রাজনীতি ও নির্বাচন- আস্থা ফিরবে কীভাবে by এম সাখাওয়াত হোসেন
বহু নাটকের মধ্যে সমাপ্ত দশম জাতীয় সংসদ
নির্বাচনে কে কী পেল তার অঙ্ক অনেকে করছেন। নির্বাচন কমিশনের হিসাবমতে, দুই
কোটির কম ভোটার ভোট দিয়েছেন। অবশ্য অনেকেই এই তথ্যের সঙ্গে একমত নন।
অনেকের
ধারণা, ১০-১২ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। কিছু কেন্দ্রে কোনো ভোটই পড়েনি।
ফলে দেশের নির্বাচনব্যবস্থায় কিছুটা হলেও যে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল, এই
নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা বহুলভাবে ব্যাহত হয়েছে। ভবিষ্যতে সুস্থ ব্যবস্থা
ফিরিয়ে আনতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।
নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্ক এবং পশ্চিমা দেশের কাছে যতই অগ্রহণযোগ্য হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে একটি নির্বাচন হয়েছে এবং তা সংবিধান ও আইনের দৃষ্টিতে বৈধ। ফলাফলের গেজেট প্রকাশ ও দশম জাতীয় সংসদের সদস্যদের শপথ গ্রহণ সম্পন্ন করার পর এক নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। ২৯ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা। নবম সংসদের মেয়াদকালেই দশম জাতীয় সংসদকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়টি কতখানি সংবিধানসম্মত বা আইনানুগ, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। নবম সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া এই সরকারকে অবৈধ আখ্যা দিয়েছেন। আর ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা, বিশিষ্ট নাগরিক ফজলে হাসান আবেদ বলেছেন, ‘এ সরকার অবৈধও নয়, বৈধও নয়’।
বর্তমান সরকার ‘জনপ্রিয়’ হিসেবে জোর গলায় দাবি করতে পারে তেমন নয়। কাজেই প্রধানমন্ত্রী যেখানে এই নির্বাচনকে সংবিধান ও নিয়মরক্ষার নির্বাচন বলেছেন, সেখানে সরকারের মেয়াদ নিয়ে অহেতুক অতি মন্তব্য জনগণের কাছে শ্রুতিমধুর হওয়ার কথা নয়। দলমত-নির্বিশেষে এসব ভোটার, বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মধ্যে একটা হতাশা বিরাজমান। কারণ, তাঁরা সংসদ ও সরকার গঠনে অংশ নিতে পারেননি। সিংহভাগ ভোটারের ভোটদানে বিরত থাকা বা ভোট দিতে না পারার মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদ ও সরকার প্রকৃতপক্ষে জনসমর্থিত বলে বিবেচিত হয় না।
এ ধরনের সরকার আগাম নির্বাচনের মাধ্যমে আবার জনমত নিয়ে থাকে বা নেওয়া বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়ে। নবগঠিত সরকার কখন এ ধরনের জনমত পুনর্যাচাইয়ে যাবে তা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে বলে মনে হয়। সরকারের ওপর বিদেশের চাপ রয়েছে, তবে এটা ছাড়াও যে দুটি অভ্যন্তরীণ কারণে সরকার আগাম নির্বাচনে যেতে পারে, তার একটি রাজনৈতিক ও অপরটি নৈতিক। ২৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। ভবিষ্যতে তাদের রাজনৈতিক চাপ কতখানি সরকারকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করবে, তা পরের বিষয়। রাজনৈতিক চাপ তেমন অনুভব না করলেও নৈতিক কারণেও সরকার আগাম বা মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে সুবিধামতো সময়ে, জনসমর্থন পুনর্যাচাই করতে পারে।
শুধু বিরোধী ১৮-দলীয়জোট নয়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে আরও প্রায় ডজন খানেক দল, যার মধ্যে রয়েছে এ অনেক পুরোনো দলও। এমন অনেক দলও রয়েছে, যেগুলো একটি আদর্শিক ভাবধারায় পরিচালিত। তবে বৃহত্তর দল হিসেবে সর্বাগ্রে রয়েছে তিনবার ক্ষমতায় থাকা বিএনপি, যার রয়েছে ব্যাপক জনসমর্থন ও অনুসারী। মূলত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে ১৮-দলীয় জোটের সঙ্গে কিছু কিছু বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও আদর্শভিত্তিক এবং অন্যান্য নির্বাচন বর্জনকারী দল একটি নিরপেক্ষ ব্যবস্থার তত্ত্বাবধানে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে নিজেদের অবস্থান থেকে বৃহত্তর বিরোধী দল বিএনপির সমমনা ছিল। লক্ষণীয় বিষয় হবে আগাম নির্বাচনের দাবিতে এসব দলের অবস্থান।
