বিশেষ সাক্ষাৎকার-বিচার বিভাগকে নির্বাচনী বিতর্কের বাইরে রাখতে হবে by মাহবুবে আলম
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার মৌছামান্দ্রা গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক সম্মান ও লোকপ্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। ১৯৭৯ সালে তিনি দিল্লির ইনস্টিটিউট অব কনস্টিটিউশনাল অ্যান্ড পার্লামেন্টারি স্টাডিজ (আইসিপিএস) থেকে সাংবিধানিক আইন এবং সংসদীয়
প্রতিষ্ঠান ও কার্যপ্রণালি বিষয়ে দুটি ডিপ্লোমা করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হন। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৫-০৬ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও ১৯৯৩-৯৪ সালে সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৮ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে ২০০১ সালের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব নেন ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো নির্বাচন আইন সংস্কারের বিষয়টি নতুন মাত্রায় আলোচনায় আসছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
মাহবুবে আলম আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হলো, ভোটার যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন, কেউ যাতে আর্থিক প্রলোভন বা ভয়ভীতি না দেখাতে পারেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁদের কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল না। তাই তাঁরা রাজনীতিতে বিত্তশালীদের আমদানির পথ প্রশস্ত করেছিলেন। এখন এর রাশ টানতে হবে। নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দল—সবারই এটা বন্ধে একত্রে চেষ্টা করা উচিত। মনে রাখতে হবে, অভাবগ্রস্ত মানুষকে সহজেই প্রলুব্ধ করা সম্ভব।
প্রথম আলো কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হতে চলায় নির্বাচনী আইন সংস্কারের দিকে বিরোধী দলের মনোযোগ কীভাবে তৈরি হবে?
মাহবুবে আলম নির্বাচনকালে যে ধরনের সাংবিধানিক ব্যবস্থাই থাকুক না কেন, নির্বাচনী বিধিব্যবস্থায় দরকারি পরিবর্তন আনতেই হবে। এ জন্য আমার প্রথম সুপারিশ হচ্ছে, সংসদ নির্বাচন এক দিনে না করা। ১৫ দিন বা এক মাস ধরেও করা যেতে পারে। দুটি জেলা এক দিনে হতে পারে। তাহলে নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গণমাধ্যম প্রত্যেকেই বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে পারবে। তবে এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন সাংবাদিকেরা।
প্রথম আলো কিন্তু প্রার্থী বাছাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি দল ব্যবস্থার গণতন্ত্রায়ণের মধ্য দিয়ে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই করতে পারেন, তাহলে সার্বিক নির্বাচনী পরিবেশ উন্নত হতে পারে।
মাহবুবে আলম গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এটা বলা যাবে না যে বিত্তবান হলে আপনি নির্বাচন করতে পারবেন না। সবার জন্য দ্বার উন্মুক্ত থাকবে, কিন্তু নজরদারিটা থাকতে হবে। সংখ্যালঘুরা ভয়ভীতির শিকার হয়। তাদের অনেক সময় একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সংখ্যালঘুদের ভোট যদি ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে তাদের ওপর চাপ আরও বাড়ে। অনেক ধর্মীয় নেতাও অনেক এলাকায় মেয়েদের ভোট না দিতে ফতোয়া দেন। এ রকম বিষয়গুলো ভাগ ভাগ করে নির্বাচন হলে তা প্রতিহত করা সম্ভব।
প্রথম আলো নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণ নিয়ে কথা উঠেছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
মাহবুবে আলম আমাদের দেশে ভোটের দিন সহিংসতা ঘটে। যারা গন্ডগোল করবে, ভোটের দিনই তাৎক্ষণিক তাদের বিচার করতে হবে। ভোট গণনা বিরোধের আরেকটি উৎস। ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে ভোট গণনার পক্ষপাতী আমি নই। সবার উপস্থিতিতে সিলগালা করে তা মালখানায় রেখে দিতে হবে। সারা দেশের নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর তখন গণনা ও একসঙ্গে ফল প্রকাশ করতে হবে। এটা করা গেলে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের মতো উৎপাত থেকে বাঁচা যাবে। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আজকে যে এত বিতর্ক, তার উৎস কিন্তু মাগুরার উপনির্বাচন। সেদিন সিইসি যদি তাৎক্ষণিক পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দিতেন, তাহলে আজ এ অবস্থা হয় না।
