কনকনে ঠাণ্ডায় জবুথবু চিড়িয়াখানার প্রাণীকুল
উৎপল রায়: রেকর্ড সর্বনিম্ন তাপমাত্রার প্রভাব পড়েছে রাজধানীর মিরপুর
চিড়িয়াখানায়। কনকনে ঠাণ্ডায় কাতর চিড়িয়াখানার প্রাণীকুল। হাঁড় কাপানো শীতে
কাবু হয়ে পড়েছে ছোট-বড় সব প্রাণী। যেন প্রাণহীন একেকটি দেহ। একটু উষ্ণতার
জন্য ওষ্ঠাগত প্রাণ। সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে মিরপুর চিড়িয়াখানার মাংসাশী,
স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ ও বানরজাতীয় প্রাণীগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে। খাঁচার ভেতরে
কোনায় কোনায় জায়গা খুঁজে সেখানেই অবস্থান করছে একটু উষ্ণতার জন্য। ঘুরতে
আসা অল্পসংখ্যক দর্শনার্থীরাও প্রাণীগুলোর এ অবস্থা দেখে ব্যথিত, মর্মাহত।
মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানার প্রাণী চিকিৎসকরাও বলছেন, পরিবর্তিত আবহাওয়ায়
প্রাণীগুলোর স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন তারা। তবে
তারা এ-ও জানিয়েছেন, পৃথিবীর অনেক দেশের চিড়িয়াখানায়ই প্রচণ্ড শীত ও কনকনে
ঠাণ্ডায় অনভ্যস্ত প্রাণীকুলের জন্য আধুনিক ও বিশেষ পদ্ধতি থাকলেও আমাদের
দেশে এ সুবিধা নেই। তাই অপ্রতুল ব্যবস্থা নিয়েই প্রাণীগুলোর কষ্ট লাঘবের
চেষ্টা করা হচ্ছে। মিরপুর চিড়িয়াখানার সি-৮ নম্বর খাচার ভেতরে দেখা গেছে,
আফ্রিকার দুর্লভ প্রাণী সাদা সিংহ ও সিংহী দ্বীপ আর দ্বীপালী প্রচণ্ড
ঠাণ্ডায় দুর্বল হয়ে পড়েছে। মেঝেতে ৬ ইঞ্চি উঁচু বালি ও খরকুটো দিয়ে উষ্ণতার
ব্যবস্থা থাকলেও তা তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। সামনে খাবার পড়ে থাকলেও সেদিকে
মন নেই। শীত থেকে বাঁচতেই প্রাণান্তকর চেষ্টা তাদের। একই অবস্থা পাশের
সি-১০ (বি) নম্বর খাঁচার ভেতরে থাকা ভারতীয় সিংহ ও সিংহী রনি আর রিনার।
আয়ুষ্কাল অতিক্রম করা রয়েল বেঙ্গল টাইগার রাজা ও প্রমীলা সি-৩ (বি) নম্বর
খাঁচায় জবুথবু। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন শীতে চিড়িয়াখানার প্রাণীকুলের মধ্যে
সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয় বানর জাতীয় প্রাণীগুলো। এ সময় নিউমোনিয়া,
ফুসফুস ও শাসকষ্টজনিত রোগে দ্রুত আক্রান্ত হয় তারা। এজন্য শীতের মওসুমের
শুরুতেই তাদের জন্য ব্যবস্থা নিতে হয়। দেখা গেছে বানর জাতীয় প্রাণীগুলোর
জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। চিড়িয়াখানার বানরের
সবচেয়ে বড় খাঁচা এসএম-১। শীত ও ঠাণ্ডায় বানরগুলো একে অন্যের শরীরে শরীর
ঘেঁষে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। উষ্ণতা ও একটু উমের জন্য বানরের
বাচ্চাগুলোও মায়ের কোল জড়িয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে প্রাণান্ত। এল-২৬
খাঁচার শিম্পাঞ্জী, এসএম-৮ খাঁচার সোনালি বুক বানর, এসএম-৩ খাঁচার অলিভ
বেবুন, হনুমান সবার জন্য খাঁচার ভেতর খড়কুটো দিয়ে শীত নিবারণের ব্যবস্থা
করা হলেও তা তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। মিরপুর চিড়িয়াখানার জু অফিসার
