বেতনের জন্য সোহেল তাজের স্বাক্ষর জাল! by আশরাফুল হক রাজীব
কথা রাখেননি তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। দপ্তরবিহীন প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় বেতন-ভাতা বাবদ নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া অর্থ ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। এমনকি তাঁকে 'দপ্তরবিহীন' করার আগের ১৩ মাসের বেতন-ভাতা ভোগ করতেও আপত্তি ছিল তাঁর।
কিন্তু সেই অর্থ এখনো ফেরত যায়নি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। বরং সোহেল তাজ দপ্তরবিহীন থাকা অবস্থায়ও ব্যক্তিগত কর্মীরা (পারসোনেল স্টাফ) তাঁর সঙ্গে ছিলেন- এ ধরনের প্রত্যয়নপত্র পেয়ে সরকার তাঁদের ওই সময়ের বেতন-ভাতা পরিশোধ করার উদ্যোগ নিয়েছে।
এদিকে সোহেল তাজ দাবি করছেন, তিনি তাঁর সাবেক কর্মীদের এ ধরনের কোনো প্রত্যয়নপত্র দেননি। কেউ তাঁর সই করা প্রত্যয়নপত্র জমা দিয়ে থাকলে সেটা হবে জালিয়াতি।
সোহেল তাজ দপ্তরবিহীন অবস্থার ২২ মাসের এবং এর আগের রহস্যময় ১৩ মাসের বেতন-ভাতা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত দিয়েছেন কি না তা জানে না মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে, কোষাগারে টাকা ফেরত দিতে হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে টাকার পরিমাণ নিশ্চিত হওয়া। ফেরত দেওয়ার পর তা ওই বিভাগকে অবগত করাও রেওয়াজ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা কালের কণ্ঠকে বলেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রীর অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া বেতন-ভাতা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত দেওয়ার কোনো তথ্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে নেই।
টাকা ফেরত দিয়েছেন কি না তা বারবার জানতে চাইলে সোহেল তাজ কোনো বক্তব্য দেননি। অন্যান্য বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দিলেও এ প্রশ্নে তিনি চুপ থাকেন।
সোহেল তাজ দপ্তরবিহীন থাকা অবস্থায়ও ব্যক্তিগত কর্মীরা তাঁর সঙ্গে ছিলেন- এ ধরনের প্রত্যয়নপত্র দেওয়ার পর সরকার তাঁদের ওই সময়ের বেতন-ভাতা পরিশোধ করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়েও রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। সোহেল তাজ দাবি করেছেন, তিনি কোনো প্রত্যয়নপত্র দেননি। অন্যদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সোহেল তাজের স্বাক্ষরযুক্ত তারিখবিহীন একটি প্রত্যয়নপত্র জমা হয়েছে।
সোহেল তাজ যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। কিন্তু মোবাইল ফোনে এসএমএস করা হলে এর জবাব দিয়েছেন। তবে তিনি নিজের অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া সেই বেতন-ভাতা তুলেছেন কি না এরও কোনো জবাব দেননি। এমনকি তাঁকে বলা হয়, প্রশ্নটির কোনো জবাব না দিলে ধরে নেওয়া হবে তিনি বেতন-ভাতা তুলেছেন এবং প্রতিবেদন প্রকাশ করার বিষয়ে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। এ পর্যায়েও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি সাবেক এ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
ব্যক্তিগত কর্মীদের বিষয়ে সোহেল তাজ বলেন, 'আমি যত দূর জানি আমার সাবেক কোনো স্টাফ বেতনের জন্য আবেদন করেননি।' এসএমএসে অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমি আবারও বলছি, স্টাফদের বেতন-ভাতা তোলার জন্য আমি কোনো চিঠি দিইনি। আমার জানামতে কোনো স্টাফ ওই সময়ের বেতন-ভাতা তোলেননি।'
সোহেল তাজকে জানানো হয়, তাঁর সাবেক এপিএস আবু কাউছারসহ মোট পাঁচজন পারসোনেল স্টাফ বেতন-ভাতার জন্য আবেদন করেছেন। কাউছারের আবেদন পাওয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বলা হয়, সোহেল তাজ দপ্তরবিহীন থাকা অবস্থায়ও ওই পাঁচ পারসোনেল স্টাফ তাঁর সঙ্গে ছিলেন কি না তা উল্লেখ করে প্রত্যয়নপত্র দিতে। এরপর গত বছর ২১ অক্টোবর সোহেল তাজের সই করা প্রত্যয়নপত্র জমা দেন কাউছার। তবে সেই স্বাক্ষরের নিচে কোনো তারিখ নেই। এ তথ্য জানার পর সোহেল তাজ বলেন, 'এটা অবশ্যই জালিয়াতি।'
মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পারিতোষিক ও বিভিন্ন ভাতার টাকা ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) পদ্ধতিতে সরাসরি তাঁদের ব্যাংক হিসাবে চলে যায়। সোহেল তাজ পদত্যাগ করে সরকারি দায়িত্ব পালন থেকে দূরে ছিলেন। পদত্যাগ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলেও এক সময় তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সব টাকা জমা হয়। দায়িত্ব পালন না করেও টাকা নেওয়ার সমালোচনা শুরু হলে সোহেল তাজ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া বেতন-ভাতার টাকা ফেরত দিতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'আমার অজান্তে যদি কোনো টাকা আমার অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে থাকে, তবে সেই টাকার দাবিদার আমি নই। যেকোনো মুহূর্তে আমি এই টাকা ফেরত দিতে প্রস্তুত।'
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা বলেন, 'সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ যখন দপ্তরবিহীন ছিলেন তখন প্রতিমন্ত্রীর পারসোনেল স্টাফরা বেতন-ভাতা পাননি। পরে তাঁরা সেই বেতন-ভাতার জন্য আবেদন করেন। তাঁদের আবেদন সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রীর কোনো নির্দেশনা ছিল না। দপ্তরবিহীন প্রতিমন্ত্রী ঘোষণা করার পর তাঁর আগের কর্মস্থল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাঁরা তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন তাঁরাই পরে ধারাবাহিকভাবে প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন কি না এ-সংক্রান্ত তথ্যাদি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে অবহিত করার জন্য সাবেক প্রতিমন্ত্রীর এপিএসকে একাধিকবার অনুরোধ করা হয়। প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিমন্ত্রীর কাজে নিয়োজিত ছিলেন মর্মে দপ্তরবিহীন প্রতিমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে অবহিত করেন। তাঁর এ প্রত্যয়ন পাওয়ার পর আমরা পারসোনেল স্টাফদের বেতন-ভাতা পরিশোধের পদক্ষেপ নিয়েছি। কারণ তাঁরা আইন অনুযায়ী বেতন-ভাতা পান।'
জানা যায়, সোহেল তাজের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁদের বেতন-ভাতা পাওয়ার জন্য গত বছর জানুয়ারি মাসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আবেদন করেন। প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সোহেল তাজের সহকারী একান্ত সচিব আবু কাউছার, ব্যক্তিগত সহকারী অভিনয় কুমার দে, ব্যক্তিগত সহকারী দিপক মজুমদার, জমাদার বাদল খন্দকার এবং অর্ডালি পদে জহিরুল ইসলাম নিয়োজিত ছিলেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে এমএলএসএস মো. মনির হোসেন, কুক দেলোয়ার হোসেন পারসোনেল স্টাফ হিসেবে থাকলেও সোহেল তাজের চিঠিতে এই দুজনের নাম উল্লেখ ছিল না। এ দুজন ছাড়া বাকি পাঁচজনের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ জন্য তাঁদের সর্বশেষ বেতনের প্রত্যয়নপত্র দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে। সেই প্রত্যয়নপত্র পাওয়া গেলে শিগগিরই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তাঁদের বকেয়া বেতন-ভাতা দেবে।
যখন কোনো মন্ত্রীকে দপ্তরবিহীন করা হয় তখন তাঁর নিজের ও পারসোনেল স্টাফদের বেতন-ভাতা সরাসরি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দেওয়া হয়। অন্য মন্ত্রীদের বেতন-ভাতার টাকা দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে। আর পারসোনেল স্টাফদের বেতন-ভাতা তাঁদের নিজেদের নামে পরিশোধ করা হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৩১ জুলাই শামসুল হক টুকুকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ এবং এর আগে সোহেল তাজ নিজেই মিডিয়ার কাছে তাঁর পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর সৃষ্ট জটিলতায় বন্ধ হয়ে যায় তাঁর বেতন-ভাতা। সেই সময় সোহেল তাজ প্রতিমন্ত্রী পদে বহাল ছিলেন কি না, তা নিয়ে সরকারের ভেতর-বাইরে সৃষ্টি হয় ধূম্রজাল। এ অবস্থায় ২০১০ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. আবদুল আজিজ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তানজিম আহমেদ সোহেল তাজের পদত্যাগের গেজেট নোটিফিকেশন জারির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু একই বছরের ২৪ আগস্ট সোহেল তাজকে দপ্তরবিহীন প্রতিমন্ত্রী করে গেজেট জারি করার পর অবসান ঘটে সব জল্পনা-কল্পনার। এরপর আটকে থাকা বেতন-ভাতা দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু ২০০৯ সালের ৩১ জুলাই শামসুল হক টুকুকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ এবং ২০১০ সালের ২৪ আগস্ট দপ্তরবিহীন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে সোহেল তাজের গেজেট জারির আগ পর্যন্ত ১৩ মাস 'দপ্তর' অথবা 'দপ্তরবিহীন' প্রতিমন্ত্রীর গেজেট না থাকায় প্রশ্ন তোলে সিজিএ কার্যালয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক চিঠিতে সিজিএ কার্যালয়কে জানায়, 'যেহেতু তানজিম আহমেদ সোহেল তাজের নিয়োগ আদেশ বাতিল করা হয়নি, সেহেতু তিনি অব্যাহতভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিমন্ত্রী পদে বহাল রয়েছেন মর্মে বিবেচনা করে তাঁর বকেয়া বেতন-ভাতা প্রতিমন্ত্রী কর্তৃক ব্যাংক হিসাবে প্রদান করা যেতে পারে।'
মন্ত্রিপরিষদের মতামতের পর প্রতিমন্ত্রী হিসেবে সোহেল তাজের ৩১ মাসের (২০০৯ সালের আগস্ট থেকে ২০১২-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) বেতন-ভাতা তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতি মাসের বেতন-ভাতার মধ্যে রয়েছে রেম্যুনারেশন বা পারিতোষিক ৪৭ হাজার ৮০০ টাকা, নির্বাচনী এলাকা ভাতা পাঁচ হাজার, নির্বাচনী এলাকায় অফিস পরিচালনা ভাতা ছয় হাজার, আপ্যায়ন ভাতা চার হাজার, বাড়িভাড়া ভাতা ২০ হাজার এবং গাড়ি জ্বালানি ভাতা প্রতিদিন ১৮ লিটার হিসেবে প্রায় ৩৮ হাজার টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী ৩১ মাসে সোহেল তাজের অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে ৩৭ লাখ ৪৪ হাজার ৮০০ টাকা। পরে আরো চার মাসের বেতন-ভাতার টাকা জমা হয়েছে।
দপ্তরবিহীন বা দপ্তরবিহীন নয় এমন পুরো সময়টাই সোহেল তাজ বিদেশে ছিলেন। নির্বাচনী এলাকা গাজীপুরের কাপাসিয়ায় না গেলেও এলাকা ভাতা, অফিস না থাকলেও এর পরিচালনা ভাতা, কাউকে আপ্যায়ন না করলেও তাঁকে আপ্যায়ন ভাতা দেওয়া হয়েছে। তাঁকে এ টাকা দেওয়ার পর পারসোনেল স্টাফরাও সোহেল তাজের দপ্তরবিহীন থাকার সময়ের বেতন-ভাতা দাবি করতে উদ্বুদ্ধ হন বলে মন্ত্রিপরিষদ সূত্রে জানা গেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) এম হাফিজউদ্দিন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কাজ না করে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা উচিত। এটা হয়তো আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ নয়, কিন্তু নৈতিকতার দিক থেকে অপরাধ। সোহেল তাজ এ টাকা না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ঘোষণা দেওয়ার পর তা বাস্তবায়ন করতে পারলে ভালো হতো। জাতির সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত। এ ধরনের দৃষ্টান্তের বড় অভাব।'
প্রথম দফায় সোহেল তাজ ২০০৯ সালের ৩১ মে এবং পরের দফায় একই বছরের ১ জুন পদত্যাগ করেছেন বলে বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে দাবি করেন। ৯ জুন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন তিনি। সোহেল তাজ পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের অনুরোধ জানান। পরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসানোর জন্য তাঁকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী এক রকম জোর করেই প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে নিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সফল আলোচনার পর সোহেল তাজ গত ৪ জুন অফিস করেন এবং পদত্যাগের বিষয়টি নাকচ করে দেন। ৮ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অংশ নেন সোহেল তাজ। কিন্তু পরদিন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে তিনি গণমাধ্যমের কাছে তাঁর পদত্যাগ করার বিষয়টি উল্লেখ করার পর আবার সৃষ্টি হয় ধূম্রজাল।
