সময়ের কথা-চিনিল কেমনে, চিনিব কেমনে by অজয় দাশগুপ্ত
আমার মোবাইল ফোনে একটি বার্তা এলো_ আর্মিতে সৈনিক পদে ভর্তির জন্য ৩১ জানুয়ারির মধ্যে টেলিটকের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
এমন অফার এখন বাংলাদেশে অনেক কিছুতেই মেলে।
এমন অফার এখন বাংলাদেশে অনেক কিছুতেই মেলে।
এর ফলে প্রার্থীদের দূরের কোনো এলাকায় গিয়ে ফরম জমা দেওয়ার জন্য সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হয় না। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের যে স্লোগান, তার ব্যাপ্তি অনেক। উন্নত ধনী দেশগুলোর মানুষ এ সুবিধা অনেক বছর আগে থেকেই ভোগ করছে। বাংলাদেশে লাখ লাখ পরিবার রয়েছে, যাদের নুন আনতে গিয়ে পান্তা ফুরায়। তারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করবে, দেশে বা বিদেশে চাকরি করার জন্য এ ফোনে আবেদন করবে_ সেটা এই সেদিনও ভাবা যেত না। এক সময়ে মোবাইল ফোনে কথা বলতে গেলে প্রতি মিনিটে ৭ টাকা চার্জ পড়ত। আপনার ফোনে বাইরের কেউ কল করলেও আপনাকে প্রতি মিনিটে ৭ টাকা গচ্চা দিতে হতো। এখন মোবাইল ফোন জল-ভাত হয়ে গেছে। কত রকমের সুবিধা এই ছোট যন্ত্রে!
চাকরির কথায় ফিরে যাই। বরিশালের গৈলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন লাল্টুকে এই মোবাইল ফোনেই জিজ্ঞেস করি, মালয়েশিয়ায় সরকারি উদ্যোগে বাগানের কাজে যাওয়ার জন্য কতজন রেজিস্ট্রেশন করেছেন। তিনি বলেন, প্রথম দিন প্রায় ৪০০ জন খাতায় নাম তুলেছে। বিকেল সাড়ে ৩টা নাগাদ ২শ' জনের মতো অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫০ টাকা নেওয়া হয়েছে। বহু বছর ধরে সৌদি আরব বা মালয়েশিয়া কিংবা লিবিয়ায় চাকরির জন্য আবেদন করতে ম্যানপাওয়ার এজেন্সির কোনো দালাল ধরতে হতো। সেই দালাল ঠিক ঠিক দালাল কি-না, সেটা সব মানুষ বুঝে উঠতে পারত না। হয়তো ভুল লোক অর্থাৎ প্রতারককে ধরা হয়েছে এবং তার হাতে ঘরবাড়ি-জমি বেচা হাজার হাজার টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে। এক সময়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে নিয়মিত ফুটবল খেলা দেখতে যেতাম। আবাহনী ও মোহামেডানের খেলায় বড় বড় লাইন পড়ত দর্শকদের। অনেকবার এমন হয়েছে যে, ৪০০-৫০০ লোকের পেছনে লাইন দিয়ে বেশ কিছু সময় কাটানোর পর লাইন আর এগোয় না দেখে বুঝতে পারি যে, আসলে স্টেডিয়ামের কোনো গেট দিয়ে গ্যালারিতে যাওয়ার জন্য এটা কোনো লাইনই ছিল না। আমার এবং আরও কিছু লোকের জন্য কিছু সময়ের কেবল অপচয় হয়েছে। কিন্তু বিদেশে চাকরির জন্য ভুল লোক ধরে যারা অর্থ দিয়েছে, তাদের চোখের জলে কেবল বুক ভাসেনি_ সংসারও ভেসে গিয়েছে।
