চারদিক-একজন সাদামনের মানুষ by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
মীর আবুল হোসেন হলেন এমনই একজন মানুষ, যাঁর সততা, দায়িত্ববোধ, মানবতাবোধ, জ্ঞানপিপাসা, সাধারণ মানুষের উপকার করার আগ্রহ, ভোগবিবর্জিত জীবনের তুলনা পাওয়া ভার। কদিন আগে তিনি ৭০ বছর বয়সে পদার্পণ করলেন। তাঁর জন্ম ১৯৪১ সালের ৯ মার্চ, মানিকগঞ্জ জেলার জাবরা গ্রামে।
ভালো ছাত্র হিসেবে গ্রামে নামডাক থাকলেও পড়ার বাইরে নানা কর্মকাণ্ডে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল খুবই জোরালো। স্কুল-কলেজে বক্তৃতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, জারিগান, ভাওয়াইয়া আর পল্লিগীতি গেয়ে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে তিনি সব সময় চ্যাম্পিয়ন। বাহাদুর শাহ পার্ক স্কুলে ইংরেজি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় গ্রামের এই ছেলেটি একবার ১০ টাকা পুরস্কারও পেয়েছিলেন। সাহিত্য প্রতিযোগিতা থেকে পাওয়া সব পুরস্কার দিয়ে প্রথমে বানিয়াজুরী ইউনিয়ন প্রগতি সংঘের লাইব্রেরি এবং পরবর্তী সময় জাবরা নবারুণ সংঘের লাইব্রেরি সমৃদ্ধ করেছেন। নিজে বই পড়েছেন এবং গ্রামের অন্যদের উৎসাহিত করেছেন।
মীর আবুল হোসেন রোজনামচা লেখা শুরু করেছেন ১৯৫৯ সাল থেকে। ব্যাধি, অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো ব্যস্ততা তাঁকে এক দিনের জন্যও বিরত করতে পারেনি। সেই গ্রামের ছেলেটির রোজনামচায় নিজের, পরিবারের, এলাকার খবরকে ছাপিয়ে উঠত পৃথিবীর সংবাদ, ফিলিস্তিনে কী হচ্ছে, আরও কত কী! চাকরিজীবনে তাঁর দিনলিপি অনেক সরকারি কাজে সাহায্য করেছে। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেগুলো ছিল সর্বক্ষণের সঙ্গী। এসব দিনলিপি ঘাঁটলে পাওয়া যাবে জাবরা গ্রাম থেকে মানিকগঞ্জ শহরে বা ঢাকা আসতে কত সময় লাগত কিংবা কত টাকা, ওই দিনগুলোতে দ্রব্যমূল্যসহ নানা পত্রিকায় প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বগুড়ায় ছিলেন তিনি। পাকিস্তানি বাহিনী বগুড়া দখল করার পর জলেশ্বরীতলা, খামারকান্দি, জয়ভোগা ও মহিষাবানের মসজিদে দেশ স্বাধীন করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন খুতবার মাধ্যমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ১৯৬৭ সাল থেকে দুই বছর চাকরি করেছেন কুমিল্লার বুড়িচং থানার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে। এরপর সস্ত্রীক নিজ গ্রামে চলে আসেন; গ্রামের স্কুলে অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং বাবার নামে একটি বৃত্তি চালু করেন। একজন বেকার মানুষ কতটা করতে পারেন, তার কী অসাধারণ উদাহরণ! শুধু তা-ই নয়, ছাত্রদের বাড়িতে শেখানোর বাড়তি ঝামেলাও আনন্দে গ্রহণ করতেন। চাকরিজীবনে শিল্পসম্পর্কিত শিক্ষায়তনগুলোয় চাকরি করা পছন্দ করতেন। খুলনা ও চট্টগ্রামের শিক্ষায়তনের পাঠাগার ঢাকা ল রিপোর্টের কপি দিয়ে সমৃদ্ধ করেছিলেন তিনি।
