একটি মহাকাব্যের শেষ অধ্যায় by আবদুল মান্নান
২০০৯-এর ১৯ নবেম্বর দেশে এবং দেশের বাইরে সকল বাঙালী, বিশেষ করে যারা বাংলাদেশের নাগরিক বেলা বারোটা অবধি থমকে ছিল। কারণ বাংলাদেশের সবের্্বাচ্চ আদালতে একটি মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হবে।
এই রায়টির জন্য এই মানুষগুলো অধীর আগ্রহ নিয়ে দীর্ঘ ৩৪ বছর অপো করেছে। ঠিক একইভাবে এই মানুষগুলো ২৭ জানুয়ারি ২০১০ সালে দিবাগত রাতে এক স্বাভাবিক উত্তেজনাকর অবস্থার মধ্যে একই আগ্রহ নিয়ে অপো করেছে ১৯ নবেম্বরের চূড়ান্ত রায়টি বাস্তবায়নের সংবাদ শোনার জন্য। কাব্যিক ভাষায় বললে বলতে হয়, আজ রাতে একটি মহাকাব্যের শেষ অধ্যায় রচিত হবে। তার খবর শোনার জন্য দেশের কোটি কোটি মানুষ নিঘর্ুম রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রস্তুতি দীর্ঘ ৩৪ বছরের শেষ হতে এক ঘণ্টা। একইভাবে আগ্রহভরে অপো করছে সারাবিশ্বে ছড়ানো ছিটানো লাখ লাখ বাঙালী। আজ রাতে ৩৪ বছর আগে সংঘটিত এক ভয়ঙ্কর অপরাধের দায়ে দণ্ডিত পাঁচ জন অপরাধীর মৃতু্যদণ্ড কার্যকর করা হবে। এই পাঁচ জন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারের হত্যা করেছিল। এরা শুধু একজন ব্যক্তি বা কয়েকটি পরিবারকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত নয়, এরা একটা দেশ একটা জাতিকে হত্যাচেষ্টার সাথে জড়িত ছিল। এরা ইতিহাসের ঘৃণ্য খলনায়ক। ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে এই পাঁচজনের ফাঁসির রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে সত্যি সত্যি একটি মহাকাব্যের শেষ অধ্যায় রচনার সমাপ্তি ঘটল।কখন হয়েছিল এই মহাকাব্যের রচনা শুরু এ নিয়ে মতভেদ থাকতেই পারে। শুরুটা কি ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, যখন ফরিদপুর জেলার নিভৃত টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ লুৎফর রহমান আর সায়েরা খাতুনের ঘরে এক ফুটফুটে শিশুর জন্ম হয়েছিল যার নাম বাবা-মা আদর করে রেখেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান তখন থেকে? নাকি তিনি যখন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়া অবস্থায় নেতাজি সুভাষ বোসের আহ্বানে হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙ্গার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তখন থেকে? কেউ কেউ বলবেন এই মহাকাব্যের শুরুটা হোক ১৯৪৭ সাল থেকে যখন তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের জন্ম দিলেন তখন থেকে। কেউ বলবেন_ না, তাহলে মহাকাব্যটা কলেবরে অনেক বড় হয়ে যাবে। যাঁরা মহানায়কদের মহাকাব্য পড়তে অভ্যস্থ তাঁরা বলতেই পারেন বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ট মহানায়ক যখন একটি মহাকাব্যের নায়ক সেই মহাকাব্য তো কলেবরে বড় হবেই। যখন থেকেই সেই মহাকাব্যের শুরুটা হোক না কেন, তাতে যে কয়টি অধ্যায়ই থাকুক না কেন অবশ্যই তাতে থাকতে হবে সেই মহানায়কের দীর্ঘ সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের কথা; ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বছরের পর বছর কারা অন্তরালে কাটানোর কথা; একাধিকবার মৃতু্যর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তাঁর ল্যে অবিচল থাকার কথা। সব শেষে একটি স্বাধীন দেশের স্থপতি, একটি জাতির জনক হয়ে ওঠার কথা। শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবের সাথে বিশ্ব ইতিহাসের অন্য যে কম্বজনের নাম উচ্চারিত হতে পারে তাদের মধ্যে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, চীনের মাও সে তুং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, দণি আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা অথবা আলজিরিয়ার আহমেদ বেন বেল্লা আর কিউবার ফিডেল ক্যাস্ট্রো। এই একজন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাঙালী একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। সেই জনককে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করেছিল একদল তস্কর, যাদেরকে পরবতর্ীকালে এই হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগীরা নাম দিয়েছিল সূর্য সন্তান।