মালয়েশিয়ায় এখন লোক পাঠানোর জন্য রেজিস্ট্রেশন চলছে। গৈলা ইউনিয়ন পরিষদের মতো বরিশালের বাগদা ইউনিয়নে ইন্টারনেট সুবিধা ভালো নয়। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাবুল ভাট্টির মন খারাপ। কারণ, সেখানে রেজিস্ট্রেশন করতে অনেক সময় লাগছে। আমাদের দেশে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-মেম্বাররা বহু বছর মন খারাপ করতেন রিলিফের চাল-গম-কম্বল কম পেলে। এখন মন খারাপ তথ্যপ্রযুক্তির সেবা ঠিকমতো না পাওয়ার জন্য। ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রের সেবার জন্য অবশ্য খুশি বাকাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিপুল দাস। তিনি রেজিস্ট্রেশন করতে আসা প্রত্যেককে নিজের পকেটের পয়সা ব্যয় করে চা খাইয়েছেন। অনলাইন সুবিধা নিয়ে তিনি বেজায় খুশি। সরকারকে তিনি সাধুবাদ দিয়েছেন এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য।
গৈলা, বাগধা ও বাকাল_ তিনটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উদ্বিগ্ন একটি বিষয়ে_ তাদের জন্য কতজনের কোটা বরাদ্দ হবে। দেশে মোট ইউনিয়ন ৪ হাজার ৪৫১টি। মালয়েশিয়ায় প্রথম পর্যায়ে লোক নেওয়া হবে দশ হাজার। বলা যায়, গড়ে প্রতিটি ইউনিয়নে দু'জনের মতো লোক নেওয়া সম্ভব হবে। বরিশালের জেলা প্রশাসক শহীদুল আলমের কাছে জানতে চেয়েছি, তার জেলায় কীভাবে লোক নির্বাচন করা হবে। উত্তর মিলল এভাবে_ জেলার জনসংখ্যা অনুযায়ী প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কোটা ঠিক করে দিয়েছে। এর ভিত্তিতে ইউনিয়ন পর্যায়ে সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কারও তদবির-সুপারিশের প্রয়োজন হবে না। কাউকে ঘুষ দেওয়ারও দরকার নেই।
রোববার এ বিষয় নিয়ে যেসব চেয়ারম্যান-মেম্বারের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের মুখে শুনেছি তথ্যপ্রযুক্তির জন্য সচরাচর ব্যবহার করা হয় এমন নানা শব্দ। সরকারের একটি সিদ্ধান্ত এভাবেই মুখের ভাষা বদলে দিচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের। আশা করব, এর ধারাবাহিকতায় তাদের কাজের ধারাও ক্রমে বদলে যাবে। ষাটের দশকে আইয়ুব খান চালু করেছিলেন বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্র_ জনগণের ভোট নয়, পাকিস্তানের দুই অংশে ৪০ হাজার করে মাত্র মোট ৮০ হাজার ভোটার প্রেসিডেন্ট বানাবে। তারা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ও চেয়ারম্যান। তৎকালীন (১৯৬৪-১৯৬৫ সাল) পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ চাইত না আইয়ুব খানকে। অথচ ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার ও চেয়ারম্যানদের তিনি হাত করে নিয়েছেন নানা প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে। একটি সুবিধা ছিল এভাবে_ গ্রামে মাটির সড়ক, কাঠের সেতু কিংবা এ ধরনের উন্নয়ন কাজের জন্য সরকার দায়িত্ব দেবে মেম্বার-চেয়ারম্যানদের। তারা টাকা