প্রথম আলো তৎকালীন সিইসি যুক্তি দিয়েছিলেন, তাঁর হাত-পা বাঁধা ছিল। তাৎক্ষণিক নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার মতো ক্ষমতা তখন নির্বাচন কমিশনের ছিল না। ২০০৮ সালে এটা এসেছে।
মাহবুবে আলম নির্বাচন কমিশন যদি দেখে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না, তাহলে তাকে তো অবশ্যই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, নির্বাচন কমিশন সাক্ষীগোপাল হতে পারে না। তারা যদি দেখে, কোনো এক এলাকায় বিরাট বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে, ভোটাধিকার প্রয়োগ ব্যাহত হচ্ছে, তার পরও কি নির্বাচন কমিশন চুপ করে বসে থাকবে? এটা হতে পারে না। সেদিন যদি তারা নির্বাচন বন্ধ করে দিত, তাহলে তাদের ক্ষমতা নিয়ে বিতর্ক হতো না। ভারতের সাবেক সিইসি টি এন সেশন সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর একক সক্রিয়তার কারণে ভারতীয় নির্বাচনব্যবস্থার বিরাট গুণগত উৎকর্ষ ঘটেছে। যেকোনো সময়ে পুরো সংসদীয় আসনের নির্বাচন স্থগিতের ক্ষমতা ইসির থাকতে হবে। প্রয়োজনে তাদের জন্য হেলিকপ্টার থাকবে। প্রহসনের নির্বাচন তারা হতেই দেবে না। এখন কমিশন যদি তাৎক্ষণিক শুধু কয়েকটি ভোট কেন্দ্রই নয়, পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দেয়, তাহলে আর কেউ অবৈধ তৎপরতায় লিপ্ত হতে সাহসী হবে না।
প্রথম আলো নির্বাচন কমিশনকে আমাদের রাজনীতিকেরা রেফারি মানতে রাজি। কিন্তু তার কাছে লাল কার্ড থাকুক, তার প্রয়োগ হোক, সেটা তাঁরা চান না।
মাহবুবে আলম দেখুন, সারা দেশে যদি এক দিনে নির্বাচন হয় তাহলে তার পক্ষে মনোযোগী হওয়া একেবারেই অসম্ভব। এক দিনে যদি দুটো জেলার সংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে কমিশন তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে পারবে। তবে কমিশনের ক্ষমতার প্রয়োগ হতে হবে বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কেন তারা নির্বাচন স্থগিত করল, তার কারণ সবার কাছে স্পষ্ট ও স্বচ্ছ প্রতীয়মান হতে হবে। ভোটকেন্দ্রগুলো যদি লাইভ সম্প্রচারের আওতায় থাকে, তাহলে সবাই বুঝতে পারবে। পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করলেই তো চলবে না। নির্বাচন কমিশন ঠিক কাজ করেছে কি করেনি, সেটা জনগণও তাৎক্ষণিক বুঝতে পারবে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা থাকাই শেষ নয়। সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করার মতো ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব থাকতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পর নির্বাচন কমিশনে অনেকেই গেছেন, পদ অলংকৃত করেছেন। কিন্তু সত্যিকারভাবে সে রকম কায়িক পরিশ্রম এবং একাগ্রতা নিয়ে খুব কম ব্যক্তিই দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রথম আলো সামরিক শাসকেরা জনগণের মধ্যে আস্থা সৃষ্টির জন্য ইসিতে বিচারকদের এনেছেন। কিন্তু আমরা এর সুফল পাইনি।
মাহবুবে আলম নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব বিচারিক-প্রক্রিয়া থেকে ভিন্ন। এটা অনেকটাই প্রশাসনিক। ভোটকেন্দ্রে কারা কারচুপি করছে, কারা মাস্তানি করছে—এসব বিষয়ে দক্ষতার সঙ্গে বুঝতে পারা, ধরতে পারা, ত্বরিত গতিতে সেখানে গিয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার মধ্যে একটা শারীরিক শক্তিরও ব্যাপার আছে। অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এসব কাজ করতে পারবেন না। স্যুট-টাই পরে পুলিশ নিয়ে ঘুরলেই তো চলবে না।
প্রথম আলো কর্মরত বিচারকদের নির্বাচন কমিশনে নিষিদ্ধ করে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের রায়কে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। কর্মরত বিচারকদের নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের কি অবসান ঘটবে?
