জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র by শহীদুল্লাহ ফরায়জী

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতাসহ সকল মুক্তিকামী মানুষের মাঝে যে অভূতপূর্ব জাগরণ ঘটেছে, ফ্যাসিবাদী শাসন ও ব্যবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্য অগণিত মানুষের আত্মবলিদানের যে মহৎ উৎসব সংঘটিত হয়েছে, তা ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে ঐতিহাসিকতায় স্থাপিত হবে।  বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে- শিক্ষার্থী, জনতা ও তরুণ প্রজন্ম কীভাবে মৃত্যুকে সংবর্ধিত করার জন্য আনন্দিত, উদ্বেলিত, বিমোহিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছে! প্রসারিত হাত পেতে বুলেটকে নিমন্ত্রণ এবং মৃত্যুভয়কে জয় করার প্রতিযোগিতা- পরাক্রমশালী ও স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার অহংকার এবং দম্ভকে চিরদিনের জন্য চুরমার করে দিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম- ছয় বছরের শিশুসহ অনেক নারীকে কোনোরকম যুদ্ধের ঘোষণা ছাড়াই নির্বিচারে প্রাণ দিতে হয়েছে। জুলাই গণহত্যাসহ গত ১৫ বছরের শাসনামলের ভয়াবহতা, নির্মমতা, অত্যাচার-নিপীড়নের ভয়ঙ্করচিত্র, গোপন বন্দিশালা ও আয়নাঘরের নরক সমতুল্য বর্বরদৃশ্য এখনো বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে লুণ্ঠন করার গুরুতর পাপে পাপী ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার- হীনস্বার্থে রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানকে আইনগত ও নৈতিকভাবে ধ্বংস করে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে বিপজ্জনক ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। ফলে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা সরকারের পতন বা উৎখাত করা-ই সকল মুক্তিকামী মানুষের অন্যতম কর্তব্য হয়ে ওঠে।

যেকোনো বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থানের আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি প্রদানে ঘোষণাপত্র উপস্থাপিত করতে হয়। এতে করে গণহত্যাকারী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের যেকোনো লড়াই-সংগ্রাম সাংবিধানিকভাবে বৈধ এবং জনগণের সম্মতিপ্রাপ্ত হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের জুলাই বিপ্লবের প্রোক্লেমেশন বা ঘোষণাপত্র প্রকাশের অভিপ্রায়ের পর, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। এই উদ্যোগ ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল শক্তিকে একদিকে সংহত করবে, অন্যদিকে গণ-অভ্যুত্থানের দার্শনিকভিত্তি ও অভিপ্রায় নিয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি করবে।

