়ে আছে কৌতূহলী আরেকটি কলি। সেই কলিকে আবিষ্কার করে অন্দরমহলের ভেতর চোখ বোলাতে লাগল। এর পূর্বে মসজিদের কাজে ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের ফিনিশিং টাচের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। তাই অনেকগুলো টার্মের সঙ্গে পরিচিতি রয়েছে।
ভিজ্যুয়াল রেফারেন্স কাকে বলে টের পেল রুস্তম। স্টোন ফিনিশড টাইল ও পলিশড উডের ব্যবহারের কারণে ফ্লোর থেকে পাওয়া যাচ্ছে ওল্ড ওয়ার্ল্ড এবং রাস্টিক ফিল। ওয়াল পেন্ট হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে ওল্ডফিল। টেক্সচারড ওয়াল পেন্টে ডান পাশটায় রয়েছে মাটিলেপা দেয়ালের অনুভব। মাটিলেপা দেয়ালজুড়ে রয়েছে ওয়াল আর্ট। দুবাই কলিকে ভুলে মুগ্ধ হয়ে দেয়ালের আর্ট দেখতে থাকল রুস্তম।
দুবাই কলি বলল, পরিবারের সবাই বলে, আমি হচ্ছি স্বর্গ থেকে নেমে আসা অতি মানবী অপ্সরী। সবাই আমায় দেখে চোখ ফেরাতে পারে না। আপনি পারছেন!
রুস্তম বুঝল, মিথ্যা বলেনি মেয়েটি। স্বর্গের পরী কেমন দেখতে, জানা নেই। তবে অনুভব করল, স্বর্গে যদি এমন পরী থাকে, তবে স্বর্গে তাকে পাওয়ার জন্যই নৈতিকশক্তিতে বলবান হতে হবে। নিয়ন্ত্রণ হারালে চলবে না। ভেবে বলল, না। স্বর্গের পরীর চেয়েও সুন্দর আপনি!
বাহ! মুখে তো দেখছি কথা ফুটছে! স্বর্গের পরী দেখেননি, তবুও তুলনা করলেন! ভালো লাগল কথাটি শুনে।
রুস্তম জবাব দিল না। বেডরুমের প্রতিটি অনুষঙ্গে চোখ বোলাতে লাগলÑবিশেষ করে ওয়াল আর্ট থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। সঙ্গে উডেন ফার্নিচার ও আপহোলস্ট্রির ফ্যাব্রিকে ন্যাচারাল টাচ দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।
শুনুন, মাটির মানুষ! স্বর্গে যাওয়ার পূর্বে যেতে হবে সাড়ে তিন হাত ভূমির বাসঘরে। জানেন?
জানি। নির্লিপ্তভাবে জবাব দিল রুস্তম।
এ ঘরের আয়তন সাড়ে তিন হাত নয়, বিশাল। তবে দেয়ালে মাটির অনুভব জুড়ে দেওয়ার কারণে সব সময় মনে করার সুযোগ রয়েছে, সাড়ে তিন হাত ভূমিতেই আমার বাস। মানেন?
মানি। জবাব দিল রুস্তম।
গুড। তাহলে ভয়ের কিছু নেই। মাটির মানুষ মাটির ঘরেই ঢুকেছেন, ভেবে নিন।
ভেবে নিলাম। আবারও সহজ উত্তর দিল রুস্তম।
কখনো কোনো পুরুষ মানুষ আমার বেডরুমে ঢোকেনি। আপনিই প্রথম ঢুকলেন।
সাহসের সঙ্গে রুস্তম জবাব দিল, কথাটা ঠিক বলেননি। পুরুষ মানুষ অবশ্যই ঢুকেছে।
এ ধরনের বাধা সাধারণত পায় না দুবাই কলি। সে যা বলে, চারপাশের সবাই মেনে নেয় তার কথা। অথচ রুস্তমই এর ব্যতিক্রম। দপ করে ফুলে উঠল কপালের শিরা। উদ্যত চোখ তুলে প্রশ্ন করল, কী বলছেন? ভুল কোথায় পেলেন আমার কথায়?
