ঢাকায় চিকিৎসক উপচে পড়ছে, গ্রামে পদ শূন্য by শিশির মোড়ল
ঢাকার কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি চিকিৎসক রয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০ শয্যার স্ত্রীরোগ বিভাগে চিকিৎসক আছেন ২৮৪ জন। আর ঢাকার বাইরে ভোলা জেলায় চিকিৎসকদের ৭০ শতাংশ পদ খালি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, চিকিৎসকদের দলবাজির কারণে গ্রামে চিকিৎসক থাকছেন না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের অদক্ষতা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসকদের গ্রামের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে একাধিকবার অনুরোধ করেছেন, নির্দেশও দিয়েছেন। চিকিৎসকদের আচরণ নিয়ে জাতীয় সংসদে সাংসদেরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক এ ব্যাপারে জনসমক্ষে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন।
গ্রামে চিকিৎসক রাখার কথা বলে বর্তমান সরকার অস্থায়ী (অ্যাডহক) ভিত্তিতে চার হাজার ১৩৩ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেয়। তাঁদের কতজন গ্রামে আছেন, তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানাতে পারেনি। এই আমলে প্রায় দেড় হাজার চিকিৎসক বিসিএসের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছেন। আরও চিকিৎসক নিয়োগের উদ্যোগ রয়েছে বলে জানা গেছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ খায়রুল ইসলাম বলেন, নিয়োগ দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। চিকিৎসকদের গ্রামে থাকা বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি স্থানীয় সরকারকে বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
৭০ শতাংশ পদ শূন্য: ভোলা জেলায় ২১ লাখ মানুষের বাস। সরকারি সূত্র বলছে, সদর ও উপজেলা পর্যায়ে আটটি হাসপাতাল ও পাঁচটি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের পদ ১৯৩টি। বর্তমানে ১৩৫টি অর্থাৎ ৭০ শতাংশ পদ শূন্য।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগে শয্যা ৭৯টি। এখানে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক আছেন ১৬ জন। রেজিস্ট্রার ও সহকারী রেজিস্ট্রার ১১ জন। মেডিকেল কর্মকর্তা ৩০ জন। এ ছাড়া অবৈতনিক চিকিৎসা কর্মকর্তা আছেন ৩০ জন। এসব চিকিৎসকের সঙ্গে কাজ করেন ৪৫ জন শিক্ষানবিশ চিকিৎসক। মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পদস্থ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ৭৯টি শয্যার জন্য ১৩২ জন চিকিৎসকের দরকার নেই। অনেকেরই নিয়মিত কাজ থাকে না। উপস্থিতিও তদারক করা হয় না।
রাজধানী থেকে কত দূরে: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সারা দেশে ৪৮১টি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের পদ আছে নয় হাজার ১৫০টি। ১ জানুয়ারির হিসাবে দুই হাজার ২৯৪টি পদে চিকিৎসক নেই। অর্থাৎ উপজেলা পর্যায়ে ২৫ শতাংশ পদ শূন্য।
এটা গড় হিসাব। কিন্তু রাজধানী থেকে উপজেলার অবস্থান যত দূরে, সেখানে শূন্য পদের সংখ্যা তত বেশি।
ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে চিকিৎসকের পদ আছে ৩০টি, এর মধ্যে ২৫টিই শূন্য। ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ ২১টি। কোনো পদ শূন্য নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ বার্ষিক প্রকাশনা হেলথ বুলেটিন ২০১২-এ বলা হয়েছে, বরিশাল বিভাগে ৩৬ শতাংশ চিকিৎসকের পদ শূন্য, এটাই সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে ঢাকা বিভাগে পদ শূন্য ১৭ শতাংশ, এটা সবচেয়ে কম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপক ছয়জন, সহযোগী অধ্যাপক ১৪ জন, ১৭ জন সহকারী অধ্যাপক এবং পরামর্শক চিকিৎসক (কনসালটেন্ট) আছেন সাতজন। চিকিৎসা কর্মকর্তা আছেন ৫০ জন। এ ছাড়া ডিপ্লোমা, এমএস ও এফসিপিএস শিক্ষার্থী ১৯০ জন—তাঁরাও প্রত্যেকে এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসক। ১০০ শয্যার এই বিভাগে চিকিৎসক আছেন ২৮৪ জন।
স্ত্রীরোগ বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ১৫৮ জন রোগী দেখা হয়, দায়িত্ব পালন করেন আটজন চিকিৎসক। প্রতিদিন গড়ে অস্ত্রোপচার হয় ১০টি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহযোগী অধ্যাপক বলেছেন, তিনি মাসে দুই দিনের বেশি অস্ত্রোপচার করার সুযোগ পান না।
বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, অনেক বিভাগেই চিকিৎসক বেশি। তাঁদের অনেকেরই পর্যাপ্ত কাজ নেই।
ঢাকার আশপাশ: ঢাকায় থাকতে চান চিকিৎসকেরা। ঢাকায় ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখার এবং বেসরকারি ক্লিনিকে কাজ করার সুযোগ বেশি। তাই ঢাকার আশপাশে পদায়ন হলেও তাঁদের আপত্তি নেই।
দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালগুলো ৫০ শয্যার। দোহার ও নবাবগঞ্জে চিকিৎসক আছেন ৩৬ জন করে। এসব উপজেলার ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রেও চিকিৎসক পদায়ন করা আছে। কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমল্পেক্সে শয্যাসংখ্যা ৩১। এখানে চিকিৎসক আছেন ২৬ জন। ঢাকার আশপাশে ইউনিয়ন পর্যায়ের উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রেও কোনো পদ খালি নেই।
উত্তরের একটি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্বামী-স্ত্রী দুজন কাজ করতেন। স্বামী স্নাতকোত্তর শিক্ষা কোর্সে ভর্তি হওয়ার পর ঢাকায় এসেছেন। স্ত্রীও প্রেষণে ঢাকার একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে প্রভাষক হিসেবে কাজ করছেন। গত বছর ঢাকা থেকে একজন চিকিৎসককে ময়মনসিংহে বদলি করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তিনি কাজে যোগ দেননি। প্রভাবশালী মন্ত্রীর মাধ্যমে সেই বদলি বাতিল করান। একই ঘটনা ঘটে জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউটের এক চিকিৎসকের ক্ষেত্রে। তাঁকে খুলনায় বদলি করা হয়েছিল।
প্রেষণ ও সংযুক্তি: স্নাতকোত্তর শিক্ষার নামে চিকিৎসকেরা ঢাকায় চলে আসেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বলছে, বর্তমানে এমডি, এমএস, এফসিপিএস, এমফিল ও ডিপ্লোমা কোর্সে এক হাজার ৪৯৭ জন চিকিৎসক প্রেষণে আছেন। অনেকে একটি কোর্স শেষ করে অন্য কোর্সে ভর্তি হন।
এ ছাড়া সংযুক্তির (অ্যাটাচমেন্ট) মাধ্যমে অনেকে রাজধানীর বড় বড় হাসপাতালে কাজ করছেন। তাই দেখা যায়, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে অনুমোদিত পদের চেয়ে বেশিসংখ্যক চিকিৎসক কাজ করছেন। তাঁদের সঠিক সংখ্যা অধিদপ্তর জানাতে পারেনি। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেছেন, ‘কয়েক শ’।
প্রশিক্ষণ, স্নাতকোত্তর শিক্ষা, প্রেষণ, সংযুক্তি—এ রকম নানা অজুহাতে চিকিৎসকদের গ্রাম থেকে ঢাকা, ঢাকার আশপাশ বা বড় শহরে আনা হয়। এখন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চিকিৎসকেরা এই সুযোগ ভোগ করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার মো. সিফায়েত উল্লাহ বলেন, সব আমলেই দেখা গেছে, সরকারের সমর্থক চিকিৎসকেরা ঢাকায় আসেন বেশি।
