এ ডিফিকাল্ট ভিকটরি @জটিল বিজয় by সুবীর ভৌমিক
জটিল এক বিজয় অর্জন করেছেন বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাকে সমর্থন দিয়েছে চীন। হতে পারে এর মাধ্যমে
ভারতকে একটি বার্তা দেয়া হয়েছে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে শেখ হাসিনার আওয়ামী
লীগ যখন ভূমিধস বিজয় অর্জন করে তখন বেশির ভাগ মানুষ প্রশ্ন করেছিলেন, এ
সরকার টিকবে কতদিন।
এটা কোন অযৌক্তিক প্রশ্ন নয়। ১৯৯৬
সালের শুরুর দিকে একই রকম নির্বাচন করেছিলেন তখন ক্ষমতায় থাকা বিএনপি
নেত্রী খালেদা জিয়া। এতে তীব্র প্রতিবাদ সৃষ্টি হয়। তার প্রেক্ষিতে বিএনপির
এ নেত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা মেনে নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে অবাধ
নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। এবারও অনেকেই সেই সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতিকে তুলনা
করেন। খালেদা জিয়ার দেয়া ওই নির্বাচনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। এবার ৫ই
জানুয়ারির নির্বাচনের পর পরিস্থিতিকে সেই সময়ের সঙ্গে সমান্তরালে তুলনা
করছেন বেশির ভাগ মানুষ। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল শতকরা মাত্র ৭
ভাগ। ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল আওয়ামী লীগ। তবে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে তার
চেয়ে অনেক ভাল ভোট পড়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ ভোট
পড়ে। সে তুলনায় এবারের ভোট ধারেকাছেও ছিল না। এবারের নির্বাচন বর্জন করে
বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট। এছাড়া, তীব্র সহিংসতা ভোটদানে বাধা সৃষ্টি
করে। তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রিত্ব নেয়ার সময় শেখ হাসিনা ওয়াজেদ তার
সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তাই তিনি বিরোধী দলের সঙ্গে একটি সংলাপের
প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বলেছেন, সমঝোতা হওয়ার পর পরই যত তাড়াতাড়ি একটি অবাধ
নির্বাচন হবে। এবারের নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্যতার চেয়ে কম বলে আখ্যায়িত
করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা
সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন এবং মধ্যবর্তী একটি নির্বাচন দেয়ার আহ্বান
জানিয়েছেন, যে নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ অবাধে তাদের মত প্রকাশের সুযোগ
পাবে। এ নির্বাচনকে একদলীয় বলে আখ্যায়িত করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কমনওয়েলথ।
তারাও সুষ্ঠু একটি নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী
ভারত সমর্থন দেয় শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে। তারা বলেছে, বাংলাদেশের এ নির্বাচন
ছিল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা।
কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে শেখ হাসিনার জন্য পাল্টে গেছে পরিস্থিতি। তার সরকারকে সমর্থন দিয়েছে রাশিয়া। তারা বলেছে, বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে গঠনমূলক অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতামূলক কাজ করতে চায়। আরও মজার কথা, সহিংসতা ও নির্বাচন বর্জনের জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করেছে রাশিয়া। তবে তারা একদলীয় নির্বাচনের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে। এতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়কার স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়। তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল ভারত ও রাশিয়া। পাকিস্তানি সেনারা নৃশংসতা চালাচ্ছিল সাধারণ বাঙালিদের ওপর। পাকিস্তানি সেনাদের সমর্থন দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। সিরিয়া পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করেছে ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া। তারপর রাশিয়া এবার সমর্থন করছে শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে। একে এশিয়ার একটি বড় ইস্যুতে ক্রেমলিনের শক্ত অবস্থান বলে দেখা হয়। কিন্তু তারপরে যা ঘটলো তা আরও বিস্ময়কর।