ভুল বলেছেন, কারণ শুধু নির্মাণই করেনি, ইন্টেরিয়র ডিজাইন কিংবা ঘরের ফিনিশিং কাজও করেছে আমার মতো কোনো পুরুষ শ্রমিক। ফিনিশিং কাজ পরিদর্শন করেছেন এ বাড়ির সর্বোচ্চ কর্তৃত্ববান পুরুষ। তার পরই কন্ট্রাক্টর বিল পেয়েছেন, ঠিক না?
না। ঠিক না। আমার কথাই ঠিক । নির্মাণ শ্রমিকরা পুরুষ নয় কেবল, তারা শ্রমিক। শ্রমিকরা তার দায়িত্ব পালন করেছেন। আমার সর্বোচ্চ কর্তৃত্ববান পুরুষ হচ্ছেন বাবা। পুরুষ চরিত্র এখানে অনুপস্থিত। বাবাসত্তায় পুরুষসত্তার আগমন ঘটে না। শ্রমিক কিংবা ইঞ্জিনিয়াররাও পুরুষ নয়। নির্মাতা। পুরুষসত্তা আলাদা, জানেন না আপনি?
মানে?
মানে সহজ। আপনিই একজন আলাদা পুরুষ। ইচ্ছা করলে এই নিভৃত ঘরে আক্রমণ করতে পারেন নারীসত্তায়। তুলে নিতে পারেন পুরুষসত্তার গৌরব। কথাটা বলেই খলবল করে হাসতে হাসতে কোমরের ওপর শরীরের উপরের অংশ বাঁকিয়ে প্রায় নব্বই ডিগ্রি অবস্থানে এনে পাক দিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল দুবাই-কলি।
নিভে গেল রুস্তমের চোখের আলো। অনুভব করল ঘুটঘুটে আঁধারে যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ত্রয়দশী এক জল্লাদ। হাতে তুলে ধরেছে নাঙ্গা তলোয়ার। মাথা-ঘাড়ে কালো কাপড় মোড়ানো, হাত পেছনে বাঁধা, গোড়ালিও শক্ত শেকলে মোড়ানোÑ হাঁটু গেড়ে বসা রুস্তমের মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে ঘাড়ে কোপ এসে পড়বে, ধড় থেকে আলাদা হয়ে যাবে মাথা। শেষ মুহূর্তের জন্য কল্পচোখে ভেসে উঠল মায়ের মুখ। দেশের কলির মুখ স্মরণ করতে চাইল। স্মরণ করতে পারল না। মনে হলো চাচাত ভাই শৌর্যের দেহের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে নববধূ কলি। বুকের ব্যথাটা বেড়ে গেল। চিনচিন ব্যথা খুলে দিল বাস্তবের চোখ। কল্পলোক থেকে ফিরে দেখল দুবাই কলি এখনো হাসছে। অট্টহাসি নয়। মৃদু হাসিতে ভরে আছে তার দেহভঙ্গিমা, দেহের ভাষায় ধেয়ে এসেছে আদিম জোয়ার। জোয়ার কি সামাল দিতে পারছে না দুবাই কলি? প্রশ্নের সঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন এসে বাড়ি খেল, কোনো বিভ্রমে ডুবে যায়নি তো সে আবার? বড় করে শ্বাস টেনে বুক ফুলিয়ে বাতাস ছেড়ে নিজেকে দৃঢ় করে রুস্তম প্রশ্ন করল, এত ছোট মেয়ে আপনি, এতসব ভারি ভারি কথা শিখলেন কীভাবে?