বিএনপি এ নির্বাচন শুধু বর্জনই করেনি, প্রতিহত করার ঘোষণাও দিয়েছিল। এ ঘোষণার পর ১৮-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল জামায়াতে ইসলামীর সহিংস তৎপরতাও নির্বাচন প্রতিহত করতে পারেনি। তবে শুধু সহিংসতার মাধ্যমে অতীতেও যেমন এ ধরনের নির্বাচন বানচাল করা যায়নি, তেমনিভাবে এ নির্বাচনও বানচাল করা যায়নি। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে জনসম্পৃক্ততা যত কমই থাকুক না কেন। নির্বাচন কেমন হয়েছে তার সাক্ষী এ দেশের জনগণ। বিরোধী দলের আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা দৃশ্যত কম থাকলেও একাধিক কারণে ভোটার সমাগম হয়নি। তবে সর্বক্ষেত্রে সহিংসতা একমাত্র কারণ নয়। এর উদাহরণ ঢাকা শহর, যেখানে নির্বাচনের দিনের পরিস্থিতি দেশের যেকোনো স্থানের তুলনায় শান্তিপূর্ণ থাকলেও ভোটের বাক্সে আশাতীত ভোট পড়েনি। এর কারণ বিরোধী বিএনপিসহ সিংহভাগ দলের নির্বাচন বর্জনও বটে।
তাই বিরোধী দলের আন্দোলন যে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে এমনটা বলা যায় না। ১৪৭টি আসনে যেভাবে, যে পরিবেশে, ব্যাপক কারচুপির অভিযোগের এবং অব্যবস্থার মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে আমাদের দেশে ক্ষমতায় থেকে সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার মতো পরিস্থিতি, পরিবেশ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। কাজেই বিশ্বাসযোগ্য নিরপেক্ষ পরিবেশ না হলে ভবিষ্যতে ভোটারদের আস্থা ফেরানো কঠিন হবে।
বিরোধী জোট হয়তো সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে এ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পেরেছে কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে কাছে টানতে পারেনি। জনগণকে আন্দোলনে তেমনভাবে উদ্বুদ্ধ করতেও পারেনি। দেশের আপামর জনসাধারণ সহিংস নয় অহিংস আন্দোলন সমর্থন করতে পারে আর বিরোধী দল যদি সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে চায় তবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে, তাদের উদ্বুদ্ধ করে আন্দোলন করতে হবে। আর আন্দোলন করতে হবে নিজস্ব ক্ষমতায়।
গত কয়েক মাসের আন্দোলন দমাতে সরকারের তরফ থেকে বলপ্রয়োগ করা হয়েছে যে মাত্রায়, সহিংসতাও ওই মাত্রায় হয়েছে। এ সহিংসতার শিকার শুধু রাজনৈতিক কর্মীই হননি, হয়েছে জনগণ, যাঁরা রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় নন। মানুষ আগুনে পুড়েছে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সাধারণ মানুষের জানমালের। দুঃখের বিষয়, এর দায়দায়িত্বের কথা উঠলে দোষারোপের বিতর্ক উঠে আসে। যেহেতু বিরোধী জোট সহিংস আন্দোলনে ছিল, তাই দৃশ্যত দায়দায়িত্বের সিংহভাগ তাদের ওপরই বর্তায়। অপরদিকে সরকারি দল বা জোট বিরোধী জোটকে দায়ী করেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে কিন্তু প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে এখনো সুষ্ঠু তদন্তের ব্যবস্থা করেনি।
তবে সবচেয়ে দুঃখজনক ও নিন্দনীয় হলো নির্বাচনোত্তর সহিংস কর্মকাণ্ড। নির্বাচনের বলি হতে হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের। শুধু ভোট দেওয়া না-দেওয়ার অথবা নির্ধারিত ব্যক্তিকে ভোট দেওয়াসহ অন্যান্য কারণে গরিব শ্রেণীর এসব বাংলাদেশিকে এবং ভোটারের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ হয়েছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ভোটারদের সুরক্ষা করা। শুধু ভোট দেওয়ার জন্য কাউকে নির্যাতন যাতে না করা হয়, তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশাল আয়োজন করা হয়। এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। কেন এবারও এ ধরনের ঘটনা ঘটল তার সঠিক কারণ নিরূপণ করা জরুরি। এ ধরনের হামলা শুধু দোষারোপ অথবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহার না করে একটি বিচার বিভাগীয় নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করা হোক।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার এবং নির্বাচনের বাইরে থাকা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ভবিষ্যতে কোন পথে হাঁটবে, তা হয়তো দু-এক মাসের মধ্যেই পরিষ্কার হবে । তবে এ কথা ঠিক যে দুই পক্ষই জনসম্পৃক্ততা হারিয়েছে এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ একটি নির্বাচন। এ জন্য দরকার জাতীয় সংলাপের, যার মাধ্যমে সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের দাবি। আর প্রয়োজন ভেঙে পড়া নির্বাচনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। অন্যথায় জনগণ নির্বাচন-প্রক্রিয়ার ওপর ফের আস্থা হারিয়ে ফেলবে। নির্বাচন যেভাবেই হোক, একটি সরকার গঠিত হয়েছে এবং এ সরকারের অন্যান্য দায়িত্বের মধ্যে প্রধান দায়িত্ব হবে জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং নির্বাচন-প্রক্রিয়ায় আস্থা ফিরিয়ে আনা।
এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com
No comments