৯ মাসেও রানা প্লাজা নিয়ে স্বচ্ছ পরিসংখ্যান হয়নি
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ৯ মাসেও নিহত ও
নিখোঁজের প্রকৃত পরিসংখ্যান বের করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে জানার জন্য আজ
পর্যন্ত কোন ওয়েবসাইট বা ডাটাবেজ তৈরি হয়নি।
আর এতে
আগামীতে নেয়া পদক্ষেপ বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে দুর্ঘটনার পর
সরকারি-বেসরকারি যেসব প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, সেগুলোরও সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে
না। এ অবস্থায় রানা প্লাজা নিয়ে সার্বিক তথ্য বের করা জরুরি। গতকাল
ব্র্যাক সেন্টার ইনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) উদ্যোগে আয়োজিত
আলোচনায় অংশ নেয়া প্যানেল আলোচকরা এসব কথা বলেন। এতে ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনা
ও পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ, প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নের সর্বশেষ
পরিস্থিতিবিষয়ক’ রিপোর্ট উপস্থাপন করেন ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। আলোচনা
সভার সভাপতিত্ব করেন সিপিডি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ
নেন শ্রম সচিব মিকাইল শিপার, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, অধ্যাপক এমএম আকাশ,
বিজিএমইএ’র সভাপতি আতিকুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি টিপু মুন্সী, সফিউল ইসলাম
মহিউদ্দিন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিসের (বিলস) যুগ্ম সচিব
জাফরুল হাসান, বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ও ফায়ার সার্ভিস ও
সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক আলী আহমেদ খান প্রমুখ।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রানা প্লাজা ধসের পরে নিহত-আহত শ্রমিকদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে কত টাকা জমা হয়েছে, কে কত টাকা দিয়েছেন, আর কাকে কত টাকা দেয়া হয়েছে তা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। আমরা শেষ পর্যন্ত দেখবো শ্রমিকরা কত টাকা পেয়েছে। আর শ্রমিকদের দেখিয়ে কে কত টাকা নিয়েছে। কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকলে কোন প্রশ্ন উঠবে না। তিনি বলেন, রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার ফলে সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কাজের অগ্রগতি হয়নি। ব্যক্তি পর্যায়ে কিছু কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্ত সামগ্রিকভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এসব বিষয় সামনে রেখে দ্বিতীয় প্রজন্মের গার্মেন্ট শিল্প তৈরি করতে একটি জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। ড. দেবপ্রিয় বলেন, এখন তিনটি বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। প্রথমত, নিহত-আহত শ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সমাধান করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় মেয়াদের কারখানাগুলো কিভাবে হবে তা ঠিক করা। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দরকষাকষি করে কারখানায় কাজ নিতে হবে। অনেকেই ঋণ দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদি অবকাঠামোগত উন্নয়নে ঋণ কিভাবে পাওয়া যাবে সেটা ঠিক করা দরকার। তিনি বলেন, একটা সমন্বয়ের অভাব ছিল রানাপ্লাজা উত্তর পরিস্থিতিতে। মানুষের নিহত ও নিখোঁজের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো সৃষ্টিতে কিভাবে ঋণ পাওয়া যায় তা নিয়ে চিন্তা করা উচিত। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এটি করতে হবে। ড. দেবপ্রিয় বলেন, স্বচ্ছতার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হতে হবে। ডিএনএ টেস্টে কাদের পরিচয় মিললো তা-ও প্রকাশিত হয়নি।
