আইন-শৃঙ্খলা-হাতকড়া পরা লাশ ও জননিরাপত্তা by সুলতান মাহমুদ রানা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির এক ক্রান্তিলগ্নে পুলিশের হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় একটি লাশ যা সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগজনক অবস্থার জন্ম দিয়েছে।
গত ৫ জানুয়ারি শনিবার বিএনপি নেতা ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম মজুমদারকে তার শ্বশুরবাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকূপা থেকে র্যাবের পোশাক পরিহিত সশস্ত্র ব্যক্তিরা ধরে নিয়ে যায়। তিনি ছিলেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এবং বঙ্গবাজার মার্কেট কমিটির সহ-সভাপতি। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদপুরের শাহরাস্তির রায়শ্রী উত্তর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি। তাকে হত্যার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক শত্রুতা, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব নাকি অন্য কোনো কিছু, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে হত্যার উদ্দেশ্য যা-ই হোক, সন্দেহ বা অভিযোগের আঙুল উঠেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় এখানেই। নিহত রফিকুলের স্বজনদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, শুক্রবার রাতে রফিকুল ঝিনাইদহের শৈলকূপার আনন্দপুর গ্রামে তার শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। শনিবার সন্ধ্যায় পরিবারের লোকজনের সঙ্গে বসে আলাপ করার সময় র্যাবের পোশাক পরা সাত-আটজন র্যাবের পরিচয় দিয়ে তাকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের সবার হাতে অস্ত্র ছিল। তাকে যে মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাওয়া হয়, তাতেও র্যাবের স্টিকার লাগানো ছিল। কিন্তু রফিকুলকে মৃত অবস্থায় উদ্ধারের পর র্যাবের পক্ষ থেকে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসীরা তাকে র্যাব পরিচয় দিয়ে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, এটি যদি সন্ত্রাসীদের কাজ হয়ে থাকে তাহলে তারা র্যাবের পোশাক, স্টিকার, মাইক্রোবাস, অস্ত্র, হাতকড়া ইত্যাদি জোগাড় করল কোথা থেকে? রফিকুলের হাতে যে হাতকড়া পরানো ছিল, তাতে 'পুলিশ' শব্দটি খোদাই করে লেখা রয়েছে বলে জানা যায়। এটি সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দেয়। এ ঘটনা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমকে আবারও প্রচণ্ডভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করল। এরপর পুলিশ লেখা হাতকড়া পরা অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার হয়। পরিবারের লোকের ধারণা এবং অভিযোগ, র্যাব কিংবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারাই এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে। এমন অভিযোগ অত্যন্ত স্বাভাবিক, কারণ ইতিপূর্বে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে অনেক। বরাবরের মতোই এবারও যে এমন ঘটনা ঘটেনি তা কোনোভাবে বলা যায় না। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সম্পূর্ণভাবে এ ঘটনার দায়কে অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, এ ঘটনার সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কিন্তু আমার প্রশ্ন, তাহলে কে নেবে এই দায়? আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কি এই দায় অস্বীকার করতে পারে? একজন রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীর পুলিশ হাতকড়া পরিহিত লাশ কি শুধু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবেই বিবেচিত হবে, নাকি একটি সাধারণ মানুষ হত্যার বিবেচনায় আসবে?
ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ও এনকাউন্টারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা ছাড়াও অপহরণ ও গুমের কিছু ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে খোদ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানও অভিযোগ তুলেছিলেন। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা এখনও রহস্যে ঘেরা। বিএনপির পক্ষ থেকে ওই ঘটনার জন্য সরকারকে দায়ী করা হয়েছে। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া এবং শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম গুম ও খুন হওয়ার ঘটনা দেশ ছাপিয়ে বহির্বিশ্বেও ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। বস্তুত গত দুই বছরে দেশব্যাপী অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যার যেসব ঘটনা ঘটেছে, অনেক ক্ষেত্রেই তার শিকার হয়েছেন বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা। মূলত এ কারণেই অভিযোগের আঙুল উঠছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে। এটি সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। বাড়িয়ে দিচ্ছে জনগণের আস্থাহীনতা।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে রফিকুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড কে বা কারা ঘটিয়েছে তা নিঃসন্দেহে তদন্তসাপেক্ষ বিষয়। এ ঘটনাকে নিছক রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত বলে উড়িয়ে না দিয়ে তা যত দ্রুত সম্ভব যথাযথ তদন্ত করে দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরই। যদি তা করা সম্ভব না হয় তাহলে এমন ধরনের হত্যাকাণ্ড যে বহু পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে তা নিদ্বর্িধায় বলা যায়। কোনো সন্ত্রাসীর আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা বা সাহস যেমন সাধারণ মানুষের রয়েছে যথেষ্ট, তেমনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের রয়েছে শ্রদ্ধা। কাজেই যখন কোনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লেবাস ধরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়, তখন তা প্রতিহত করার হাতিয়ার মানুষের কাছে থাকে না। এমন কায়দায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে হত্যাকাণ্ডের মতো সহিংসতা ঘটতে থাকলে তা সাধারণ মানুষের কাছে নিরাপত্তাহীনতার চরম রূপের সৃষ্টি হবে। এ হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে বিবেচনা না করে একটি নিরপেক্ষ তদন্তসাপেক্ষে প্রকৃত দোষীদের বিচারের আওতায় আনা দরকার।