এদিকে সোহেল তাজ দাবি করছেন, তিনি তাঁর সাবেক কর্মীদের এ ধরনের কোনো প্রত্যয়নপত্র দেননি। কেউ তাঁর সই করা প্রত্যয়নপত্র জমা দিয়ে থাকলে সেটা হবে জালিয়াতি।
সোহেল তাজ দপ্তরবিহীন অবস্থার ২২ মাসের এবং এর আগের রহস্যময় ১৩ মাসের বেতন-ভাতা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত দিয়েছেন কি না তা জানে না মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে, কোষাগারে টাকা ফেরত দিতে হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে টাকার পরিমাণ নিশ্চিত হওয়া। ফেরত দেওয়ার পর তা ওই বিভাগকে অবগত করাও রেওয়াজ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা কালের কণ্ঠকে বলেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রীর অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া বেতন-ভাতা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত দেওয়ার কোনো তথ্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে নেই।
টাকা ফেরত দিয়েছেন কি না তা বারবার জানতে চাইলে সোহেল তাজ কোনো বক্তব্য দেননি। অন্যান্য বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দিলেও এ প্রশ্নে তিনি চুপ থাকেন।
সোহেল তাজ দপ্তরবিহীন থাকা অবস্থায়ও ব্যক্তিগত কর্মীরা তাঁর সঙ্গে ছিলেন- এ ধরনের প্রত্যয়নপত্র দেওয়ার পর সরকার তাঁদের ওই সময়ের বেতন-ভাতা পরিশোধ করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়েও রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। সোহেল তাজ দাবি করেছেন, তিনি কোনো প্রত্যয়নপত্র দেননি। অন্যদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সোহেল তাজের স্বাক্ষরযুক্ত তারিখবিহীন একটি প্রত্যয়নপত্র জমা হয়েছে।
সোহেল তাজ যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। কিন্তু মোবাইল ফোনে এসএমএস করা হলে এর জবাব দিয়েছেন। তবে তিনি নিজের অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া সেই বেতন-ভাতা তুলেছেন কি না এরও কোনো জবাব দেননি। এমনকি তাঁকে বলা হয়, প্রশ্নটির কোনো জবাব না দিলে ধরে নেওয়া হবে তিনি বেতন-ভাতা তুলেছেন এবং প্রতিবেদন প্রকাশ করার বিষয়ে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। এ পর্যায়েও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি সাবেক এ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
ব্যক্তিগত কর্মীদের বিষয়ে সোহেল তাজ বলেন, 'আমি যত দূর জানি আমার সাবেক কোনো স্টাফ বেতনের জন্য আবেদন করেননি।' এসএমএসে অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমি আবারও বলছি, স্টাফদের বেতন-ভাতা তোলার জন্য আমি কোনো চিঠি দিইনি। আমার জানামতে কোনো স্টাফ ওই সময়ের বেতন-ভাতা তোলেননি।'
সোহেল তাজকে জানানো হয়, তাঁর সাবেক এপিএস আবু কাউছারসহ মোট পাঁচজন পারসোনেল স্টাফ বেতন-ভাতার জন্য আবেদন করেছেন। কাউছারের আবেদন পাওয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বলা হয়, সোহেল তাজ দপ্তরবিহীন থাকা অবস্থায়ও ওই পাঁচ পারসোনেল স্টাফ তাঁর সঙ্গে ছিলেন কি না তা উল্লেখ করে প্রত্যয়নপত্র দিতে। এরপর গত বছর ২১ অক্টোবর সোহেল তাজের সই করা প্রত্যয়নপত্র জমা দেন কাউছার। তবে সেই স্বাক্ষরের নিচে কোনো তারিখ নেই। এ তথ্য জানার পর সোহেল তাজ বলেন, 'এটা অবশ্যই জালিয়াতি।'
মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পারিতোষিক ও বিভিন্ন ভাতার টাকা ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) পদ্ধতিতে সরাসরি তাঁদের ব্যাংক হিসাবে চলে যায়। সোহেল তাজ পদত্যাগ করে সরকারি দায়িত্ব পালন থেকে দূরে ছিলেন। পদত্যাগ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলেও এক সময় তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সব টাকা জমা হয়। দায়িত্ব পালন না করেও টাকা নেওয়ার সমালোচনা শুরু হলে সোহেল তাজ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া বেতন-ভাতার টাকা ফেরত দিতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'আমার অজান্তে যদি কোনো টাকা আমার অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে থাকে, তবে সেই টাকার দাবিদার আমি নই। যেকোনো মুহূর্তে আমি এই টাকা ফেরত দিতে প্রস্তুত।'
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা বলেন, 'সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ যখন দপ্তরবিহীন ছিলেন তখন প্রতিমন্ত্রীর পারসোনেল স্টাফরা বেতন-ভাতা পাননি। পরে তাঁরা সেই বেতন-ভাতার জন্য আবেদন করেন। তাঁদের আবেদন সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রীর কোনো নির্দেশনা ছিল না। দপ্তরবিহীন প্রতিমন্ত্রী ঘোষণা করার পর তাঁর আগের কর্মস্থল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাঁরা তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন তাঁরাই পরে ধারাবাহিকভাবে প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন কি না এ-সংক্রান্ত তথ্যাদি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে অবহিত করার জন্য সাবেক প্রতিমন্ত্রীর এপিএসকে একাধিকবার অনুরোধ করা হয়। প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিমন্ত্রীর কাজে নিয়োজিত ছিলেন মর্মে দপ্তরবিহীন প্রতিমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে অবহিত করেন। তাঁর এ প্রত্যয়ন পাওয়ার পর আমরা পারসোনেল স্টাফদের বেতন-ভাতা পরিশোধের পদক্ষেপ নিয়েছি। কারণ তাঁরা আইন অনুযায়ী বেতন-ভাতা পান।'
জানা যায়, সোহেল তাজের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁদের বেতন-ভাতা পাওয়ার জন্য গত বছর জানুয়ারি মাসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আবেদন করেন। প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সোহেল তাজের সহকারী একান্ত সচিব আবু কাউছার, ব্যক্তিগত সহকারী অভিনয় কুমার দে, ব্যক্তিগত সহকারী দিপক মজুমদার, জমাদার বাদল খন্দকার এবং অর্ডালি পদে জহিরুল ইসলাম নিয়োজিত ছিলেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে এমএলএসএস মো. মনির হোসেন, কুক দেলোয়ার হোসেন পারসোনেল স্টাফ হিসেবে থাকলেও সোহেল তাজের চিঠিতে এই দুজনের নাম উল্লেখ ছিল না। এ দুজন ছাড়া বাকি পাঁচজনের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ জন্য তাঁদের সর্বশেষ বেতনের প্রত্যয়নপত্র দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে। সেই প্রত্যয়নপত্র পাওয়া গেলে শিগগিরই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তাঁদের বকেয়া বেতন-ভাতা দেবে।
যখন কোনো মন্ত্রীকে দপ্তরবিহীন করা হয় তখন তাঁর নিজের ও পারসোনেল স্টাফদের বেতন-ভাতা সরাসরি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দেওয়া হয়। অন্য মন্ত্রীদের বেতন-ভাতার টাকা দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে। আর পারসোনেল স্টাফদের বেতন-ভাতা তাঁদের নিজেদের নামে পরিশোধ করা হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৩১ জুলাই শামসুল হক টুকুকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ এবং এর আগে সোহেল তাজ নিজেই মিডিয়ার কাছে তাঁর পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর সৃষ্ট জটিলতায় বন্ধ হয়ে যায় তাঁর বেতন-ভাতা। সেই সময় সোহেল তাজ প্রতিমন্ত্রী পদে বহাল ছিলেন কি না, তা নিয়ে সরকারের ভেতর-বাইরে সৃষ্টি হয় ধূম্রজাল। এ অবস্থায় ২০১০ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. আবদুল আজিজ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তানজিম আহমেদ সোহেল তাজের পদত্যাগের গেজেট নোটিফিকেশন