ইউরোপের চিঠি-জার্মানির পরমাণুশক্তি ত্যাগ পথ দেখাবে বিশ্বকে by পিটার কাস্টার্স
সিদ্ধান্তটি প্রত্যাশিতই ছিল। তবু তা বিশ্বের পরমাণু এস্টাবলিশমেন্টকে নাড়িয়ে দিয়েছে। জাপানের ফুকুশিমা-দাইচি পারমাণবিক কেন্দ্রে বিপর্যয়ের আড়াই মাস পর গত ২৯ মে অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের নেতৃত্বাধীন জার্মানির ডানপন্থী সরকার দেশটির পরমাণু-যুগের অবসানের ঘোষণা দিয়েছে।
যদিও এখন পর্যন্ত দেশটির বিদ্যুতের চাহিদার ২৭ শতাংশ আসে পারমাণবিক জ্বালানি থেকে, তবু আগামী ১১ বছরে পারমাণবিক জ্বালানিনির্ভরতা পুরোপুরি শেষ হবে। জাপান বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যমান ১৭টি চুল্লির মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো সাতটিসহ আটটির কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। এখন মেরকেল জার্মানির জ্বালানি করপোরেশনগুলোর বিরোধিতা সত্ত্বেও ঘোষণা দিলেন, বাকি সব পারমাণবিক কেন্দ্রও বন্ধ করে দেওয়া হবে ২০২২ সালের মধ্যে। জার্মানির নীতিগত জায়গায় এটা বড় মোড় পরিবর্তন। কেননা, মেরকেলের সরকারের পূর্ববর্তী পরিকল্পনা ছিল পরমাণু জ্বালানিনির্ভরতা বাড়ানো। জার্মান সরকারের সমালোচকেরা বলছেন, মেরকেল জনতার চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছেন মাত্র। সুবিধাবাদী জ্বালানিনীতির বিরুদ্ধে জনতার আন্দোলনের ফলেই যে সরকারের এই মোড় পরিবর্তন ঘটেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সময় জার্মান নগরে পরমাণু জ্বালানিনির্ভরতা অব্যাহত রাখার বিরুদ্ধে বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। আঞ্চলিক নির্বাচনে বরাবরের মতো পরমাণু জ্বালানির পথ পরিত্যাগের জন্য প্রচারণা চালিয়ে গ্রিন পার্টি প্রধান বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হয়। মেরকেলদের হটানোর মধ্যে জনগণের ইচ্ছাই প্রতিফলিত হয়।
জার্মানির এ সিদ্ধান্তের আন্তর্জাতিক তাৎপর্য কী? শুরুতেই বলা ভালো, পরমাণুনির্ভরতা পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত শুধু জার্মানি একাই নেয়নি, এই প্রবণতা ইউরোপজুড়ে না হলেও কিছু অংশের ক্ষেত্রে অন্তত ঘটেছে। পশ্চিম ইউরোপের কমপক্ষে আরও দুটি দেশ জনমতের চাপে একই রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুইজারল্যান্ড নতুন পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছিল, এখন তা আনুষ্ঠানিকভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। ইতালিতে পরমাণু জ্বালানিবিরোধী মনোভাবের নাটকীয় পুনর্জাগরণ ঘটতে দেখছে বেরলুসকোনির ডানপন্থী সরকার। ২০০৮ সালে বেরলুসকোনি সরকার চারটি নতুন পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর পরমাণু কর্মসূচি মুলতবি রাখার অবস্থান থেকে সরে গিয়ে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তথাপি গত মে মাসে বেরলুসকোনি সরকার নতুন পারমাণবিক স্থাপনা তৈরির কাজ স্থগিত করে। নাজুক অবস্থায় থাকা সরকার পরমাণু উৎপাদন শুরু করার মতো পরিস্থিতিতে নেই। কেননা, ১৫ জুন পরমাণু উৎপাদনসহ বেশ কতগুলো বিষয়ে একযোগে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। খবর অনুযায়ী, ৯৪ থেকে ৯৬ শতাংশ ভোটার নতুন চুল্লি নির্মাণের বিপক্ষে মত দিয়েছেন। যদিও ভোটার উপস্থিতি ছিলেন ৫৭ শতাংশ; তবু নির্বাচনের ফলাফল বেরলুসকোনি সরকারের প্রতি শক্ত আঘাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পুরো পশ্চিম ইউরোপে জনগণের যে মনোভাব ক্রিয়াশীল, তারই এক নমুনা ইতালির নির্বাচনী ফল। এই মনোভাবটি হলো, পরমাণু উৎপাদনের দিন শেষ।