নেতারা কী বলেন: বর্তমান সরকারের আমলে চিকিৎসকদের পদায়ন, বদলি ও নিয়োগে সবচেয়ে বেশি প্রভাব খাটিয়েছেন আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক বদিউজ্জামন ভূঁইয়া, বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক মহাসচিব মো. শারফুদ্দিন আহমেদ এবং আওয়ামী লীগপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব ও বর্তমানে বিএমএর মহাসচিব ইকবাল আর্সলান। অভিযোগ আছে, তাঁদের কারণে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বদলি হয়েছেন। তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নিয়োগ-বদলি তদারক করেন তিনজন চিকিৎসক কর্মকর্তা।
নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বদিউজ্জামান ভূঁইয়া। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এসব সমস্যা নিয়ে একাধিকবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বলেছি, লাভ হয়নি। প্রয়োজনে এসব অভিযোগ আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরব।’
মো. শারফুদ্দিন বলেন, ব্যক্তিগতভাবে কোনো চিকিৎসকের পদোন্নতি বা বদলির তদবির তিনি করেননি বা কাউকে চাপ দেননি। তবে কোনো মন্ত্রী বা সাংসদের ভাতিজা বা ভাগনের জন্য সুপারিশ করেছেন। এর সংখ্যা খুবই কম।
ইকবাল আর্সলান বলেন, বদলির ক্ষেত্রে নিয়মনীতি ভাঙেন প্রভাবশালী আমলারা। তাঁরা নিজেদের ছেলেমেয়েদের গ্রামে পাঠান না, পাঠালেও দু-এক দিন পর ঢাকায় ফেরত আনেন। এর সুযোগ নেন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত চিকিৎসকেরা।
শূন্য পদে সমস্যা: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশে সরকারি চিকিৎসকের পদ ২৪ হাজার ৩০০। এর মধ্যে আট হাজারের কিছু বেশি (৩৩ শতাংশ) পদ শূন্য। খন্দকার সিফায়েত উল্লাহ বলেন, ঢাকার আশপাশে এসব শূন্য পদে নানা পন্থায় চিকিৎসকেরা চলে আসেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসকদের গ্রামের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে একাধিকবার অনুরোধ করেছেন, নির্দেশও দিয়েছেন। চিকিৎসকদের আচরণ নিয়ে জাতীয় সংসদে সাংসদেরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক এ ব্যাপারে জনসমক্ষে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন।
গ্রামে চিকিৎসক রাখার কথা বলে বর্তমান সরকার অস্থায়ী (অ্যাডহক) ভিত্তিতে চার হাজার ১৩৩ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেয়। তাঁদের কতজন গ্রামে আছেন, তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানাতে পারেনি। এই আমলে প্রায় দেড় হাজার চিকিৎসক বিসিএসের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছেন। আরও চিকিৎসক নিয়োগের উদ্যোগ রয়েছে বলে জানা গেছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ খায়রুল ইসলাম বলেন, নিয়োগ দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। চিকিৎসকদের গ্রামে থাকা বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি স্থানীয় সরকারকে বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
