রাজসিক সংবর্ধনা- বর্ণিল তোরণ আর সোনার নৌকা by আলী ইমাম মজুমদার
অতীতে ভূরি ভূরি হয়েছে। সমালোচনা যতই হোক,
থেমে থাকেনি। তবে আশা করা হয়েছিল, এবার অন্তত এসব কিছু পরিহার করা হবে।
কেননা, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি স্বাভাবিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়নি, এটা
সবার জানা।
জনগণের প্রকৃত অংশগ্রহণ কী পরিমাণ ছিল, তা দেশ
কিংবা বিদেশেও অনেকের জানা। তাই নির্বাচনের পর সরকার গঠনে কিছুটা ইতিবাচক
দিক নজরে এল। দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ কতিপয় নেতা সরকারে যোগ দিলেন।
বাদ পড়লেন বিতর্কিত কিছু ব্যক্তি। এতে ধারণা করা হয়, সরকার নির্বাচনের
ঘাটতিটি আপাতত সুশাসনের মাধ্যমে পূরণের চেষ্টা করবে। অবশ্য উল্লেখ করা
আবশ্যক যে সুশাসন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রতিকল্প নয়; বরং পরিপূরক।
যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত, তা উপেক্ষা করার নয়। প্রথমটি যমুনার অপর পারের এক জেলার। একজন সাংসদ মন্ত্রী হয়ে আসছেন নিজ এলাকায়। এক শ মাইক্রোবাস আর তিন হাজার মোটরসাইকেলের বহর তাঁকে স্বাগত জানায়। স্বাগত জানায় প্রায় দেড় শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। তীব্র ঠান্ডায় তারা তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল। বন্ধ করে দেওয়া হয় সেদিনের পাঠক্রম। অপর ঘটনাটিও একই জেলার। একজন সাংসদকে সংবর্ধনার খবর। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর শপথ নিয়ে ঢাকা থেকে ফিরলেন। খবরে প্রকাশ, নিজ এলাকার কাছাকাছি আসতেই শতাধিক গাড়ি আর সহস্রাধিক মোটরসাইকেলের বহর যুক্ত হয় তাঁর গাড়ির সামনে-পেছনে। রাস্তার দুই পাশে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকেরা প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন আর রঙিন বেলুন হাতে নিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান। নির্মিত হয়েছে শতাধিক তোরণ।
হরতাল-অবরোধে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা গোল্লায় যেতে বসেছে। সেখানে এক দিনের জন্য হলেও মন্ত্রী-সাংসদকে স্বাগত জানাতে ছাত্র-শিক্ষকেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবেন কেন? এভাবে স্বাগত না জানানোর জন্য সরকারের নির্দেশও রয়েছে। তা সত্ত্বেও এমনটা ঘটে চলছে। পরবর্তী ঘটনাটি ব্রহ্মপুত্রতীরের একটি জেলা শহরের। সেই শহরের একজন নেতা মন্ত্রী হয়ে জেলা সদর সফরে আসছেন। জানা যায়, শহরেই নির্মিত হয়েছে গোটা ত্রিশেক তোরণ। তার বেশ কয়েকটি বর্ণিল ও ব্যয়বহুল। তদুপরি আগমনপথে অন্যান্য স্থানেও এ ধরনের সংবর্ধনার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কেউ মন্ত্রিত্ব পেলে তাঁকে সংবর্ধনা জানানোর রেওয়াজ রয়েছে। তবে তাতে এরূপ রাজসিক আয়োজন করার আবশ্যকতা আছে কি? সরকারের টাকায় না হলেও যারা এগুলো করছে, তারা বিনিয়োগের সহস্র গুণ কড়ায়-গন্ডায় উশুল করে নেবে। সেটা নেবে মন্ত্রী-সাংসদদের আশীর্বাদধন্য হয়ে। অপর খবরটি হচ্ছে, দেশের উত্তরাঞ্চলের একটি উপজেলায় একজন সাংসদকে সংবর্ধনায় উপহার দেওয়া হয়েছে সোনার নৌকা। সমালোচনা হলে আয়োজকেরা বলেন, নৌকাটি রুপার। সোনার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে মাত্র। হতেও পারে। তবে রাজসিক মানসিকতার প্রমাণ কিন্তু এতেই মেলে। ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন। তবে ইদানীং প্রতিদিনই ঘটে চলছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