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল চীন। কিন্তু দ্রুততার সঙ্গে তারা ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলে বাংলাদেশের সঙ্গে। বাংলাদেশের দু’টি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তারা সম-দূরত্ব বজায় রাখে। এ দু’টি দলই ১৯৯০-এর দশকে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শাসন করেছে বাংলাদেশকে। ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি চুন বরাবরই চুপচাপ থাকেন। কিন্তু এবার ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ আহ্বান করেন, যাতে সহিংসতার বিরুদ্ধে বিচক্ষণতা জয়ী হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতা নিয়ে গঠন করেছেন মন্ত্রিসভা। এ সময়ে তিনি একটি বার্তা পেয়েছেন চীনা প্রধানমন্ত্রী লি খেছিয়াং-এর কাছ থেকে। তাতে বলা হয়েছে, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সমন্বিত ও সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে হাত মেলাতে তার সরকার উদগ্রীব। রাষ্ট্রদূত লি চুন এ বিষয়ক একটি চিঠি পৌঁছে দেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হকের কাছে। এতে আরও পরিষ্কার করে যে বার্তা দেয়া হয় তাহলো এই সমর্থনের অর্থ অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। তবে লি’র ওই চিঠিতে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা বা এর একদলীয় প্রকৃতির উল্লেখ করা দূরের কথা নির্বাচন প্রসঙ্গই অনুপস্থিত। পশ্চিমাদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এর মাধ্যমে চীন একটি পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে। তাতে বোঝানো হয়েছে ঢাকার সরকারের কাছেই গণতন্ত্র ও সুশাসনের বিষয়টি ছেড়ে দেয়া ভাল। ডিসেম্বরে খুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত হয় বিসিআইএম-এর মিটিং। ওই বৈঠকে ভারত ও বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের কাছে চীন জানায় যে, তারা কলকাতা ও খুনমিংয়ের অর্থনৈতিক সংযোগ করিডোর উন্নয়নে দিল্লি ও ঢাকার সঙ্গে কাজ করতে উদগ্রীব হয়ে আছে। চীন জানায়, এতে ‘আমাদের সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা’ হবে। কিন্তু চীন এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সমদূরত্ব বজায় রাখার নীতি থেকে দূরে সরে এসেছে এবং তারা সমর্থন দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকারকে। একই সঙ্গে তারা ভারতের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক গড়তে চায়। এর মাধ্যমে তারা একটি বার্তা পৌঁছে দিতে চায় যে, তারা ভারতের সঙ্গে এ অঞ্চলে কাজ করতে পারলে ভীষণ সন্তুষ্ট হবে। এটা এমন এক সময়ে ঘটছে যখন ভারতীয় কূটনীতিক দেবযানী খোবরাগাড়ে ঘটনায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে এসেছে। এর আগে ভারতীয় কূটনীতিকদের কাছে চীন একটি ইঙ্গিত দিয়েছে যে, কক্সবাজার উপকূলে সোনাদিয়ায় তারা যে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে তা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে ভারতের যোগাযোগে সহায়ক হবে। ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের কব্জা থেকে বের করে আনতে ভীষণভাবে তৎপর পেইচিং। তা করতে এখনকার চেয়ে ভাল সময় আর কখন? শেখ হাসিনাকে দেখা হয় ভারতের খুব ঘনিষ্ঠ হিসেবে। তাই তার প্রতি চীনের সমর্থনকে দেখা হয় এক ঢিলে দুই পাখি শিকার হিসেবে।
গোপনীয় কথা হলো, যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা কেন বিএনপিকে নির্বাচনে এত দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন দিয়েছেন এবং দৃশ্যত এখনও দিচ্ছেন তাতে বিস্মিত চীনা কূটনীতিকরা। দক্ষিণ ভারতে একটি ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ভারত তা প্রত্যাখ্যান করে। তাই বঙ্গোপসাগরে এমন ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করার উপযোগী করে খালেদা জিয়াকে ওয়াশিংটন গড়ে তুলছে বলে সন্দেহ ওই সব কূটনীতিকের। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সমুদ্র সংযোগ রুটের খুব কাছাকাছি ঘাঁটি বসাতে তৎপর যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি চীনের কাছে স্পর্শকাতর। রাখাইন রাজ্যে চীন নির্মাণ করেছে কিইয়াউকপিউ বন্দর, একটি বিশাল তেল ও গ্যাস পাইপলাইন। এ পাইপলাইনের মধ্যে কিউকপুর সঙ্গে ইউন্নানকে সংযুক্ত করা হয়েছে। মালাক্কা প্রণালী এড়িয়ে চলবে কিনা সে সিদ্ধান্তে আসা চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পেইচিং এই প্রণালীকে দেখে একটি ‘চোক-পয়েন্ট’ হিসেবে। তাই পরিবহন খাতে বিপুল পরিমাণ খরচ কমাতে তারা এই প্রণালী ব্যবহার করা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিরোধ রয়েছে চীনা নেতারা নিশ্চিত এর ফলে ওয়াশিংটন যদি বাংলাদেশে একটি ঘাঁটি স্থাপন করতে চায় তাতে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে সায় দেবেন না। এতে ভারতও সন্তুষ্ট হবে। কারণ, প্রতিবেশী দেশে তেমন মার্কিন ঘাঁটির বিরোধী দিল্লি, যেমন ঘাঁটি ডারউইনে স্থাপন করার অনুমতি দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি চীন সমর্থন দিয়ে বিবৃতি দেয়ার একদিন পরেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দৃশ্যত নমনীয় হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মেরি হার্ফ বলেছেন, আমরা শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত। দ্রুততার সঙ্গে তিনি আরও বলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে নি। ড্যান ডব্লিউ মজিনা গত সপ্তাহে ‘অবিলম্বে নির্বাচন’ দেয়ার যে আহ্বান জানিয়েছেন মেরি হার্ফ সে বিষয়টি উল্লেখ করেন নি।
যে নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হতে পারতো তা থেকে সরে এসে তারা বড় একটি ভুল করেছে এটা বুঝতে পেরে হরতাল অবরোধ, যা তারা নির্বাচনের আগে ব্যাপক আকারে করেছে তা অব্যাহতভাবে করার মুডে নেই বিএনপি। তারা ক্ষোভ প্রকাশ স্থগিত করেছে। এ কর্মসূচির সমালোচনা হয়েছে সব মহল থেকে। যে সহিংসতা হয়েছে তাতে অর্থনীতি আক্রান্ত হয়েছে। রাজপথে চলমান মানুষ বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন। শহরের বাজারে উৎপাদিত ফসল পৌঁছে দিতে পারলে কৃষক স্বস্তি অনুভব করে। কারণ, এতে তারা ভাল দাম পান। রপ্তানিকারকরা ব্যাপক ক্ষতির পরে আইনশৃঙ্খলা ফিরে আসুক এমনটা চাইছেন। ছাত্রছাত্রীরা স্কুল-কলেজে ফিরতে উদগ্রীব। অফিসগামী মানুষ ভাবতে চান তারা আর আতঙ্কের ভিতর নেই।
অনেক কিছুই হয়ে গেছে এমনটা সম্ভবত অনুধাবন করতে শুরু করেছেন খালেদা জিয়া। বাংলাদেশে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভোটাররা প্রস্তুত ছিলেন তাকে ভোট দিতে। দেশকে সুপথে রাখার জন্য এটা বিএনপির জন্য একটি সুযোগই ছিল না, একই সঙ্গে এটা ছিল দেশরক্ষার জন্য একটি নিশ্চিত সুযোগ। ক্ষমতা কোন একক দলের একচ্ছত্র দখলের বিষয় নয় একথা নিশ্চিত করতে ভোটাররা ক্ষমতাসীনদের পরিবর্তন করে। বাংলাদেশের অনেক ভোটার রাজনৈতিক মেরুর নন। আওয়ামী লীগকে এখন ক্ষমতা থেকে উৎখাতের মতো ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তোলার আগ্রহ তাদের নেই। অন্যদিকে গণআন্দোলন বেগবান করার পরিবর্তে বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচন বর্জনের সন্ত্রাসী কৌশলকে সমর্থন দেয়। এ নির্বাচন শেষ হয়েছে শেখ হাসিনা ওয়াজেদের বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এতে তার আত্মতুষ্টির কোন কারণ নেই। মন্ত্রিসভায় তিনি বহু দলকে ঠাঁই দিয়েছেন। তিনি হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছেন সামনেই তাকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে শেখ হাসিনার জন্য পাল্টে গেছে পরিস্থিতি। তার সরকারকে সমর্থন দিয়েছে রাশিয়া। তারা বলেছে, বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে গঠনমূলক অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতামূলক কাজ করতে চায়। আরও মজার কথা, সহিংসতা ও নির্বাচন বর্জনের জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করেছে রাশিয়া। তবে তারা একদলীয় নির্বাচনের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে। এতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়কার স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়। তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল ভারত ও রাশিয়া। পাকিস্তানি সেনারা নৃশংসতা চালাচ্ছিল সাধারণ বাঙালিদের ওপর। পাকিস্তানি সেনাদের সমর্থন দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। সিরিয়া পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করেছে ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া। তারপর রাশিয়া এবার সমর্থন করছে শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে। একে এশিয়ার একটি বড় ইস্যুতে ক্রেমলিনের শক্ত অবস্থান বলে দেখা হয়। কিন্তু তারপরে যা ঘটলো তা আরও বিস্ময়কর।