৭০ শতাংশ পদ শূন্য: ভোলা জেলায় ২১ লাখ মানুষের বাস। সরকারি সূত্র বলছে, সদর ও উপজেলা পর্যায়ে আটটি হাসপাতাল ও পাঁচটি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের পদ ১৯৩টি। বর্তমানে ১৩৫টি অর্থাৎ ৭০ শতাংশ পদ শূন্য।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগে শয্যা ৭৯টি। এখানে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক আছেন ১৬ জন। রেজিস্ট্রার ও সহকারী রেজিস্ট্রার ১১ জন। মেডিকেল কর্মকর্তা ৩০ জন। এ ছাড়া অবৈতনিক চিকিৎসা কর্মকর্তা আছেন ৩০ জন। এসব চিকিৎসকের সঙ্গে কাজ করেন ৪৫ জন শিক্ষানবিশ চিকিৎসক। মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পদস্থ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ৭৯টি শয্যার জন্য ১৩২ জন চিকিৎসকের দরকার নেই। অনেকেরই নিয়মিত কাজ থাকে না। উপস্থিতিও তদারক করা হয় না।
রাজধানী থেকে কত দূরে: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সারা দেশে ৪৮১টি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের পদ আছে নয় হাজার ১৫০টি। ১ জানুয়ারির হিসাবে দুই হাজার ২৯৪টি পদে চিকিৎসক নেই। অর্থাৎ উপজেলা পর্যায়ে ২৫ শতাংশ পদ শূন্য।
এটা গড় হিসাব। কিন্তু রাজধানী থেকে উপজেলার অবস্থান যত দূরে, সেখানে শূন্য পদের সংখ্যা তত বেশি।
ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে চিকিৎসকের পদ আছে ৩০টি, এর মধ্যে ২৫টিই শূন্য। ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ ২১টি। কোনো পদ শূন্য নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ বার্ষিক প্রকাশনা হেলথ বুলেটিন ২০১২-এ বলা হয়েছে, বরিশাল বিভাগে ৩৬ শতাংশ চিকিৎসকের পদ শূন্য, এটাই সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে ঢাকা বিভাগে পদ শূন্য ১৭ শতাংশ, এটা সবচেয়ে কম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপক ছয়জন, সহযোগী অধ্যাপক ১৪ জন, ১৭ জন সহকারী অধ্যাপক এবং পরামর্শক চিকিৎসক (কনসালটেন্ট) আছেন সাতজন। চিকিৎসা কর্মকর্তা আছেন ৫০ জন। এ ছাড়া ডিপ্লোমা, এমএস ও এফসিপিএস শিক্ষার্থী ১৯০ জন—তাঁরাও প্রত্যেকে এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসক। ১০০ শয্যার এই বিভাগে চিকিৎসক আছেন ২৮৪ জন।
স্ত্রীরোগ বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ১৫৮ জন রোগী দেখা হয়, দায়িত্ব পালন করেন আটজন চিকিৎসক। প্রতিদিন গড়ে অস্ত্রোপচার হয় ১০টি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহযোগী অধ্যাপক বলেছেন, তিনি মাসে দুই দিনের বেশি অস্ত্রোপচার করার সুযোগ পান না।
বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, অনেক বিভাগেই চিকিৎসক বেশি। তাঁদের অনেকেরই পর্যাপ্ত কাজ নেই।
ঢাকার আশপাশ: ঢাকায় থাকতে চান চিকিৎসকেরা। ঢাকায় ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখার এবং বেসরকারি ক্লিনিকে কাজ করার সুযোগ বেশি। তাই ঢাকার আশপাশে পদায়ন হলেও তাঁদের আপত্তি নেই।
দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালগুলো ৫০ শয্যার। দোহার ও নবাবগঞ্জে চিকিৎসক আছেন ৩৬ জন করে। এসব উপজেলার ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রেও চিকিৎসক পদায়ন করা আছে। কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমল্পেক্সে শয্যাসংখ্যা ৩১। এখানে চিকিৎসক আছেন ২৬ জন। ঢাকার আশপাশে ইউনিয়ন পর্যায়ের উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রেও কোনো পদ খালি নেই।