১৯৯০ সালে সরকার তাঁকে প্রথম সচিব হিসেবে কুয়েতে পাঠায় কূটনৈতিক দায়িত্বে। ইরাকের কুয়েত দখলকে কেন্দ্র করে তাঁদের বাগদাদে আসতে হয়। ওই দুর্দিনে বাগদাদে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের তিনি ইরাক ছাড়তে সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে কুয়েতে থাকার সময় যেসব মানুষ নানাভাবে বিড়ম্বিত হয়েছে বিদেশ-বিভুঁইয়ে, তাদের সবার আশা-ভরসার স্থল ছিলেন মীর আবুল হোসেন। প্রতি রাতে তাঁর বাসায় থাকত ১৪-১৫ জন নিগৃহীত মানুষ, যা নিয়ে দেনদরবার করে তাদের চাকরিস্থলে ফেরত পাঠানোর গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন এই কর্মকর্তা।
এসব বিষয় জানার সুযোগ হলো যখন এ মানুষটি কিছুদিনের জন্য আমার বাসায় ছিলেন। সরকারি চাকরিতে বদলি কিংবা পদোন্নতির জন্য জীবনে কখনো চেষ্টা করেননি। তাতে পার্থিব ক্ষতিও হয়েছে, জুনিয়ররা সিনিয়র হয়েছে, পদোন্নতি হয়েছে শম্বুকগতিতে, বেতন-ভাতাদিতে কখনো বরকত হয়নি। তা সত্ত্বেও আত্মীয়স্বজন কিংবা এলাকার আগন্তুকদের যাতায়াত খরচ দিতেও দ্বিধা করেননি। চাকরির সুবাদে যে এলাকাতেই থাকতে হয়েছে, নিজ গরজে ছাত্রদের খুঁজে বের করেছেন এবং পড়ালেখায় সাহায্য করেছেন অত্যন্ত আন্তরিকভাবে।
২০০০ সালে অবসরে যাওয়ার পর ঢাকা শহরে থাকাটা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু চলে গেলেন নিজের গ্রামে, যদি এলাকার ছাত্রদের পড়ালেখায় সহায়তা করা যায়। অবশ্য এমন মানুষের পক্ষে গ্রামের স্কুলে শিক্ষক হওয়া সম্ভব হয়নি। তাতে কী? প্রতিদিনই অনেক ছাত্র তাঁর বাসায় পড়তে এসেছে অবশ্যই বিনা বেতনে। মানিকগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চলের ছাত্ররা যাতে পড়ালেখায় ভালো করে, তার জন্য তিনি একটি প্রতিষ্ঠানও করেছিলেন।
এই মানুষটির দিনলিপির সুবাদেই পরিবারের চার-পাঁচ শ মানুষের জন্মদিন, বিয়ের দিনসহ নানা ধরনের উপাত্ত ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। মীর আবুল হোসেনের বংশবৃক্ষ তাঁর নিকটজনদের অত্যন্ত পরিচিত। নিজের মতো করে তিনি এই বৃক্ষ আঁকেন, পুরুষ হলে বৃত্ত ও নারী হলে আয়তক্ষেত্র দিয়ে তাকে বোঝান। অতি যত্নে সংগ্রহ করা তাঁর উপাত্তগুলো আমাকে www.geni.com-এ সংরক্ষণ করতে দেখে তিনি খুবই খুশি হয়েছেন। সচিবালয়ের একটি কাজে বাংলা ও ইংরেজি শব্দের অর্থ এবং অনুবাদ নিয়ে যখন আমরা প্রায় পরাজিত সৈনিক, তখন তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। অনুবাদের কাজটি এমন দক্ষতার সঙ্গে করলেন যে বাংলা, ইংরেজিতে লেটার পাওয়া মেধাবী শিক্ষকেরাও তাঁর এসব বিষয়ের পারদর্শিতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন।
