বিদায় ঢাকাই সিনেমার রঙিন নবাব: তারকাদের তারকা প্রবীর মিত্র (হাসান ইমাম)
প্রবীর মিত্রের প্রথম জানাজা হয় কিংবদন্তির দীর্ঘদিনের কর্মস্থল বিএফডিসিতে। গতকাল সোমবার বাদ জোহর জানাজার পর তাকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
প্রবীর মিত্রের দুই পায়ের হাঁটুতে সমস্যার কারণে দীর্ঘ ১৬ বছর ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। যার কারণে দীর্ঘ সময় একটানা বিছানায় খুব বেশি নড়াচড়া না করে অবস্থান করতে হয়। দীর্ঘ সময় ধরে একটানা এভাবে থাকায় এই অভিনেতার বেড সোর হয়। এর পরই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরিবার থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হয় অপারেশনেরও। তবে তা আর করা হলো না। এর আগেই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন এই অভিনেতা।
প্রবীর মিত্র বড় ছেলে মিঠুন ও মেজো ছেলে নিপুণের কাছে রাজধানীর ধানমন্ডির ৮ নম্বর রোডের একটি বাসায় থাকতেন। জীবনের শেষ সময়টা সেখানেই একটি ঘরেই সময় কাটে প্রবীর মিত্রের। মৃত্যুর আগে দীর্ঘ চার বছর এ বাসায় ছিলেন প্রবীর মিত্র।
জীবনের শেষ সময়ে এসে কাউকে আর এক নজর দেখারও আগ্রহ প্রকাশ করেননি এই অভিনেতা।
মিঠুন জানান, তার বড় বোন ফেরদৌস পারভীন প্রায়ই তাদের বাসায় আসতেন বাবাকে দেখতে। সবাই মিলে বাবাকে একটু আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করতেন। তিনি আরও জানান, তার মা নাজমুন্নাহার মারা গেছেন ২০০০ সালে। বলে রাখা ভালো, নাজমুন্নাহারকে ভালোবেসে বিয়ের জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন প্রবীর মিত্র।
মিঠুনের ছোট ভাই আকাশ ২০১২ সালে মারা গেছেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন অভিনয়শিল্পীর অভিনয়ের স্থান থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের সরিয়ে নিতে হয়, যেন তারই প্রমাণ বহন করছিলেন প্রবীর মিত্র। যে কারণে প্রবীর মিত্রের মতো একজন গুণী শিল্পী ‘বৃদ্ধাশ্রম’ নামক একটি চলচ্চিত্রেই সর্বশেষ অভিনয় করেন। শুধু সিনেমাপ্রেমী দর্শকের কাছেই নয় প্রবীর মিত্রের সহকর্মীদের কাছেও তিনি ভীষণ প্রিয় ছিলেন।
কিন্তু তেমন কেউই তার খোঁজ রাখতেন না। সবসময়ই সাদাসিধে জীবন পছন্দ ছিল তার। যে কারণে উচ্চাভিলাষ তাকে কখনোই পেয়ে বসেনি। জীবনের মতো করেই জীবন চলে গেছে। জীবনের নিয়মে জীবন চলে যাচ্ছিল। বয়স বাড়ছিল, তাও মেনে নিয়েছিলেন। আর তাই সব মেনে নিয়েই চলচ্চিত্র থেকে অনেকটা দূরেও চলে গিয়েছিলেন তিনি।
বেলাল আহমেদ পরিচালিত ‘নয়নের আলো’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রবীর মিত্র। প্রবীর মিত্রের ভাষায় তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে রিমার্কেবল ছবি ‘নয়নের আলো’। সুমিতা দেবী এই ছবিতে প্রবীর মিত্রের অভিনয় দেখে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি এ ছবিতে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না পাও, তাহলে অভিনয় ছেড়ে, এই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেও।’ কিন্তু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না মিললেও প্রবীর মিত্র তার দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে, ভালোবাসার জায়গা থেকে অভিনয়ই করে গেলেন আজীবন।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সে ছবিতে না পেলেও পরে তিনি মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য পেয়েছিলেন।
প্রবীর মিত্রের চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। মূলত ছবিতে কাজের ব্যাপারে তার বন্ধু এটিএম শামসুজ্জামান তাকে সহযোগিতা করেছিলেন। ‘জলছবি’র পর নায়ক হিসেবে প্রবীর মিত্র ‘চাবুক’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, জালিয়াত’, ‘তীর ভাঙ্গা ঢেউ’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ‘রামের সুমতি’, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’সহ আরও বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন। তবে এইচ আকবর পরিচালিত ‘জীবন তৃষ্ণা’ ছবিতে শিল্পী আব্দুল জব্বারের গাওয়া ‘এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে আমার পৃথিবী থেকে’ গানটি তাকে ব্যাপকভাবে পরিচিতি এনে দেয়।
এরপর আরও বহু চলচ্চিত্রে তিনি অনবদ্য অভিনয় করেছেন। ভাগ্যে জুটেনি আর কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। তবে চলচ্চিত্রে ‘আজীবন সম্মাননা’ পেয়েছেন তিনি ২০১৮ সালে। আরও পেয়েছেন ‘প্রযোজক সমিতি অ্যাওয়ার্ড’, ‘জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার’, ‘বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট সম্মাননা’, ‘মাদার তেরেসা স্মৃতি পদক-২০১৭’, ‘বাবিসাস সম্মাননা ২০০৮ ও ২০১০’, ‘এজেএফবি স্টার অ্যাওয়ার্ড’, ‘জাগো বাংলা সম্মাননা’, ‘আমরা কুড়ি সম্মাননা’, ‘ মহানগরী অ্যাওয়ার্ড’, ‘দর্শক ফোরাম অ্যাওয়ার্ড’, ‘ঢাকা কালচারাল রিপোর্টার্স ইউনিটি অ্যাওয়ার্ড’সহ আরও বহু সম্মাননা।
প্রবীর মিত্রের দুই বোন, একজন সরস্বতী বসূ অন্যজন রমা সরকার। ছোট ভাই সুবীর কুমার মিত্র। রাজধানীর তাঁতীবাজারের হরিপ্রসন্ন মিত্র রোড প্রবীর মিত্ররই দাদার নামে। প্রবীর মিত্রের বাবা গোপেন্দ্র নারায়ণ মিত্র এবং মা অমিয় বালা মিত্র। নায়ক হিসেবে প্রবীর মিত্রের প্রথম চলচ্চিত্র ছিল জহির রায়হানের শেষ সহকারী শেখ নজরুল ও ইলতুত মিস পরিচালিত ‘চাবুক’। এতে প্রবীর মিত্রের নায়িকা ছিলেন কবরী। অভিনয়ের পথচলায় বহু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। অনেক প্রযোজক-পরিচালকের কাছে টাকা পাওনাও ছিল তার। তবে জীবনের শেষভাগে সব হিসাব নিজের মতো করে চুকিয়ে নিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন এই কিংবদন্তি। রেখে গেলেন শুধুই স্মৃতি আর স্মৃতি।
নবাবখ্যাত এ অভিনেতাকে বিদায় দিতে এসে স্মৃতিচারণ করেন তার সহকর্মী ও চলচ্চিত্র অঙ্গণের তারকারা।
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, “আমাদের সিনিয়র যারা আছে, সকলেই অবহেলিত। তবে প্রবীরদা আসলে একটু আড়ালেই থাকার চেষ্টা করেছেন। প্রবীরদাও প্রথমে অন্য ধর্মে ছিলেন, পরবর্তীতে ভাবীকে ভালোবেসে ধর্মান্তরিত হন। তবে শেষ বয়সে উনি নামাজ, রোজা, কোরআন, ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। দুনিয়াতে চলতে গেলে আমাদের মধ্যে যে ভুলভ্রান্তি হয়ে যায়, প্রবীরদাসহ আমরা যেন সকলে সকলে মাফ করে দেই।“