ব্যয় করবে, কিন্তু হিসাব প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো কড়াকড়ি করা হবে না। কোনো চেয়ারম্যান পুরো টাকা মেরে দিলেও আইযুব খান তাকে কোনো শাস্তি দিতেন না। অথচ স্বায়ত্তশাসনসহ নানা দাবিতে আমাদের এই অঞ্চলের মানুষ তখন ঘোরতর আইয়ুব খান বিরোধী। এই রোষ গিয়ে পড়ল তার সমর্থক মেম্বার-চেয়ারম্যানদের ওপরও। আমার নিজের মনে আছে, ১৯৬৪ সালে গৈলা স্কুলে গোটা থানার ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার ও চেয়ারম্যানদের এক সমাবেশ ডাকা হয়েছিল আইয়ুব খানের সমর্থনে। অনেক পুলিশও ছিল। আমরা জনা কুড়ি ছাত্র যেই না আইয়ুববিরোধী মিছিল শুরু করেছি কালো পতাকা নিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে জনতার বিপুল সমর্থন পাওয়া গেল এবং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সমর্থকরা পালিয়ে বাঁচল। ষাটের দশকের শেষ দিকে এক ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় তাকে একটি ষাঁড় তাড়া করে। একটি দৈনিক এ খবরটি পরিবেশন করে, যার শিরোনাম দেওয়া হয়, 'চিনিল কেমনে'। এ শিরোনাম থেকে এটাই বোঝানো হয় যে মেম্বার-চেয়ারম্যানরা এতই খারাপ যে সবাই তাদের ধিক্কার দেয় এবং এমনকি ষাঁড়ের হাত থেকেও তাদের নিস্তার নেই।
এখন আমরা এই জনপ্রতিনিধিদের ভিন্নভাবে চিনতে চাই। তারা জনগণের পাশে থাকবেন এবং তাদের ভাষা বুঝবেন, সেটাই চাইব। বাংলাদেশে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমে অনলাইনে ভর্তির সিস্টেম চালু করে। এ সুবিধা সৃৃষ্টির পেছনে ছাত্রদরদি ড. জাফর ইকবালের অবদান ছিল অপরিসীম। পরে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হতে থাকে। কলেজে ভর্তির জন্যও চালু রয়েছে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন। এর ফলে ছাত্রছাত্রীদের ভোগান্তি কমেছে। বিদেশে চাকরির জন্য অনলাইনে নাম লেখানো যাবে এবং তার ভিত্তিতে কম্পিউটারে লটারি করে লোক পাঠানো হবে এবং ব্যয় পড়বে মাত্র ৪০ হাজার টাকা_ এটা তো রীতিমতো স্বপ্ন। এমন প্রস্তাব প্রথম কে করেছিলেন, জানা নেই। তবে এটা বুঝতে পারি যে, এ পদ্ধতি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিদেশে লোক পাঠানোর জন্য যারা সক্রিয় তাদের একটি নাম আছে_ 'আদম ব্যবসায়ী'। তারা এটাকে বদনাম হিসেবে মনে করেন এবং মন খারাপ করেন। তারা বলেন, বিভিন্ন দেশ থেকে যে শত শত কোটি ডলার-রিয়াল প্রতি বছর আসে তার পেছনে তাদের অবদানই বেশি। এর প্রশংসা না করে আদম বেপারি বা আদম ব্যবসায়ী বলা গুরুতর অন্যায়। এখন কিন্তু তারা একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়বেন_ সরকার যদি শেষ পর্যন্ত মাত্র ৪০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ায় লোক পাঠাতে পারে এবং লোক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় যদি