তাঁর সান্নিধ্যে আসা অনেক মানুষই তাঁর কাছে চিরঋণী। তিনি শুধু একজন আলোকিত সৎ মানুষই নন, তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। সমাজের যেকোনো স্তরের মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা, কাজে তিনি অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ। আমাদের এই কলুষিত সমাজেও যে এমন নির্লোভ, নির্ভোগ, সজ্জন মানুষ থাকতে পারেন, তার জ্বলন্ত উদাহরণ মীর আবুল হোসেন, যা সব মানুষকে সৎ ও জ্ঞান অন্বেষণে আগ্রহী করতে পারে। তাঁর দিনলিপি লেখা, অভিধানচর্চা এবং সব মানুষের সঙ্গে সহমর্মিতা নিয়ে সদালাপ করার গুণ অসাধারণ। তাঁর দিনলিপি ধারণ করে আছে ৫০ বছরের ইতিহাস, যা আমাদের দেশে একটি বিরল সম্পদ।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ
মীর আবুল হোসেন রোজনামচা লেখা শুরু করেছেন ১৯৫৯ সাল থেকে। ব্যাধি, অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো ব্যস্ততা তাঁকে এক দিনের জন্যও বিরত করতে পারেনি। সেই গ্রামের ছেলেটির রোজনামচায় নিজের, পরিবারের, এলাকার খবরকে ছাপিয়ে উঠত পৃথিবীর সংবাদ, ফিলিস্তিনে কী হচ্ছে, আরও কত কী! চাকরিজীবনে তাঁর দিনলিপি অনেক সরকারি কাজে সাহায্য করেছে। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেগুলো ছিল সর্বক্ষণের সঙ্গী। এসব দিনলিপি ঘাঁটলে পাওয়া যাবে জাবরা গ্রাম থেকে মানিকগঞ্জ শহরে বা ঢাকা আসতে কত সময় লাগত কিংবা কত টাকা, ওই দিনগুলোতে দ্রব্যমূল্যসহ নানা পত্রিকায় প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বগুড়ায় ছিলেন তিনি। পাকিস্তানি বাহিনী বগুড়া দখল করার পর জলেশ্বরীতলা, খামারকান্দি, জয়ভোগা ও মহিষাবানের মসজিদে দেশ স্বাধীন করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন খুতবার মাধ্যমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ১৯৬৭ সাল থেকে দুই বছর চাকরি করেছেন কুমিল্লার বুড়িচং থানার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে। এরপর সস্ত্রীক নিজ গ্রামে চলে আসেন; গ্রামের স্কুলে অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং বাবার নামে একটি বৃত্তি চালু করেন। একজন বেকার মানুষ কতটা করতে পারেন, তার কী অসাধারণ উদাহরণ! শুধু তা-ই নয়, ছাত্রদের বাড়িতে শেখানোর বাড়তি ঝামেলাও আনন্দে গ্রহণ করতেন। চাকরিজীবনে শিল্পসম্পর্কিত শিক্ষায়তনগুলোয় চাকরি করা পছন্দ করতেন। খুলনা ও চট্টগ্রামের শিক্ষায়তনের পাঠাগার ঢাকা ল রিপোর্টের কপি দিয়ে সমৃদ্ধ করেছিলেন তিনি।
১৯৯০ সালে সরকার তাঁকে প্রথম সচিব হিসেবে কুয়েতে পাঠায় কূটনৈতিক দায়িত্বে। ইরাকের কুয়েত দখলকে কেন্দ্র করে তাঁদের বাগদাদে আসতে হয়। ওই দুর্দিনে বাগদাদে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের তিনি ইরাক ছাড়তে সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে কুয়েতে থাকার সময় যেসব মানুষ নানাভাবে বিড়ম্বিত হয়েছে বিদেশ-বিভুঁইয়ে, তাদের সবার আশা-ভরসার স্থল ছিলেন মীর আবুল হোসেন। প্রতি রাতে তাঁর বাসায় থাকত ১৪-১৫ জন নিগৃহীত মানুষ, যা নিয়ে দেনদরবার করে তাদের চাকরিস্থলে ফেরত পাঠানোর গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন এই কর্মকর্তা।
