ব্যাংক ঋণ অবলোপন প্রসঙ্গ by এম এ খালেক
ক'দিন আগে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থাকে একীভূত করে নবগঠিত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)-এর কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
অনুষ্ঠানে জানানো হয় যে, নতুন এই ব্যাংকটি ওপর ৪০০টি অবলোপনকৃত প্রকল্পের দায় বর্তাবে যাদের নিকট পাওনা ঋণের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত একটি শীর্ষস্থানীয় ইংরেজী জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক কিছুটা বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চান, যে প্রকল্প অবলোপন করা হয়েছে তাদের নিকট আবার ব্যাংকের পাওনা থাকে কিভাবে? আসলে তিনি ঋণ অবলোপন এবং ঋণ মওকুফ শব্দ দু'টি গুলিয়ে ফেলেছেন। আর এ কারণেই এমনটি হয়েছে। এতে তার কোন দোষ দেয়া যাবে না। কারণ ঋণ অবলোপন সংক্রানত্ম আইনটি আমাদের দেশে বেশ ক'বছর আগে প্রণীত হলেও প্রচারণার অভাবে তা এখনও অস্পষ্ট রয়ে গেছে। অনেকেই অজ্ঞতাবশত মনে করেন, ঋণ অবলোপন এবং ঋণ মওকুফ একই বিষয়। আমাদের দেশের প্রেেিত ঋণ অবলোপন খুব একটা প্রচলিত ধারণা নয়। তাই এ নিয়ে বিসত্মারিত আলোচনার অবকাশ রয়েছে। ব্যাংকের খেলাপী ঋণ ব্যবস্থাপনার একটি অঙ্গ হচ্ছে ঋণ অবলোপন পদ্ধতি। ব্যাংক যে ঋণ আদায়ের আশা প্রায় পরিত্যাগ করে অর্থাৎ ধরে নেয় যে, ঋণটি আর কখনই আদায় হবে না সেই ঋণকে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে অবলোপন করা হয়। ঋণ অবলোপন কোনভাবেই ঋণ মওকুফের পর্যায়ে পড়ে না। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ঋণ মওকুফ করা হলে সেই ঋণের ওপর ব্যাংকের আর কোন দাবি থাকে না। কিন্তু যে ঋণ অবলোপন করা হয় তার ওপর থেকে ব্যাংকের দাবি কোনভাবেই পরিত্যক্ত হয় না। তাই এ দু'টি বিষয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান তা অনুধাবনযোগ্য। আসলে ব্যাংকগুলোর ঋণ হিসাব পরিষ্কার রাখার জন্যই অবলোপন নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। ব্যাংকের খেলাপী ঋণের পরিমাণ যাতে দৃশ্যমান না হয় মূলত সেটা নিশ্চিত করাই ঋণ অবলোপন নীতিমালার প্রকৃত উদ্দেশ্য। খেলাপী ঋণ আছে, ব্যাংক তা উদ্ধার করার চেষ্টা করছে কিন্তু তা জনসাধারণকে জানানো হচ্ছে না এটাই অবলোপন নীতিমালা। বিষয়টি একটি ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যেতে পারে। কোন ব্যক্তির তিন ছেলের মধ্যে একজন হয়ত পঙ্গু, চলতে অম। বাড়িতে কোন অত্মীয়স্বজন এলে দু'টি সনত্মানকে তাদের সামনে এনে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় কিন্তু তৃতীয় যে পঙ্গু ছেলে তাকে আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয় পারিবারিক সম্মানের কথা বিবেচনা করে। এতে পারিবারিক সম্মান কৃত্রিমভাবে রতি হলেও পঙ্গু ছেলেটি যেমন অসত্মিত্ববিহীন হয়ে যায় না, তেমনি ঋণ অবলোপন করা হলে লোন এ্যাকাউন্ট হয়ত কিন দেখানো যায় কিন্তু এতে খেলাপী ঋণ আদায়ের কোনো অগ্রগতি হয় না। কাজেই অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে ব্যর্থতার দায়ভার কোনভাবেই ব্যাংকগুলো এড়াতে পারে না।ব্যাংক ঋণ অবলোপন কোন ব্যতিক্রমী বা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। যথাযথ প্রভিশন সংরণের বিপরীতে ঋণ অবলোপন আনত্মর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও প্রচলিত একটি পদ্ধতি। বিশ্বের অনেক দেশই এই পদ্ধতি অনুসরণ করে তাদের লোন এ্যাকাউন্ট কিন রাখছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো এই পদ্ধতি অনুসরণে তেমন কোন আগ্রহ প্রদর্শন করেনি। অবলোপনের পরও সংশিস্নষ্ট ঋণের ওপর ব্যাংকের দাবি বহাল রাখার উদ্দেশ্যে ২০০১ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এ ধারা ২৮ 'ক' সনি্নবেশ করে আদায় বিষয়ক