জার্মানি কীভাবে তার জ্বালানির রূপান্তর ঘটাচ্ছে, তা লক্ষণীয়। মেরকেলের সিদ্ধান্তটি আসলে দীর্ঘকালীন ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল, যে প্রক্রিয়ার শুরু নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। ২০ বছর আগে জার্মানির অভিজাত রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের একাংশ বুঝতে পেরেছিলেন, পরমাণু উৎপাদন ও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণের প্রয়োজন। উত্তরণের অভিমুখ ছিল জলবিদ্যুৎ, বায়ুকল ও সৌর প্যানেলের মতো জ্বালানির ‘বিকল্প’ উৎসমুখী। জার্মান সরকার ১৯৯১ সালে একটি আইন পাস করে। এতে বলা হয়, যেসব কোম্পানি জার্মান ভোক্তাদের জ্বালানির জোগান দেয়, সেসব কোম্পানিকে এখন জ্বালানির উৎস হিসেবে বায়ু ও সৌরশক্তি গ্রহণ করতে হবে এবং সেটা জীবাশ্ম জ্বালানির সমান হতে হবে। বিকল্প জ্বালানি জোগানদারকে কী দাম পরিশোধ করতে হবে, সেটাও সুনির্দিষ্ট করা আছে আইনটিতে। ২০০০ সালে আইনটির আরেকটু পরিমার্জন করা হয়। তখন দ্বিতীয় আরেকটি দলিল গৃহীত হয়। তাতে বিকল্প জ্বালানি সরবরাহকারীদের জন্য ২০ বছরের নিশ্চয়তা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। সমালোচকদের মতে, জার্মান আইনি ব্যবস্থায় কতগুলো জঘন্য ফাঁকফোকর আছে। জ্বালানি ভোক্তাদের মধ্যে করপোরেট খাত নয়, বরং সাধারণ জার্মানদেরই বিকল্প জ্বালানি-নিরাপত্তা ব্যয়ের হ্যাপা সামলাতে হয়। তবু জার্মানির আইনিকাঠামো তাৎপর্যপূর্ণভাবে উত্তরণকে সহজ করেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৯০ সালে যেখানে জার্মানির বিদ্যুতের ৩ দশমিক ১ শতাংশেরও কম আসত নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে, সেখানে ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ শতাংশ। তা ছাড়া বায়ুকল থেকে বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ সরবরাহ করে জার্মানি।
জার্মানি ও অন্যান্য দেশে পরমাণুশক্তির প্রস্তাবকেরা প্রবল আক্রমণাত্মক ভূমিকায় নেমেছেন। জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে চলমান বৈশ্বিক প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে মেরকেলের সিদ্ধান্তটির তাৎপর্য নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন। কাণ্ডজ্ঞান থেকে যে প্রশ্নটি বারবার উচ্চারিত হচ্ছে, পরমাণু উৎপাদনের ওপর আর নির্ভর না করলে জার্মানি তার বর্ধিষ্ণু জ্বালানির চাহিদা কীভাবে মেটাবে? জীবাশ্ম জ্বালানির বিরুদ্ধে পরমাণুশক্তিকে দাঁড় করিয়ে শোরগোল তোলার ক্ষেত্রে উদ্দীপনা দেবে পরমাণুশক্তি পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত—এ কথা ভালোভাবেই জানা থাকায় মেরকেল সরকার একটি নৈতিক কমিশন গঠন করেছে। কমিশনের কর্মকাণ্ড সন্দেহের অবকাশ সৃষ্টি করেছে। কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে সংগতি রেখে জার্মান সরকার কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমানো (১৯৯০ সালের পর্যায় থেকে ২০২০ সাল নাগাদ ৪০ শতাংশের নিচে রাখা) এবং বায়ুশক্তি উৎপাদনের দ্রুত বিস্তৃত করার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ রয়েছে। তবু স্বল্প মেয়াদে জার্মানি গ্যাস ও কয়লার মতো দূষণ সৃষ্টিকারী জ্বালানি উৎসের ওপর নির্ভর করে নতুন শক্তিকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে। এটা বৈপরীত্য। ইউরোপের ভাবী জ্বালানির চাহিদাবিষয়ক পুরো বিতর্কটা এখনো সীমাবদ্ধ হয়ে আছে এক অনাক্রম্য অনুমানের ওপর। অনুমানটি হলো, জ্বালানি উৎপাদনের সূচকগত প্রবৃদ্ধি চিরকাল ধরে বাড়তে থাকা উচিত। জরুরি ভিত্তিতে এ বিষয়েই প্রশ্ন তোলা দরকার। কেননা, পশ্চিমা ভোক্তাদের জ্বালানি ব্যবহারের ওপর কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করার ব্যাপারে সম্মত হওয়া গেলেই কেবল জলবায়ু বিপর্যয়, পরমাণু বিপর্যয় ও জলবায়ু-পরমাণু যৌথ বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব।