মাহবুবে আলম আমি সব সময়ই বলে আসছি, বিচারপতি খায়রুল হক শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ বিচারপতি। অনেকে না বুঝে তাঁর সমালোচনা করছেন। তাঁর রায়গুলো যদি আপনারা পড়েন, তাহলে অনুধাবন করবেন তিনি কত বড় মাপের একজন দেশপ্রেমিক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় বিচারকদের যুক্ত করায় বিচার বিভাগ শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তিনি সেটা থেকে সুরক্ষা দিয়েছেন।
প্রথম আলো ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে প্রধান উপদেষ্টার পদে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের বাদ দিয়ে সংবিধান সংশোধনে নির্দেশনা রয়েছে। তাহলে কি—
মাহবুবে আলম এই বিষয়টি নিয়ে যত পানি ঘোলা করা হয়েছে, তা দুঃখজনক। গণতান্ত্রিক দেশে যেকোনো বিদায়ী মন্ত্রিসভা তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবেই কাজ করে। মাগুরার পর ভাবা হয়েছিল প্রধান বিচারপতিকে যুক্ত করলে হয়তো ভালো হবে।
প্রথম আলো আপনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে দুই মেয়াদে কীভাবে নির্বাচন হবে, সে জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় দেখতে হবে।
মাহবুবে আলম আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আদালত দুই মেয়াদের যে কথা বলেছেন, তা কী যুক্তিতে বলেছেন। তখন আমি বলেছি, এটা তো রায় না পড়ে বলা যাবে না। তারা কোন পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন। শর্ট অর্ডার যেটা আমরা পেয়েছি, সেখানে সংসদ এখন কিছুই করতে পারবে না, তা কিন্তু আদালত বলেননি। শর্ট অর্ডারে আছে তত্ত্বাবধায়ক সম্পূর্ণ অবৈধ। তবে কিছু রোমান প্রবচন ব্যবহার করে তাঁরা বলেছেন, আগামী দুই মেয়াদ এটা চলতে পারে। তবে ইতিমধ্যে সংসদের যে ক্ষমতা, তা প্রয়োগে কোনো বাধা নেই।
প্রথম আলো এই যে ‘ইতিমধ্যে’ কথাটা বলেছেন, তাকে কি দুই মেয়াদের আগে নাকি দুই মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও আমরা বুঝতে পারি?
মাহবুবে আলম যখন কোনো সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয় তখন সেই মুহূর্ত থেকে তা বাতিল হয়ে যায়।
প্রথম আলো কিন্তু রায়ে কথাটি ভবিষ্যৎসাপেক্ষে বলা হয়েছে।
মাহবুবে আলম এর মানে হলো, আপনি যদি ভূতাপেক্ষ বলেন তাহলে অতীতের যে নির্বাচন হয়েছে, তা অবৈধ হয়ে যায়। সেটা তো হতে পারে না।
প্রথম আলো আমরা বিষয়টি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ‘গোলকনাথ’ রায়ের আলোকে বুঝব। মাহমুদুল ইসলামের বইতেও এটা স্বীকৃত। এখন পূর্ণাঙ্গ রায় না পাওয়া পর্যন্ত বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার নয়। এখন যদি প্রকৃত কার্যকর অর্থে বাতিল বলেন, তাহলে আপনি দুই মেয়াদে কী করে নির্বাচন করবেন?
মাহবুবে আলম আমার ব্যাখ্যা হলো, কী যুক্তিতে দুই মেয়াদ করা যাবে, সেটা আমরা সংক্ষিপ্ত রায়ে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তাই বলে সংসদকে সে জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে, সেটা আমি মনে করি না। যেমন পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে সবকিছু অবৈধ বলেও কতিপয় বিষয়ে মার্জনা করা হয়েছে। এখন রিভিউর পরে আপিল বিভাগ বলেছেন, সামরিক ফরমান দ্বারা সংযোজিত কতিপয় বিষয় ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মার্জনা করা হলো। আগে তা অনির্দিষ্ট ছিল। এখন নির্দিষ্ট করা হলো। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের আলোকে এটা করা হলো।
প্রথম আলো ওই সময়ের মধ্যে সংসদ কোনো পদক্ষেপ না নিলে কী হবে?
মাহবুবে আলম বাতিল হয়ে যাবে। সে জন্যই বলছি, সংসদ বসে থাকতে পারে না। আজকে সংসদের যে একটি দলের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, সেটা ভবিষ্যতে কোনো সরকারের নাও থাকতে পারে। তাহলে তো একটি শূন্যতা সৃষ্টি হবে।
প্রথম আলো তাহলে দুটি হরতালের পর আপনার কী পরামর্শ?
মাহবুবে আলম যা কিছুই হোক না কেন এখনই সংসদকে যা করার করতে হবে। দুই মেয়াদে অপেক্ষা করলে দীর্ঘ মেয়াদে আমরা বিপদে পড়ে যাব। পুরো জাতি বিপদে পড়ে যাবে।
প্রথম আলো পঞ্চম সংশোধনীর পর সংবিধান পুনর্মুদ্রণের আমরা ব্যাখ্যা পেয়েছিলাম যে, বাতিল অনুচ্ছেদগুলো আর নেই। ত্রয়োদশ সংশোধনীর কি এখন অস্তিত্ব আছে?
মাহবুবে আলম ত্রয়োদশ সংশোধনী যেটা করা হয়েছিল, সেটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর ঘোষণা হয়ে গেছে।
প্রথম আলো সেটা ঠিক। কিন্তু ঘোষণাটা কি সম্পূর্ণ? শর্তসাপেক্ষ নয়? ধরুন কালই সংবিধান ছাপা হলো, তখন কি এটি বাদ যাবে নাকি যাবে না?