কোনো কারচুপি না হয়, তাহলে এই পদ্ধতি সৌদি আরবসহ সব দেশেই অনুসরণ করার দাবি জোরেশোরে উঠবে। মালয়েশিয়া লোক নেবে ফসলের মাঠে বা পাম অয়েলের বাগানে কাজ করার জন্য। বড্ড পরিশ্রমের কাজ। আমার পরিচিত এক তরুণ সেখানকার অভিজ্ঞতা জানিয়ে লিখেছিল_ হনুমানে তাড়ায়, সাপে কামড়ায়, পোকার হুলে জ্বলতে হয়। থাকতে হয় গোডাউনের মতো ঘরে। বড় কষ্ট। তারপরও একটু ভালো থাকার আশায় প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষ চলে যায় দেশের বাইরে_ মরুভূমিতে, শীতের দেশ বা দুর্গম বনাঞ্চলে। এই যাওয়ার প্রক্রিয়ায় তারা প্রতারণার শিকার হয় প্রথম দিন থেকে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়ায় লোক নিয়োগের যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছে তার পেছনে মালয়েশিয়া সরকারের প্রচণ্ড চাপ ছিল। কিন্তু পাল্টা চাপ ছিল আমাদের ম্যানপাওয়ার এজেন্সিগুলোর। ৪০ হাজার টাকায় বিদেশ যাওয়ার নিয়োগপত্র হাতে এবং এর মধ্যে বিমান ভাড়াও ধরা আছে_ সেটা কী করে সম্ভব, এই প্রশ্ন তারা বারবার তুলেছে। সরকারের অনড় মনোভাবের কারণে শেষ পর্যন্ত একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন হচ্ছে। আশা করব যে এক মণ দুধে কেউ যেন এক ফোঁটা চোনা ঢেলে না দেন।
আমরা চাইলে বাংলাদেশের প্রশাসন দিয়েই অনেক ভালো কাজ করতে পারি। এর বড় উদাহরণ স্কুলের প্রায় ৪ কোটি ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই প্রদান। বইয়ের প্রকাশক ও ব্যবসায়ীরা এটা চাননি। তারা নিজেদের ব্যবসাকে বড় করে দেখেছিলেন। আদম বেপারিরাও নিজেদের ব্যবসাকে বড় করে দেখেছেন বলেই ৪০ হাজার টাকায় লোক পাঠানোর পদক্ষেপকে বলেছিলেন 'অবাস্তব ও দিবা স্বপ্ন'। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বই বিতরণ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করেছে পরপর চারবার। তারা পাবলিক পরীক্ষা নিচ্ছে সময়মতো। এর ফল মিলছে_ সবাই বলছে, সরকারের সেরা মন্ত্রণালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদি মালয়েশিয়ায় ঘুষ-হয়রানি ছাড়া মাত্র ৪০ হাজার টাকায় কৃষি কাজের জন্য লোক যেতে পারে এবং অন্য দেশে লোক পাঠানোর ক্ষেত্রে একই নিয়ম কাজে লাগে, তাহলে তারাও কিন্তু মানুষের বিবেচনায় সেরা মন্ত্রণালয় হতে পারে।
ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে এখন তথ্যপ্রযুক্তির ভাষা মুখে মুখে। প্রকৃত অর্থেই এটা নবযুগ। এর সুফল আরও নানাভাবে পেতে পারি। এ সম্ভাবনা যেন হেলাফেলায় না হারাই। আমরা আমাদের জনপ্রতিনিধিদের এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নতুনভাবে চিনতে চাই। সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ কিন্তু রয়েছে_ যদি কিছু ইউনিয়নের কেউই লটারিতে নির্বাচিত না হয়!
