উইকিলিকস: মার্কিন নথিতে এক-এগারো- রাষ্ট্রদূতের কাছে সেনা কর্মকর্তার ব্যাখ্যা by মশিউল আলম

১১ জানুয়ারি সকালের এক তারবার্তায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস ওয়াশিংটনকে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটের ‘সামরিক সমাধানের’ জন্য সামরিক বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সংকেত ছাড়া সামরিক বাহিনী পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা বোধ করছে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার কোনো সংকেত দিয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি। কিন্তু দেখা গেল, ওই দিনই ঢাকার সময় সন্ধ্যা সাতটা ২০ মিনিটে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হলো। সে রাতেই একটি তারবার্তায় বিউটেনিস সে সংবাদ ওয়াশিংটনকে জানিয়ে দেন। পরদিন ১২ জানুয়ারি তিনি আরেকটি তারবার্তা পাঠান। ‘সিক্রেট/নোফর্ন’ শ্রেণীভুক্ত সে তারবার্তায় তিনি লেখেন, সামরিক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সন্ত্রাসবাদ দমন বিভাগের তৎকালীন প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ টি এম আমিনের অনুরোধক্রমে রাষ্ট্রদূত বিউটেনিস ও দূতাবাসের আঞ্চলিক বিষয়াদিসংক্রান্ত কর্মকর্তা (আরএও) তাঁকে ১২ জানুয়ারি সাক্ষাৎ দেন। সে সাক্ষাতে ব্রিগেডিয়ার আমিন তাঁদের বলেন, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে এবং প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে ইস্তফা দিতে চাপ প্রয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতি/ প্রধান উপদেষ্টার কাছে গিয়েছিল। রাষ্ট্রদূত বিউটেনিস ও আরএওর কাছে ব্রিগেডিয়ার আমিন সেই ঘটনা বর্ণনা করেন এবং কেন সামরিক বাহিনী এই পদক্ষেপ নিয়েছে তার ব্যাখ্যা দেন।
বিউটেনিস লিখেছেন, ব্রিগেডিয়ার আমিনের ভাষ্য অনুসারে, ‘সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মইন উ আহমেদসহ তিন বাহিনীর প্রধানেরা তাঁদেরই অনুরোধক্রমে ১১ জানুয়ারি বিকেল পাঁচটার দিকে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সে সাক্ষাতে তাঁরা রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে নতুন একজন প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করতে, ২২ জানুয়ারি নির্ধারিত নির্বাচন বাতিল করতে এবং অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টির পর নির্বাচনের তারিখ পুনর্নির্ধারণ করতে অনুরোধ জানান।’
বিউটেনিস লিখেছেন, এরপর তিনি ব্রিগেডিয়ার আমিনকে প্রশ্ন করেন। কিন্তু ঠিক কী প্রশ্ন করেন তা তিনি লেখেননি। তবে লিখেছেন যে তাঁর প্রশ্নের উত্তরে ব্রিগেডিয়ার আমিন তাঁকে বলেন, সাক্ষাৎকারী শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তারা রাষ্ট্রপতিকে তাঁদের অনুরোধের বিষয়গুলো বিবেচনা করে দেখার সময় দেননি। কেন সময় দেননি এর ব্যাখ্যা হিসেবে ব্রিগেডিয়ার আমিন রাষ্ট্রদূত বিউটেনিসকে বলেন, ‘তাঁরা জানতেন যে তিনি [ইয়াজউদ্দিন] যদি এ বিষয়ে (বিএনপির) মতামত জানতে চান, তাহলে বিএনপি তাঁকে বলবে রাজি না হতে।’
বিউটেনিসের তারবার্তার ভাষ্য অনুযায়ী, ব্রিগেডিয়ার আমিন তাঁর কাছে দাবি করেন যে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে—এর পক্ষে সামরিক বাহিনীর দেওয়া যুক্তিগুলো রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ মেনে নিয়েই জরুরি অবস্থা জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
রাষ্ট্রদূত বিউটেনিসের এই তারবার্তার এই জায়গাটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি তাঁর সদর দপ্তরকে জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ সামরিক বাহিনীর ‘অন্যায্য চাপের মুখে’ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন কি না, তা তিনি ব্রিগেডিয়ার আমিনের কাছে জানতে চাননি; ব্রিগেডিয়ার আমিনও নিজে থেকে তাঁকে এ বিষয়ে কিছু বলেননি।
ব্রিগেডিয়ার আমিন রাষ্ট্রদূত বিউটেনিসকে জানান, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তাঁর সম্পর্কে তদন্ত চলছে এবং তাঁকে সম্ভবত বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হবে। এখানে বিউটেনিস বন্ধনীর মধ্যে টীকা আকারে লিখেছেন, রেজ্জাকুল হায়দারকে অনেকে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে দেখে থাকেন।
তারপর রাষ্ট্রদূত বিউটেনিস ব্রিগেডিয়ার আমিনের কাছে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চান। আমিন তাঁকে বলেন, ‘আমরা ওইটাতেও হাত দেব।’
জরুরি অবস্থা জারি ও অন্যান্য পদক্ষেপ নিতে রাষ্ট্রপতিকে চাপ দেওয়ার সিদ্ধান্তে সামরিক বাহিনী কীভাবে ও কেন উপনীত হয়েছে, ব্রিগেডিয়ার আমিন তা রাষ্ট্রদূত বিউটেনিসের কাছে ব্যাখ্যা করেন। আমিন বলেন, ১১ জানুয়ারি সকালে জাতিসংঘের গৃহীত কয়েকটি পদক্ষেপের ফলে প্রশ্ন দেখা দেয়, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী যদি একতরফা নির্বাচনের সমর্থনে কাজ করে, তাহলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অব্যাহত থাকবে কি না? জাতিসংঘের পদক্ষেপগুলো ছিল: বাংলাদেশ সম্পর্কে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিবৃতি; জাতিসংঘের বাংলাদেশ প্রতিনিধির বিবৃতি—যেখানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে নির্বাচনে সামরিক বাহিনীর সমর্থনের বিষয়টিকে সুনির্দিষ্টভাবে যুক্ত করা হয়েছে; এবং জাতিসংঘ থেকে পাঠানো কথিত একটি চিঠি। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে কি থাকবে না। এর আগে সেনাপ্রধান মইন জাতিসংঘের কাছ থেকে এ রকম একটি চিঠি চেয়ে অনুরোধ করেছিলেন—এই তথ্য বিউটেনিস আবারও উল্লেখ করেন।
ব্রিগেডিয়ার আমিনের ভাষ্য অনুসারে, দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল জেএমবি সদস্যদের সাম্প্রতিক গ্রেপ্তার ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনাগুলো। আমিন দাবি করেন, জেএমবি ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বানচাল বা প্রতিহত করতে চায় এই তথ্য, আওয়ামী লীগের অব্যাহত প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত তৎপরতা—এসব মিলিয়ে সামরিক বাহিনীর মনে হয়েছে জনজীবনের শৃঙ্খলা হুমকির সম্মুখীন এবং এ থেকেই তাঁরা রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
আমিন বিউটেনিসকে নিশ্চিত করেন, রাষ্ট্রপতির জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর পরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা পদত্যাগপত্র পেশ করেছেন। তিনি বিউটেনিসকে জানান, অধ্যাপক ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছিল, কিন্তু তিনি রাজি হননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা করা হবে। বিউটেনিস ওই তারবার্তাতেই লেখেন, রাষ্ট্রপতির কার্যালয় তাঁকে নিশ্চিত করেছে, পরবর্তী প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ফখরুদ্দীনকে মনোনীত করা হয়েছে।
ব্রিগেডিয়ার আমিন বলেন, এসব উদ্যোগের প্রধান লক্ষ্য সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা। বিউটেনিস জানতে চান, কবে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা হবে। আমিন সংক্ষেপে বলেন, বছর খানেক লেগে যেতে পারে। বিউটেনিস জিজ্ঞাসা করেন, নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা কী হবে। উত্তরে আমিন বলেন, সামরিক বাহিনী সরকারকে জোরালোভাবে সহযোগিতা দিয়ে যাবে। কর্তৃত্ব থাকবে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের হাতেই। তিনি বিউটেনিসের কাছে অঙ্গীকার করেন, সামরিক বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে অব্যাহতভাবে সহযোগিতা করে যাবে।
রাষ্ট্রদূত বিউটেনিসের একাধিক তারবার্তার বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার একটি বিশুদ্ধ রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করেছিল এবং এর সমাধানও চেয়েছিল রাজনৈতিকভাবে। সামরিক বাহিনীর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সমর্থন ছিল না। কিন্তু সামরিক বাহিনীর সুস্পষ্ট চাপে জরুরি অবস্থা জারি ও নতুন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ফখরুদ্দীন আহমদের নাম ঘোষণা করার পর ঢাকার মার্কিন দূতাবাস অবস্থান পরিবর্তন করে (demarche) এবং নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি কূটনৈতিক সমর্থন জানায়।
তবে ১২ জানুয়ারি ব্রিগেডিয়ার আমিনের সঙ্গে বৈঠকে রাষ্ট্রদূত বিউটেনিস বলেন, জরুরি অবস্থাকালে ‘বাকস্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ রাজনৈতিক অধিকারগুলোর প্রতি সম্মান দেখানো হচ্ছে কি না, এবং বাংলাদেশ কত দ্রুত নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হয় সেদিকে আমরা দৃষ্টি রেখে চলব। গ্রেপ্তারের ঘটনাগুলোও আমাদের পর্যবেক্ষণে থাকবে, যেন নিশ্চিত করা যায় যে সেগুলো নিরপেক্ষ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়।’
বিউটেনিস আরও লিখেছেন, তিনি ব্রিগেডিয়ার আমিনকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, দুর্নীতি দমন ও অর্থনৈতিক সংস্কারসহ যেসব সমস্যা দ্রুত সমাধানযোগ্য নয়, সামরিক বাহিনীর সেগুলোতে জড়িয়ে পড়া উচিত হবে না। বরং সেই কাজগুলো নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের জন্য রেখে দেওয়াই ভালো হবে। (শেষ)

‘প্রথমা’ থেকে প্রকাশিতব্য বই উইকিলিকসে বাংলাদেশ অবলম্বনে
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.