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল চীন। কিন্তু দ্রুততার সঙ্গে তারা ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলে বাংলাদেশের সঙ্গে। বাংলাদেশের দু’টি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তারা সম-দূরত্ব বজায় রাখে। এ দু’টি দলই ১৯৯০-এর দশকে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শাসন করেছে বাংলাদেশকে। ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি চুন বরাবরই চুপচাপ থাকেন। কিন্তু এবার ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ আহ্বান করেন, যাতে সহিংসতার বিরুদ্ধে বিচক্ষণতা জয়ী হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতা নিয়ে গঠন করেছেন মন্ত্রিসভা। এ সময়ে তিনি একটি বার্তা পেয়েছেন চীনা প্রধানমন্ত্রী লি খেছিয়াং-এর কাছ থেকে। তাতে বলা হয়েছে, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সমন্বিত ও সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে হাত মেলাতে তার সরকার উদগ্রীব। রাষ্ট্রদূত লি চুন এ বিষয়ক একটি চিঠি পৌঁছে দেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হকের কাছে। এতে আরও পরিষ্কার করে যে বার্তা দেয়া হয় তাহলো এই সমর্থনের অর্থ অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। তবে লি’র ওই চিঠিতে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা বা এর একদলীয় প্রকৃতির উল্লেখ করা দূরের কথা নির্বাচন প্রসঙ্গই অনুপস্থিত। পশ্চিমাদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এর মাধ্যমে চীন একটি পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে। তাতে বোঝানো হয়েছে ঢাকার সরকারের কাছেই গণতন্ত্র ও সুশাসনের বিষয়টি ছেড়ে দেয়া ভাল। ডিসেম্বরে খুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত হয় বিসিআইএম-এর মিটিং। ওই বৈঠকে ভারত ও বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের কাছে চীন জানায় যে, তারা কলকাতা ও খুনমিংয়ের অর্থনৈতিক সংযোগ করিডোর উন্নয়নে দিল্লি ও ঢাকার সঙ্গে কাজ করতে উদগ্রীব হয়ে আছে। চীন জানায়, এতে ‘আমাদের সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা’ হবে। কিন্তু চীন এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সমদূরত্ব বজায় রাখার নীতি থেকে দূরে সরে এসেছে এবং তারা সমর্থন দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকারকে। একই সঙ্গে তারা ভারতের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক গড়তে চায়। এর মাধ্যমে তারা একটি বার্তা পৌঁছে দিতে চায় যে, তারা ভারতের সঙ্গে এ অঞ্চলে কাজ করতে পারলে ভীষণ সন্তুষ্ট হবে। এটা এমন এক সময়ে ঘটছে যখন ভারতীয় কূটনীতিক দেবযানী খোবরাগাড়ে ঘটনায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে এসেছে। এর আগে ভারতীয় কূটনীতিকদের কাছে চীন একটি ইঙ্গিত দিয়েছে যে, কক্সবাজার উপকূলে সোনাদিয়ায় তারা যে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে তা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে ভারতের যোগাযোগে সহায়ক হবে। ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের কব্জা থেকে বের করে আনতে ভীষণভাবে তৎপর পেইচিং। তা করতে এখনকার চেয়ে ভাল সময় আর কখন? শেখ হাসিনাকে দেখা হয় ভারতের খুব ঘনিষ্ঠ হিসেবে। তাই তার প্রতি চীনের সমর্থনকে দেখা হয় এক ঢিলে দুই পাখি শিকার হিসেবে।