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
চাকরির কথায় ফিরে যাই। বরিশালের গৈলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন লাল্টুকে এই মোবাইল ফোনেই জিজ্ঞেস করি, মালয়েশিয়ায় সরকারি উদ্যোগে বাগানের কাজে যাওয়ার জন্য কতজন রেজিস্ট্রেশন করেছেন। তিনি বলেন, প্রথম দিন প্রায় ৪০০ জন খাতায় নাম তুলেছে। বিকেল সাড়ে ৩টা নাগাদ ২শ' জনের মতো অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫০ টাকা নেওয়া হয়েছে। বহু বছর ধরে সৌদি আরব বা মালয়েশিয়া কিংবা লিবিয়ায় চাকরির জন্য আবেদন করতে ম্যানপাওয়ার এজেন্সির কোনো দালাল ধরতে হতো। সেই দালাল ঠিক ঠিক দালাল কি-না, সেটা সব মানুষ বুঝে উঠতে পারত না। হয়তো ভুল লোক অর্থাৎ প্রতারককে ধরা হয়েছে এবং তার হাতে ঘরবাড়ি-জমি বেচা হাজার হাজার টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে। এক সময়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে নিয়মিত ফুটবল খেলা দেখতে যেতাম। আবাহনী ও মোহামেডানের খেলায় বড় বড় লাইন পড়ত দর্শকদের। অনেকবার এমন হয়েছে যে, ৪০০-৫০০ লোকের পেছনে লাইন দিয়ে বেশ কিছু সময় কাটানোর পর লাইন আর এগোয় না দেখে বুঝতে পারি যে, আসলে স্টেডিয়ামের কোনো গেট দিয়ে গ্যালারিতে যাওয়ার জন্য এটা কোনো লাইনই ছিল না। আমার এবং আরও কিছু লোকের জন্য কিছু সময়ের কেবল অপচয় হয়েছে। কিন্তু বিদেশে চাকরির জন্য ভুল লোক ধরে যারা অর্থ দিয়েছে, তাদের চোখের জলে কেবল বুক ভাসেনি_ সংসারও ভেসে গিয়েছে।
মালয়েশিয়ায় এখন লোক পাঠানোর জন্য রেজিস্ট্রেশন চলছে। গৈলা ইউনিয়ন পরিষদের মতো বরিশালের বাগদা ইউনিয়নে ইন্টারনেট সুবিধা ভালো নয়। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাবুল ভাট্টির মন খারাপ। কারণ, সেখানে রেজিস্ট্রেশন করতে অনেক সময় লাগছে। আমাদের দেশে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-মেম্বাররা বহু বছর মন খারাপ করতেন রিলিফের চাল-গম-কম্বল কম পেলে। এখন মন খারাপ তথ্যপ্রযুক্তির সেবা ঠিকমতো না পাওয়ার জন্য। ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রের সেবার জন্য অবশ্য খুশি বাকাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিপুল দাস। তিনি রেজিস্ট্রেশন করতে আসা প্রত্যেককে নিজের পকেটের পয়সা ব্যয় করে চা খাইয়েছেন। অনলাইন সুবিধা নিয়ে তিনি বেজায় খুশি। সরকারকে তিনি সাধুবাদ দিয়েছেন এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য।
গৈলা, বাগধা ও বাকাল_ তিনটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উদ্বিগ্ন একটি বিষয়ে_ তাদের জন্য কতজনের কোটা বরাদ্দ হবে। দেশে মোট ইউনিয়ন ৪ হাজার ৪৫১টি। মালয়েশিয়ায় প্রথম পর্যায়ে লোক নেওয়া হবে দশ হাজার। বলা যায়, গড়ে প্রতিটি ইউনিয়নে দু'জনের মতো লোক নেওয়া সম্ভব হবে। বরিশালের জেলা প্রশাসক শহীদুল আলমের কাছে জানতে চেয়েছি, তার জেলায় কীভাবে লোক নির্বাচন করা হবে। উত্তর মিলল এভাবে_ জেলার জনসংখ্যা অনুযায়ী প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কোটা ঠিক করে দিয়েছে। এর ভিত্তিতে ইউনিয়ন পর্যায়ে সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কারও তদবির-সুপারিশের প্রয়োজন হবে না। কাউকে ঘুষ দেওয়ারও দরকার নেই।