মাহবুবে আলম এই মুহূর্তে তো পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে না। যেহেতু জিনিসটা সংসদের বিবেচনায় আছে। আমার মনে হয়, এসব কারণ বিবেচনায় নিয়েই সংসদ অনতিবিলম্বে জিনিসটি মাথায় নিয়ে করতে চাইছে। আদালত দুই মেয়াদ চলতে পারে বলে যে কথাটা বলেছেন, সেই দুই মেয়াদও তো চলার মতো বাস্তব অবস্থায় আমরা নেই। প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার কথা খায়রুল হক সাহেবের। কিন্তু বিএনপি বলেই দিয়েছে, তারা মানবে না। তাহলে বিচার বিভাগ তো বিতর্কিত হয়ে যাচ্ছে। তাই সুপ্রিম কোর্টের মতো প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কের বাইরে রাখতে সংবিধান সংশোধন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ কমিটি অনেকের কথাই শুনেছেন। আমিও তাঁর মধ্যে ছিলাম।
প্রথম আলো কিন্তু আপনারা বাতিলের পক্ষে কেউ বলেননি। দেখা যাচ্ছে, দায়টা শুধু বিচার বিভাগই নিচ্ছে।
মাহবুবে আলম দায়টা বিচার বিভাগ নিচ্ছে, এটা সঠিক নয়। তাঁরা যেটা বলার তা বলে দিয়েছেন। এখন যথাবিহিত ব্যবস্থা নেওয়ার দায় রাজনীতিকদের। তাঁরা চুপ থাকলে দেশ ভবিষ্যতে আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। যাহোক, বিচার বিভাগকে আমাদের বাঁচাতে হবে। আপনি কি বিচার বিভাগকে আরও বিতর্কিত করবেন?
প্রথম আলো বিচার বিভাগকে বাদ দিয়ে বিএনপি প্রস্তাব দিলে সেটা কি গ্রহণযোগ্য হবে? রায় কিন্তু বলছে যে, বিচারকদের বাদ দিয়ে দরকারি সংশোধনী আনতে সংসদ স্বাধীন।
মাহবুবে আলম প্রশ্ন হলো, বিরোধী দল কেন সংসদে যাবে না? পৃথিবীতে এমন সমস্যা নেই, যা আলোচনা করে সুরাহা হয় না। সংসদে গিয়ে বিরোধী দল কথা বললে তারা তো অন্তত বলতে পারবে যে, আমরা এটা বলেছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তারা নিজেদের মুক্ত ও স্বচ্ছ রাখতে পারে।
প্রথম আলো আপনি যে ধরনের নির্বাচনী সংস্কারের কথা বলছেন, তা কী করে জাতীয় আলোচনায় আসতে পারে।
মাহবুবে আলম আমি যে এই কথা বললাম কমিশন একটা কথা বলল, গণমাধ্যম থেকে কথা এল, নাগরিক সমাজ থেকে আসল এভাবেই নানা মহলের কথা থেকেই জনমত তৈরি হয়। আরেকটি কথা বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি সম্পূর্ণরূপে আমাদের গ্রহণ করতে হবে। একে উপেক্ষা করলে চলবে না। যদি সেটা আমরা করি তা হবে বোকামি। বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে, তা আমরা মুহূর্তের মধ্যে প্রত্যক্ষ করতে পারি। আমাদেরও সেটা রপ্ত করতে হবে। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ভোট হলে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের অবসান ঘটবে। আপনি তো দেখে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর ধরে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় ছিল। এবার মমতা ব্যানার্জি তাদের হারিয়ে দিলেন। এই ভোট তো ইভিএম পদ্ধতিতে হয়েছে। কিন্তু সেখানে ভোট-প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো সংশয় সৃষ্টি হয়নি। এই পদ্ধতিতে ভোট হলে জাল ভোট, ব্যালট নষ্ট করা, ব্যালটপত্র কিংবা ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের মতো কোনো ঘটনা ঘটার আর কোনো সুযোগ থাকে না। তাহলে আমরা এটা উপেক্ষা করব কেন। এখন প্রযুক্তির আরও উন্নতি ঘটিয়ে অনলাইনব্যবস্থার সাহায্য নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায়। তাহলে যে ভয়ভীতির কারণে আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চেয়েছিলাম, তার তো প্রাসঙ্গিকতা থাকে না।
প্রথম আলো কিন্তু আমাদের রাজনীতির সমস্যা ভিন্ন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, এখন এর বিরোধিতা বা এর পুনঃপ্রবর্তন করাই বিরোধী দলের রাজনীতির একমাত্র এজেন্ডা। অতীতেও নির্বাচনী ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানোর প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল।