জার্মানির পরমাণু-যুগ অবসানের সিদ্ধান্ত সার্বিক প্রতিবেশগত দিক থেকে স্বাস্থ্যকর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সরকারের ম্যানহাটান প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপে পরমাণু খাতের প্রতিষ্ঠা। এর দ্বিগুণা নেতিবাচক তাৎপর্য পরেছিল। একদিকে মানবজাতি আণবিক বোমা অর্থাৎ গণবিধ্বংসী বোমার যুগে প্রবেশ করে, অন্যদিকে পরমাণু উৎপাদনের সূত্রপাত হয়—প্রথম সামরিক উদ্দেশ্যে, পরবর্তী সময়ে বেসামরিক উদ্দেশ্যে। এটা বৈশ্বিক প্রতিবেশগত বিপর্যয়ের সূচনা ঘোষণা করে অথবা ঘটতে শুরু করে। সেই সংকট আজ এত তীব্র হয়েছে যে তা প্রায় মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের দাবির কাছে জার্মান সরকারের নতিস্বীকার নতুন প্রবণতার সূচনা। এ কথা সত্য যে জার্মানি ‘সবুজ’ অর্থনীতি গড়ে তোলার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়নি, এখনো বহু দূরে। আরও সত্যি, বিকল্প জ্বালানিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে জার্মানির ব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত নয়। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে তা ‘কেইনসীয়’ এক উপাদানের অধিক কিছু নয়, আদতে তা অনেকটাই নয়া উদারপন্থী। আরও সত্যি, জার্মানিতে জ্বালানি-বিতর্কের মোড় ঘুরে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বায়ুকল ও সৌর প্যানেল দিয়ে শক্তি উৎপাদন করপোরেট-নিয়ন্ত্রিত হবে নাকি বিকেন্দ্রীভূত হবে, তা নিয়ে তর্ক হচ্ছে। তথাপি পশ্চিম ইউরোপের সরকারগুলোর পরমাণু ‘পুনর্জাগরণ’-এর চিন্তা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রভাব ফেলে পরমাণু উৎপাদনের বাইরের ক্ষেত্রেও। মানবজাতির একাংশ অবশেষে সচেতনভাবে পৃথিবীতে প্রাণের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক এক প্রযুক্তি প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত পথ দেখাচ্ছে, মানবজাতির জন্য একটি প্রতিবেশগত ভবিষ্যৎ সম্ভব।
‘লেইডেন দ্য নেদারল্যান্ডস’-এর ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব।
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক, বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ ও প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।
জার্মানির এ সিদ্ধান্তের আন্তর্জাতিক তাৎপর্য কী? শুরুতেই বলা ভালো, পরমাণুনির্ভরতা পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত শুধু জার্মানি একাই নেয়নি, এই প্রবণতা ইউরোপজুড়ে না হলেও কিছু অংশের ক্ষেত্রে অন্তত ঘটেছে। পশ্চিম ইউরোপের কমপক্ষে আরও দুটি দেশ জনমতের চাপে একই রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুইজারল্যান্ড নতুন পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছিল, এখন তা আনুষ্ঠানিকভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। ইতালিতে পরমাণু জ্বালানিবিরোধী মনোভাবের নাটকীয় পুনর্জাগরণ ঘটতে দেখছে বেরলুসকোনির ডানপন্থী সরকার। ২০০৮ সালে বেরলুসকোনি সরকার চারটি নতুন পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর পরমাণু কর্মসূচি মুলতবি রাখার অবস্থান থেকে সরে গিয়ে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তথাপি গত মে মাসে বেরলুসকোনি সরকার নতুন পারমাণবিক স্থাপনা তৈরির কাজ স্থগিত করে। নাজুক অবস্থায় থাকা সরকার পরমাণু উৎপাদন শুরু করার মতো পরিস্থিতিতে নেই। কেননা, ১৫ জুন পরমাণু উৎপাদনসহ বেশ কতগুলো বিষয়ে একযোগে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। খবর অনুযায়ী, ৯৪ থেকে ৯৬ শতাংশ ভোটার নতুন চুল্লি নির্মাণের বিপক্ষে মত দিয়েছেন। যদিও ভোটার উপস্থিতি ছিলেন ৫৭ শতাংশ; তবু নির্বাচনের ফলাফল বেরলুসকোনি সরকারের প্রতি শক্ত আঘাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পুরো পশ্চিম ইউরোপে জনগণের যে মনোভাব ক্রিয়াশীল, তারই এক নমুনা ইতালির নির্বাচনী ফল। এই মনোভাবটি হলো, পরমাণু উৎপাদনের দিন শেষ।
জার্মানি কীভাবে তার জ্বালানির রূপান্তর ঘটাচ্ছে, তা লক্ষণীয়। মেরকেলের সিদ্ধান্তটি আসলে দীর্ঘকালীন ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল, যে প্রক্রিয়ার শুরু নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। ২০ বছর আগে জার্মানির অভিজাত রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের একাংশ বুঝতে পেরেছিলেন, পরমাণু উৎপাদন ও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণের প্রয়োজন। উত্তরণের অভিমুখ ছিল জলবিদ্যুৎ, বায়ুকল ও সৌর প্যানেলের মতো জ্বালানির ‘বিকল্প’ উৎসমুখী। জার্মান সরকার ১৯৯১ সালে একটি আইন পাস করে। এতে বলা হয়, যেসব কোম্পানি জার্মান ভোক্তাদের জ্বালানির জোগান দেয়, সেসব কোম্পানিকে এখন জ্বালানির উৎস হিসেবে বায়ু ও সৌরশক্তি গ্রহণ করতে হবে এবং সেটা জীবাশ্ম জ্বালানির সমান হতে হবে। বিকল্প জ্বালানি জোগানদারকে কী দাম পরিশোধ করতে হবে, সেটাও সুনির্দিষ্ট করা আছে আইনটিতে। ২০০০ সালে আইনটির আরেকটু পরিমার্জন করা হয়। তখন দ্বিতীয় আরেকটি দলিল গৃহীত হয়। তাতে বিকল্প জ্বালানি সরবরাহকারীদের জন্য ২০ বছরের নিশ্চয়তা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। সমালোচকদের মতে, জার্মান আইনি ব্যবস্থায় কতগুলো জঘন্য ফাঁকফোকর আছে। জ্বালানি ভোক্তাদের মধ্যে করপোরেট খাত নয়, বরং সাধারণ জার্মানদেরই বিকল্প জ্বালানি-নিরাপত্তা ব্যয়ের হ্যাপা সামলাতে হয়। তবু জার্মানির আইনিকাঠামো তাৎপর্যপূর্ণভাবে উত্তরণকে সহজ করেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৯০ সালে যেখানে জার্মানির বিদ্যুতের ৩ দশমিক ১ শতাংশেরও কম আসত নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে, সেখানে ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ শতাংশ। তা ছাড়া বায়ুকল থেকে বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ সরবরাহ করে জার্মানি।
জার্মানি ও অন্যান্য দেশে পরমাণুশক্তির প্রস্তাবকেরা প্রবল আক্রমণাত্মক ভূমিকায় নেমেছেন। জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে চলমান বৈশ্বিক প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে মেরকেলের সিদ্ধান্তটির তাৎপর্য নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন। কাণ্ডজ্ঞান থেকে যে প্রশ্নটি বারবার উচ্চারিত হচ্ছে, পরমাণু উৎপাদনের ওপর আর নির্ভর না করলে জার্মানি তার বর্ধিষ্ণু জ্বালানির চাহিদা কীভাবে মেটাবে? জীবাশ্ম জ্বালানির বিরুদ্ধে পরমাণুশক্তিকে দাঁড় করিয়ে শোরগোল তোলার ক্ষেত্রে উদ্দীপনা দেবে পরমাণুশক্তি পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত—এ কথা ভালোভাবেই জানা থাকায় মেরকেল সরকার একটি নৈতিক