গোপনীয় কথা হলো, যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা কেন বিএনপিকে নির্বাচনে এত দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন দিয়েছেন এবং দৃশ্যত এখনও দিচ্ছেন তাতে বিস্মিত চীনা কূটনীতিকরা। দক্ষিণ ভারতে একটি ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ভারত তা প্রত্যাখ্যান করে। তাই বঙ্গোপসাগরে এমন ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করার উপযোগী করে খালেদা জিয়াকে ওয়াশিংটন গড়ে তুলছে বলে সন্দেহ ওই সব কূটনীতিকের। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সমুদ্র সংযোগ রুটের খুব কাছাকাছি ঘাঁটি বসাতে তৎপর যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি চীনের কাছে স্পর্শকাতর। রাখাইন রাজ্যে চীন নির্মাণ করেছে কিইয়াউকপিউ বন্দর, একটি বিশাল তেল ও গ্যাস পাইপলাইন। এ পাইপলাইনের মধ্যে কিউকপুর সঙ্গে ইউন্নানকে সংযুক্ত করা হয়েছে। মালাক্কা প্রণালী এড়িয়ে চলবে কিনা সে সিদ্ধান্তে আসা চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পেইচিং এই প্রণালীকে দেখে একটি ‘চোক-পয়েন্ট’ হিসেবে। তাই পরিবহন খাতে বিপুল পরিমাণ খরচ কমাতে তারা এই প্রণালী ব্যবহার করা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিরোধ রয়েছে চীনা নেতারা নিশ্চিত এর ফলে ওয়াশিংটন যদি বাংলাদেশে একটি ঘাঁটি স্থাপন করতে চায় তাতে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে সায় দেবেন না। এতে ভারতও সন্তুষ্ট হবে। কারণ, প্রতিবেশী দেশে তেমন মার্কিন ঘাঁটির বিরোধী দিল্লি, যেমন ঘাঁটি ডারউইনে স্থাপন করার অনুমতি দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি চীন সমর্থন দিয়ে বিবৃতি দেয়ার একদিন পরেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দৃশ্যত নমনীয় হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মেরি হার্ফ বলেছেন, আমরা শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত। দ্রুততার সঙ্গে তিনি আরও বলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে নি। ড্যান ডব্লিউ মজিনা গত সপ্তাহে ‘অবিলম্বে নির্বাচন’ দেয়ার যে আহ্বান জানিয়েছেন মেরি হার্ফ সে বিষয়টি উল্লেখ করেন নি।
যে নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হতে পারতো তা থেকে সরে এসে তারা বড় একটি ভুল করেছে এটা বুঝতে পেরে হরতাল অবরোধ, যা তারা নির্বাচনের আগে ব্যাপক আকারে করেছে তা অব্যাহতভাবে করার মুডে নেই বিএনপি। তারা ক্ষোভ প্রকাশ স্থগিত করেছে। এ কর্মসূচির সমালোচনা হয়েছে সব মহল থেকে। যে সহিংসতা হয়েছে তাতে অর্থনীতি আক্রান্ত হয়েছে। রাজপথে চলমান মানুষ বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন। শহরের বাজারে উৎপাদিত ফসল পৌঁছে দিতে পারলে কৃষক স্বস্তি অনুভব করে। কারণ, এতে তারা ভাল দাম পান। রপ্তানিকারকরা ব্যাপক ক্ষতির পরে আইনশৃঙ্খলা ফিরে আসুক এমনটা চাইছেন। ছাত্রছাত্রীরা স্কুল-কলেজে ফিরতে উদগ্রীব। অফিসগামী মানুষ ভাবতে চান তারা আর আতঙ্কের ভিতর নেই।
অনেক কিছুই হয়ে গেছে এমনটা সম্ভবত অনুধাবন করতে শুরু করেছেন খালেদা জিয়া। বাংলাদেশে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভোটাররা প্রস্তুত ছিলেন তাকে ভোট দিতে। দেশকে সুপথে রাখার জন্য এটা বিএনপির জন্য একটি সুযোগই ছিল না, একই সঙ্গে এটা ছিল দেশরক্ষার জন্য একটি নিশ্চিত সুযোগ। ক্ষমতা কোন একক দলের একচ্ছত্র দখলের বিষয় নয় একথা নিশ্চিত করতে ভোটাররা ক্ষমতাসীনদের পরিবর্তন করে। বাংলাদেশের অনেক ভোটার রাজনৈতিক মেরুর নন। আওয়ামী লীগকে এখন ক্ষমতা থেকে উৎখাতের মতো ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তোলার আগ্রহ তাদের নেই। অন্যদিকে গণআন্দোলন বেগবান করার পরিবর্তে বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচন বর্জনের সন্ত্রাসী কৌশলকে সমর্থন দেয়। এ নির্বাচন শেষ হয়েছে শেখ হাসিনা ওয়াজেদের বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এতে তার আত্মতুষ্টির কোন কারণ নেই। মন্ত্রিসভায় তিনি বহু দলকে ঠাঁই দিয়েছেন। তিনি হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছেন সামনেই তাকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
সুবীর ভৌমিক ভারতের সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর সিনিয়র ফেলো। এর আগে তিনি বিবিসি’র সাংবাদিকতা করেন। লিখেছেন বেশ কিছু আলোচিত বই।
(গতকাল ভারতের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘এ ডিফিকাল্ট ভিকটরি’ শীর্ষক লেখার অনুবাদ)
No comments