বিজিএমইএ’র সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, যে সব শ্রমিক ক্ষতিপূরণ পায়নি তাদেরকেও ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এতিম শিশুদের শিক্ষা, খাদ্য, চিকিৎসাসহ সব ধরনের সহায়তা দেয়া হবে। ৩০০ জন এতিম শিশুর দায়িত্ব বিজিএমইএ নেবে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, উত্তর আমেরিকান ক্রেতাদের জোট (অ্যাকর্ড) ও ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট (অ্যালায়েন্স) যে শর্ত দিচ্ছে তাতে দেশের কোন কারখানাই থাকবে না। তারা বলছে, নিচে দোকান ও উপরে কারখানা থাকলে কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে। এভাবে করলে পুরো পোশাকখাত লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। তারা আর্থিক সহযোগিতা করার কথা বললেও এক টাকাও দেয়নি। জাইকা একটি ফান্ড দেয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু তাদের চাহিদা পূরণ করে ফান্ড পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, গার্মেন্ট শিল্পে রাজনীতি ঢুকে গেছে। এ শিল্পকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে একটি চক্র। ২১ বিলিয়ন রপ্তানির এ খাত অনেকেই সহ্য করতে পারছে না। আমরা বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে এটাই আমাদের দোষ।
টিপু মুন্সি বলেন, নিহত-আহত শ্রমিকদের সহায়তার মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন। যাতে সবাই সমান ভাবে ক্ষতিপূরণ পায়। তিনি সিপিডি’র উদ্দেশে বলেন, শুধু নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে কথা বললে সামনের দিকে এগোনো সম্ভব হবে না। সবাইকে মিলেই তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
জাফরুল হাসান বলেন, শ্রম আইনে ভাল-মন্দ দুই দিকই আছে। ২০০৬ সালের শ্রম আইনের অনেক কিছুই সংশোধন করতে হবে। যে করেই হোক আমাদেরকে গার্মেন্ট শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে। রানাপ্লাজা ও তাজরীনের মতো আর কোন ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
শ্রমিক নেতা বাবুল আকতার বলেন, রানা প্লাজায় যারা কাজ করেছেন তারা এখন কোন গার্মেন্টে কাজ করতে চান না। তাদেরকে অন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির কথা এলেই বলে কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু কোন কারখানাই বন্ধ হয়নি। মালিকদের মানসিকতা পরিবর্তন হলে সবকিছু সম্ভব হবে। নয়তো কোন কিছুই সম্ভব নয়।
অনুষ্ঠানে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নিহত মোজাম্মেল হকের স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, রানা প্লাজার তিন তলায় নিউ বটনে কাজ করতো তার স্বামী। তাকে কবর দেয়ার পরে এ পর্যন্ত বিকাশের মাধ্যমে মাত্র ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। এরপর আর কেউ কোন খোঁজখবর নেয়নি। ঘরে এখন বাতি জ্বলে না। টাকার অভাবে ছোট মেয়ের বই কিনতে পারি না। মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ।
বেঁচে যাওয়া আরেক শ্রমিক মরিয়ম বলেন, আমাকে একটা কৃত্রিম হাত দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা দিয়ে কাজ করতে পারি না। কারণ এটা অনেক ভারি, ব্যবহার করলে খুব কষ্ট হয়, শরীরে যন্ত্রণা হয়।
রানা প্লাজার ওপর প্রতিবেদনে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দুর্ঘটনায় নিহত ও নিখোঁজের সংখ্যা নিয়ে একেকটি সংস্থা একেক ধরনের তথ্য দিয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস নিখোঁজের সংখ্যা জানাচ্ছে ৩৭৯ জন। অন্যদিকে রানা প্লাজা কো-অর্ডিনেশন সেল এই সংখ্যা ১৮৯ জন এবং সিপিডি’র মতে ৯৮ জন। প্রতিবেদনে তিনি বলেন, দুর্ঘটনার সময় ভবনটিতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা নিয়েও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। বিজিএমইএ-অ্যাকশন এইড-এর রিপোর্ট বলছে ৩৫৭২ জন, সিপিডি ৩৬৭০, বিলস ৩৯৪৮ আর কো-অর্ডিনেশন সেল ৩৮৪৮ জন। দুর্ঘটনার নয় মাসেও নিহত ও নিখোঁজের প্রকৃত সংখ্যা বের করতে না পারা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং এ কারণেই পরবর্তী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান গোলাম মোয়াজ্জেম। প্রতিবেদনে আরও বলেন, দুর্ঘটনায় আহতদের যারা পরে কাজে যোগ দিয়েছেন তাদের কেউই কাজের জন্য পুরোমাত্রায় সক্ষম নন। এতে তাদের আয় কমেছে। গার্মেন্ট খাতে স্বাভাবিক আয়ের তুলনায় ৬০ শতাংশ কম আয় করছেন এই শ্রমিকরা।
No comments