তদন্তে অগ্রগতি নেই ক্ষুব্ধ জাপান অপেক্ষায় ইতালি, ফ্রান্সের নিন্দা, কর্মী সরিয়ে নিলো স্পেন
দুই
বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ড রহস্যাবৃত রয়ে গেছে এখনও। হত্যার রহস্য উদঘাটন,
খুনিদের চিহ্নিত করতে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তত সাতটি সংস্থা।
কিন্তু এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত কোন সুখবর মেলেনি। ইতালিয়ান নাগরিক
সিজার তাভেলা হত্যার পর পেরিয়ে গেছে ৮ দিন। তার লাশ নেয়ার ব্যাপারে এখনও
কোন সিদ্ধান্ত দেয়নি ইতালি। লাশ রয়েছে ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে। জাপানি
নাগরিক হোশিও কুনি হত্যার তদন্তেও নেই কোন অগ্রগতি। এ হত্যার ঘটনায় ক্ষোভ
প্রকাশ করেছে জাপান। হত্যাকাণ্ডের দ্রুত তদন্তে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি
আহ্বান জানিয়েছে দেশটি। জাপানের একটি প্রতিনিধি দল বর্তমানে বাংলাদেশ সফরে
রয়েছে। ঘটনার নিন্দা ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছে ফ্রান্স। সর্বশেষ খবরে
জানা যাচ্ছে, নিরাপত্তাজনিত কারণে স্প্যানিশ প্রতিষ্ঠান আইসোলাক্স বাংলাদেশ
থেকে সাময়িকভাবে কর্মী ফিরিয়ে নিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ঢাকায় মামলার তদন্ত সংস্থা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ- ডিবির পাশাপাশি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি, র্যাব, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন- পিবিআই, পুলিশের বিশেষ শাখা- এসবি এবং সরকারের দুটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র বলছে, হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে এখন দুটি বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। কারণ, ইতালিয়ান নাগরিক সিজার তাভেলার ব্যক্তিগত বা এনজিও সংক্রান্ত কোন বিরোধ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখন এই হত্যাকাণ্ডে জঙ্গি সম্পৃক্ততা কিংবা আন্তর্জাতিক বা রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ কারণে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক দল এই তিনটি বিষয় মাথায় রেখে কাজ করছে। ওই সূত্র জানায়, তারা প্রাথমিকভাবে মনে করছেন পুরো হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি দেশের বাইরে থেকে কলকাঠি নাড়া হয়েছে। তারা এসব বিষয়ে কিছু তথ্য-প্রমাণও হাতে পেয়েছেন। এসব তথ্য-প্রমাণ যাচাই বাছাইয়ের কাজ চলছে। তবে সুনির্দিষ্ট করে বলার মতো সময় এখনও হয়নি। সূত্র জানায়, দুটি হত্যাকাণ্ডই একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে হচ্ছে। খুনের ধরনও একই। এ কারণে একটি খুনের রহস্য উন্মোচিত হলে অপরটির রহস্য উন্মোচন অনেক সহজ হয়ে যাবে। গোয়েন্দা পুলিশের ধারণা, দেশকে অস্থিতিশীল করতেই বিদেশীদের খুনের টার্গেট নিয়ে চক্রটি মাঠে নেমেছে। এক্ষেত্রে তাদের নির্দিষ্ট কোন দেশ টার্গেট নেই। তারা রেকি করে যাকে হাতের কাছে পেয়েছে এবং খুন করে পালাতে পারবে তাকেই হত্যা করেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা জঙ্গি ও আন্তর্জাতিক চক্রের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছি। সূত্র জানায়, প্রযুক্তিগত ও ম্যানুয়ালি- দুই ভাবেই তদন্ত চলছে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রের সন্ধানের জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করা হয়েছে। সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে পারলেই নেপথ্য মদতদাতাদের নাম-পরিচয় বেরিয়ে আসবে। পুলিশের বিশেষ শাখার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক বলেই ধারণা তাদের। জঙ্গিদের খুনের ধরন অন্য। আর বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট শক্তভাবে সংগঠিত হতে পারেনি যে তারা পরিকল্পনা করে বিদেশী নাগরিকদের ওপর হামলা চালাবে। বিভিন্ন সময়ে আইএস সন্দেহে যেসব জঙ্গি গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা আইএসের সমর্থক। সুপরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মতো শক্তি তাদের নেই।
এদিকে রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিওকে গুলি করে হত্যার ঘটনার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও রহস্য উদঘাটন হয়নি। জাপানি নাগরিক কুনিওকে কেন হত্যা করা হলো এমন প্রশ্নের জট এখনও খোলেনি। হোশি কুনিও যে বাড়িতে থাকতেন তার মালিকসহ প্রত্যক্ষদর্শী চার জনকে পুলিশ নিজেদের হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তবে তাদের কাছ থেকে খুনের বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। পুলিশের দাবি, ঘটনা যা-ই হোক অবিলম্বে তার ক্লু বের করা হবে। এদিকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জাপানি ফরেনসিক চিকিৎসক কোর্সিয়া মরিটার উপস্থিতিতে হোশি কুনিও’র লাশ ময়না তদন্ত করেছে হাসপাতালের ৩ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দল। নিহত জাপানি নাগরিক হোশির লাশ জাপানি দূতাবাসের নিকট হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া চলছে বলে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেন জানান।
এদিকে গতকাল পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি হুমায়ুন কবীর, র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় ডিআইজি হুমায়ুন কবীর বলেন, খুনিদের চিহ্নিত করা, যে যানবাহনের মাধ্যমে খুনিরা গিয়েছে এগুলো শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে। তদন্ত সুষ্ঠুভাবে করার জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ ও কিছু আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো যাচাই বাছাই চলছে। তিনি বলেন, রহস্য উদঘাটনে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের কাজ করছে পুলিশ। ডিআইজি বলেন, আমরা সবদিক থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি দ্রুত হোশি কুনিও’র হত্যার রহস্য উদঘাটনে।
ক্ষুব্ধ জাপান, দ্রুত তদন্তের আহ্বান
বাংলাদেশের রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও হত্যায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে জাপান। একইসঙ্গে হত্যাকাণ্ড দ্রুত তদন্তে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশটি। এদিকে, ঢাকাস্থ জাপানি দূতাবাস থেকে বাংলাদেশী মিডিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, দূতাবাস কর্মকর্তাদের ছবি, ভিডিও ধারণ না করতে। বার্তা সংস্থা এপি’র খবরে বলা হয়, জাপানের মন্ত্রিপরিষদ শীর্ষ সচিব ইয়োশিহিদে সুগা বলেছেন, এমন কাপুরুষোচিত কর্মকাণ্ড বার বার ঘটতে দেয়া যায় না। এমন ঘটনায় আমি ক্ষুব্ধ। গতকাল টোকিওতে সাংবাদিকদের কাছে তিনি এ কথা বলেন। নিহত হোশি কুনিওর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তিনি বলেন, জাপান সরকার হোশি হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চায়। জাপানের গণমাধ্যম এনএইচকে’র খবরে বলা হয়, হোশি কুনিও হত্যাকাণ্ডে আইএস জঙ্গিদের সম্ভাব্য সম্পৃক্ততা দ্রুত তদন্ত করতে বাংলাদেশকে আহ্বান জানিয়েছে জাপান সরকার। বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত মাসাতো ওয়াতানাবি বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে এ অনুরোধ করেছেন। একইসঙ্গে তিনি বাংলাদেশে অবস্থানরত আনুমানিক ১০০০ জাপানি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। এদিকে, হোশি কুনিও’র হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশী মিডিয়ার প্রতি তিনটি আহ্বান জানিয়েছে ঢাকাস্থ জাপানি দূতাবাস। বলা হয়েছে, ‘সম্প্রচার বা প্রচার করার জন্য রংপুরে সফররত জাপানি দূতাবাস কর্মকর্তাদের ছবি নেয়া বা ভিডিও ধারণ করা থেকে বিরত থাকুন। তদন্তের স্বার্থে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলে পুলিশের দেয়া বেষ্টনী লঙ্ঘন করা এড়িয়ে চলুন।’ সর্বশেষ আহ্বানে বলা হয়েছে, ‘ হোশি কুনিও’র পরিবারের অনুরোধ বিবেচনায় তার ছবি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন; বিশেষ করে তার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত ছবি।’ হোশি হত্যাকাণ্ডের পরদিন ঢাকার একটি জাপানি স্কুল জানিয়েছে, তারা ক্লাস বন্ধ করে দিচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় ইতালির এনজিও কর্মী সিজার তাভেলা হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে শনিবার রংপুরে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হন হোশি। এ ঘটনায় জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস দায় স্বীকার করলেও বাংলাদেশ সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ইট ইজ অ্যাবসোলুটলি রাবিশ। দেশে কোন আইএস নেই। থাকতে পারে না। রোববার তিনি এপিকে বলেন, আইএস কেন এখানে থাকবে? দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। আইএস হামলা চালিয়েছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে তা সন্দেহজনক। আমরা বিষয়টি যাচাই করছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায়ও। তিনি আইএসের বিষয়ে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, কেউ অনলাইনে কিছু পোস্ট করলো, কেন আমরা কোন প্রমাণ ছাড়া তা মেনে নেব? আমরা এটা মেনে নিতে পারি না। এপি আরও লিখেছে, ইসলামপন্থি গ্রুপগুলোর সহিংসতা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বেড়ে গেছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে দেশ। এ বছর চার ব্লগারকে হত্যার পর নিষিদ্ধ করা হয়েছে কয়েকটি সংগঠনকে। ওদিকে হোশি কুনিওকে হত্যার পর আইএস এ হত্যার দায় স্বীকার করে একটি বিবৃতি দিয়েছে। এমন দাবি করেছে এসআইটিই ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। এ গ্রুপটি জিহাদি সংগঠনগুলোর অনলাইন পোস্টগুলো অনুসরণ করে থাকে। তবে তারা আইএসের দাবির পক্ষে যে তথ্য দিয়েছে তা নিরপেক্ষ কোন সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এর আগে সিজার তাভেলাকে হত্যার দায়ও স্বীকার করেছিল আইএস। ওদিকে দেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তার প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামী দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে বলে তাদের দায়ী করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে বিএনপির এক মুখপাত্র প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ খণ্ডন করেছেন। বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্য দুঃখজনক।
কর্মী সরিয়ে নিচ্ছে স্প্যানিশ প্রতিষ্ঠান আইসোলাক্স
স্প্যানিশ প্রতিষ্ঠান আইসোলাক্স কোরসান বাংলাদেশ থেকে তাদের বিদেশী কর্মী সাময়িকভাবে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত সপ্তাহে বাংলাদেশে দুই বিদেশী নাগরিক নিহত হওয়ার প্রেক্ষিতে আইসোলাক্স এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক মার্টা ফার্নান্দেজ। এ খবর দিয়েছে ফক্স নিউজ ল্যাটিনো। গতকাল মার্টা ফার্নান্দেজ জানিয়েছেন, ‘স্পেন ও অন্যান্য দেশের ২০ জন আইসোলাক্স কর্মী রোববার ঢাকা ছেড়েছে। আরও ৩০ জন কর্মী দ্রুতই বাংলাদেশ ছেড়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।’ তিনি আরও জানিয়েছে, কর্মীদের ফিরে যাওয়াটা সাময়িক। বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ার আগ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আপাতত নভেম্বর মাসে আবারও তাদের বাংলাদেশে ফেরার সময়সূচি রাখা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ৫ বছর ধরে কাজ করছে আইসোলাক্স। বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে চলমান বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের ৭০ শতাংশ বাংলাদেশী। আর বাকি ৩০ শতাংশ স্পেন ও অন্যান্য দেশের। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, কর্মী সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত তাদের প্রকল্পের ওপর কোন প্রভাব ফেলবে না। প্রতিষ্ঠানটির অধীনে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলছে ঢাকার অদূরে সিদ্ধিরগঞ্জে। ২০১৬ সালের মার্চে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা।
পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি ফ্রান্সের
বাংলাদেশে দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার নিন্দা এবং পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়েছে ফ্রান্স। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া এক বার্তায় নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে দেশটি। একইসঙ্গে বলেছে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশের পাশে আছে ফ্রান্স।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ঢাকায় মামলার তদন্ত সংস্থা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ- ডিবির পাশাপাশি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি, র্যাব, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন- পিবিআই, পুলিশের বিশেষ শাখা- এসবি এবং সরকারের দুটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র বলছে, হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে এখন দুটি বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। কারণ, ইতালিয়ান নাগরিক সিজার তাভেলার ব্যক্তিগত বা এনজিও সংক্রান্ত কোন বিরোধ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখন এই হত্যাকাণ্ডে জঙ্গি সম্পৃক্ততা কিংবা আন্তর্জাতিক বা রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ কারণে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক দল এই তিনটি বিষয় মাথায় রেখে কাজ করছে। ওই সূত্র জানায়, তারা প্রাথমিকভাবে মনে করছেন পুরো হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি দেশের বাইরে থেকে কলকাঠি নাড়া হয়েছে। তারা এসব বিষয়ে কিছু তথ্য-প্রমাণও হাতে পেয়েছেন। এসব তথ্য-প্রমাণ যাচাই বাছাইয়ের কাজ চলছে। তবে সুনির্দিষ্ট করে বলার মতো সময় এখনও হয়নি। সূত্র জানায়, দুটি হত্যাকাণ্ডই একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে হচ্ছে। খুনের ধরনও একই। এ কারণে একটি খুনের রহস্য উন্মোচিত হলে অপরটির রহস্য উন্মোচন অনেক সহজ হয়ে যাবে। গোয়েন্দা পুলিশের ধারণা, দেশকে অস্থিতিশীল করতেই বিদেশীদের খুনের টার্গেট নিয়ে চক্রটি মাঠে নেমেছে। এক্ষেত্রে তাদের নির্দিষ্ট কোন দেশ টার্গেট নেই। তারা রেকি করে যাকে হাতের কাছে পেয়েছে এবং খুন করে পালাতে পারবে তাকেই হত্যা করেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা জঙ্গি ও আন্তর্জাতিক চক্রের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছি। সূত্র জানায়, প্রযুক্তিগত ও ম্যানুয়ালি- দুই ভাবেই তদন্ত চলছে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রের সন্ধানের জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করা হয়েছে। সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে পারলেই নেপথ্য মদতদাতাদের নাম-পরিচয় বেরিয়ে আসবে। পুলিশের বিশেষ শাখার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক বলেই ধারণা তাদের। জঙ্গিদের খুনের ধরন অন্য। আর বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট শক্তভাবে সংগঠিত হতে পারেনি যে তারা পরিকল্পনা করে বিদেশী নাগরিকদের ওপর হামলা চালাবে। বিভিন্ন সময়ে আইএস সন্দেহে যেসব জঙ্গি গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা আইএসের সমর্থক। সুপরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মতো শক্তি তাদের নেই।