গত দুম্বশম্ব বছরের বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে। কিন্তু নানা কারণে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ছিল অনেকটা অভূতপূর্ব। এর সাথে জড়িত ছিল এক দল সেনা কর্মকর্তা। তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তারা পূর্বেই অবহিত করেছিল সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াকে। তার উচিত ছিল সে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে অবহিত করা। তা তো তিনি করেনই নাই, তার বদলে তিনি প্রত্য ও পরোভাবে এই ষড়যন্ত্রে সায় দিয়েছিলেন। ষড়যন্ত্রকারীরা আস্থার মধ্যে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আস্থাভাজন সহকমর্ী খোন্দকার মোশতাককে। তাদের পুরো ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সহায়তা করেছিল বহিশক্তি যুক্তরাষ্ট্র আর পাকিস্তান। ঘাতকদের আশ্রয় দিয়েছিল আফ্রিকার দেশ লিবিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে তাদের প্রথম আশ্রয়স্থল ছিল থাইল্যান্ড। কোন একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে এত ব্যক্তি, দেশ, গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা নজিরবিহীন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনকে হত্যা করেছিল বীল পুথ। পুথ একাই এই কাজটি করেছিল, যদিও এই হত্যা কাণ্ডের সঙ্গে সেই দেশের কিছু ব্যক্তি জড়িত ছিল বলে প্রমাণিত। কেনেডিকে লি হারবে ওসওয়াল্ড হত্যা করেছিল। এই হত্যাকাণ্ডের জট এখনও পুরোপুরি খোলেনি। ভারতের মহান নেতা গান্ধীকে নাথুরাম গডসে হত্যা করেছিল। এই হত্যা-ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আরএসএস-এর কিছু নেতাকমর্ী জড়িত ছিল। এর বাইরে আর কিছুর প্রমাণ নেই। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকাত আলী খানকে আফগান যুবক সৈয়দ আকবর গুলি করে হত্যা করেছিল। সে ছাড়া অন্য কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। এ সবের বিচারে বঙ্গবন্ধু আর তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ড অনেকটা নজিরবিহীন।
উপরে উলি্লখিত হত্যাকাণ্ডের হোতাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করার কোন নজির নেই। আর আইন করে হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয়া তো সভ্যতার ইতিহাসে একটি অকল্পনীয় বিষয় যা বাংলাদেশে ঘটেছিল। বীল পুথ লিংকনকে হত্যা করে পালিয়ে গিয়েছিল। পরবতর্ীকালে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। নাথুরাম গডসেকে বিচারের মাধ্যমে মৃতু্যদণ্ড দেয়া হয়েছিল। ওসওয়াল্ডকে আর একজন ঘাতক জ্যাক রুবি হত্যা করেছিল। আকবর পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল। আর বঙ্গবন্ধুর ঘাতকেরা? প্রথমে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর খোন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয় এবং ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে হত্যাকারীদের ১৯৭৫-এর ২৬ সেপ্টেম্বর সকল হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে মুক্তি দিয়ে এক বিরল নজির সৃষ্টি করে। পরবতর্ীকালে মেজর জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রমতা দখল করে এই ঘাতকদের বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে কূটনীতিকের চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন। সেই জিয়া ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি সংবিধানে অন্তভর্ুক্ত করে হত্যাকারীদের বিচারের পথ চিরতরে রুদ্ধ করার ব্যবস্থা করেন। অন্য কোন দেশে কখন ও একজন রাষ্ট্রপতি অথবা রাজনৈতিক ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডের দায়ে ুুুুুু১ অভিযুক্তদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সহায়তা বা পৃষ্ঠপোষকতা করার নজির নেই। বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি। জেনারেল জিয়ার উত্তরসূরি জেনারেল এরশাদ বঙ্গবন্ধুর ঘাতক কর্নেল ফারুককে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজনৈতিক দল খোলার ব্যবস্থা করে দিয়েই ান্ত হননি, তাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছেন। তাঁর উত্তরসূরি বেগম জিয়া আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে কর্নেল রশিদ আর বজলুল হুদাকে সংসদ সদস্য হওয়ার ব্যবস্থা করেন। ঘাতকদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা পাওয়ায় এই বিরল ঘটনা ছিল এই মহাকাব্যের এক কালো অধ্যায়।