শিখতে হয় না, প্রকৃতিই শিখিয়ে দেয় সব। যেমন আমার মিনস শুরু হয়ে গেছে, প্রায় ৬ মাস হতে চলল। অথচ এ বাড়ির কর্তৃত্ববান পুরুষরা সে খবর জানে না। জানলে ভাববে, বিয়ে দেওয়ার উপযুক্ত হয়ে গেছি আমি। বিয়ের ব্যবস্থা হবে কোনো ধনবান আমিরের সঙ্গে। আমিরের বয়স কত, আমার পছন্দ হলো কি হলো না, আমিরের পূর্বের কয়টা বৌ আছে, সে সব ভাববেন না তারা। আমাকে যত দ্রুত সম্ভব ঘর থেকে বিদেয় করবেন! এই ট্রাডিশনের জন্য আমার কাজিন ভেগে গেছে বাংলাদেশের এক রুস্তমের সঙ্গে। আমার কাছে এসেছেন আপনি। এখন নিশ্চয় কড়া নজরে রাখবে আপনাকে। ওরা ভাববে, একই কাণ্ড ঘটাতে পারি আমিও। কী বলেন, পারি? তেমন মনে হয় আমাকে?
সে সাহস আছে আপনার। তবে নিশ্চিত আমার মতো ছা-পোষা কাউকে নিয়ে পালানোর ইচ্ছা হবে না, রুচিতে বাধবে আপনার।
ছুঃ! এ কারণেই তো আপনাদেরকে আমরা মিসকিন বলি, বলতে বাধ্য হই। এত হীনম্মন্য ভাববেন কেন নিজেকে। ঠিকই ধরেছেন, আপনাকে নিয়ে ভাগব না আমি। ভাগার পরিকল্পনা নেই। তবে আপনাকে প্রয়োজন রয়েছে আমার। বুঝেছেন?
কী প্রয়োজন? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল রুস্তম।
সেটা পরে টের পাবেন। তবে আমার অবাধ্য হবেন না। যা বলি সেটা পালন করবেন, শুনবেন। বুঝেছেন?
উত্তর দিল না রুস্তম। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল কেবল।
চুপ করে থাকলে চলবে না। কথার নড়চড় হতে দেব না আমি। আমার অবাধ্য হলে বিপদে কেবল আপনিই পড়বেন না। আমারও শাস্তি হবে। শাস্তি হিসেবে জানালা-দরজাবিহীন ওমেন্সরুমে সিলগালা করে মৃত্যু পর্যন্ত আটকে রাখা হবে আমাকে। চিৎকার কিংবা কান্না যেন বাইরে যেতে না পারে, তেমন একটি রুমে বিশেষ ফুটোর মধ্যে দিয়ে খাবার দেওয়া হবে, বিশেষ সময়ে। তারপর ফুটো বন্ধ করে দেবে। ফ্লোরে বিশেষ ফুটো তৈরি করবে মলমূত্র ত্যাগের জন্য। এমন নির্মম-পাষাণ দেয়ালের মধ্যে আটকে রেখে শেষ করে দেওয়া হয় ব্যভিচারিণী নারীদের, জানা আছে আপনার? জানা নেই। সহস্র নারী নিজেদের ভুল কিংবা পাপের শাস্তি পেয়ে যান ইহজগতে। এমন নির্মম শেকলে কেন আপনাকে আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছি, শোনার চেষ্টা করবেন না। শুনবেন না আমার দ্বিতীয় শর্তটি কী?
এক সপ্তাহ পর আবার কল পাবেন আপনি। অনুমোদনও পেয়ে যাবেন ভেতরে ঢোকার। ওই দিন আপনার পাসপোর্টটা নিয়ে আসবেন। বিশেষ প্রয়োজন আছে। আনবেন না? এটা হচ্ছে আমার দ্বিতীয় শর্ত।
ঝড়ো কথাগুলোর মধ্যে আছে বিষাদের ঘনঘটা। কালো মেঘের শরীর ভেঙে উষ্ণ বৃষ্টি এসে যেন আচ্ছন্ন করে দিল রুস্তমকে। পাসপোর্টে কী দেখতে চায় এই অপ্সরী, মনে প্রশ্ন এলেও মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। হ্যাঁ-বোধক সায় দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কেবল।
(চলবে)
No comments