(স্তন্যপায়ী ও সরীসৃপ প্রাণী শাখা) ডা. সঞ্জীব কুমার বিশ্বাস মানবজমিনকে
বলেন, অধিকাংশ সরীসৃপ প্রাণী শীতকালে খুব বেশি খাবার গ্রহণ করে না। যেমন:
সাপ, কুমির গরিলা। তখন তারা দিন-রাতের বেশিরভাগ সময় শীত নিদ্রায়
(হাইবারনেশান)-এ থাকে। এ সময় তারা খাবারও গ্রহণ করে কম। কারণ, গরমকালে তারা
যে খাবার গ্রহণ করে তা তাদের শরীরে এবডোমেনাল ফ্যাট হিসেবে জমা থাকে।
কিন্তু রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় সরীসৃপ
প্রাণীগুলোর শীত নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটছে। এ অবস্থায় খাবার গ্রহণ না করাতে
তাদের শরীরে পর্যাপ্ত ক্যালোরি ও ভিটামিনের অভাব দেখা দিচ্ছে। এতে করে
তাদের অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। তবে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি
প্রাণীগুলোকে সঠিক তাপমাত্রা দিয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত রাখার
জন্য। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে পরিবর্তিত আবহাওয়ায় বিপন্ন, দুর্লভ এমন
প্রাণীগুলোর জন্য চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ নিয়েছে জরুরী ব্যবস্থা। বিশেষ করে
চিতা বাঘ, র্যাটল, কালো ভল্লুক, ক্যাঙ্গারু, গিনিপিগ, হায়েনা ও বিরল
প্রজাতির পাখিগুলোর খাবার ও থাকার পরিবেশে আনা হয়েছে পরিবর্তন। চিড়িয়াখানার
প্রাণী চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শীতকালে বেশিরভাগ প্রাণীর শরীরের ক্যালোরি ও
ভিটামিন কমে যায়। সে জন্য প্রাণীগুলোকে বেশি পরিমানে ক্যালোরি ও
ভিটামিনযুক্ত খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। এমনকি কোন কোন প্রাণীকে বাঁচিয়ে
রাখার জন্য রুম হিটারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এ বিষয়ে মিরপুর জাতীয়
চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. এ বি এম শহীদ উল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, এখন পর্যন্ত
প্রাণীগুলোকে প্রচন্ড শীত ও ঠাণ্ডা থেকে রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা
নিয়েছি। তাদের খাদ্যাভ্যাস ও থাকার পরিবেশেও আনতে হয়েছে পরিবর্তন। তবে আশার
কথা হচ্ছে শীত ও ঠাণ্ডায় এখন পর্যন্ত কোন প্রাণী মারা যায়নি। কিন্তু
সমস্যা হচ্ছে বয়স্ক ও আয়ুষ্কাল পেরিয়ে যাওয়া বাঘ, সিংহ, হাতি, কুমির এসব
প্রাণীদের জন্য বেশি যত্ন নিতে হচ্ছে। এজন্য রুম হিটার, অক্সিজেন ও আইসিইউর
(ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে চিড়িয়াখানার হাসপাতালে। আর
যে সব প্রাণী এতো সর্বনিম্ন তাপমাত্রাতে অভ্যস্থ নয় ও শীতে বেশি কাবু হয়
সেগুলোকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি। এ ছাড়া শীত ও
ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে পড়া প্রাণীগুলোকে বিরক্ত না করার জন্য চিড়িয়াখানায় আগত
দর্শনার্থীদের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
No comments