রাশিমণি হাজং এবং টঙ্ক আন্দোলন- সোহেল হাজং
ময় তিমাদ, তিমাদ হুয়ে আরেগ তিমাদলা মান ময় বাঁচাব, মুরিবা লাগে মুরিব।ঃ হাজং ভাষার এ বাক্যটির অর্থ হলো "আমি নারী, নারী হয়ে আরেক নারীর সম্ভ্রম রা আমিই করব, মরতে হয় মরব।
কথাগুলো বলেছিলেন বিপ্লবী নারী রাশিমণি হাজং ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি জীবনযুদ্ধে ঝাঁপানোর পূর্ব মুহূর্তে। তাঁর আত্মবিসর্জনে সেদিন রা পান কুমুদিনী হাজং। রাশিমণি হাজংয়ের জন্ম তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলাধীন বগাঝরা নামক গ্রামে ১৯০৮ সালে। সে সময় এ গ্রামটি ব্রিটিশ বিরোধী গ্রামগুলোর মধ্যে একটি ছিল। রাশিমণি হাজংয়ের মনেও শুরু থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী চেতনা গড়ে ওঠে। মহাজন ও জোতদারদের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শেখেন। এক সময় হয়ে ওঠেন টঙ্ক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী।টঙ্ক আন্দোলন প্রকৃতপ েকৃষক আন্দোলন। টঙ্ক মানে ধান কড়ারি খাজনা। টঙ্ক প্রথার শতর্ানুসারে জমিতে ফসল হোক বা না হোক চুক্তি অনুযায়ী টঙ্কের ধান জমির মালিককে দিতেই হতো। ফলে দেখা যায় কোন বছর যদি জমিতে ফসল না হয় বা খরা এবং প্রাকৃতিক দুযের্াগে শস্য নষ্ট হয়ে যায় তবুও কৃষককে তার নিধর্ারিত খাজনা পরিশোধ করতে হতো। এতে হাজংসহ অন্যান্য সম্প্রদায় এবং অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষক সমাজ অর্থনৈতিক দূরবস্থায় পড়ে। আর কোন কারণে টঙ্কের ধান পরিশোধ করতে না পারলেই কৃষকদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার-নিপীড়ন।
টঙ্ক প্রথা কৃষকদের জন্য ছিল অভিশাপ। তারা টঙ্কের হাত থেকে মুক্তির জন্য সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ বা আন্দোলন গড়ে তোলেন। প্রথমে টঙ্কের কুফল বিষয়ে গ্রামে গ্রামে বৈঠক করা হয়। পরে ঐকমত্য সৃষ্টি হলে কৃষকরা জমিদারদের টঙ্ক ধান দেয়া বন্ধ করে দেয়। এতে টঙ্ক চাষীদের ভাগ্যে অনেক দুভের্াগ দেখা দেয়। কেননা জমিদারগোষ্ঠী টঙ্ক ধান আদায়ের জন্য যথাসাধ্য শক্তি প্রয়োগ করে। মূলত হাজং কৃষকগণই টঙ্ক প্রথা উচ্ছেদের জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথমে তাদের জমিদার গোষ্ঠীর সাথে, অতঃপর ব্রিটিশ সরকারের সাথে এবং শেষে পাক সরকারের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়। হাজংদের এ টঙ্ক ও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন কমরেড মনি সিংহ। যদিও বলা হয় ১৯৩৮ সাল থেকে টঙ্ক আন্দোলন শুরু হয়েছিল কিন্তু তার বহু পূর্বেই আন্দোলনের ত্রে প্রস্তুত ছিল এবং হাজংদের মাঝে সেটা কাজ করছিল।
রাশিমণি হাজংয়ের নেতৃত্বে নেত্রকোনার প্রতিটি অঞ্চলে যখন আন্দোলন তুঙ্গে, সে সময় ১৯৪৬ সালের ১ জানুয়ারি দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস্ বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এ সশস্ত্র বাহিনী বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে বিদ্রোহী হাজং কৃষকসহ অন্য কৃষকদের খুঁজতে শুরু করে। সে ল্যেই ৩১ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল্স বাহিনী বিরিশিরি থেকে চার মাইল উত্তরে বহেরাতলী গ্রামে তল্লাশি চালায়। কিন্তু এ দিনে এ গ্রামের বিদ্রোহী কৃষক নর-নারীরা প্রতিবেশীদের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করার কাজে অন্য গ্রামে চলে গিয়েছিল।
অবশেষে এ গ্রামে কাউকে না পেয়ে প্তি পুলিশ বাহিনী লঙ্কেশ্বর হাজংয়ের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে বিরিশিরি ক্যাম্পের দিকে রওনা হয়। হাজং গ্রামগুলোতে এ সংবাদটি ছড়িয়ে পড়লে শতাধিক হাজং নারী-পুরুষ সশস্ত্র বাহিনীর পথরোধ করে। এ সময় বিপ্লবী রাশিমণি হাজং তার দলবলসহ কুমুদিনী হাজংকে বাঁচাতে পুলিশ বাহিনীর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পুলিশ বাহিনীও নৃশংসভাবে গুলি চালায়। ফলে এক সময় পেছন থেকে আসা গুলিতে রাশিমণি হাজং মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পেছনে পুরুষ দলের নেতা সুরেন্দ্র হাজং রাশিমণিকে ধরতে গেলে তাকেও নির্দয়ভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। এতে অন্য হাজংরা প্তি হয়ে পুলিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। প্তি হাজং পুরুষদের বল্লমের আঘাতে ঘটনাস্থলেই ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার বাহিনীর দুম্বজন পুলিশ নিহত হয়। অন্যরা কুমুদিনী হাজংকে ছেড়ে দৌড়ে পালিয়ে আত্মরা করে।
একজন নারী হয়ে অন্য একজন নারীকে বাঁচাতে আত্মবিসর্জন দিয়ে রাশিমণি হাজং যে মহৎ দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। অতি সাহসিকতার সাথে তিনি শত্রু পকে ঘায়েল করেছিলেন। তাছাড়া রাশিমণি হাজং সমাজে অত্যন্ত সাহসী ও লড়াকু মহিলা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রধারী পুলিশদের বিপ েতিনি সেদিন হার মানেন।
নারী হয়ে নারীর সম্ভ্রম রার্থে জীবন দিয়ে রাশিমণি আজ হাজংদের কাছে হাজংমাতা হিসেবে পরিচিত। তাঁরই স্মৃতি রার্থে দীর্ঘ ৫৮ বছর পর বিভিন্ন গুণীজনের উদ্যোগে ২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি বহেরাতলী গ্রামে তাঁর মৃতু্য সংলগ্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে "শহীদ হাজংমাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধঃ_ যা হাজং বিদ্রোহের অন্যতম সাী হিসেবে পরিচয় বহন করছে। হাজংরা তাই প্রতিবছর এ দিনটি আসলেই শ্রদ্ধার সাথে পালনের চেষ্টা করে থাকে। এ বছর রাশিমণি হাজংয়ের ৬৪তম মৃতু্যবার্ষিকী।
No comments