কিশোরগঞ্জে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৬ কোটি টাকা লুট by আশরাফুল ইসলাম
গোপন সুড়ঙ্গপথে কিশোরগঞ্জে সোনালী
ব্যাংকের প্রধান শাখা থেকে ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে গেছে
দুর্বৃত্তরা। জেলা শহরের রথখলা এলাকায় ব্যাংকের ওই শাখার পাশের বাসভবনের
একটি কক্ষ থেকে সুড়ঙ্গপথ তৈরি করে ব্যাংকের ভল্টরুমে রাখা এ টাকা লুট করা
হয়।
শুক্র ও শনিবার ব্যাংক বন্ধ থাকার পর গতকাল ব্যাংক
খোলার পর বেলা আড়াইটার দিকে টাকা লুট হওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে। শুক্র কিংবা
শনিবারের কোন একসময় এ ঘটনা ঘটেছে বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা ধারণা
করছেন। শহরের অন্যতম ব্যস্ততম এলাকার প্রধান সড়কের ওপর অবস্থিত ব্যাংকের
শাখা থেকে দুঃসাহসিক লুটের ঘটনায় পুরো এলাকায় ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক হুমায়ূন কবির ভূঁইয়া ও প্রিন্সিপাল অফিসার
হাসান আহমেদ মঈন জানান, ভল্টরুমে দু’টি কক্ষ রয়েছে, তবে প্রবেশপথ একটিই।
সামনের কক্ষ পেরিয়ে পেছনের কক্ষে যেতে হয়। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ব্যাংক
চলাকালে ভল্টরুমে তারা প্রবেশ করেছিলেন। তারা জানান, সে সময় ভল্টের দু’টি
কক্ষের মধ্যে পেছনের কক্ষটিতে ৬টি স্টিলের আলমারির বাইরে টেবিলের ওপর
উন্মুক্ত অবস্থায় ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা ও সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রার রাখা ছিল।
এরপর নির্ধারিত সাপ্তাহিক ছুটির কারণে শুক্র ও শনিবার ব্যাংক বন্ধ ছিল।
গতকাল সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসের শুরুতে ভল্ট খুলে দু’টি কক্ষের
সামনেরটিতে তারা কাজ করেন। বেলা আড়াইটায় তালাবদ্ধ পেছনের কক্ষটি খুলে ভেতরে
প্রবেশ করেন। সে সময় টেবিলের ওপর রাখা টাকা দেখতে না পেয়ে এবং কক্ষের
মেঝেতে গর্ত দেখতে পেয়ে টাকা লুট হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন। দুর্বৃত্তরা
স্টিলের আলমারির লক ভাঙারও চেষ্টা করেছিল বলে তারা জানান। বিষয়টি সদর মডেল
থানার ওসিকে অবহিত করার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়।
এদিকে ঘটনাটি জানার পরপরই রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশ, ডিবি পুলিশ ও সিআইডি তদন্তে নামে। ভল্টরুমের সুড়ঙ্গপথ ধরে তারা পাশের একটি টিনশেড বাসায় সুড়ঙ্গপথের উৎসমুখ আবিষ্কার করে। ওই সুড়ঙ্গপথের মাধ্যমেই ভল্টরুম থেকে লুট করা টাকা সরানো হয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন। সুড়ঙ্গপথের বর্ণনা দিতে গিয়ে সদর থানার এসআই শফিকুল ইসলাম জানান, সুড়ঙ্গপথটি খুব কৌশলে তৈরি করা হয়েছে। প্রায় ১৮ ফুট দীর্ঘ সুড়ঙ্গপথটি যেন ভেঙে না পড়ে সে জন্য সুড়ঙ্গের দু’পাশের পাড়ে বাঁশের খুঁটি দেয়া হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৩ ফুট উঁচু ও ৩ ফুট প্রস্থ সুড়ঙ্গপথ ধরে একজন ব্যক্তি অনায়াসেই চলাচল করতে পারবেন।