মাহবুবে আলম বিরোধী দল অবশ্যই বুঝবে। মাইকে আজান দেওয়া নিয়ে একসময় ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নাজায়েজ কাজ আর নাজায়েজ নেই। এখন প্রতিটি মসজিদই অন্তত একটি মাইক পাওয়ার জন্য আগ্রহ দেখিয়ে থাকে। একটি রাজনৈতিক দলকে একসময় পরিবার পরিকল্পনাসংক্রান্ত সাইনবোর্ড ভাঙতে দেখেছি। তারাও বিজ্ঞানমনস্ক হবে। কলেরার জন্য একসময় পানি পড়া, তাবিজ ছিল গ্রামবাসীর ভরসা। আজ আর কাউকে পানি পড়া দিয়ে তুষ্ট রাখা যাবে না। গ্যালিলিও ও কোপার্নিকাসের প্রতি তৎকালীন পোপরা যে ভূমিকা রেখেছিলেন, সে জন্য পরে তাঁরা অনুশোচনা করেছেন, ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। কাজেই বিজ্ঞানকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুবে আলম আপনাকে ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো নির্বাচন আইন সংস্কারের বিষয়টি নতুন মাত্রায় আলোচনায় আসছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
মাহবুবে আলম আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হলো, ভোটার যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন, কেউ যাতে আর্থিক প্রলোভন বা ভয়ভীতি না দেখাতে পারেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁদের কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল না। তাই তাঁরা রাজনীতিতে বিত্তশালীদের আমদানির পথ প্রশস্ত করেছিলেন। এখন এর রাশ টানতে হবে। নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দল—সবারই এটা বন্ধে একত্রে চেষ্টা করা উচিত। মনে রাখতে হবে, অভাবগ্রস্ত মানুষকে সহজেই প্রলুব্ধ করা সম্ভব।
প্রথম আলো কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হতে চলায় নির্বাচনী আইন সংস্কারের দিকে বিরোধী দলের মনোযোগ কীভাবে তৈরি হবে?
মাহবুবে আলম নির্বাচনকালে যে ধরনের সাংবিধানিক ব্যবস্থাই থাকুক না কেন, নির্বাচনী বিধিব্যবস্থায় দরকারি পরিবর্তন আনতেই হবে। এ জন্য আমার প্রথম সুপারিশ হচ্ছে, সংসদ নির্বাচন এক দিনে না করা। ১৫ দিন বা এক মাস ধরেও করা যেতে পারে। দুটি জেলা এক দিনে হতে পারে। তাহলে নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গণমাধ্যম প্রত্যেকেই বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে পারবে। তবে এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন সাংবাদিকেরা।
প্রথম আলো কিন্তু প্রার্থী বাছাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি দল ব্যবস্থার গণতন্ত্রায়ণের মধ্য দিয়ে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই করতে পারেন, তাহলে সার্বিক নির্বাচনী পরিবেশ উন্নত হতে পারে।
মাহবুবে আলম গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এটা বলা যাবে না যে বিত্তবান হলে আপনি নির্বাচন করতে পারবেন না। সবার জন্য দ্বার উন্মুক্ত থাকবে, কিন্তু নজরদারিটা থাকতে হবে। সংখ্যালঘুরা ভয়ভীতির শিকার হয়। তাদের অনেক সময় একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সংখ্যালঘুদের ভোট যদি ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে তাদের ওপর চাপ আরও বাড়ে। অনেক ধর্মীয় নেতাও অনেক এলাকায় মেয়েদের ভোট না দিতে ফতোয়া দেন। এ রকম বিষয়গুলো ভাগ ভাগ করে নির্বাচন হলে তা প্রতিহত করা সম্ভব।
প্রথম আলো নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণ নিয়ে কথা উঠেছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
মাহবুবে আলম আমাদের দেশে ভোটের দিন সহিংসতা ঘটে। যারা গন্ডগোল করবে, ভোটের দিনই তাৎক্ষণিক তাদের বিচার করতে হবে। ভোট গণনা বিরোধের আরেকটি উৎস। ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে ভোট গণনার পক্ষপাতী আমি নই। সবার উপস্থিতিতে সিলগালা করে তা মালখানায় রেখে দিতে হবে। সারা দেশের নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর তখন গণনা ও একসঙ্গে ফল প্রকাশ করতে হবে। এটা করা গেলে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের মতো উৎপাত থেকে বাঁচা যাবে। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আজকে যে এত বিতর্ক, তার উৎস কিন্তু মাগুরার উপনির্বাচন। সেদিন সিইসি যদি তাৎক্ষণিক পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দিতেন, তাহলে আজ এ অবস্থা হয় না।