মিশা সওদাগর বলেন, একে একে করে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি শূন্য হয়ে যাচ্ছে। সে সময়টাকে আমরা বলতাম সোনালী যুগ। আমরা যে স্কুলিং থেকে এসেছি, আমরা সবসময় সিনিয়র বা মুরব্বীদের সম্মান করতাম। প্রবীর মিত্র সাহেবের কাজ থেকে আমরা সহনশীলতা, ধৈর্য্যের শিক্ষা পেয়েছি। শিল্পী কাকে বলে এখনকার সাথে তখনকার পার্থক্য দেখলেই বুঝবেন। প্রবীর মিত্রের কাছ থেকে শিখেছি, একজন শিল্পীকে শিল্পীর পরিচয় বহন করতে হলে মৃত্যু অবধি শিল্পকে ধারন করতে হয়। তার নিয়ন্ত্রিত জীবন, ভদ্রতায় মুগ্ধ সবাই। তিনি প্রোডাকশন বয় থেকে শুরু করে সবাইকে আপনি সম্মোধন করতেন। তাকে নিয়ে কেউ কখনো কটু কথা লিখতে পারেননি।“
চিত্রনায়ক বাপ্পি চৌধুরী বলেন, “আমার সঙ্গে উনার একটা ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি তার বাসায় যেতাম বার্থডে সেলিব্রেট করতে, আড্ডা দিতে। তার মধ্যে অনেক কষ্ট কাজ করতো যে কারও সঙ্গে তার দেখা হয় না। আজ সবাই এই সমাগম অথচ উনি থাকাকালীন যখন চাইতেন তখন কেউ আসেনি। বলা হয়, আমাদের ইন্ডাস্ট্রি একটা ফ্যামিলি। কিন্তু আমরা আসলে ফ্যামিলি না। আমাদের প্রবীণ শিল্পীরা, যারা ১৬০০ হল লিড করে এসেছে, তারা আমাদের সুপারস্টার। তারা একটু ভালোবাসাই চেয়েছে। সবার কাছে অনুরধ, বেঁচে থাকাকালীন তাদের উৎসবগুলো উদযাপন করুন।“
নির্মাতা ছটকু আহমেদ বলেন, “আমাদের একজন অসাধারণ গুণী শিল্পী প্রবীরদা। আমার সঙ্গে অনেক ছবিতেই কাজ করে গেছে। তার অসাধারণ অভিনয়ের জন্য আমাদের প্রতিটা গল্পেই তাকে চিন্তা করে রাখতাম। এবং তার অভিনয় নৈপুণ্যে প্রতিটি চরিত্রকে অসাধারণ রূপায়ন করেছেন। সে নায়ক, ভাই, বাবা নানান চরিত্র করেছে। আমরা তার অভিনয়ে মুগ্ধ ছিলাম। এমন কোন শিল্পী ছিল না যে তাকে ভালোবাসে না। একের পর এক এ শূন্যতা তৈরি হচ্ছে তা যেন নতুন প্রজন্ম দিয়ে পূরণ হয়।“
চিত্রনায়ক উজ্জ্বল বলেন, “প্রবীর ছিল জনতার শিল্পী। তার আগমন হয়েছিল নায়ক হিসেবে। পরবর্তীতে পরিচালক, প্রযোজকদের আস্থাপূর্ণ শিল্পীতে পরিণত হয়েছিলেন। এবং দর্শকরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার অভিনয় দেখেছেন এবং স্বীকৃতি দিয়েছেন। এ ইন্ডাস্ট্রিকে যারা গড়ে দিয়ে গেছেন, তাদের মধ্যে প্রবীর মিত্র অন্যতম। সে সহ সবার প্রতি আমার শ্রদ্ধা। আমাদের ইন্ডাস্ট্রির সোনালী দিন ফিরে আসুক।“
চিত্রনায়িকা মুক্তি বলেন, “প্রবীর মিত্র মামা অনেক ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আমার পরিবারের সঙ্গে তার অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল। উনার মৃত্যুতে খুব কষ্ট লাগছে। তাকে শেষ দেখাও দেখতে পারলাম না। আমাদের পরপর দুজন তারকা চলে গেলেন, যারা দুজনেই ফিল্মের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত ছিলেন। তারকাদের তারকা ছিলেন প্রবীর মিত্র। আর যে মানুষগুলোর সঙ্গে ওঠাবসা, পরিবারের মতন, সেখান থেকে যদি খোঁজ-খবর না নেয়া হয় তবে তো কষ্ট থাকবেই।
No comments