জারির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু একই বছরের ২৪ আগস্ট সোহেল তাজকে দপ্তরবিহীন প্রতিমন্ত্রী করে গেজেট জারি করার পর অবসান ঘটে সব জল্পনা-কল্পনার। এরপর আটকে থাকা বেতন-ভাতা দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু ২০০৯ সালের ৩১ জুলাই শামসুল হক টুকুকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ এবং ২০১০ সালের ২৪ আগস্ট দপ্তরবিহীন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে সোহেল তাজের গেজেট জারির আগ পর্যন্ত ১৩ মাস 'দপ্তর' অথবা 'দপ্তরবিহীন' প্রতিমন্ত্রীর গেজেট না থাকায় প্রশ্ন তোলে সিজিএ কার্যালয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক চিঠিতে সিজিএ কার্যালয়কে জানায়, 'যেহেতু তানজিম আহমেদ সোহেল তাজের নিয়োগ আদেশ বাতিল করা হয়নি, সেহেতু তিনি অব্যাহতভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিমন্ত্রী পদে বহাল রয়েছেন মর্মে বিবেচনা করে তাঁর বকেয়া বেতন-ভাতা প্রতিমন্ত্রী কর্তৃক ব্যাংক হিসাবে প্রদান করা যেতে পারে।'
মন্ত্রিপরিষদের মতামতের পর প্রতিমন্ত্রী হিসেবে সোহেল তাজের ৩১ মাসের (২০০৯ সালের আগস্ট থেকে ২০১২-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) বেতন-ভাতা তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতি মাসের বেতন-ভাতার মধ্যে রয়েছে রেম্যুনারেশন বা পারিতোষিক ৪৭ হাজার ৮০০ টাকা, নির্বাচনী এলাকা ভাতা পাঁচ হাজার, নির্বাচনী এলাকায় অফিস পরিচালনা ভাতা ছয় হাজার, আপ্যায়ন ভাতা চার হাজার, বাড়িভাড়া ভাতা ২০ হাজার এবং গাড়ি জ্বালানি ভাতা প্রতিদিন ১৮ লিটার হিসেবে প্রায় ৩৮ হাজার টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী ৩১ মাসে সোহেল তাজের অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে ৩৭ লাখ ৪৪ হাজার ৮০০ টাকা। পরে আরো চার মাসের বেতন-ভাতার টাকা জমা হয়েছে।
দপ্তরবিহীন বা দপ্তরবিহীন নয় এমন পুরো সময়টাই সোহেল তাজ বিদেশে ছিলেন। নির্বাচনী এলাকা গাজীপুরের কাপাসিয়ায় না গেলেও এলাকা ভাতা, অফিস না থাকলেও এর পরিচালনা ভাতা, কাউকে আপ্যায়ন না করলেও তাঁকে আপ্যায়ন ভাতা দেওয়া হয়েছে। তাঁকে এ টাকা দেওয়ার পর পারসোনেল স্টাফরাও সোহেল তাজের দপ্তরবিহীন থাকার সময়ের বেতন-ভাতা দাবি করতে উদ্বুদ্ধ হন বলে মন্ত্রিপরিষদ সূত্রে জানা গেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) এম হাফিজউদ্দিন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কাজ না করে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা উচিত। এটা হয়তো আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ নয়, কিন্তু নৈতিকতার দিক থেকে অপরাধ। সোহেল তাজ এ টাকা না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ঘোষণা দেওয়ার পর তা বাস্তবায়ন করতে পারলে ভালো হতো। জাতির সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত। এ ধরনের দৃষ্টান্তের বড় অভাব।'
প্রথম দফায় সোহেল তাজ ২০০৯ সালের ৩১ মে এবং পরের দফায় একই বছরের ১ জুন পদত্যাগ করেছেন বলে বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে দাবি করেন। ৯ জুন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন তিনি। সোহেল তাজ পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের অনুরোধ জানান। পরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসানোর জন্য তাঁকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী এক রকম জোর করেই প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে নিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সফল আলোচনার পর সোহেল তাজ গত ৪ জুন অফিস করেন এবং পদত্যাগের বিষয়টি নাকচ করে দেন। ৮ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অংশ নেন সোহেল তাজ। কিন্তু পরদিন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে তিনি গণমাধ্যমের কাছে তাঁর পদত্যাগ করার বিষয়টি উল্লেখ করার পর আবার সৃষ্টি হয় ধূম্রজাল।
No comments