জন্ম থেকে জ্বলছে by সুভাষ সাহা
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন মাওলানা মওদুদী সেদেশে পা রাখলেন, তখন থেকেই সেখানে ধর্মের নামে সহিংস রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের উদ্যোগ শুরু। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রশাসনিক দক্ষতায় অগ্রসর আহমদিয়া সম্প্র্রদায়ের ওপর হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও,
লুটপাট চাপিয়ে দিয়ে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা এই মাওলানা প্রথম তার নিজের ও সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর জঙ্গিবাদী মানসিকতাকে স্পষ্ট করেন। এজন্য অবশ্য মাওলানার মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে সে দণ্ডাদেশ কার্যকর করা যায়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এদের কর্মকাণ্ড বাঙালি তাদের জীবন, সহায়-সম্পদ ও ইজ্জত দিয়ে উপলব্ধি করেছে। আমরা এখনও সেই জামায়াতি অপরাধের গ্গ্নানি বয়ে বেড়াচ্ছি। আর পাকিস্তান এখনও তার জন্মলগ্নে জামায়াতের লাগানো সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও জঙ্গিবাদী আগুনে জ্বলছে। '৭৪ সালে ভুট্টো তার শাসনামলে সৌদি ওয়াহাবি শেখকুলের কুমন্ত্রণায় মজে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার জামায়াতের পাঁকে পা দিয়ে নিজের ও দেশের ভবিষ্যৎকে এক অন্তহীন কৃষ্ণগহ্বরে নিক্ষেপ করেন। সেই থেকে পাকিস্তানকে আর আধুনিক দুনিয়ার দিকে ফিরে তাকাতে হয়নি। জামায়াতি রাজনীতির নির্যাস তালেবান ও আল কায়দার সঙ্গে মিতালি করে তারা নতুন করে পাকিস্তানকে আবিষ্কারের চেষ্টা করে। অধিকাংশ পাকিস্তানির মনোজগতে নিজেদের আরব দেশীয় ভাবতে শেখায় এবং ওখানেই তাদের শিকড় প্রোথিত_ এই ধারণায় মগ্ন করে। ফলে তারা নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে মরীচিকার পেছনে দৌড়ায়। এ কাজে (কুকাজে) সর্বংসহায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় আমেরিকা। এভাবে দেশটি সামরিকতন্ত্র, ডলার, পেট্রোডলারের সঙ্গে ইসলামী জঙ্গিবাদে নিজেদের ভবিষ্যৎকে সঁপে দেয়। কিন্তু এতে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিল হলেও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি কার্যত ব্যর্থ খেতাব পেয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে পেঁৗছে যায়। এ সময় রাজাধিরাজ আমেরিকা সম্বিত ফিরে পায়। তখনই ব্যাক গিয়ার মেরে তালেবানি-আল কায়দা ক্যারাভান থামানোর চেষ্টার শুরু। কিন্তু তাতে ইতিমধ্যে জন্ম নেওয়া মিলিটারি এস্টাবলিশমেন্টের বিশেষ স্বার্থ, মৌলবাদী-জঙ্গিবাদীদের ভোটব্যাংকের ওপর রাজনৈতিক দলের নজর, গোষ্ঠীগত স্বার্থ অব্যাহত রাখা ইত্যাকার স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কারণে জঙ্গিবাদ ফের পাকিস্তানে নতুন অবয়ব নিয়ে তার অবস্থানকে জানান দিতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিককালে শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলার বিস্তার এর নির্দিষ্ট কর্মধারার নির্দেশক। ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত তাদের জানবাজ কর্মীরা বালুচিস্তানে অন্তত ৭৫৮ জন শিয়ার প্রাণ সংহার করতে সক্ষম হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এদের হামলায় ১০০ শিয়ার প্রাণ গেছে। মনে হচ্ছে, পাকিস্তানের গোলমেলে পরিস্থিতি এবং আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা দ্রুত প্রত্যাহার করার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানি তালেবান এহেন সম্প্রদায়গত বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের শক্তিমত্তার প্রমাণ দিতে চাচ্ছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেহেতু এসব ধর্মীয় মৌলবাদী ও জঙ্গি সুনি্ন ইসলামী গ্রুপগুলোকে তাদের দ্বিতীয় ডিফেন্স লাইন মনে করে এবং রাজনৈতিক দল যেমন মুসলিম লীগ, জামায়াত, সিপাহ-ই-সাহবা পাকিস্তান (শিয়া ও আহমদিয়াবিরোধী সুনি্ন জঙ্গি গ্রুপ) ও লস্কর-ই ঝাংভির মতো সংগঠনকে ভোটের সময় প্রয়োজনীয় মনে করে; তাই এদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা সচরাচর দেখা যায় না। আর এর সুযোগ নিয়ে এরা এবং পাকিস্তান তালেবান তাদের শক্তি-সামর্থ্য ও পাওয়ার বেজ সম্প্রসারণের মওকা পেয়ে যাচ্ছে। এটা অনেকটা সাপ নিয়ে খেলার মতো। অনেক সময় সাপের কামড়েই ওঝার মৃত্যু হয়। পাকিস্তানের দশাও অনেকটা তাই। জেনেশুনে মৌলবাদের বিষপান করার পর এখন সেই বিষেই জারিত খোদ পাকিস্তান। প্রশ্ন হলো_ দেশটি কি আদৌ এই মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী ঘেরাও থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে, নাকি সম্প্রদায়গত ও জঙ্গি সহিংসতার যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকাই পাকিস্তানের নিয়তি?
No comments