সারাদেশ ক্ষুব্ধ

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় প্রত্যাখ্যান করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দেশের মানুষ।
রায় ঘোষণার পর পরই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় ক্ষোভে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে হাজারও জনতা। উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম এ রায়ে চরম হতাশা ব্যক্ত করেছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর রাজপথ অবরোধ করে মশাল মিছিলসহ বিক্ষোভ করেছে প্রগতিশীল বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনসহ সাংস্কৃতিক কর্মীরা। রাজনৈতিক দল, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সংগঠনসমূহকে ঢাকার রাস্তায় বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। সবার দাবি একটাই-কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই।
বিক্ষোভে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠনসহ সব শ্রেণী পেশার নেতারা বলেছেন, অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কাদের মোল্লার মৃত্যুদ-ই হলো স্বাভাবিক ন্যায়বিচার। ঘোষিত রায়ে দেশের মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এছাড়া ফেসবুক, টুইটার, গুগল প্লাসসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রায় প্রত্যাখ্যান মন্তব্য করেছেন সাধারণ মানুষ। সরকারের প্রতি সতর্ক প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্ত করেছেন তারা।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল চত্বরে রায় শুনতে জড়ো হওয়া বিশিষ্ট নাগরিকরা দাবি করেছেন এ রায় জাতির প্রত্যাশা পূরণ করেনি। এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত প্রতিটি মানুষকেই হতাশ করেছে বলেও দাবি করেছেন তারা। তারা মনে করেন, রাষ্ট্রপক্ষের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা উচিত। এ রায়কে ‘বজ্র আঁটুনি, ফসকা গেরো বলেও আখ্যায়িত করেছেন অনেকে।
সাক্ষী ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া ॥ রায় ঘোষণার পরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, যেসব অপরাধে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-ের রায় দেয়া হয়েছে, ওই একই অপরাধে কাদের মোল্লারও সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, ছয়টি অভিযোগের মধ্যে আদালতে যে ৫টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে তাতে কাদের মোল্লার মৃত্যুদ-ের রায় হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু রায়ে তা বাস্তবায়ন হয়নি। কাদের মোল্লার মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী বলেন, আমি এ রায়ে সন্তুষ্ট নই। তিনি বলেন, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণ করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। ৪০০ লোককে গুলি করে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ধর্ষণের এবং ধর্ষণ করে হত্যার অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে। তাহলে আর কত লোককে হত্যা করলে, আর কত নারীকে ধর্ষণ করলে; কাদের মোল্লার মৃত্যুদ- হতো। তিনি আরও বলেন, আমরা এ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে কাউন্সিলিং করে আপীলের সিদ্ধান্ত নেব।
কাদের মোল্লার মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী, ১৯৭১ সালের ২৫ নবেম্বর কেরানীগঞ্জের ভাটেরচরের ঘটনায় দায়ের করা মামলার বাদী মোজাফফর আহমেদ খান রায় ঘোষণার পর তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ রায় হতাশাজনক। রায় এমন হওয়ায় প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা দায়ী। তারা কেন কেরানীগঞ্জের ঘটনায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পারল না। আমার মনে হয় তারা টাকার বিনিময়ে অভিযোগ ভালভাবে উপস্থাপন করেনি। কাদের মোল্লা সরাসরি হত্যাকা-ে জড়িত ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে কেরানীগঞ্জে গণহত্যা পরিচালিত হয়। এ রায়ের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার আরও হতাশাগ্রস্ত হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কাদের মোল্লার মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আরেক সাক্ষী যুদ্ধকালীন মামা গ্রুপ গেরিলা বাহিনীর প্রধান সৈয়দ শহীদুল হক মামা বলেন, দক্ষ জনবলের অভাবেই আজ এ রায় হয়েছে। একাত্তরের খুনীরা আমাদের লাল সবুজের খামচাচ্ছে, আমরা জানি না আমাদের পতাকাকে ধরে রাখতে পারব কি না? তিনি বলেন, আজ ফাঁসির রায়ের দাবিতে অলিগলিতে, রাজপথে মিছিল হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা হয়নি। কোথায় গেল আমাদের নেতারা। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধরে রাখতে হলে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এক হয়ে জামায়াত-শিবির প্রতিহত করতে হবে। এ রায়কে বাংলা প্রবাদ বাক্য ‘বজ্র আঁটুনি, ফসকা গেরো’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন তিনি।