প্রথম আলো তৎকালীন সিইসি যুক্তি দিয়েছিলেন, তাঁর হাত-পা বাঁধা ছিল। তাৎক্ষণিক নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার মতো ক্ষমতা তখন নির্বাচন কমিশনের ছিল না। ২০০৮ সালে এটা এসেছে।
মাহবুবে আলম নির্বাচন কমিশন যদি দেখে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না, তাহলে তাকে তো অবশ্যই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, নির্বাচন কমিশন সাক্ষীগোপাল হতে পারে না। তারা যদি দেখে, কোনো এক এলাকায় বিরাট বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে, ভোটাধিকার প্রয়োগ ব্যাহত হচ্ছে, তার পরও কি নির্বাচন কমিশন চুপ করে বসে থাকবে? এটা হতে পারে না। সেদিন যদি তারা নির্বাচন বন্ধ করে দিত, তাহলে তাদের ক্ষমতা নিয়ে বিতর্ক হতো না। ভারতের সাবেক সিইসি টি এন সেশন সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর একক সক্রিয়তার কারণে ভারতীয় নির্বাচনব্যবস্থার বিরাট গুণগত উৎকর্ষ ঘটেছে। যেকোনো সময়ে পুরো সংসদীয় আসনের নির্বাচন স্থগিতের ক্ষমতা ইসির থাকতে হবে। প্রয়োজনে তাদের জন্য হেলিকপ্টার থাকবে। প্রহসনের নির্বাচন তারা হতেই দেবে না। এখন কমিশন যদি তাৎক্ষণিক শুধু কয়েকটি ভোট কেন্দ্রই নয়, পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দেয়, তাহলে আর কেউ অবৈধ তৎপরতায় লিপ্ত হতে সাহসী হবে না।
প্রথম আলো নির্বাচন কমিশনকে আমাদের রাজনীতিকেরা রেফারি মানতে রাজি। কিন্তু তার কাছে লাল কার্ড থাকুক, তার প্রয়োগ হোক, সেটা তাঁরা চান না।
মাহবুবে আলম দেখুন, সারা দেশে যদি এক দিনে নির্বাচন হয় তাহলে তার পক্ষে মনোযোগী হওয়া একেবারেই অসম্ভব। এক দিনে যদি দুটো জেলার সংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে কমিশন তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে পারবে। তবে কমিশনের ক্ষমতার প্রয়োগ হতে হবে বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কেন তারা নির্বাচন স্থগিত করল, তার কারণ সবার কাছে স্পষ্ট ও স্বচ্ছ প্রতীয়মান হতে হবে। ভোটকেন্দ্রগুলো যদি লাইভ সম্প্রচারের আওতায় থাকে, তাহলে সবাই বুঝতে পারবে। পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করলেই তো চলবে না। নির্বাচন কমিশন ঠিক কাজ করেছে কি করেনি, সেটা জনগণও তাৎক্ষণিক বুঝতে পারবে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা থাকাই শেষ নয়। সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করার মতো ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব থাকতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পর নির্বাচন কমিশনে অনেকেই গেছেন, পদ অলংকৃত করেছেন। কিন্তু সত্যিকারভাবে সে রকম কায়িক পরিশ্রম এবং একাগ্রতা নিয়ে খুব কম ব্যক্তিই দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রথম আলো সামরিক শাসকেরা জনগণের মধ্যে আস্থা সৃষ্টির জন্য ইসিতে বিচারকদের এনেছেন। কিন্তু আমরা এর সুফল পাইনি।
মাহবুবে আলম নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব বিচারিক-প্রক্রিয়া থেকে ভিন্ন। এটা অনেকটাই প্রশাসনিক। ভোটকেন্দ্রে কারা কারচুপি করছে, কারা মাস্তানি করছে—এসব বিষয়ে দক্ষতার সঙ্গে বুঝতে পারা, ধরতে পারা, ত্বরিত গতিতে সেখানে গিয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার মধ্যে একটা শারীরিক শক্তিরও ব্যাপার আছে। অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এসব কাজ করতে পারবেন না। স্যুট-টাই পরে পুলিশ নিয়ে ঘুরলেই তো চলবে না।
প্রথম আলো কর্মরত বিচারকদের নির্বাচন কমিশনে নিষিদ্ধ করে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের রায়কে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। কর্মরত বিচারকদের নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের কি অবসান ঘটবে?