সম্ভাব্য আইনী জটিলতা নিরসন করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সালের ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক হতে ঋণ অবলোপন নীতিমালা ঘোষণা করা হয়। উক্ত আইনের 'ঋণ অবলোপন প্রক্রিয়া ধারা (১)-এ বলা হয়েছে, মন্দ/তি হিসেবে শ্রেণীকৃত হয়েছে এমন ঋণ ও অগ্রিম ব্যাংকসমূহ যে কোন সময় অবলোপন করতে পারে। মন্দ/তি হিসেবে শ্রেণীকৃত হবার পর ইতোমধ্যেই পাঁচ বছর অতিক্রানত্ম হয়েছে এবং ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরতি রয়েছে এরূপ ঋণ হিসাবসমূহ অবিলম্বে অবলোপন করতে হবে। অর্থাৎ কোন ঋণ হিসেব মন্দ ঋণ হিসেবে শ্রেণীবিন্যাসিত হবার পর ৫ বছর অতিক্রানত্ম হলে এবং সেই ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরতি থাকলে তা অবলোপন করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় কালানুক্রমিকভাবে অধিক পুরনো মন্দ ঋণ হিসেবগুলোকে আগে অবলোপন করতে হবে। ঋণ হিসেব অবলোপনযোগ্য কিন্তু শতভাগ প্রভিশন সংরতি নেই এমন েেত্র চলতি বছরের আয় খাত বিকলন করে ঋণ অবলোপন করা যেতে পারে। ৩নং ধরায় বলা হয়েছে, অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। অবলোপনের জন্য নির্বাচিত ঋণ হিসাবসমূহের েেত্র কোন কারণে পূর্বে আইনগত ব্যবস্থা গৃহীত হয়ে না থাকলে অবলোপনের আগে অবশ্যই আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। এ ছাড়া অবলোপনকৃত ঋণের হিসেব একটি আলাদা লেজারে সংরণ করতে হবে। অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের জন্য প্রয়োজন হলে ব্যাংক বহিভর্ূত কোন ঋণ আদায়কারী সংস্থাকে দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। ঋণ হিসেব অবলোপন করা হলেও সংশিস্নষ্ট ঋণ গ্রহীতা ঋণখেলাপী হিসেবে চিহ্নিত হবেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন বু্যরোতে তাদের তথ্য পাঠাতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক হতে ২০০৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর জারিকৃত অন্য এক সার্কুলারে অবলোপনের আগে আদালতে মামলা দায়েরের শর্ত শিথিল করা হয়। এতে বলা হয়, কেস টু কেসভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন গ্রহণসাপে েআদালতে মামলা দায়েরের আগেও ঋণ অবলোপন করা যাবে। তবে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে। কোন ঋণ হিসেব অবলোপনের আগে আদালতে মামলা দায়েরের শর্ত শিথিল করার ফলে ঋণ আদায় প্রক্রিয়া আরও কিছু প্রলম্বিত হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ঋণ অবলোপনকে মূলত ব্যাংকিং সেক্টরের ঋণ হিসেবকে কিন দেখানোর একটি প্রচেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। কেউ যদি ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপী ঋণ সংক্রানত্ম তথ্য জানতে চান তাহলে তাকে জানানো হবে, বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপী ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ২৪ বা ২৫ হাজার কোটি টাকা। এটা প্রকৃত খেলাপী ঋণের চিত্র নয়। কারণ এর সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অবলোপনকৃত ঋণের হিসেব প্রদর্শন করা হয়নি। উলেস্নখ্য, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে গত কয়েক বছরে মোট ১৬ হাজার কোটি টাকা খেলাপী ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এর মধ্যে গত তিন বছরেই অবলোপন করা হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। মোট খেলাপী ঋণের মধ্যে যে ১৬ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে তার মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণ অবলোপন করেছে। তাদের অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ৬৫৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। ৩০টি স্থানীয় বেসরকারী ব্যাংক ৫ হাজার ৬৩৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ঋণ অবলোপন করে। বিশেষায়িত ৫টি ব্যাংক ৩ হাজার ১৭৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ঋণ অবলোপন করে। বিদেশি ৯টি ব্যাংক অবশিষ্ট ঋণ অবলোপন করে। কাজেই অবলোপনকৃত ঋণের অঙ্ক একত্রিত করে দেখানো হলে মোট খেলাপী ঋণের পরিমাণ কত টাকায় উন্নীত হবে তা সহজেই অনুমেয়।
ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান পর্বত প্রমাণ খেলাপী ঋণ আদায়ের বাসত্মবধর্মী এবং কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা একানত্ম জরম্নরী হয়ে পড়েছে। বর্তমানে দেশে ঋণ অবলোপনের জন্য যে নীতিমালা রয়েছে তা খেলাপী ঋণ আদায়ের জন্য কতটা কার্যকর বিবেচনার দাবি রাখে বটে। অবলোপনের মাধ্যমে সেই পঙ্গু ছেলেকে পর্দার আড়ালে রাখা যেতে পারলেও তাকে যেমন অসত্মিত্ববিহীন করা যায় না অবলোপন নীতিমালা ঠিক তেমনটিই করছে। অবলোপনের মাধ্যমে ব্যাংক হয়ত তার মূল লেজারে খেলাপী ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখাতে পারছে কিন্তু তাতে ঋণ আদায়ের েেত্র কোন সাফল্য অর্জিত হচ্ছে না। খেলাপী ঋণ আদায় করতে হলে আমাদের কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। উলেস্নখ্য, আমাদের দেশে দু'ধরনের ঋণ খেলাপী দেখতে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে একটি শ্রেণী রয়েছেন যারা নানা প্রতিকূলতার কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক ফেরত দিতে পারছেন না। এরা প্রকৃত ঋণ খেলাপী। এরা সব দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পাবার যোগ্য। এদের আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান করে তোলার জন্য উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। আর একটি শ্রেণী রয়েছেন যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছে করেই ব্যাংক ঋণ আটকে রাখেন। এরা হচ্ছেন ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপী। এরা ভয়ঙ্কর এবং এরাই সমাজের শত্রম্ন হিসেবে চিহ্নিত হবার দাবি রাখেন। এদের মতো ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপীদের কোন ধরনের ছাড় দেয়া উচিত নয়। একটি কথা প্রচলিত আছে, আমাদের দেশে ঋণ গ্রহণ করতেও যেমন মতা (আর্থিক অথবা রাজনৈতিক) লাগে। আবার ঋণ খেলাপী হতেও মতা লাগে। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপীদের নিকট থেকে ঋণ আদায়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঋণ অবলোপন নীতিমালা ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপী ঋণ আদায়ে কোন ইতিবাচক অবদান রাখতে পারছে না। বরং এই নীতিমালা আদায় প্রক্রিয়াকে কিছুটা হলেও দুর্বল করে দিয়েছে। তাই ঋণ অবলোপন আইনটি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। অবলোপনকৃত প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে ঋণ আদায়ের পরিমাণ খুবই সামান্য। ঋণ অবলোপন নীতিমালায় বাইরের প্রতিষ্ঠান দিয়ে ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করার বিষয়ে উৎসাহিত করা হয়েছে। এটি ঋণ আদায়ের েেত্র একটি ভাল পদপে হতে পারে। আমাদের দেশে বিগত কয়েক বছর ধরে কোন কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের খেলাপী ঋণ আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এদের সাফল্য উলেস্নখ করার মতো নয়। নানা ধরনের প্রতিকূলতার কারণে এরা কাঙ্ৰিত মাত্রায় সাফল্য পাচ্ছে না। বেসরকারী ঋণ আদায়কারী সংস্থাগুলোকে অধিকতর কার্যকর করতে হলে এদের আইনী মতা প্রদান করা দরকার। প্রয়োজনে তারা যাতে তাৎণিকভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা পেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
No comments