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুড়ঙ্গপথের উৎসমুখটি যে টিনশেড বাসার একটি কক্ষে পাওয়া গেছে সে বাসাটির মালিক আমিনুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। বর্তমানে ওই বাসার মালিক তার মেয়ে মিনা আক্তার। তিনি ঢাকার উত্তরায় ১২ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর রোডের ৫৩নং বাসায় স্বামীর সঙ্গে বসবাস করেন। মিনা আক্তার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা এবং তার স্বামী মো. ইব্রাহীম উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। ঢাকায় বসবাসকারী মিনা আক্তারের মালিকানাধীন ওই বাসায় বর্তমানে ১১টি পরিবার ভাড়ায় রয়েছেন। বাসার যে রুমে সুড়ঙ্গপথটির উৎসমুখ পাওয়া গেছে সে বাসার ১নং রুমে সোহেল নামে ৩২-৩৩ বছর বয়সী যুবক ভাড়া থাকতেন বলে জানান বাসার ৩নং রুমের ভাড়াটিয়া মার্জিয়া আক্তার। মার্জিয়া জানান, প্রায় আড়াই বছর আগে সোহেল বাসার ওই রুমটি ভাড়া নিলেও অন্য ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে তার তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না। সে একাকী ওই রুমে বসবাস করতো। তার বাবা ঢাকায় সোনালী ব্যাংকের কোন এক শাখায় চাকরি করেন বলে তারা শুনেছেন। তার বাড়ি হোসেনপুরের চরপুমদি এলাকায় হতে পারে বলে তিনি ধারণা দেন। বাসায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে সে সোনালী ব্যাংক গলির দিকের দরজা ব্যবহার করতো বলেও তিনি জানান।
ওই বাসার মালিক মিনা আক্তারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, সেলিম নামে শহরের এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে সোহেলকে তার বাড়ির দায়িত্বে থাকা গোকুল বাবু বাসাভাড়া দিয়েছিলেন। সোহেলের বাবার নাম না জানলেও তিনি ঢাকায় সোনালী ব্যাংকের কোন এক শাখায় চাকরি করেন বলে তিনি জানতেন।
এ ঘটনার মূল সন্দিগ্ধ সোহেলের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, দুই রুমবিশিষ্ট বাসার একটি রুমে কাঠের কিছু আসবাবপত্র এলোপাতাড়ি পড়ে রয়েছে। অন্য রুমের অবস্থাও তথৈবচ। সোনালী ব্যাংক ভবনের ভল্টরুম থেকে সবচেয়ে কাছের ওই বাসার দরজা সংলগ্ন পরিত্যক্ত একটি টয়লেটের পাশে খোঁড়া হয়েছে সুড়ঙ্গটি। সুড়ঙ্গের পাশে একটি হাতুড়ি ও কোদাল পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজে এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে। কোন রুমেই থাকার কোন খাট পাওয়া যায়নি। তবে প্রথম রুমটিতে খাট ছিল বলে জানা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ঘটনার পর পালানোর আগে খাটটি অন্যত্র নিয়ে গেছে সোহেল।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বখাটে টাইপের সোহেল অন্য ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে মিশতো না। কয়েক দিন ধরে রাতে তার বাসায় হাতুড়ির শব্দও শোনা গেছে। বিষয়টি নিয়ে কেউ জিজ্ঞেস করলে বাসায় কাঠের কাজ করছেন বলে সে জানাতো। সর্বশেষ শুক্রবার রাতেও বাসায় সোহেলের অবস্থান টের পেয়েছিলেন ২-১ জন প্রতিবেশী ও ভাড়াটিয়া।
এদিকে ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের ওই শাখায় দায়িত্বরত কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যাংকেই অবস্থান করছিলেন। এ ছাড়া সোহেলকে বাসা ভাড়া পাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতাকারী স্থানীয় ব্যবসায়ী সেলিমকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে বলে জানান সদর সার্কেলের এএসপি মো. শাহেন শাহ। অন্যদিকে ব্যাংকের নিরাপত্তা ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনকারী ২ এএসআই ও ৬ কনস্টেবলকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। পরে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন খান জানান, ভাড়াটিয়া সোহেলসহ একাধিক ব্যক্তি এ কাজে জড়িত থাকতে পারে। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন এবং জড়িতদের চিহ্নিত করার জন্য পুলিশের বেশ কয়েকটি টিম কাজ করছে।
No comments