একের পর এক রহস্যময় হত্যা, গুম, অপহরণ এবং বিশ্বজিতের মতো পথচারীর নির্মম হত্যা সাধারণ জনগণকে অনেকাংশে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। পুলিশ কিংবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী যে কোনো বাহিনীকে যখন কোনো নির্মম হত্যাকাণ্ডকে দর্শকের ভূমিকায় উপভোগ করতে দেখা যায়, তখন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার আস্থার জায়গাটি অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে যায়।
জনগণের নিরাপত্তার জন্য যে বাহিনী গঠিত সেই বাহিনীর পোশাক এবং হ্যান্ডকাফ যদি হয় জীবনের প্রতি হুমকি, তাহলে অবশ্যই জাতির নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। রফিকুল ইসলামের হাতকড়া পরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত দোষীদের যত দ্রুত সম্ভব খুঁজে বের করে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে জনগণের মনে নিরাপত্তা রক্ষার প্রকৃত আস্থার জায়গাটি ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অপহরণ, হত্যা, গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাস, সহিংসতা ও যে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই সজাগ ও সতর্ক থাকা উচিত। শুধু কোনো নেতা বা কর্মীর হত্যাকাণ্ডকে বিশেষ বিবেচনায় না এনে গোটা জাতির যে কোনো সাধারণ মানুষের হত্যাকাণ্ডকে সুষ্ঠু তদন্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচারের মুখোমুখি করা অতীব জরুরি। যে কোনো ধরনের দৃষ্টান্তমূলক বিচার প্রক্রিয়াই জনগণের মনে নিরাপত্তার আস্থা তৈরি করে নিরাপত্তার দায় সংক্রান্ত জটিলতার অবসান ঘটাতে পারে।
সুলতান মাহমুদ রানা : শিক্ষক
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
sultanmahmud.rana@gmail.com
ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ও এনকাউন্টারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা ছাড়াও অপহরণ ও গুমের কিছু ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে খোদ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানও অভিযোগ তুলেছিলেন। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা এখনও রহস্যে ঘেরা। বিএনপির পক্ষ থেকে ওই ঘটনার জন্য সরকারকে দায়ী করা হয়েছে। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া এবং শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম গুম ও খুন হওয়ার ঘটনা দেশ ছাপিয়ে বহির্বিশ্বেও ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। বস্তুত গত দুই বছরে দেশব্যাপী অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যার যেসব ঘটনা ঘটেছে, অনেক ক্ষেত্রেই তার শিকার হয়েছেন বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা। মূলত এ কারণেই অভিযোগের আঙুল উঠছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে। এটি সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। বাড়িয়ে দিচ্ছে জনগণের আস্থাহীনতা।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে রফিকুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড কে বা কারা ঘটিয়েছে তা নিঃসন্দেহে তদন্তসাপেক্ষ বিষয়। এ ঘটনাকে নিছক রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত বলে উড়িয়ে না দিয়ে তা যত দ্রুত সম্ভব যথাযথ তদন্ত করে দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরই। যদি তা করা সম্ভব না হয় তাহলে এমন ধরনের হত্যাকাণ্ড যে বহু পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে তা নিদ্বর্িধায় বলা যায়। কোনো সন্ত্রাসীর আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা বা সাহস যেমন সাধারণ মানুষের রয়েছে যথেষ্ট, তেমনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের রয়েছে শ্রদ্ধা। কাজেই যখন কোনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লেবাস ধরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়, তখন তা প্রতিহত করার হাতিয়ার মানুষের কাছে থাকে না। এমন কায়দায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে হত্যাকাণ্ডের মতো সহিংসতা ঘটতে থাকলে তা সাধারণ মানুষের কাছে নিরাপত্তাহীনতার চরম রূপের সৃষ্টি হবে। এ হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে বিবেচনা না করে একটি নিরপেক্ষ তদন্তসাপেক্ষে প্রকৃত দোষীদের বিচারের আওতায় আনা দরকার।
একের পর এক রহস্যময় হত্যা, গুম, অপহরণ এবং বিশ্বজিতের মতো পথচারীর নির্মম হত্যা সাধারণ জনগণকে অনেকাংশে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। পুলিশ কিংবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী যে কোনো বাহিনীকে যখন কোনো নির্মম হত্যাকাণ্ডকে দর্শকের ভূমিকায় উপভোগ করতে দেখা যায়, তখন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার আস্থার জায়গাটি অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে যায়।
জনগণের নিরাপত্তার জন্য যে বাহিনী গঠিত সেই বাহিনীর পোশাক এবং হ্যান্ডকাফ যদি হয় জীবনের প্রতি হুমকি, তাহলে অবশ্যই জাতির নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। রফিকুল ইসলামের হাতকড়া পরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত দোষীদের যত দ্রুত সম্ভব খুঁজে বের করে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে জনগণের মনে নিরাপত্তা রক্ষার প্রকৃত আস্থার জায়গাটি ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অপহরণ, হত্যা, গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাস, সহিংসতা ও যে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই সজাগ ও সতর্ক থাকা উচিত। শুধু কোনো নেতা বা কর্মীর হত্যাকাণ্ডকে বিশেষ বিবেচনায় না এনে গোটা জাতির যে কোনো সাধারণ মানুষের হত্যাকাণ্ডকে সুষ্ঠু তদন্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচারের মুখোমুখি করা অতীব জরুরি। যে কোনো ধরনের দৃষ্টান্তমূলক বিচার প্রক্রিয়াই জনগণের মনে নিরাপত্তার আস্থা তৈরি করে নিরাপত্তার দায় সংক্রান্ত জটিলতার অবসান ঘটাতে পারে।
সুলতান মাহমুদ রানা : শিক্ষক
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
sultanmahmud.rana@gmail.com
No comments