উত্তরের একটি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্বামী-স্ত্রী দুজন কাজ করতেন। স্বামী স্নাতকোত্তর শিক্ষা কোর্সে ভর্তি হওয়ার পর ঢাকায় এসেছেন। স্ত্রীও প্রেষণে ঢাকার একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে প্রভাষক হিসেবে কাজ করছেন। গত বছর ঢাকা থেকে একজন চিকিৎসককে ময়মনসিংহে বদলি করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তিনি কাজে যোগ দেননি। প্রভাবশালী মন্ত্রীর মাধ্যমে সেই বদলি বাতিল করান। একই ঘটনা ঘটে জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউটের এক চিকিৎসকের ক্ষেত্রে। তাঁকে খুলনায় বদলি করা হয়েছিল।
প্রেষণ ও সংযুক্তি: স্নাতকোত্তর শিক্ষার নামে চিকিৎসকেরা ঢাকায় চলে আসেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বলছে, বর্তমানে এমডি, এমএস, এফসিপিএস, এমফিল ও ডিপ্লোমা কোর্সে এক হাজার ৪৯৭ জন চিকিৎসক প্রেষণে আছেন। অনেকে একটি কোর্স শেষ করে অন্য কোর্সে ভর্তি হন।
এ ছাড়া সংযুক্তির (অ্যাটাচমেন্ট) মাধ্যমে অনেকে রাজধানীর বড় বড় হাসপাতালে কাজ করছেন। তাই দেখা যায়, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে অনুমোদিত পদের চেয়ে বেশিসংখ্যক চিকিৎসক কাজ করছেন। তাঁদের সঠিক সংখ্যা অধিদপ্তর জানাতে পারেনি। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেছেন, ‘কয়েক শ’।
প্রশিক্ষণ, স্নাতকোত্তর শিক্ষা, প্রেষণ, সংযুক্তি—এ রকম নানা অজুহাতে চিকিৎসকদের গ্রাম থেকে ঢাকা, ঢাকার আশপাশ বা বড় শহরে আনা হয়। এখন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চিকিৎসকেরা এই সুযোগ ভোগ করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার মো. সিফায়েত উল্লাহ বলেন, সব আমলেই দেখা গেছে, সরকারের সমর্থক চিকিৎসকেরা ঢাকায় আসেন বেশি।
নেতারা কী বলেন: বর্তমান সরকারের আমলে চিকিৎসকদের পদায়ন, বদলি ও নিয়োগে সবচেয়ে বেশি প্রভাব খাটিয়েছেন আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক বদিউজ্জামন ভূঁইয়া, বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক মহাসচিব মো. শারফুদ্দিন আহমেদ এবং আওয়ামী লীগপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব ও বর্তমানে বিএমএর মহাসচিব ইকবাল আর্সলান। অভিযোগ আছে, তাঁদের কারণে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বদলি হয়েছেন। তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নিয়োগ-বদলি তদারক করেন তিনজন চিকিৎসক কর্মকর্তা।
নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বদিউজ্জামান ভূঁইয়া। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এসব সমস্যা নিয়ে একাধিকবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বলেছি, লাভ হয়নি। প্রয়োজনে এসব অভিযোগ আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরব।’
মো. শারফুদ্দিন বলেন, ব্যক্তিগতভাবে কোনো চিকিৎসকের পদোন্নতি বা বদলির তদবির তিনি করেননি বা কাউকে চাপ দেননি। তবে কোনো মন্ত্রী বা সাংসদের ভাতিজা বা ভাগনের জন্য সুপারিশ করেছেন। এর সংখ্যা খুবই কম।
ইকবাল আর্সলান বলেন, বদলির ক্ষেত্রে নিয়মনীতি ভাঙেন প্রভাবশালী আমলারা। তাঁরা নিজেদের ছেলেমেয়েদের গ্রামে পাঠান না, পাঠালেও দু-এক দিন পর ঢাকায় ফেরত আনেন। এর সুযোগ নেন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত চিকিৎসকেরা।
শূন্য পদে সমস্যা: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশে সরকারি চিকিৎসকের পদ ২৪ হাজার ৩০০। এর মধ্যে আট হাজারের কিছু বেশি (৩৩ শতাংশ) পদ শূন্য। খন্দকার সিফায়েত উল্লাহ বলেন, ঢাকার আশপাশে এসব শূন্য পদে নানা পন্থায় চিকিৎসকেরা চলে আসেন।
No comments