বাহরাইন অগি্নকাণ্ড- আমরা শোকাহত
অধিকাংশই বয়সে তরুণ, কর্মোদ্যমী ও স্বপ্নচারী। ছোট ছোট কত আশা ছিল তাদের বুকে। নিজের ও পরিবারের সমৃদ্ধির সাধ পূরণ করতে পাড়ি জমিয়েছিলেন সুদূর বাহরাইনে। কেউ দেশে রেখে গেছেন পরিবার, কেউ-বা নিজের পরিবার গড়তেই পারেননি এখনও।
পরিবার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে কেউ কেউ শিগগিরই ফিরতে চেয়েছিলেন দেশে। সব স্বপ্ন পূরণের একমাত্র সম্বল শারীরিক শ্রম। প্রবাসে একটু বেশি মূল্যে শ্রম বিক্রি করার জন্য যারা সমস্ত বিপদ ও ঝুঁকিকে ম্লান করেছেন, নিজের সমস্ত দুঃখকষ্টকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছেন সেই প্রবাসী শ্রমিকদের ছোট ছোট স্বপ্ন রেমিট্যান্সের মহাসমুদ্র তৈরি করেছে বাংলাদেশে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ এখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বিদেশে কেমন আছেন এই শ্রমিকরা? বড় খবর তৈরি না হলে তাদের যথাযথ খবর সহসা মেলে না। বাহরাইনে ১১ শ্রমিকের মৃত্যুসংবাদ আমাদের সামনে যে ছবিটি তুলে ধরল তা মোটেও সুখকর নয়। এ কথা সত্য, দেশেও শ্রমিকদের জীবন সুখকর নয়। গার্মেন্ট কারখানায় অগি্নকাণ্ডে শত প্রাণহানির খবর তো এখনও টাটকা। এরই মধ্যে মিলল ১১ প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যুর সংবাদ। জানা গেল, দেশ থেকে বাহরাইনে যাওয়া এ শ্রমিকদের অধিকাংশের কোনো স্থায়ী কাজ ছিল না। তারা বাস করতেন অবৈধভাবে তৈরি একটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে। আর এ ভবনটি এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে অগি্নকাণ্ডের পরপরই তা ধসে পড়ে। ঝুঁকিপূর্ণ এ ভবনে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটে আগুন লেগে গিয়েছিল। এমন ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনায় শর্ট সার্কিট হতে পারে। এর আগেও একই ধরনের অগি্নকাণ্ডে বাহরাইনেই ১০ প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল। ফলে অগি্নকাণ্ডের ঘটনাকে শুধু শ্রমিকদের অসাবধানতা বা অজ্ঞানতার ফল বলার উপায় থাকছে না। আমাদের বিমানবন্দরে প্রতিনিয়ত লাশের মিছিল বড় হচ্ছে। বিপুলসংখ্যক শ্রমিক দেশের বাইরে থাকে। তাদের মধ্যে স্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু মৃত্যুর মিছিল বড় হওয়ার পেছনে আছে দুর্ঘটনা, অগি্নকাণ্ডসহ নানা কারণ। অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিদেশে কাজ করতে গিয়ে আমাদের শ্রমিকরা উপযুক্ত কর্মপরিবেশ ও বাসস্থান পাচ্ছে কি-না সে বিষয়েও নাগরিকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। এসব বিষয়ে সরকারের নজরদারি বাড়ানো দরকার। বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোর বিবেচনায় শ্রমিকদের কল্যাণের বিষয়টি অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়েরও এক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীলতার দেখা মেলে না। প্রবাসে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করার মতো দক্ষতা ও যোগ্যতা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো আজ অবধি রপ্ত করতে পারেনি। জীবিত অবস্থায় তাদের পাশে দাঁড়ানো দূরের কথা, মৃত্যুর পর লাশ বহন করে দেশে আনার ক্ষেত্রেও নানা গাফিলতির অভিযোগ ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমিকরা যে নিঃসহায় হয়ে পড়বেন তাতে সন্দেহ নেই। দূতাবাসের লোক সংকট আছে, মন্ত্রণালয়ের লোক সংকটের কথাও আমাদের জানা। কিন্তু লোকবলই কি মূল কথা? আন্তরিকতা থাকলে বিদেশে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো কঠিন কিছু নয়। কিন্তু সে মনোভাব থাকা দরকার। শ্রমিক পাঠানোর আগে কর্মপরিবেশ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দরকার। এটি সরকারেরই দায়িত্ব। যারা ইতিমধ্যে বিদেশে আছেন তারা কী অবস্থায় আছেন সে বিষয়েও তদারকি ব্যবস্থা তৈরি করা দরকার। আজ যারা বাহরাইনে মারা গেলেন, তাদের ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। রিক্ত পরিবারগুলোতে আশা জাগানোও সম্ভব নয়। কিন্তু এভাবে করুণ মৃত্যু যেন নতুন করে কোনো পরিবারকে রিক্ত করতে না পারে সে উদ্যোগটি অন্তত আসুক। নতুন কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু যাতে আমাদের আর শোকগ্রস্ত না করে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত হোক।
No comments