যেহেতু গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনসহ অংশগ্রহণকারী সকল শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মতামত গ্রহণ করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করছে, সেহেতু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্রে সংযুক্ত বা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমার প্রস্তাবনা হাজির করছি।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র: যেহেতু, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি স্বাধীনতার মর্মবস্তুকে উপেক্ষা করে এই পূর্ব-বাংলার মানুষের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করে এবং পরিশেষে জনগণের রায়কে বানচাল করে দিয়ে জনগণের বিরুদ্ধে একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় এবং গণহত্যা সংঘটিত করে, সেহেতু এর প্রেক্ষিতে এ দেশের জনগণ বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী উদ্দীপনায় সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম এবং একসাগর রক্তের বিনিময়ে ’৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে স্বাধীন ও সার্বভৌম ভূখণ্ডের সৃষ্টি করে। এ ভূখণ্ডের উপর কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পরও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ‘সাম্য’ ‘মানবিক-মর্যাদা’ এবং ‘সামাজিক-সুবিচার’ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি অস্বীকার করে ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণীত হয়। যার মাধ্যমে মূলত রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন রুদ্ধ হয়ে পড়ে।
এবং যেহেতু ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ অসমাপ্ত থেকে যাওয়ার ফলে অব্যাহত রাজনৈতিক সংকটে দলীয়শাসনের ব্যর্থতায়  পৌনঃপুনিক সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক স্বার্থে সংবিধান সংশোধনীতে রাষ্ট্র ক্রমাগত ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য লাভ করে
এবং
যেহেতু, দলীয় এবং সামরিক শাসনের ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হয়েও বাংলাদেশে সুশাসন, জবাবদিহিতা বা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি
এবং
যেহেতু, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে, বাইরের হস্তক্ষেপে গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া থেকে জনগণকে অনুপস্থিত রেখে সকল সাংবিধানিক পথ রুদ্ধ করে
এবং
যেহেতু, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ক্ষমতার দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশে শেখ হাসিনার অবৈধ ক্ষমতা ও আধিপত্যের পথ তৈরি করে
এবং
যেহেতু, রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগ অন্ধ আনুগত্য ও ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িয়ে ফ্যাসিবাদীব্যবস্থার রক্ষক বা হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে
এবং
যেহেতু, গত ১৫ বছরে বিরোধী দল ও ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক-আন্দোলন স্তব্ধ করতে গিয়ে নজিরবিহীন নির্যাতন, হত্যা, গ্রেপ্তার, রিমান্ড, গোপন বন্দিশালা, আয়নাঘর, গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রকে কসাইখানায় পরিণত করে
এবং
যেহেতু, রাষ্ট্রীয়ভাবে পিলখানায় কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বিপর্যস্ত করার নীল-নকশা বাস্তবায়ন করে
এবং
যেহেতু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসহ সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষকে ফ্যাসিবাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে
এবং
যেহেতু, ন্যায়সঙ্গত অধিকারের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র-যুবকদের এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী জাগ্রত জনতাকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করে
এবং
যেহেতু, উন্নয়নের নামে রাষ্ট্রীয়-সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচারে নতুন অলিগার্কির মাধ্যমে জাতীয় সম্পদ আত্মসাৎ এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভূলুণ্ঠিত করে
এবং
যেহেতু, জাতীয় সংসদের তিনটি ধারাবাহিক নির্বাচনে প্রতারণাপূর্ণ ও জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ করে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করে
এবং
যেহেতু, সমাজ বিকাশের ধারায় বিকশিত সমাজশক্তির রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে অংশীদারিত্ব বা অন্তর্ভুক্তির অনিবার্যতা উপেক্ষা করে
এবং
যেহেতু, প্রজাতন্ত্রের কর্ম লাভ করার ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং বৈষম্য সৃষ্টি করে
এবং
যেহেতু, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নিরস্ত্র লড়াইকে রাষ্ট্রযন্ত্রের সশস্ত্র শক্তির হামলা, আক্রমণ, অভিযান ও নির্মম বল প্রয়োগ করে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী-জনতাকে নির্বিচারে হত্যা, হাজার হাজার মানুষকে আহত এবং অগণিত মানুষের দৃষ্টিশক্তিহরণ করে
এবং
যেহেতু, শিক্ষার্থীদের ৯ দফা ঘোষণার পর সরকার ইন্টারনেট বন্ধ রেখে কারফিউ এবং শিক্ষার্থী ও এই দেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ব্লকরেইড ঘোষণা করে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ে
এবং
যেহেতু, ফ্যাসিবাদী সরকার এবং ফ্যাসিস্টের সহযোগী দ্বারা বর্বর-নৃশংস ‘গণহত্যা’ সংঘটিত করে
এবং
যেহেতু, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদীব্যবস্থা বিলোপের একদফার চূড়ান্ত কর্মসূচি- ‘মার্চ টু ঢাকা’ আহ্বান করে
এবং
যেহেতু, দল-মত, ধর্ম-বর্ণ, সংস্কৃতি ও শ্রেণি নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ একত্রিত হয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অপ্রত্যাশিত ও সুমহান ঐক্যের মাধ্যমে আত্মবলিদানের অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে
এবং
যেহেতু, রাষ্ট্রের দেশপ্রেমিক প্রতিরক্ষা বাহিনী ফ্যাসিবাদী সরকারের আরও রক্তপাতের নির্দেশনা অগ্রাহ্য করে জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বপক্ষে নৈতিক অবস্থান গ্রহণে ঐতিহাসিক কর্তব্য সম্পাদন করে
সেহেতু আমরা, ফ্যাসিবাদী সরকার উৎখাত করে ৫ই আগস্ট জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করি।
আমরা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি এবং ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায়ভিত্তিক বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ তথা- ‘সাম্য’, ‘মানবিক-মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক-সুবিচার’র দর্শনগত নির্দেশনায় রাষ্ট্র পরিচালনার অঙ্গীকার ঘোষণা করছি।
আমরা আরও দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করছি- বাংলাদেশে আর কোনোদিন ফ্যাসিবাদের উত্থান, জনগণের মালিকানা ছিনতাই এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বেচা-কেনার সামগ্রী হতে দেবো না।
আমরা আরও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি- ‘জনগণের সার্বভৌমত্ব’ এবং ‘আইনগত সার্বভৌমত্ব’ ন্যায়সংগত বণ্টনের জন্য ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য অপসারণ করে ’৭২ সালের সংবিধান সংস্কার করার মাধ্যমে বিকশিত সামাজিক শক্তিসহ জনগণের অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করবো। আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী অভ্যুত্থানকারী শক্তি তথা জনগণের সম্মতি ও সমর্থনের ভিত্তিতে ডক্টর ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করছি। এই সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে-
এক)
ফ্যাসিবাদের উৎস এবং সৃষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত ও ঔপনিবেশিক সকল আইন, শাসনের অবসান করা।
দুই)
মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ গণহত্যায় জড়িতদের এবং জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করা।
তিন)
জনগণের ক্ষমতায়ন অর্থাৎ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উপর জনগণের ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও মালিকানা প্রতিষ্ঠার উপযোগী সাংবিধানিক ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা।
চার)
গণবিরোধী শাসন পদ্ধতির বিপরীতে স্থানীয় স্ব-শাসনসহ গণমুখী বিকেন্দ্রীকৃত শাসন পদ্ধতির প্রচলন করা।
পাঁচ)
ফ্যাসিবাদী অপশাসনের শিকার বেগম খালেদা জিয়াসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি নিশ্চিত করা।
ছয়)
রাষ্ট্রীয় রাজনীতির প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচনের রূপরেখা প্রণয়ন করা।
আমরা ঘোষণা করছি যে- ‘সাম্য’, ‘মানবিক-মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক-সুবিচার’র নির্দেশনায় দেশজ ইতিহাস-ঐতিহ্যকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক এবং বৈষম্যহীন প্রজাতন্ত্র বিনির্মাণে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় জাতীয় ঐক্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করবো। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, মানবিক ও জ্ঞাননির্ভর, বৈষম্যহীন একটি সমাজ বিনির্মাণ হবে- আমাদের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু।
আমরা আরও ঘোষণা করছি যে- ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের আইনগত ও নৈতিকভিত্তির অনুমোদনপ্রাপ্ত এই ঘোষণাপত্রটি ৫ই আগস্ট ২০২৪ থেকে কার্যকর হয়েছে বলে বিবেচিত হবে।
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
faraizees@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.