অসাম্প্রদায়িকতা গণতন্ত্র মানবাধিকার আইনের প্রতীক- বিনোদবিহারী জন্মশত বার্ষিকী অনুষ্ঠান
এ জীবন মধুময়/মধুময় পৃথিবীর ধূলি/অনত্মরে নিয়েছি আমি তুলি/এই মহামন্ত্রখানি/চরিতার্থ জীবনের বাণী'- নিজের শততম জন্মদিনে এই চয়নটি লিখেছেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসের জীবনত্ম সাৰী বিপস্নবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী।
প্রকৃতি-দুহিতা চট্টগ্রামের সমুদ্রের বিসত্মার, পাহাড়ের অটল দৃঢ়তা আর বনাঞ্চলের সজীব প্রাণময়তার গুণাবলী ধারণ করে বেড়ে ওঠা এই কালোত্তীর্ণ মহীরম্নহকে রাজধানী ঢাকাতেও সংবর্ধনা দেয়া হলো গত শুক্রবার। তারই ধারাবাহিকতায় বিপস্নবী বিনোদ বিহারী জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন পরিষদ, ঢাকা শনিবার শিল্পকলা একাডেমীতে আয়োজন করেছিল আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। প্রদীপ প্রজ্বলন করে এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বিপস্নবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। এ সময় তাঁর পাশে ছিলেন বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের আরেক কিংবদনত্মি ভাষা মতিন। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন আয়োজক পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এই মহান বিপস্নবীর বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে আলোচনা করেন অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক, কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক কামাল লোহানী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, ম. হামিদ, শব্দ সৈনিক বেলাল মোহাম্মদ, মুক্তিযুদ্ধের পরম বন্ধু ব্রিটিশ অধ্যাপক এলেন ডি উইলিয়াম, ভারত থেকে আগত ড. তপতী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।উদীচীর শিল্পীদের গাওয়া আগুনের পরশ মণি ছোঁয়াও প্রাণে...গানটির সঙ্গে সঙ্গে প্রদীপ প্রজ্বলন করে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বর্ষীয়ান বিপস্নবী বিনোদ বিহারী। এই বিপস্নবীর দুর্মম জীবন কাহিনী নিয়ে লেখা পটের গান পরিবেশন করে রূপানত্মরের শিল্পীরা। তারপর শুরম্ন হয় আলোচনা। তবে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে এই বিপস্নবীকে ফুলসহ নানা সামগ্রী দিয়ে শুভেচ্ছা জানায় বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি। এতে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায় শিল্পকলা একাডেমী, মিডিয়া বক্স ও বিনোদ বিহারীর প্রতিকৃতি এঁকে উপহার দেন শিল্পী কৃটি রঞ্জন বিশ্বাস।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, এই ছোটখাটো বিপস্নবী মানুষটির দীর্ঘ সক্রিয় জীবনের মূলে রয়েছে তাঁর ঋজু চরিত্র। প্রথম যৌবনে মাস্টারদা সূর্যসেনের সহযাত্রীরূপে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে শামিল হয়ে অর্জন করেছেন আপন অঙ্গীকার ও কর্তব্যে অটল থাকার শিৰা। পরবর্তী জীবনে গান্ধীবাদী দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে ত্যাগ ও সেবার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছেন একই দৃঢ়তায়। এ কারণে তিনি হয়ে উঠেছেন স্পষ্টবাদী ও নিজের অবস্থানে বরাবর অবিচল। বক্তারা আরও বলেন, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের সূত্রে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের সব স্বাধীনতাকামী মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে তিনি এগিয়েছেন একই ধারাবাহিকতায়। বাংলাদেশের সব সঙ্কটে, বিপদে তিনি রয়েছেন সরব, সচল ও সক্রিয়। খ্যাতি, স্বীকৃতি, সাফল্য তাঁর ভেতরের অনাড়ম্বর সরল সত্তাকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। বসনে-ভূষণে, বচনে-আচরণে তিনি বিনোদ বিহারী- গলির কুটিরের হ্যাস্যোজ্জ্বল উষ্ণ হৃদয়ের ছোটখাটো সাধারণ মানুষ। বক্তারা আরও বলেন, তাঁর জীবনযাপন, জীবনযাত্রা, জীবন সংগ্রামে এখনও ছেদ পরেনি। নাগরিক পৰ থেকে এখনও আন্দোলনের আওয়াজ তুললে তাঁকে আমরা পাই। তাঁর এক শ' বছর হয়েছে এটা বড় কথা নয়, তিনি আমাদের জন্য হয়ে উঠেছেন রাজনৈতি-মানবিক জীবনের প্রতিকায়িত মানুষ। অর্থাৎ প্রতীক মানুষ। বীজ মানুষ। বীজ যেমন বংশ বিসত্মার করে, তেমনি তিনি হাজারো মানুষকে উজ্জীবিত করতে পারেন এবং করেও যাচ্ছেন। তাই বিনোদ আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে প্রণোদনার নাম, মানবাধিকারের নাম, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নাম।
তাই এই বিপস্নবীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে উদীচীর শিল্পীরা পরিবেশন করে কালজয়ী প্রতিবাদী গান। তাঁদের পরিবেশিত উলেস্নখযোগ্য গান হলো- আমি যুগে যুগে আসিয়াছি পুনঃ মহা বিপস্নব হেতু..., মানুষেরে ভালবাসি এই মোর অপরাধ..., মুক্তির মন্দির সোপান তলে..., বান এসেছে মরা গাঙে খুলতে হবে নাও..., আমাদের নানান মতে নানান দলে দলাদলি..., নাম তাঁর ছিল জন হেনরী..., হে মহামানব একবার এসো ফিরে... প্রভৃতি গান। শেষে বিনোদ বিহারীর জীবন নিয়ে তৈরি প্রামাণ্যচিত্র অগি্নপুরম্নষ প্রর্দশিত হয়।
No comments