কমিশন গঠন করেছে। কমিশনের কর্মকাণ্ড সন্দেহের অবকাশ সৃষ্টি করেছে। কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে সংগতি রেখে জার্মান সরকার কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমানো (১৯৯০ সালের পর্যায় থেকে ২০২০ সাল নাগাদ ৪০ শতাংশের নিচে রাখা) এবং বায়ুশক্তি উৎপাদনের দ্রুত বিস্তৃত করার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ রয়েছে। তবু স্বল্প মেয়াদে জার্মানি গ্যাস ও কয়লার মতো দূষণ সৃষ্টিকারী জ্বালানি উৎসের ওপর নির্ভর করে নতুন শক্তিকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে। এটা বৈপরীত্য। ইউরোপের ভাবী জ্বালানির চাহিদাবিষয়ক পুরো বিতর্কটা এখনো সীমাবদ্ধ হয়ে আছে এক অনাক্রম্য অনুমানের ওপর। অনুমানটি হলো, জ্বালানি উৎপাদনের সূচকগত প্রবৃদ্ধি চিরকাল ধরে বাড়তে থাকা উচিত। জরুরি ভিত্তিতে এ বিষয়েই প্রশ্ন তোলা দরকার। কেননা, পশ্চিমা ভোক্তাদের জ্বালানি ব্যবহারের ওপর কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করার ব্যাপারে সম্মত হওয়া গেলেই কেবল জলবায়ু বিপর্যয়, পরমাণু বিপর্যয় ও জলবায়ু-পরমাণু যৌথ বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব।
জার্মানির পরমাণু-যুগ অবসানের সিদ্ধান্ত সার্বিক প্রতিবেশগত দিক থেকে স্বাস্থ্যকর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সরকারের ম্যানহাটান প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপে পরমাণু খাতের প্রতিষ্ঠা। এর দ্বিগুণা নেতিবাচক তাৎপর্য পরেছিল। একদিকে মানবজাতি আণবিক বোমা অর্থাৎ গণবিধ্বংসী বোমার যুগে প্রবেশ করে, অন্যদিকে পরমাণু উৎপাদনের সূত্রপাত হয়—প্রথম সামরিক উদ্দেশ্যে, পরবর্তী সময়ে বেসামরিক উদ্দেশ্যে। এটা বৈশ্বিক প্রতিবেশগত বিপর্যয়ের সূচনা ঘোষণা করে অথবা ঘটতে শুরু করে। সেই সংকট আজ এত তীব্র হয়েছে যে তা প্রায় মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের দাবির কাছে জার্মান সরকারের নতিস্বীকার নতুন প্রবণতার সূচনা। এ কথা সত্য যে জার্মানি ‘সবুজ’ অর্থনীতি গড়ে তোলার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়নি, এখনো বহু দূরে। আরও সত্যি, বিকল্প জ্বালানিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে জার্মানির ব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত নয়। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে তা ‘কেইনসীয়’ এক উপাদানের অধিক কিছু নয়, আদতে তা অনেকটাই নয়া উদারপন্থী। আরও সত্যি, জার্মানিতে জ্বালানি-বিতর্কের মোড় ঘুরে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বায়ুকল ও সৌর প্যানেল দিয়ে শক্তি উৎপাদন করপোরেট-নিয়ন্ত্রিত হবে নাকি বিকেন্দ্রীভূত হবে, তা নিয়ে তর্ক হচ্ছে। তথাপি পশ্চিম ইউরোপের সরকারগুলোর পরমাণু ‘পুনর্জাগরণ’-এর চিন্তা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রভাব ফেলে পরমাণু উৎপাদনের বাইরের ক্ষেত্রেও। মানবজাতির একাংশ অবশেষে সচেতনভাবে পৃথিবীতে প্রাণের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক এক প্রযুক্তি প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত পথ দেখাচ্ছে, মানবজাতির জন্য একটি প্রতিবেশগত ভবিষ্যৎ সম্ভব।
‘লেইডেন দ্য নেদারল্যান্ডস’-এর ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব।
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক, বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ ও প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।
No comments