অনেক মন্ত্রী-সাংসদ এ ধরনের সংবর্ধনা নেন। আর তা আয়োজন করতে কর্মী-সমর্থকদের একটি অংশ নেমে পড়েন চাঁদা তোলায়। কেউ বা ভবিষ্যতের বিনিয়োগ হিসেবে শুরুতে নিজেই দেন কিছু অর্থ। তদুপরি একেবারে হাতের মুঠোয় থাকা ছাত্র-শিক্ষকদের ব্যবহার করেন বিবেচনাহীনভাবে। এ ধরনের রাজসিক চমকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-সাংসদ তৃপ্ত হতে পারেন। তবে তাঁদের জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার নিম্নমুখী হওয়ারই কথা। কেননা, আমাদের মতো দেশে সাধারণ মানুষের কোনো ভাষা নেই। তবে তারা সব বোঝে। আর সুযোগ পেলেই ব্যালটের মাধ্যমে এই রাজসিক বিলাসিতার বিরুদ্ধে মতামত দেয়। অতীতে তা-ই দিয়েছে। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে চারদলীয় জোট সরকারের সময়েও একই ধরনের রাজসিক সংবর্ধনা মানুষ দেখেছে। জেনেছে একজন সাংসদের সোনার মুকুট উপহার নেওয়ার কাহিনি। সময়ে ব্যালটে এর মীমাংসা করেছে তারা।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। ২০০৯-এর সূচনায় যে ধরনের জনসমর্থন নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছিল, ২০১৪-তে তা কিন্তু হয়নি। এই সরকারের সাংবিধানিক ও আইনি বৈধতা থাকলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় অসম্পূর্ণতার ভার বহন করতে হবে। আর তা দেশে ও বিদেশে সমান তালে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট, ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট—সবাই আমাদের গেল নির্বাচনটি নিয়ে ব্যক্ত করেছে হতাশা। আশঙ্কা করছে গণতান্ত্রিক পথ থেকে আমাদের বিচ্যুতির। ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সহিংসতা ও অস্থিরতার বিষয়ে। আশা প্রকাশ করেছে, রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে একটি বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পর্কে সমঝোতার। এই দুটি মহাদেশ আমাদের রপ্তানির প্রধান বাজার। আমাদের উন্নয়নের অংশীদার বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ আর এডিবির ওপরও তাদের রয়েছে প্রভূত প্রভাব। সুতরাং বাংলাদেশকে নিজ স্বার্থেই এসব মতামত বিবেচনায় নিতে হবে।
অন্যদিকে, জাতীয় বাস্তবতার বিষয়টিও উপেক্ষা করার নয়। নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশে আপাতত একটি স্বস্তির পরিবেশ বইছে। তবে একে স্থায়ী ও নিশ্চিত বলে ধরে নেওয়া যৌক্তিক হবে না। এটা সবাই জানেন ও বোঝেন যে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটকে নির্বাচনে আনতে সরকার তেমন কোনো জোরদার উদ্যোগ নেয়নি। তেমনি তারাও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগ্রাসী প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। ফলে ভোটারের উপস্থিতি খুব কম হলেও নির্বাচনটি হয়ে গেছে। তবে এটাকে জনসমর্থিত বলার সুযোগ নেই।
উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে সুশাসন জনগণের অধিকার। আর সেই অধিকার নিকট অতীতে আমরা ভোগ করতে পারিনি। চারদলীয় জোট সরকারের শাসনে হতাশ হয়ে ২০০৮-এর শেষে মহাজোটকে মহাবিজয় দিয়েছিল দেশবাসী। কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য থাকলেও তারা সুশাসন দিতে পারেনি জাতিকে। দলীয়করণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারহীনতা, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ইত্যাদি মিলিয়ে তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ প্রায় কাছাকাছি। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে সমঝোতার অভাব গেল নির্বাচনটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাই এই নির্বাচনে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে, এটা জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই। অন্যদিকে যারা নির্বাচন বর্জন করে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েছিল, তাদের পক্ষে জনমত সৃষ্টি হয়েছে—এমন ভাবারও কোনো কারণ নেই। বিশেষ করে তাদের লাগাতার সহিংস কর্মসূচি সরকারের বিরুদ্ধে দাবি করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে এটাকে জনগণের বিরুদ্ধে বলেই মনে করলে দোষ দেওয়া যাবে না। তাই জনগণ অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলেও তাদেরই সমর্থন দেবে, এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না।
এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের সুযোগ রয়েছে তাদের নিকট অতীতের কালিমা দূর করে আবার জনগণের মুখোমুখি হওয়ার। সরকারের গঠনকাঠামো কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে অনেকটা সেই প্রত্যাশারই ইঙ্গিত দেয়। এমনকি সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী নয়াদিল্লি সফরকালে গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অদূর ভবিষ্যতে নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই। তাঁর ভাষায়, ‘ভোট নয়। আমাদের মাথায় এখন সুশাসনের চিন্তা। হিংসা থামানোর চিন্তা।’ এ চিন্তা বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে দলমত-নির্বিশেষে যেকোনো হিংসাত্মক কর্মসূচির বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে তা করতে গিয়ে একের পর এক মামলার আসামিকে এখানে-সেখানে নিহত অবস্থায় উদ্ধার হলে হিংসার রাজনীতি আবারও জোরদার হতে পারে। পাশাপাশি বাদ দিতে হবে বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিঘ্ন সৃষ্টি। বিবেচনায় রাখা দরকার, প্রকৃতপক্ষে প্রধান বিরোধী দল সংসদে নেই। তবে মাঠে আছে। আর তার কলেবর উপেক্ষা করার নয়। সংসদের বিরোধী দলটি সরকারের রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য কতটা সহায়ক হবে, এটা বোধগম্য হচ্ছে না। যা-ই হোক, প্রধান বিরোধী দলের অস্তিত্বকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।
বলা হয়তো যায়, মন্ত্রী-সাংসদেরা কেউ কেউ জাঁকজমকপূর্ণ সংবর্ধনা নিলেই সুশাসনের ঘাটতি হতে পারে না। বক্তব্যটি সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা, এর ব্যয় জনগণই কোনো না কোনোভাবে মেটাবে। তদুপরি স্কুল-কলেজ বন্ধ করে ছাত্র-শিক্ষকদের এতে অংশ নিতে উৎসাহ দেওয়া সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। আবার জানা যায়, ইতিমধ্যে সাংসদদের কেউ কেউ খবরদারি শুরু করেছেন স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থার ওপর। এগুলো অনুচিত, অযাচিত আর সুশাসনের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। একজন সাংসদ তো একটি সিটি করপোরেশনের ময়লা নিষ্কাশন স্থানটি বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো বিকল্প পরামর্শ তিনি দেননি। তাঁর বিরুদ্ধে কতিপয় পরিবহন কোম্পানির অভিযোগ ছিল চাঁদাবাজির। এখন তাদের বিরুদ্ধেই চাঁদাবাজির মামলা হচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে হলেও এ ধরনের ঘটনা সুশাসনের অন্তরায়। আর সরকারের সদিচ্ছার পরিপন্থী। যাঁরা এগুলো করছেন, তাঁরা তাঁদের নির্বাচনে নৈতিক ভিত্তিটা কি তলিয়ে দেখেছেন? দেখলে এমন হওয়ার কথা ছিল না। তাঁরা না দেখলেও কিন্তু দেশ-বিদেশের অনেকেই তা দেখছেন। আর সবাইকে দীর্ঘকাল অব্যাহতভাবে উপেক্ষা করা যাবে না।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments