দেশেই বিপন্ন দেশি কাগজ by এম সায়েম টিপু
চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন করার ক্ষমতা রয়েছে দেশীয় কাগজ কলগুলোর। এসব কলে উৎপাদিত বিশ্বমানের কাগজ বিদেশেও যাচ্ছে। এর পরও আমদানি করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ কাগজ। দেশীয় উদ্যোক্তারা বলছেন, আমদানি করা বেশির ভাগ কাগজই নিম্নমানের।
মিথ্যা ঘোষণা এবং শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি করার কারণে এসব কাগজ কম দামে বিক্রি হচ্ছে। দেশে উৎপাদিত কাগজের মান পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলেও আমদানীকৃত কাগজের মান যাচাই করা হয় না। ফলে দেশের বিকাশমান কাগজশিল্প এখন হুমকির মুখে।
উদ্যোক্তাদের দাবি, অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ, অবকাঠামো সমস্যাসহ বিভিন্ন অসুবিধার কারণে এমনিতেই দেশে কাগজ উৎপাদনে খরচ বেশি পড়ছে। অন্যদিকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এবং বন্ডেড ওয়্যারহাউসের অপব্যবহার করে আমদানি করা শুল্কমুক্ত কাগজ খোলাবাজারে কম দামে বিক্রি করায় দেশীয় কাগজ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। কাগজ রপ্তানিতেও কোনো প্রণোদনা নেই। ভারতে কাগজ রপ্তানিতে ৭ শতাংশেরও বেশি নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। ইন্দোনেশিয়ায় এ সহায়তা ৩৩ শতাংশ। বাংলাদেশে এ ধরনের সরকারি প্রণোদনা না থাকার পরও রপ্তানিবাজারে জায়গা করে নিয়েছে দেশে উৎপাদিত কাগজ। অন্যদিকে নিম্নমানের বিদেশি কাগজের কাছে দেশেই বাজার হারাচ্ছে দেশি কাগজ।
দেশের কাগজশিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবিকা। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, আমদানি পর্যায়ে শুল্ক ফাঁকি এবং শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা কাগজ কালোবাজারে বিক্রি বন্ধ না হলে এ খাতে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বিপন্ন হবে।
বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন কাগজকল রয়েছে ৬৭টি। এগুলোর মধ্যে ৫৮টি কারখানা চালু রয়েছে।
এসব কারখানায় প্রায় সব ধরনের কাগজই তৈরি হচ্ছে। চাহিদার পুরোটাই আমদানি করে মেটাতে হতো এমন অনেক ধরনের কাগজ এখন দেশে তৈরি হচ্ছে।
দেশের চালু কাগজকলগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা বছরে প্রায় ১০ লাখ টন। অন্যদিকে দেশে সব ধরনের কাগজের মোট চাহিদা পাঁচ থেকে ছয় লাখ টন। সে হিসাবে দেশে বছরে প্রায় চার লাখ টন কাগজ উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে।
বিপিএমএ-এর সহসভাপতি অধ্যাপক মাজিদুল ইসলাম বলেন, তৈরি পোশাক ও ওষুধসহ নানা ধরনের শিল্পে মোড়কজাতকরণের (প্যাকেজিং) সুবিধার্থে কাগজ আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দিয়েছে সরকার। এ সুযোগের অপব্যবহার করে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী প্রয়োজনের তুলনায় অমনক বেশি কাগজ আমদানি করছেন এবং অতিরিক্ত কাগজ দেশীয় বাজারে কম দামে ছেড়ে দিচ্ছেন। অথচ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে দেশে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ কাগজ। তিনি আরো বলেন, দেশে আমদানিকৃত কাগজ ও কাগজজাত পণ্যের পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ টন। দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ কাগজ উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও এই বিপুল পরিমাণ কাগজ কেন আমদানি হচ্ছে, সরকার তা খতিয়ে দেখছে না। ফলে প্রতিবছরই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় কাগজশিল্পের উদ্যোক্তারা বাজার হারাচ্ছেন।
সংগঠনটির কর্মকর্তারা জানান, সুনির্দিষ্ট কিছু খাতে ব্যবহারের জন্য বিশেষ ধরনের কাগজ আমদানির ক্ষেত্রে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা দেওয়া হয়। এ সুবিধার অপব্যবহার করে আমদানি করা হচ্ছে লেখার কাগজ, টয়লেট টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু ও আর্ট পেপারসহ বিভিন্ন ধরনের কাগজ। এতে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
দেশীয় শিল্প সংরক্ষণে সরকার উদাসীন বলে মন্তব্য করে মাজিদুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশীয় উদ্যোক্তারা কাগজ আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কর্তৃপক্ষের কাছে বিএসটিআইয়ের প্রত্যয়নপত্র দাখিলের বিধান করার দাবি জানিয়ে আসছেন। তা ছাড়া কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য আমদানির সময় সব ধরনের পরীক্ষা ও এইচএস কোড যাচাই করে পণ্য খালাসেরও অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই; বরং স্থানীয় কাগজকলগুলোর জন্য বিএসটিআইয়ের সনদ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বন্ড কমিশনার দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মাধ্যমে আনা বিভিন্ন ধরনের কাগজ অনিয়ম করে খোলাবাজারে বিক্রির দায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বন্ড কমিশনার দপ্তর থেকে ৩১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় তার মধ্যে এবিএ প্যাকেজিং লিমিটেড, সেঞ্চুরি প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, গোধূলি প্রিটিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, খান প্লাস্টিক অ্যান্ড একসেসরিজ কম্পানি, লিবার্টি অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং কম্পানি, ম্যাগনেট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মান্নান বঙ্ অ্যান্ড একসেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মডার্ন প্যাকার্স অ্যান্ড কার্টন লিমিটেড, প্যান প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে কাগজ আমদানি এবং বন্ডেড ওয়্যারহাউসের কাগজ বাজারে বিক্রি প্রসঙ্গে বন্ড কমিশনার এম হাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, খোলাবাজারে বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মাধ্যমে আনা কাগজ বিক্রি হচ্ছে- এমন অভিযোগ আমি অস্বীকার করব না। তবে এর ব্যাপকতা আগের চেয়ে অনেক কমেছে। আমাদের পক্ষ থেকে নিয়মিত বাজার পরিদর্শন করা হয়। কিছু কিছু মামলাও হয়েছে।
এ শুল্ক কর্মকর্তা জানান, যেসব কাগজে বেশি অনিয়ম হয় তার মধ্যে রয়েছে ডুপ্লেঙ্ বোর্ড এবং আর্ট কার্ডর্। এ দুই ধরনের কাগজ শুল্ক সংবেদনশীল বলে মনে হচ্ছে। লাইনার পেপার এবং মিডিয়াম পেপার নিয়ে আমাদের তেমন সমস্যা মোকাবিলা করতে হয় না। এ ক্ষেত্রে আমরা যা করছি তা হলো, তাদের বার্ষিক প্রাপ্যতা কমিয়ে দিচ্ছি। তাদের শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির সুবিধা নিয়ন্ত্রিতভাবে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
বাণিজ্যিক আমদানির চেয়ে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধায় বেশি কাগজ আসার কথা স্বীকার করেন ব্যবসায়ীরাও। বাংলাদেশ কাগজ আমদানিকারক সমিতির সভাপতি মো. শফিকুল ইসলাম ভরসা বলেন, বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মাধ্যমে কাগজ আমদানির পরিমাণ বাণিজ্যিকভাবে আমদানি থেকে প্রায় দশ গুণ বেশি। একটি জালিয়াতচক্র বন্ড সুবিধায় আনা কাগজের প্রায় ৭০ শতাংশই খোলাবাজারে বিক্রি করছে। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বন্ড সুবিধায় কাগজ আনা সরকার যদি নিয়ন্ত্রণ না করে, তাহলে কাগজের বৈধ আমদানিকারকরা অস্তিত্বের সংকটে পড়বেন। তাই সরকারের উচিত বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা নিয়ন্ত্রণ করা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান শুভাশিস বসু বলেন, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে কাগজ ও কাগজজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে এক কোটি ২৫ লাখ ৪০ হাজার ডলারের। ২০১১-১২ অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে এক কোটি পাঁচ লাখ ৮০ হাজার ডলারের কাগজ। প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশ। যেসব দেশে আমাদের কাগজ রপ্তানি হয় তার মধ্যে রয়েছে- কানাডা, তুরস্ক, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত ও যুক্তরাজ্য। তিনি আরো জানান, কাগজ রপ্তানিতে কোনো প্রণোদনা দেওয়া হয় না।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ফিজিক্যাল টেস্টিং উইংয়ের পরিচালক আবদুল মতিন বলেন, দেশীয় কাগজ বাজারজাত করতে বিএসটিআইয়ের মাননিয়ন্ত্রণ সনদ বাধ্যতামূলক হলেও আমদানি করা কাগজের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। তবে নতুন আমদানি নীতিমালায় এ বিধান রাখা হচ্ছে বলে তিনি জানান। নতুন নীতিমালা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
দেশের সবচেয়ে বড় কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে কাগজের মোট চাহিদা পূরণে বসুন্ধরা পেপার মিলস উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে এর বার্ষিক উৎপাদন এক লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন এবং ভবিষ্যতে এর উৎপাদন আরো বাড়ানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে বসুন্ধরার কাগজ প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানির এ ধারা অব্যাহত রাখতে এ খাতে সরকারের উচিত নগদ সহায়তা দেওয়া।
দেশীয় কাগজের বর্তমান সংকট সম্পর্কে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মাধ্যমে বিদেশ থেকে একটি চক্র প্রতিবছরই বিপুল পরিমাণ কাগজ আমদানি করছে। হার্ড টিস্যু নামে আমদানি করছে নানা ধরনের ন্যাপকিন, ফেসিয়াল টিস্যু ও টয়লেট টিস্যু। এতে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে কাগজ উৎপাদনকারী দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। তা ছাড়া একই শুল্কে মিশ্র বোর্ড আমদানির ফলে স্থানীয় মিলগুলো বাজারে টিকতে পারছে না। যেকোনো ধরনের কাগজ আমদানিতে বন্ডেড সুবিধা রহিত করার জোর দাবি জানান তিনি।
উদ্যোক্তাদের দাবি, অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ, অবকাঠামো সমস্যাসহ বিভিন্ন অসুবিধার কারণে এমনিতেই দেশে কাগজ উৎপাদনে খরচ বেশি পড়ছে। অন্যদিকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এবং বন্ডেড ওয়্যারহাউসের অপব্যবহার করে আমদানি করা শুল্কমুক্ত কাগজ খোলাবাজারে কম দামে বিক্রি করায় দেশীয় কাগজ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। কাগজ রপ্তানিতেও কোনো প্রণোদনা নেই। ভারতে কাগজ রপ্তানিতে ৭ শতাংশেরও বেশি নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। ইন্দোনেশিয়ায় এ সহায়তা ৩৩ শতাংশ। বাংলাদেশে এ ধরনের সরকারি প্রণোদনা না থাকার পরও রপ্তানিবাজারে জায়গা করে নিয়েছে দেশে উৎপাদিত কাগজ। অন্যদিকে নিম্নমানের বিদেশি কাগজের কাছে দেশেই বাজার হারাচ্ছে দেশি কাগজ।
দেশের কাগজশিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবিকা। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, আমদানি পর্যায়ে শুল্ক ফাঁকি এবং শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা কাগজ কালোবাজারে বিক্রি বন্ধ না হলে এ খাতে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বিপন্ন হবে।
বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন কাগজকল রয়েছে ৬৭টি। এগুলোর মধ্যে ৫৮টি কারখানা চালু রয়েছে।
এসব কারখানায় প্রায় সব ধরনের কাগজই তৈরি হচ্ছে। চাহিদার পুরোটাই আমদানি করে মেটাতে হতো এমন অনেক ধরনের কাগজ এখন দেশে তৈরি হচ্ছে।
দেশের চালু কাগজকলগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা বছরে প্রায় ১০ লাখ টন। অন্যদিকে দেশে সব ধরনের কাগজের মোট চাহিদা পাঁচ থেকে ছয় লাখ টন। সে হিসাবে দেশে বছরে প্রায় চার লাখ টন কাগজ উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে।
বিপিএমএ-এর সহসভাপতি অধ্যাপক মাজিদুল ইসলাম বলেন, তৈরি পোশাক ও ওষুধসহ নানা ধরনের শিল্পে মোড়কজাতকরণের (প্যাকেজিং) সুবিধার্থে কাগজ আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দিয়েছে সরকার। এ সুযোগের অপব্যবহার করে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী প্রয়োজনের তুলনায় অমনক বেশি কাগজ আমদানি করছেন এবং অতিরিক্ত কাগজ দেশীয় বাজারে কম দামে ছেড়ে দিচ্ছেন। অথচ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে দেশে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ কাগজ। তিনি আরো বলেন, দেশে আমদানিকৃত কাগজ ও কাগজজাত পণ্যের পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ টন। দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ কাগজ উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও এই বিপুল পরিমাণ কাগজ কেন আমদানি হচ্ছে, সরকার তা খতিয়ে দেখছে না। ফলে প্রতিবছরই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় কাগজশিল্পের উদ্যোক্তারা বাজার হারাচ্ছেন।
সংগঠনটির কর্মকর্তারা জানান, সুনির্দিষ্ট কিছু খাতে ব্যবহারের জন্য বিশেষ ধরনের কাগজ আমদানির ক্ষেত্রে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা দেওয়া হয়। এ সুবিধার অপব্যবহার করে আমদানি করা হচ্ছে লেখার কাগজ, টয়লেট টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু ও আর্ট পেপারসহ বিভিন্ন ধরনের কাগজ। এতে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
দেশীয় শিল্প সংরক্ষণে সরকার উদাসীন বলে মন্তব্য করে মাজিদুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশীয় উদ্যোক্তারা কাগজ আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কর্তৃপক্ষের কাছে বিএসটিআইয়ের প্রত্যয়নপত্র দাখিলের বিধান করার দাবি জানিয়ে আসছেন। তা ছাড়া কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য আমদানির সময় সব ধরনের পরীক্ষা ও এইচএস কোড যাচাই করে পণ্য খালাসেরও অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই; বরং স্থানীয় কাগজকলগুলোর জন্য বিএসটিআইয়ের সনদ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বন্ড কমিশনার দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মাধ্যমে আনা বিভিন্ন ধরনের কাগজ অনিয়ম করে খোলাবাজারে বিক্রির দায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বন্ড কমিশনার দপ্তর থেকে ৩১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় তার মধ্যে এবিএ প্যাকেজিং লিমিটেড, সেঞ্চুরি প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, গোধূলি প্রিটিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, খান প্লাস্টিক অ্যান্ড একসেসরিজ কম্পানি, লিবার্টি অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং কম্পানি, ম্যাগনেট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মান্নান বঙ্ অ্যান্ড একসেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মডার্ন প্যাকার্স অ্যান্ড কার্টন লিমিটেড, প্যান প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে কাগজ আমদানি এবং বন্ডেড ওয়্যারহাউসের কাগজ বাজারে বিক্রি প্রসঙ্গে বন্ড কমিশনার এম হাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, খোলাবাজারে বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মাধ্যমে আনা কাগজ বিক্রি হচ্ছে- এমন অভিযোগ আমি অস্বীকার করব না। তবে এর ব্যাপকতা আগের চেয়ে অনেক কমেছে। আমাদের পক্ষ থেকে নিয়মিত বাজার পরিদর্শন করা হয়। কিছু কিছু মামলাও হয়েছে।