এদিকে রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিওকে গুলি করে হত্যার ঘটনার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও রহস্য উদঘাটন হয়নি। জাপানি নাগরিক কুনিওকে কেন হত্যা করা হলো এমন প্রশ্নের জট এখনও খোলেনি। হোশি কুনিও যে বাড়িতে থাকতেন তার মালিকসহ প্রত্যক্ষদর্শী চার জনকে পুলিশ নিজেদের হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তবে তাদের কাছ থেকে খুনের বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। পুলিশের দাবি, ঘটনা যা-ই হোক অবিলম্বে তার ক্লু বের করা হবে। এদিকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জাপানি ফরেনসিক চিকিৎসক কোর্সিয়া মরিটার উপস্থিতিতে হোশি কুনিও’র লাশ ময়না তদন্ত করেছে হাসপাতালের ৩ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দল। নিহত জাপানি নাগরিক হোশির লাশ জাপানি দূতাবাসের নিকট হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া চলছে বলে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেন জানান।
এদিকে গতকাল পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি হুমায়ুন কবীর, র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় ডিআইজি হুমায়ুন কবীর বলেন, খুনিদের চিহ্নিত করা, যে যানবাহনের মাধ্যমে খুনিরা গিয়েছে এগুলো শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে। তদন্ত সুষ্ঠুভাবে করার জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ ও কিছু আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো যাচাই বাছাই চলছে। তিনি বলেন, রহস্য উদঘাটনে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের কাজ করছে পুলিশ। ডিআইজি বলেন, আমরা সবদিক থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি দ্রুত হোশি কুনিও’র হত্যার রহস্য উদঘাটনে।
ক্ষুব্ধ জাপান, দ্রুত তদন্তের আহ্বান
বাংলাদেশের রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও হত্যায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে জাপান। একইসঙ্গে হত্যাকাণ্ড দ্রুত তদন্তে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশটি। এদিকে, ঢাকাস্থ জাপানি দূতাবাস থেকে বাংলাদেশী মিডিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, দূতাবাস কর্মকর্তাদের ছবি, ভিডিও ধারণ না করতে। বার্তা সংস্থা এপি’র খবরে বলা হয়, জাপানের মন্ত্রিপরিষদ শীর্ষ সচিব ইয়োশিহিদে সুগা বলেছেন, এমন কাপুরুষোচিত কর্মকাণ্ড বার বার ঘটতে দেয়া যায় না। এমন ঘটনায় আমি ক্ষুব্ধ। গতকাল টোকিওতে সাংবাদিকদের কাছে তিনি এ কথা বলেন। নিহত হোশি কুনিওর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তিনি বলেন, জাপান সরকার হোশি হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চায়। জাপানের গণমাধ্যম এনএইচকে’র খবরে বলা হয়, হোশি কুনিও হত্যাকাণ্ডে আইএস জঙ্গিদের সম্ভাব্য সম্পৃক্ততা দ্রুত তদন্ত করতে বাংলাদেশকে আহ্বান জানিয়েছে জাপান সরকার। বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত মাসাতো ওয়াতানাবি বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে এ অনুরোধ করেছেন। একইসঙ্গে তিনি বাংলাদেশে অবস্থানরত আনুমানিক ১০০০ জাপানি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। এদিকে, হোশি কুনিও’র হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশী মিডিয়ার প্রতি তিনটি আহ্বান জানিয়েছে ঢাকাস্থ জাপানি দূতাবাস। বলা হয়েছে, ‘সম্প্রচার বা প্রচার করার জন্য রংপুরে সফররত জাপানি দূতাবাস কর্মকর্তাদের ছবি নেয়া বা ভিডিও ধারণ করা থেকে বিরত থাকুন। তদন্তের স্বার্থে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলে পুলিশের দেয়া বেষ্টনী লঙ্ঘন করা এড়িয়ে চলুন।’ সর্বশেষ আহ্বানে বলা হয়েছে, ‘ হোশি কুনিও’র পরিবারের অনুরোধ বিবেচনায় তার ছবি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন; বিশেষ করে তার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত ছবি।’ হোশি হত্যাকাণ্ডের পরদিন ঢাকার একটি জাপানি স্কুল জানিয়েছে, তারা ক্লাস বন্ধ করে দিচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় ইতালির এনজিও কর্মী সিজার তাভেলা হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে শনিবার রংপুরে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হন হোশি। এ ঘটনায় জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস দায় স্বীকার করলেও বাংলাদেশ সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ইট ইজ অ্যাবসোলুটলি রাবিশ। দেশে কোন আইএস নেই। থাকতে পারে না। রোববার তিনি এপিকে বলেন, আইএস কেন এখানে থাকবে? দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। আইএস হামলা চালিয়েছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে তা সন্দেহজনক। আমরা বিষয়টি যাচাই করছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায়ও। তিনি আইএসের বিষয়ে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, কেউ অনলাইনে কিছু পোস্ট করলো, কেন আমরা কোন প্রমাণ ছাড়া তা মেনে নেব? আমরা এটা মেনে নিতে পারি না। এপি আরও লিখেছে, ইসলামপন্থি গ্রুপগুলোর সহিংসতা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বেড়ে গেছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে দেশ। এ বছর চার ব্লগারকে হত্যার পর নিষিদ্ধ করা হয়েছে কয়েকটি সংগঠনকে। ওদিকে হোশি কুনিওকে হত্যার পর আইএস এ হত্যার দায় স্বীকার করে একটি বিবৃতি দিয়েছে। এমন দাবি করেছে এসআইটিই ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। এ গ্রুপটি জিহাদি সংগঠনগুলোর অনলাইন পোস্টগুলো অনুসরণ করে থাকে। তবে তারা আইএসের দাবির পক্ষে যে তথ্য দিয়েছে তা নিরপেক্ষ কোন সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এর আগে সিজার তাভেলাকে হত্যার দায়ও স্বীকার করেছিল আইএস। ওদিকে দেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তার প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামী দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে বলে তাদের দায়ী করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে বিএনপির এক মুখপাত্র প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ খণ্ডন করেছেন। বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্য দুঃখজনক।
কর্মী সরিয়ে নিচ্ছে স্প্যানিশ প্রতিষ্ঠান আইসোলাক্স
স্প্যানিশ প্রতিষ্ঠান আইসোলাক্স কোরসান বাংলাদেশ থেকে তাদের বিদেশী কর্মী সাময়িকভাবে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত সপ্তাহে বাংলাদেশে দুই বিদেশী নাগরিক নিহত হওয়ার প্রেক্ষিতে আইসোলাক্স এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক মার্টা ফার্নান্দেজ। এ খবর দিয়েছে ফক্স নিউজ ল্যাটিনো। গতকাল মার্টা ফার্নান্দেজ জানিয়েছেন, ‘স্পেন ও অন্যান্য দেশের ২০ জন আইসোলাক্স কর্মী রোববার ঢাকা ছেড়েছে। আরও ৩০ জন কর্মী দ্রুতই বাংলাদেশ ছেড়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।’ তিনি আরও জানিয়েছে, কর্মীদের ফিরে যাওয়াটা সাময়িক। বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ার আগ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আপাতত নভেম্বর মাসে আবারও তাদের বাংলাদেশে ফেরার সময়সূচি রাখা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ৫ বছর ধরে কাজ করছে আইসোলাক্স। বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে চলমান বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের ৭০ শতাংশ বাংলাদেশী। আর বাকি ৩০ শতাংশ স্পেন ও অন্যান্য দেশের। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, কর্মী সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত তাদের প্রকল্পের ওপর কোন প্রভাব ফেলবে না। প্রতিষ্ঠানটির অধীনে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলছে ঢাকার অদূরে সিদ্ধিরগঞ্জে। ২০১৬ সালের মার্চে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা।
পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি ফ্রান্সের
বাংলাদেশে দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার নিন্দা এবং পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়েছে ফ্রান্স। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া এক বার্তায় নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে দেশটি। একইসঙ্গে বলেছে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশের পাশে আছে ফ্রান্স।
No comments