রোববার এ বিষয় নিয়ে যেসব চেয়ারম্যান-মেম্বারের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের মুখে শুনেছি তথ্যপ্রযুক্তির জন্য সচরাচর ব্যবহার করা হয় এমন নানা শব্দ। সরকারের একটি সিদ্ধান্ত এভাবেই মুখের ভাষা বদলে দিচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের। আশা করব, এর ধারাবাহিকতায় তাদের কাজের ধারাও ক্রমে বদলে যাবে। ষাটের দশকে আইয়ুব খান চালু করেছিলেন বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্র_ জনগণের ভোট নয়, পাকিস্তানের দুই অংশে ৪০ হাজার করে মাত্র মোট ৮০ হাজার ভোটার প্রেসিডেন্ট বানাবে। তারা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ও চেয়ারম্যান। তৎকালীন (১৯৬৪-১৯৬৫ সাল) পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ চাইত না আইয়ুব খানকে। অথচ ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার ও চেয়ারম্যানদের তিনি হাত করে নিয়েছেন নানা প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে। একটি সুবিধা ছিল এভাবে_ গ্রামে মাটির সড়ক, কাঠের সেতু কিংবা এ ধরনের উন্নয়ন কাজের জন্য সরকার দায়িত্ব দেবে মেম্বার-চেয়ারম্যানদের। তারা টাকা ব্যয় করবে, কিন্তু হিসাব প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো কড়াকড়ি করা হবে না। কোনো চেয়ারম্যান পুরো টাকা মেরে দিলেও আইযুব খান তাকে কোনো শাস্তি দিতেন না। অথচ স্বায়ত্তশাসনসহ নানা দাবিতে আমাদের এই অঞ্চলের মানুষ তখন ঘোরতর আইয়ুব খান বিরোধী। এই রোষ গিয়ে পড়ল তার সমর্থক মেম্বার-চেয়ারম্যানদের ওপরও। আমার নিজের মনে আছে, ১৯৬৪ সালে গৈলা স্কুলে গোটা থানার ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার ও চেয়ারম্যানদের এক সমাবেশ ডাকা হয়েছিল আইয়ুব খানের সমর্থনে। অনেক পুলিশও ছিল। আমরা জনা কুড়ি ছাত্র যেই না আইয়ুববিরোধী মিছিল শুরু করেছি কালো পতাকা নিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে জনতার বিপুল সমর্থন পাওয়া গেল এবং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সমর্থকরা পালিয়ে বাঁচল। ষাটের দশকের শেষ দিকে এক ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় তাকে একটি ষাঁড় তাড়া করে। একটি দৈনিক এ খবরটি পরিবেশন করে, যার শিরোনাম দেওয়া হয়, 'চিনিল কেমনে'। এ শিরোনাম থেকে এটাই বোঝানো হয় যে মেম্বার-চেয়ারম্যানরা এতই খারাপ যে সবাই তাদের ধিক্কার দেয় এবং এমনকি ষাঁড়ের হাত থেকেও তাদের নিস্তার নেই।
এখন আমরা এই জনপ্রতিনিধিদের ভিন্নভাবে চিনতে চাই। তারা জনগণের পাশে থাকবেন এবং তাদের ভাষা বুঝবেন, সেটাই চাইব। বাংলাদেশে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমে অনলাইনে ভর্তির সিস্টেম চালু করে। এ সুবিধা সৃৃষ্টির পেছনে ছাত্রদরদি ড. জাফর ইকবালের অবদান ছিল অপরিসীম। পরে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হতে থাকে। কলেজে ভর্তির জন্যও চালু রয়েছে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন। এর ফলে ছাত্রছাত্রীদের ভোগান্তি কমেছে। বিদেশে চাকরির জন্য অনলাইনে নাম লেখানো যাবে এবং তার ভিত্তিতে কম্পিউটারে লটারি করে লোক পাঠানো হবে এবং ব্যয় পড়বে মাত্র ৪০ হাজার টাকা_ এটা তো রীতিমতো স্বপ্ন। এমন প্রস্তাব প্রথম কে করেছিলেন, জানা নেই। তবে এটা বুঝতে পারি যে, এ পদ্ধতি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিদেশে লোক পাঠানোর জন্য যারা সক্রিয় তাদের একটি নাম আছে_ 'আদম ব্যবসায়ী'। তারা এটাকে বদনাম