মাহবুবে আলম আমি সব সময়ই বলে আসছি, বিচারপতি খায়রুল হক শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ বিচারপতি। অনেকে না বুঝে তাঁর সমালোচনা করছেন। তাঁর রায়গুলো যদি আপনারা পড়েন, তাহলে অনুধাবন করবেন তিনি কত বড় মাপের একজন দেশপ্রেমিক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় বিচারকদের যুক্ত করায় বিচার বিভাগ শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তিনি সেটা থেকে সুরক্ষা দিয়েছেন।
প্রথম আলো ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে প্রধান উপদেষ্টার পদে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের বাদ দিয়ে সংবিধান সংশোধনে নির্দেশনা রয়েছে। তাহলে কি—
মাহবুবে আলম এই বিষয়টি নিয়ে যত পানি ঘোলা করা হয়েছে, তা দুঃখজনক। গণতান্ত্রিক দেশে যেকোনো বিদায়ী মন্ত্রিসভা তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবেই কাজ করে। মাগুরার পর ভাবা হয়েছিল প্রধান বিচারপতিকে যুক্ত করলে হয়তো ভালো হবে।
প্রথম আলো আপনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে দুই মেয়াদে কীভাবে নির্বাচন হবে, সে জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় দেখতে হবে।
মাহবুবে আলম আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আদালত দুই মেয়াদের যে কথা বলেছেন, তা কী যুক্তিতে বলেছেন। তখন আমি বলেছি, এটা তো রায় না পড়ে বলা যাবে না। তারা কোন পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন। শর্ট অর্ডার যেটা আমরা পেয়েছি, সেখানে সংসদ এখন কিছুই করতে পারবে না, তা কিন্তু আদালত বলেননি। শর্ট অর্ডারে আছে তত্ত্বাবধায়ক সম্পূর্ণ অবৈধ। তবে কিছু রোমান প্রবচন ব্যবহার করে তাঁরা বলেছেন, আগামী দুই মেয়াদ এটা চলতে পারে। তবে ইতিমধ্যে সংসদের যে ক্ষমতা, তা প্রয়োগে কোনো বাধা নেই।
প্রথম আলো এই যে ‘ইতিমধ্যে’ কথাটা বলেছেন, তাকে কি দুই মেয়াদের আগে নাকি দুই মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও আমরা বুঝতে পারি?
মাহবুবে আলম যখন কোনো সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয় তখন সেই মুহূর্ত থেকে তা বাতিল হয়ে যায়।
প্রথম আলো কিন্তু রায়ে কথাটি ভবিষ্যৎসাপেক্ষে বলা হয়েছে।
মাহবুবে আলম এর মানে হলো, আপনি যদি ভূতাপেক্ষ বলেন তাহলে অতীতের যে নির্বাচন হয়েছে, তা অবৈধ হয়ে যায়। সেটা তো হতে পারে না।
প্রথম আলো আমরা বিষয়টি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ‘গোলকনাথ’ রায়ের আলোকে বুঝব। মাহমুদুল ইসলামের বইতেও এটা স্বীকৃত। এখন পূর্ণাঙ্গ রায় না পাওয়া পর্যন্ত বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার নয়। এখন যদি প্রকৃত কার্যকর অর্থে বাতিল বলেন, তাহলে আপনি দুই মেয়াদে কী করে নির্বাচন করবেন?
মাহবুবে আলম আমার ব্যাখ্যা হলো, কী যুক্তিতে দুই মেয়াদ করা যাবে, সেটা আমরা সংক্ষিপ্ত রায়ে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তাই বলে সংসদকে সে জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে, সেটা আমি মনে করি না। যেমন পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে সবকিছু অবৈধ বলেও কতিপয় বিষয়ে মার্জনা করা হয়েছে। এখন রিভিউর পরে আপিল বিভাগ বলেছেন, সামরিক ফরমান দ্বারা সংযোজিত কতিপয় বিষয় ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মার্জনা করা হলো। আগে তা অনির্দিষ্ট ছিল। এখন নির্দিষ্ট করা হলো। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের আলোকে এটা করা হলো।
প্রথম আলো ওই সময়ের মধ্যে সংসদ কোনো পদক্ষেপ না নিলে কী হবে?
মাহবুবে আলম বাতিল হয়ে যাবে। সে জন্যই বলছি, সংসদ বসে থাকতে পারে না। আজকে সংসদের যে একটি দলের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, সেটা ভবিষ্যতে কোনো সরকারের নাও থাকতে পারে। তাহলে তো একটি শূন্যতা সৃষ্টি হবে।
প্রথম আলো তাহলে দুটি হরতালের পর আপনার কী পরামর্শ?
মাহবুবে আলম যা কিছুই হোক না কেন এখনই সংসদকে যা করার করতে হবে। দুই মেয়াদে অপেক্ষা করলে দীর্ঘ মেয়াদে আমরা বিপদে পড়ে যাব। পুরো জাতি বিপদে পড়ে যাবে।
প্রথম আলো পঞ্চম সংশোধনীর পর সংবিধান পুনর্মুদ্রণের আমরা ব্যাখ্যা পেয়েছিলাম যে, বাতিল অনুচ্ছেদগুলো আর নেই। ত্রয়োদশ সংশোধনীর কি এখন অস্তিত্ব আছে?
মাহবুবে আলম ত্রয়োদশ সংশোধনী যেটা করা হয়েছিল, সেটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর ঘোষণা হয়ে গেছে।
প্রথম আলো সেটা ঠিক। কিন্তু ঘোষণাটা কি সম্পূর্ণ? শর্তসাপেক্ষ নয়? ধরুন কালই সংবিধান ছাপা হলো, তখন কি এটি বাদ যাবে নাকি যাবে না?