এসব বিষয় জানার সুযোগ হলো যখন এ মানুষটি কিছুদিনের জন্য আমার বাসায় ছিলেন। সরকারি চাকরিতে বদলি কিংবা পদোন্নতির জন্য জীবনে কখনো চেষ্টা করেননি। তাতে পার্থিব ক্ষতিও হয়েছে, জুনিয়ররা সিনিয়র হয়েছে, পদোন্নতি হয়েছে শম্বুকগতিতে, বেতন-ভাতাদিতে কখনো বরকত হয়নি। তা সত্ত্বেও আত্মীয়স্বজন কিংবা এলাকার আগন্তুকদের যাতায়াত খরচ দিতেও দ্বিধা করেননি। চাকরির সুবাদে যে এলাকাতেই থাকতে হয়েছে, নিজ গরজে ছাত্রদের খুঁজে বের করেছেন এবং পড়ালেখায় সাহায্য করেছেন অত্যন্ত আন্তরিকভাবে।
২০০০ সালে অবসরে যাওয়ার পর ঢাকা শহরে থাকাটা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু চলে গেলেন নিজের গ্রামে, যদি এলাকার ছাত্রদের পড়ালেখায় সহায়তা করা যায়। অবশ্য এমন মানুষের পক্ষে গ্রামের স্কুলে শিক্ষক হওয়া সম্ভব হয়নি। তাতে কী? প্রতিদিনই অনেক ছাত্র তাঁর বাসায় পড়তে এসেছে অবশ্যই বিনা বেতনে। মানিকগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চলের ছাত্ররা যাতে পড়ালেখায় ভালো করে, তার জন্য তিনি একটি প্রতিষ্ঠানও করেছিলেন।
এই মানুষটির দিনলিপির সুবাদেই পরিবারের চার-পাঁচ শ মানুষের জন্মদিন, বিয়ের দিনসহ নানা ধরনের উপাত্ত ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। মীর আবুল হোসেনের বংশবৃক্ষ তাঁর নিকটজনদের অত্যন্ত পরিচিত। নিজের মতো করে তিনি এই বৃক্ষ আঁকেন, পুরুষ হলে বৃত্ত ও নারী হলে আয়তক্ষেত্র দিয়ে তাকে বোঝান। অতি যত্নে সংগ্রহ করা তাঁর উপাত্তগুলো আমাকে www.geni.com-এ সংরক্ষণ করতে দেখে তিনি খুবই খুশি হয়েছেন। সচিবালয়ের একটি কাজে বাংলা ও ইংরেজি শব্দের অর্থ এবং অনুবাদ নিয়ে যখন আমরা প্রায় পরাজিত সৈনিক, তখন তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। অনুবাদের কাজটি এমন দক্ষতার সঙ্গে করলেন যে বাংলা, ইংরেজিতে লেটার পাওয়া মেধাবী শিক্ষকেরাও তাঁর এসব বিষয়ের পারদর্শিতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন।
তাঁর সান্নিধ্যে আসা অনেক মানুষই তাঁর কাছে চিরঋণী। তিনি শুধু একজন আলোকিত সৎ মানুষই নন, তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। সমাজের যেকোনো স্তরের মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা, কাজে তিনি অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ। আমাদের এই কলুষিত সমাজেও যে এমন নির্লোভ, নির্ভোগ, সজ্জন মানুষ থাকতে পারেন, তার জ্বলন্ত উদাহরণ মীর আবুল হোসেন, যা সব মানুষকে সৎ ও জ্ঞান অন্বেষণে আগ্রহী করতে পারে। তাঁর দিনলিপি লেখা, অভিধানচর্চা এবং সব মানুষের সঙ্গে সহমর্মিতা নিয়ে সদালাপ করার গুণ অসাধারণ। তাঁর দিনলিপি ধারণ করে আছে ৫০ বছরের ইতিহাস, যা আমাদের দেশে একটি বিরল সম্পদ।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ
No comments