হিসেবে মনে করেন এবং মন খারাপ করেন। তারা বলেন, বিভিন্ন দেশ থেকে যে শত শত কোটি ডলার-রিয়াল প্রতি বছর আসে তার পেছনে তাদের অবদানই বেশি। এর প্রশংসা না করে আদম বেপারি বা আদম ব্যবসায়ী বলা গুরুতর অন্যায়। এখন কিন্তু তারা একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়বেন_ সরকার যদি শেষ পর্যন্ত মাত্র ৪০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ায় লোক পাঠাতে পারে এবং লোক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় যদি কোনো কারচুপি না হয়, তাহলে এই পদ্ধতি সৌদি আরবসহ সব দেশেই অনুসরণ করার দাবি জোরেশোরে উঠবে। মালয়েশিয়া লোক নেবে ফসলের মাঠে বা পাম অয়েলের বাগানে কাজ করার জন্য। বড্ড পরিশ্রমের কাজ। আমার পরিচিত এক তরুণ সেখানকার অভিজ্ঞতা জানিয়ে লিখেছিল_ হনুমানে তাড়ায়, সাপে কামড়ায়, পোকার হুলে জ্বলতে হয়। থাকতে হয় গোডাউনের মতো ঘরে। বড় কষ্ট। তারপরও একটু ভালো থাকার আশায় প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষ চলে যায় দেশের বাইরে_ মরুভূমিতে, শীতের দেশ বা দুর্গম বনাঞ্চলে। এই যাওয়ার প্রক্রিয়ায় তারা প্রতারণার শিকার হয় প্রথম দিন থেকে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়ায় লোক নিয়োগের যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছে তার পেছনে মালয়েশিয়া সরকারের প্রচণ্ড চাপ ছিল। কিন্তু পাল্টা চাপ ছিল আমাদের ম্যানপাওয়ার এজেন্সিগুলোর। ৪০ হাজার টাকায় বিদেশ যাওয়ার নিয়োগপত্র হাতে এবং এর মধ্যে বিমান ভাড়াও ধরা আছে_ সেটা কী করে সম্ভব, এই প্রশ্ন তারা বারবার তুলেছে। সরকারের অনড় মনোভাবের কারণে শেষ পর্যন্ত একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন হচ্ছে। আশা করব যে এক মণ দুধে কেউ যেন এক ফোঁটা চোনা ঢেলে না দেন।
আমরা চাইলে বাংলাদেশের প্রশাসন দিয়েই অনেক ভালো কাজ করতে পারি। এর বড় উদাহরণ স্কুলের প্রায় ৪ কোটি ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই প্রদান। বইয়ের প্রকাশক ও ব্যবসায়ীরা এটা চাননি। তারা নিজেদের ব্যবসাকে বড় করে দেখেছিলেন। আদম বেপারিরাও নিজেদের ব্যবসাকে বড় করে দেখেছেন বলেই ৪০ হাজার টাকায় লোক পাঠানোর পদক্ষেপকে বলেছিলেন 'অবাস্তব ও দিবা স্বপ্ন'। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বই বিতরণ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করেছে পরপর চারবার। তারা পাবলিক পরীক্ষা নিচ্ছে সময়মতো। এর ফল মিলছে_ সবাই বলছে, সরকারের সেরা মন্ত্রণালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদি মালয়েশিয়ায় ঘুষ-হয়রানি ছাড়া মাত্র ৪০ হাজার টাকায় কৃষি কাজের জন্য লোক যেতে পারে এবং অন্য দেশে লোক পাঠানোর ক্ষেত্রে একই নিয়ম কাজে লাগে, তাহলে তারাও কিন্তু মানুষের বিবেচনায় সেরা মন্ত্রণালয় হতে পারে।
ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে এখন তথ্যপ্রযুক্তির ভাষা মুখে মুখে। প্রকৃত অর্থেই এটা নবযুগ। এর সুফল আরও নানাভাবে পেতে পারি। এ সম্ভাবনা যেন হেলাফেলায় না হারাই। আমরা আমাদের জনপ্রতিনিধিদের এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নতুনভাবে চিনতে চাই। সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ কিন্তু রয়েছে_ যদি কিছু ইউনিয়নের কেউই লটারিতে নির্বাচিত না হয়!
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments