রাশি রাশি লালপদ্ম সাদা ফুল, নয়নাভিরাম দৃশ্য-মন ভরে যায়- পত্নীতলার জলাশয়ে শাপলার সমারোহ
দুপুর ছুঁই ছুঁই করলেও কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের কারণে মনে হচ্ছিল, যেন সকালই রয়ে গেছে। নওগাঁ জেলা সদর থেকে পত্নীতলা উপজেলার নজিপুর হয়ে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার উত্তরে খাসপাড়া গ্রাম।
রাস্তা দিয়ে যেতেই চোখে পড়ল দুটি শিশু এক গোছা করে সাদা শাপলা ফুল কাঁধে করে গলায় জড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করতেই ওরা বলল, এগুলো তারা বাজারে বিক্রি করতে যাচ্ছে। এ সময় পাশের জলাশয়ে চোখে পড়ল, সাদা আর লাল শাপলা ফুলের সমারোহ। এ যেন শাপলা ফুলের এক মিলনমেলা। যদিও শীতের কারণে ফুলগুলোর বেশকিছু এখনো পাঁপড়ি মেলতে পারেনি। আবার কিছু ঝড়েও গেছে। তারপরেও নয়নাভিরাম এ এক অপূর্বদৃশ্য যা দেখে মন ভরে যায়। মাঝে মাঝে কচুরিপানার ফুলগুলোও যেন নিজেকে শাপলার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতায় ওরাও যেন পিছিয়ে নেই। তারাও যেন শাপলা ফুলের সঙ্গে ফুটে আপন মহিমায় সৌন্দর্য বিলিয়ে দেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। জলাশয়টির আয়তন প্রায় অর্ধশত বিঘা। আগে প্রায় শত বিঘা আয়তন ছিল বলে স্থানীয় প্রবীণরা জানিয়েছেন। এ শাপলা খাল-বিল ও আবদ্ধ জলাশয়েই জন্মে থাকে। সেসব জলাশয় অধিকাংশই ভরাট হয়ে পানি না থাকায় এবং সেই ধরনের বড় বড় পুকুর বা দীঘিতে মাছ চাষ শুরু করায় এই জাতীয় ফুল শাপলা আর আগের মতো যত্র তত্র চোখে পড়ে না। এসব কারণে শুধু নওগাঁ জেলায় নয়, সারাদেশ থেকে ক্রমান্বয়ে জাতীয় ফুল শাপলার বিলুপ্তি ঘটছে দ্রুতগতিতে।ওই এলাকার শহিদুল ইসলাম, অলক কুমার সাহাসহ অনেকেই জানালেন, বর্ষাকালের শুরু থেকে হেমন্তকাল পর্যন্ত এ শাপলা ফুলে মিলন মেলা দেখে আসছি। এরপর এ জলাশয়টি শুকিয়ে গেলে তাতে খরা মৌসুমে বোরো ধান চাষ হয়। তবে জমির মালিকরা প্রতি বছর তলা থেকে চারিপাশে মাটি দিয়ে ভরাট করে আবাদি জমি বের করায় এ জলাশয়টির আয়তন ত্রমান্বয়ে কমে আসছে। তাদের ধারণা, একদিন হয়তো পুরো জলাশয়টি আবাদি জমিতে পরিণত হবে। আর সেই সঙ্গে শাপলাও আর জন্মাবে না। এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি শিক্ষাবিদ নূর আলম, খাদেমূল ইসলাম ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানী শিক্ষাবিদ ড. আবুল হায়াত ইসমাইল জানান, সারা বিশ্বে প্রায় ৫০ প্রজাতির শাপলা রয়েছে। জাতীয় ফুল শাপলা সাধারণত আমাদের দেশে বদ্ধ অগভীর জলাশয়, খাল-বিল অঞ্চলে জন্মায়। অত্রাঞ্চলে দুই ধরনের শাপলা ফুল দেখা যায়। সাদা ও লাল। স্থানীয় ভাষায় সাদা শাপলাকে ‘হলা’ বলা হয়। লাল শাপলাকে লাল বা ‘রক্তহলা’ বা রক্তকমল বলা হয়। এ শাপলা ফুল যখন আবদ্ধ জলাশয়ে অনেকগুলো এক সঙ্গে ফোটে তখন ওই জলাশয়ে এক অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়। আর ফুল থেকে যে ফলে রূপান্তরিত হয় তাকে বলা হয় ভ্যাঁট। এই ভ্যাঁটের ভেতরে অনেকগুলো ছোট ছোট বীজ থাকে। এগুলো মানুষ উঠিয়ে নিয়ে ভেঙ্গে শুকিয়ে খই ভেজে খেয়ে থাকে। এ ভ্যাঁটের খই খুবই সুস্বাদু। এ শাপলার বোঁটা গ্রামাঞ্চলে অনেক লোকজনের জনপ্রিয় সব্জি। শাপলা গাছের গোড়ায় যে মোথা থাকে, তাকে শালুক বলা হয়। এই শালুকও সেদ্ধ করে মানুষ খেয়ে থাকে। এসব শাপলা বর্ষা ও শরৎকালে ক্রমান্বয়ে জন্মে ও ফুল ফোটে। শীতকালের শুরুতেও ফুলগুলো চোখে পড়ে। আস্তে আস্তে পানিও কমে যায়, শাপলাও হারিয়ে যায়।
শাপলা ফুলের ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তির কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, বিল ও আবদ্ধ জলাশয়গুলো মানুষ শুকিয়ে ফেলে তাতে বোরো ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল ফলাচ্ছেন। এছাড়া আবদ্ধ জলাশয়গুলোতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করায় শাপলা জন্মানোর ক্ষেত্রগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে শাপলা ফুল এখন আর চোখে পড়ে না বললেই চলে। প্রবীণদের অনেকেই জানান, এ জাতীয় ফুল শাপলা এক সময় হয়তো কাগজে-কলমে আর পাঠ্য বইয়েই লেখা থাকবে। দ্রুত বিলুপ্তির কারণে বাস্তবে দেখা মিলবে না। অভিজ্ঞমহলের মতে, সরকারী এবং বেসরকারী উদ্যোগে আবদ্ধ জলাশয় অথবা দেশের বিভিন্ন লেকগুলোতে শাপলা উৎপাদনসহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরী।
No comments