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার দল মতায় আসার পর তাদের সামনে সব চাইতে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সংবিধান থেকে ইনডেমনিটি আইনটি রহিত করে ঘাতকদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো। তা মোটেও সহজ ছিল না। তাদের সামনে বড় বিরোধী দল বিএনপি আর জামায়াত দুই দলই বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগী। যেদিন সংসদে এই কালো আইন রহিতকরণ বিলটি পাস হয় সেদিন তারা সংসদে অনুপস্থিত থাকে। ১৯৯৬-এর ১২ নবেম্বর জাতীয় সংসদে এই আইনটি বাতিল হলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা আদালতে ওঠে। অনেকের দাবি ছিল, বিচারকার্যটি বিশেষ আদালতে হওয়া উচিত। বিশেষ আদালতের বিচারকার্যের স্বচ্ছতা নিয়ে সব সময় প্রশ্ন থাকে। নিয়মিত আদালতে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যবস্থা করে সরকার এক অনুকরণযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। মামলার রায় ঘোষণা করা হয় ১৯৯৮ সালের ৮ নবেম্বর। মহাকাব্যের একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি টানা হয় যখন আদালত সা্য প্রমাণের ভিত্তিতে পনেরো জনের মৃতু্যদণ্ড ঘোষণা করে।
আইনের প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে দণ্ডপ্রাপ্তরা উচ্চ আদালতে আপিল করলে শুরু হয় মহাকাব্যের নতুন অধ্যায়। সেই অধ্যায়ের অন্যতম হচ্ছে বিচারকদের এই মামলা শোনার েেত্র বিব্রতবোধ করার পালা। সর্বমোট আটজন বিচারপতি এই মামলা শুনতে বিব্রত বোধ করেছিলেন। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন_ কোন বোধগম্য কারণ ছাড়াই যদি উচ্চ আদালতের বিচারকরা বিব্রত বোধ করেন তাহলে তাঁরা কেন বিচারপতি?
২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে মনে হয়েছিল এই মহাকাব্য বুঝি এখানেই অসমাপ্ত অবস্থায় পরিত্যক্ত হবে। জামায়াত-বিএনপি জোট এই মহাকাব্য শেষ করার কোন পদপেই যে নেবে না তা তো অনেকটা পরিষ্কারই ছিল। আদালতের বিচারকের অপ্রতুলতা। একজন এডহক বিচারপতি নিয়োগ দিলে মহাকাব্য শেষ হয়ে আসবে। আইনমন্ত্রী ব্যরিস্টার মওদুদ বলেন এই মহাকাব্য শেষ করার কোন দায়বদ্ধতা সরকারের নেই। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। আইন আর নিজস্ব গতিতে চলল না। চলল ব্যরিস্টার মওদুদ ও তার সরকারের ইচ্ছায়। ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে এই মহাকাব্যের সমাপ্তি পর্ব শুরু হয়।
গত ১৯ নবেম্বর আপিল বিভাগ নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখে। দণ্ডপ্রাপ্ত বারজনকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হবে। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। পাপ বাপকেও ছাড়ে না। বিচার বিলম্বিত হয়েছে। পনেরো আগস্টের হত্যাকাণ্ডের দায় কাঁধে নিয়ে জাতি দীর্ঘ ৩৪ বছর বিচারের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। ঘাতকদের ঔদ্ধত্য হজম করেছে। নানাভাবে অপমানিত হয়েছে। জাতি ধৈর্য ধরেছে। অবশেষে ২৭ জানুয়ারি রাতে সে অপোর সমাপ্তি হয়েছে। সাজাপ্রাপ্ত বারোজনের মধ্যে পাঁচজনের মৃতু্যদণ্ড কার্যকর হয়েছে। সাধারণত যে কোন মৃতু্যতেই মানুষ ব্যথিত হয়। এদিন একটি নয়, পাঁচটি মৃতু্যতে মানুষ উল্লসিত হয়েছে। অসংখ্য মানুষ নফল নামাজ পড়েছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকরানা আদায় করেছে। বলেছে, দীর্ঘ ৩৪ বছর পর জাতি কলঙ্ক ও অভিশাপমুক্ত হয়েছে। প্রার্থনা করেছে, এমন ঘটনা শুধু বাংলাদেশে কেন কোন সভ্য দেশেই যেন কখনও না ঘটে। এমনিভাবে যে মহাকাব্যের রচনা ১৯২০ সালে অথবা ১৯৪৭ সালে বা ১৯৭৫-এ শুরু হয়েছিল তার পরিসমাপ্তি হলো ২৮ জানুয়ারি ২০১০ এ। আগামী দিনে কেউ যদি সত্যি সত্যি এই মহাকাব্য লেখেন, নিঃসন্দেহে বলা চলে তার শেষ অধ্যায়টি কলেবরে অনেক বড় হবে। একাত্তরের ঘাতকদের বিচারকার্য শুরু করে আর একটি মহাকাব্য রচনা শুরু হোক।
লেখক : শিাবিদ
No comments