এ শুল্ক কর্মকর্তা জানান, যেসব কাগজে বেশি অনিয়ম হয় তার মধ্যে রয়েছে ডুপ্লেঙ্ বোর্ড এবং আর্ট কার্ডর্। এ দুই ধরনের কাগজ শুল্ক সংবেদনশীল বলে মনে হচ্ছে। লাইনার পেপার এবং মিডিয়াম পেপার নিয়ে আমাদের তেমন সমস্যা মোকাবিলা করতে হয় না। এ ক্ষেত্রে আমরা যা করছি তা হলো, তাদের বার্ষিক প্রাপ্যতা কমিয়ে দিচ্ছি। তাদের শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির সুবিধা নিয়ন্ত্রিতভাবে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
বাণিজ্যিক আমদানির চেয়ে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধায় বেশি কাগজ আসার কথা স্বীকার করেন ব্যবসায়ীরাও। বাংলাদেশ কাগজ আমদানিকারক সমিতির সভাপতি মো. শফিকুল ইসলাম ভরসা বলেন, বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মাধ্যমে কাগজ আমদানির পরিমাণ বাণিজ্যিকভাবে আমদানি থেকে প্রায় দশ গুণ বেশি। একটি জালিয়াতচক্র বন্ড সুবিধায় আনা কাগজের প্রায় ৭০ শতাংশই খোলাবাজারে বিক্রি করছে। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বন্ড সুবিধায় কাগজ আনা সরকার যদি নিয়ন্ত্রণ না করে, তাহলে কাগজের বৈধ আমদানিকারকরা অস্তিত্বের সংকটে পড়বেন। তাই সরকারের উচিত বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা নিয়ন্ত্রণ করা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান শুভাশিস বসু বলেন, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে কাগজ ও কাগজজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে এক কোটি ২৫ লাখ ৪০ হাজার ডলারের। ২০১১-১২ অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে এক কোটি পাঁচ লাখ ৮০ হাজার ডলারের কাগজ। প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশ। যেসব দেশে আমাদের কাগজ রপ্তানি হয় তার মধ্যে রয়েছে- কানাডা, তুরস্ক, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত ও যুক্তরাজ্য। তিনি আরো জানান, কাগজ রপ্তানিতে কোনো প্রণোদনা দেওয়া হয় না।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ফিজিক্যাল টেস্টিং উইংয়ের পরিচালক আবদুল মতিন বলেন, দেশীয় কাগজ বাজারজাত করতে বিএসটিআইয়ের মাননিয়ন্ত্রণ সনদ বাধ্যতামূলক হলেও আমদানি করা কাগজের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। তবে নতুন আমদানি নীতিমালায় এ বিধান রাখা হচ্ছে বলে তিনি জানান। নতুন নীতিমালা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
দেশের সবচেয়ে বড় কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে কাগজের মোট চাহিদা পূরণে বসুন্ধরা পেপার মিলস উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে এর বার্ষিক উৎপাদন এক লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন এবং ভবিষ্যতে এর উৎপাদন আরো বাড়ানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে বসুন্ধরার কাগজ প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানির এ ধারা অব্যাহত রাখতে এ খাতে সরকারের উচিত নগদ সহায়তা দেওয়া।
দেশীয় কাগজের বর্তমান সংকট সম্পর্কে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মাধ্যমে বিদেশ থেকে একটি চক্র প্রতিবছরই বিপুল পরিমাণ কাগজ আমদানি করছে। হার্ড টিস্যু নামে আমদানি করছে নানা ধরনের ন্যাপকিন, ফেসিয়াল টিস্যু ও টয়লেট টিস্যু। এতে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে কাগজ উৎপাদনকারী দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। তা ছাড়া একই শুল্কে মিশ্র বোর্ড আমদানির ফলে স্থানীয় মিলগুলো বাজারে টিকতে পারছে না। যেকোনো ধরনের কাগজ আমদানিতে বন্ডেড সুবিধা রহিত করার জোর দাবি জানান তিনি।
No comments