আইনমন্ত্রী ও আইন প্রতিমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া ॥ আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও আইন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম পৃথক পৃথক ভাবে রায়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। আইনমন্ত্রী তাঁর প্রতিক্রয়ায় বলেন, ট্রাইব্যুনাল তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে রায় দিয়েছে। রায়ের কপি এখনও দেখিনি। কাজেই রায়ের ব্যাপারে কোন কিছু বলা বা মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল বিচারকাজ পরিচালনায় সঠিত ভূমিকা পালন করছে বলে আমাদের বিশ্বাস। তিনি আরও বলেন, আইন অনুযায়ী এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার সুযোগ আছে। আপীলের রায় না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না, যে এ রায়ই চূড়ান্ত।
অন্যদিকে, আইনমন্ত্রী তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, রায়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। জনগণ অন্য রায় আশা করেছিল। কিন্তু তা হয়নি। এ রায়ে জনগণ হতাশ। তিনি আরও বলেন, রায়ে আমরা জানতে পেরেছি আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ৬টি অভিযোগের মধ্যে ৫টি প্রমাণিত হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল কেন এ রায় দিল তা রায়ের সম্পূর্ণ কপি পাওয়ার পর বিশ্লেষণ করলে বুঝা যাবে।
বিশিষ্টজনদের প্রতিক্রিয়া ॥ রায় ঘোষণার পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) হেলাল মোর্শেদ খান বীর বিক্রম বলেছেন, আমরা আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রাখি। তবে এ রায় আমরা মেনে নিতে পারি না। কাদের মোল্লার অবশ্যই মৃত্যুদ- হওয়া উচিত ছিল। তিনি আরও বলেন, যে কাদের মোল্লা ছিল খুনী, যে মানুষের শরীর দ্বিখ-িত করেছে সেই কসাইয়ের যাবজ্জীবন কারাদ- দিল ট্রাইব্যুনাল। এখন এ কসাই জামাই আদরে কারাগারে থাকবে, ডিভিশন পাবে। আর সরকার পরিবর্তন হলে সংবর্ধনা নিয়ে বেরিয়ে আসবে। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাব তারা যেন আপীল করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন রায়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, রায়ে খুশি হতে পারিনি। রাষ্ট্রের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা উচিত। ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়ার পরও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন করাদ-ের যে রায় দেয়া হয়েছে, আমি তাতে বিস্মিত হয়েছি। তিনি আরও বলেন, আমি অনেক আশা ভরসা নিয়ে এসেছিলাম। রায়ে একেবারেই সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আজকে আমি শুধু ভাবছি, যারা এ হত্যাকা-ের শিকার হয়েছিল, সেসব নিহতের স্বজনদের কথা। তারা কী গভীর আশা নিয়েই আজকের দিনটির জন্য বসেছিল। তারা আজ কী ভাবছে, আমি কেবল তাদের কথাই ভাবছি।
মুক্তিযোদ্ধা ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, রায় প্রত্যাশিত হয়নি। গণহত্যাকারীর জন্য গোটা জাতি, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম, মুক্তিযোদ্ধারা যে প্রত্যাশা করেছিল, এ রায় সে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, তবে ট্রাইব্যুনালকে আমরা শিরোধার্য মনেকরি। ট্রাইব্যুনালের প্রক্রিয়া নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু যে অভিযোগে বাচ্চু রাজাকারকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে, আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, কাদের মোল্লার ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। তিনি বলেন, আমি একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে বলতে চাই, এ রায় জনগণের প্রত্যাশিত নয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের আপীল করা উচিত।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, ট্রাইব্যুনালের রায়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ফুটে উঠেছে। সেই চেতনার সঙ্গে মঙ্গলবারের রায় কতখানি প্রাসঙ্গিক? সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ বলেন, কাদের মোল্লা কবি মেহেরুন নেসা হত্যায় জড়িত। সুতরাং এ রায়টি আমাদের জন্য সন্তোষজনক নয়। তিনিও এ রায়ের বিপক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের আপীল করা উচিত বলে মনে করেন।
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক এমএ হাসান বলেন, মিরপুরের এ কসাইয়ের হত্যাকা- যেখানে প্রমাণিত সেখানে মৃত্যুদ-ের পরিবর্তে কখনো যাবজ্জীবন দ- হতে পারে না। যারা মিরপুরে শহীদ হয়েছেন, যারা ভুক্তভোগী; তাদের কাছে এ রায়ে আশার প্রতিফলন হয়নি।
যাবজ্জীবন কারাদ-ে রায় ভুয়া বলে মন্তব্য করেছেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবের ছেলে খন্দকার আবুল আহসান। তিনি বলেন, এ রায় ভুয়া কাদের মোল্লার অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে এ শাস্তি অতি নগণ্য। এ রায় কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তিনি আরও বলেন, আদালতের প্রতি আস্থা আছে। তাই আশা করছি, সরকার যখন আপীল করবে, তখন যেন কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- চেয়ে আপীল করা হয়। আবুল আহসান বলেন, কাদের মোল্লার কারণে আমার বাবা প্রাণ হারিয়েছিল। শহীদ সাংবাদিকের এ সন্তান আরও বলেন, শুধু আমার পরিবার নয়, মিরপুর ও ঢাকার অন্য এলাকায় কাদের মোল্লার নেতৃত্বে বিহারিরা শ’ শ’ মানুষকে হত্যা করেছে। কাদের মোল্লা প্রত্যক্ষভাবে এসব হত্যাকা-ে জড়িত ছিলেন। এত অপরাধ করার পরও কীভাবে তাঁর এত কম শাস্তি হলো, তা বুঝতে পারছি না।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের প্রতিক্রিয়া ॥ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ে ‘চরম’ হতাশা ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। রায় ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ফোরাম এ হতাশা প্রকাশ করে। ফোরামের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের নেতা কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত রায়ে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ হতাশা ও চরম অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছে। নির্বিচার গণহত্যা, খুন ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য অপরাধের বহুবিধ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় জাতির প্রত্যাশা পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এ রায় মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের পরিবার, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশের আপামর স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে আমরা মনে করি। অবিলম্বে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করতে রাষ্ট্রপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম।
ক্ষোভে বিক্ষোভে উত্তাল ঢাকার রাজপথ ॥ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ঘোষিত রায় প্রত্যাখ্যান করে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকার রাজপথে ক্ষোভে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সাংস্কৃতিক কর্মী, প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন, সাধারণ শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে বের হয় বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল। এতে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেয়। ‘জামায়াত-শিবিরের আস্তানা ভেঙ্গে দাও-গুঁড়িয়ে দাও, আপোসের আস্তানা ভেঙ্গে দাও-গুঁড়িয়ে দাও, নিজামীর আস্তানা-ভেঙ্গে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ মিছিলকারীরা এসব সেøাগান দিতে দিতে শাহবাগের দিকে এগিয়ে আসে। পরে তারা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। এ সময় সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় পর মিছিলকারীরা কাওরানবাজার হয়ে আবারও শাহবাগে গিয়ে অবস্থান নেয়। তারা রাতভর রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়ে সমাবেশ শুরু করে। রাত ৮টা পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা শাহবাগেই অবস্থান করছিল। মিছিলে প্রতিবাদী গান পরিবেশন করেন, কফিলউদ্দিন আহমেদ। সমাবেশে বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিরা বলেন, জাতি কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এরকম রায় প্রত্যাশা করেনি। মানবতাবিরোধী অপরাধে ঘাতক কাদের মোল্লার ফাঁসির বিকল্প নেই। এ রায়ে গোটা জাতি হতাশ হয়েছে। দেশের ৯৫ ভাগের বেশি মানুষ এ রায়ে চরম অসন্তুষ্ট।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বিক্ষোভ ॥ জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের ঘোষণা আসার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে রায় প্রত্যাখ্যান করে বিক্ষোভ করেছে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ও আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। এ সময় তারা এ রায় মানি না, কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই বলে সেøাগান দিতে থাকে। এর আগে সকাল থেকেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে অবস্থান নেয় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ মুক্তিযোদ্ধাদের এ সংগঠনের বিভিন্ন ইউনিট।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের যুগ্ম মহাসচিব সফিকুল বাহার মজুমদার টিপুর নেতৃত্বে মিছিল নিয়ে ট্রাইব্যুনালের সামনে অবস্থান নেয়। পরে তাদের সঙ্গে এসে যোগদান করেন কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) হেলাল মোর্শেদ খান বীর বিক্রম। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের মহাসচিব প্রশাসন এমদাদ হোসেন মতিন, মহাসচিব কল্যাণ মনিরুল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন পাহারী বীর প্রতীকসহ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের দুই শতাধিক প্রবীণ সদস্য জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিলে অংশ নেন। তাদের সঙ্গে আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কমান্ডও উপস্থিত ছিল।
নতুন প্রজন্মের ক্ষোভ ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছেন তাতে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। রায় ঘোষণার পর পর জাতীয় প্রেসক্লাবসহ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে রায় প্রত্যাখ্যান করে ক্ষোভে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন তারা। রায় প্রত্যাখ্যান করেছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও।
মঙ্গলবার সকাল থেকে ছাত্রলীগ কর্মীরা কাদের মোল্লার রায়ের পর আনন্দ মিছিল করবে এমন চিন্তা ভাবনা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনসহ ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়। কিন্তু রায় ঘোষণার পরপরই সাধারণ শিক্ষার্থীসহ ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে নেমে আসে ক্ষোভ ও হতাশা। রায় ঘোষণার পর পরই ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে মিছিল বের করে। তারা কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সেøাগান দেয়। পরে তারা দোয়েল চত্বরে সমাবেশ করে। রায়ের বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ বলেন, আমরা এ রায় মেনে নিতে পারছি না। ছাত্রলীগ এ রায় পুনর্বিবেচনা করে তার ফাঁসি দাবি করছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল হাসান বলেন, বাংলার মানুষ এ রায় মেনে নেবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেসরকারী বিভিন্ন বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষার্থীরা রায় প্রত্যাখ্যান করে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন। জনকণ্ঠ অফিসে ফোন করে তরুণ প্রজণে¥র অনেকে রায় প্রত্যাখ্যান করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
পল্টন-প্রেসক্লাব এলাকায় বিক্ষোভ ॥ কাদের মোল্লার রায় প্রত্যাখ্যান করে পল্টনসহ জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। রায় প্রত্যাখ্যান করে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সকল শ্রেণী পেশার মানুষ। রায় ঘোষণার পর পরই প্রেসক্লাব এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের করে ওয়ার্কার্স পার্টি। এর পর পরই রাস্তায় নামে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ। এক বিক্ষোভ সমাবেশে যুদ্ধাপরাধ বিচার মঞ্চের নেতারা বলেন, আদালত সঠিক বিচার করতে ব্যর্থ হলে প্রতিবাদের অধিকার সবার আছে। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ঘোষিত রায়ে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এমন রায়ের যৌক্তিক কারণ কোন বিচারপতি দেখাতে পারবেন না। নেতারা বলেন, কাদের মোল্লার ফাঁসির চাইতে কম শাস্তি মানতে পারি না। বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, ভাষা সৈনিক শামসুল আরেফিন ও কবি নার্গিস।
বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান আলহাজ সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভা-ারি, মহাসচিব লায়ন এমএ আউয়াল এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছে তাতে জাতির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় আজ সারাদেশে বিক্ষোভ দিবসের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল। দুই বাম রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জোট নেতারা এক বিবৃতিতে বলেন, এ রায়ে দেশের ৯৫ ভাগ মানুষ হতাশ। এছাড়া পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, সম্মিলিত নাগরিক সমাজ, বাংলাদেশ ইসলামী জোট, মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, বিশ্ব কবিতাকণ্ঠ পরিষদ, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, গণঅধিকার পার্টি, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ও বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোট পৃথক পৃথক বিবৃতিতে রায় প্রত্যাখ্যান করে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি জানিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.