মাহবুবে আলম এই মুহূর্তে তো পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে না। যেহেতু জিনিসটা সংসদের বিবেচনায় আছে। আমার মনে হয়, এসব কারণ বিবেচনায় নিয়েই সংসদ অনতিবিলম্বে জিনিসটি মাথায় নিয়ে করতে চাইছে। আদালত দুই মেয়াদ চলতে পারে বলে যে কথাটা বলেছেন, সেই দুই মেয়াদও তো চলার মতো বাস্তব অবস্থায় আমরা নেই। প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার কথা খায়রুল হক সাহেবের। কিন্তু বিএনপি বলেই দিয়েছে, তারা মানবে না। তাহলে বিচার বিভাগ তো বিতর্কিত হয়ে যাচ্ছে। তাই সুপ্রিম কোর্টের মতো প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কের বাইরে রাখতে সংবিধান সংশোধন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ কমিটি অনেকের কথাই শুনেছেন। আমিও তাঁর মধ্যে ছিলাম।
প্রথম আলো কিন্তু আপনারা বাতিলের পক্ষে কেউ বলেননি। দেখা যাচ্ছে, দায়টা শুধু বিচার বিভাগই নিচ্ছে।
মাহবুবে আলম দায়টা বিচার বিভাগ নিচ্ছে, এটা সঠিক নয়। তাঁরা যেটা বলার তা বলে দিয়েছেন। এখন যথাবিহিত ব্যবস্থা নেওয়ার দায় রাজনীতিকদের। তাঁরা চুপ থাকলে দেশ ভবিষ্যতে আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। যাহোক, বিচার বিভাগকে আমাদের বাঁচাতে হবে। আপনি কি বিচার বিভাগকে আরও বিতর্কিত করবেন?
প্রথম আলো বিচার বিভাগকে বাদ দিয়ে বিএনপি প্রস্তাব দিলে সেটা কি গ্রহণযোগ্য হবে? রায় কিন্তু বলছে যে, বিচারকদের বাদ দিয়ে দরকারি সংশোধনী আনতে সংসদ স্বাধীন।
মাহবুবে আলম প্রশ্ন হলো, বিরোধী দল কেন সংসদে যাবে না? পৃথিবীতে এমন সমস্যা নেই, যা আলোচনা করে সুরাহা হয় না। সংসদে গিয়ে বিরোধী দল কথা বললে তারা তো অন্তত বলতে পারবে যে, আমরা এটা বলেছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তারা নিজেদের মুক্ত ও স্বচ্ছ রাখতে পারে।
প্রথম আলো আপনি যে ধরনের নির্বাচনী সংস্কারের কথা বলছেন, তা কী করে জাতীয় আলোচনায় আসতে পারে।
মাহবুবে আলম আমি যে এই কথা বললাম কমিশন একটা কথা বলল, গণমাধ্যম থেকে কথা এল, নাগরিক সমাজ থেকে আসল এভাবেই নানা মহলের কথা থেকেই জনমত তৈরি হয়। আরেকটি কথা বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি সম্পূর্ণরূপে আমাদের গ্রহণ করতে হবে। একে উপেক্ষা করলে চলবে না। যদি সেটা আমরা করি তা হবে বোকামি। বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে, তা আমরা মুহূর্তের মধ্যে প্রত্যক্ষ করতে পারি। আমাদেরও সেটা রপ্ত করতে হবে। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ভোট হলে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের অবসান ঘটবে। আপনি তো দেখে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর ধরে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় ছিল। এবার মমতা ব্যানার্জি তাদের হারিয়ে দিলেন। এই ভোট তো ইভিএম পদ্ধতিতে হয়েছে। কিন্তু সেখানে ভোট-প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো সংশয় সৃষ্টি হয়নি। এই পদ্ধতিতে ভোট হলে জাল ভোট, ব্যালট নষ্ট করা, ব্যালটপত্র কিংবা ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের মতো কোনো ঘটনা ঘটার আর কোনো সুযোগ থাকে না। তাহলে আমরা এটা উপেক্ষা করব কেন। এখন প্রযুক্তির আরও উন্নতি ঘটিয়ে অনলাইনব্যবস্থার সাহায্য নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায়। তাহলে যে ভয়ভীতির কারণে আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চেয়েছিলাম, তার তো প্রাসঙ্গিকতা থাকে না।
প্রথম আলো কিন্তু আমাদের রাজনীতির সমস্যা ভিন্ন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, এখন এর বিরোধিতা বা এর পুনঃপ্রবর্তন করাই বিরোধী দলের রাজনীতির একমাত্র এজেন্ডা। অতীতেও নির্বাচনী ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানোর প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল।
মাহবুবে আলম বিরোধী দল অবশ্যই বুঝবে। মাইকে আজান দেওয়া নিয়ে একসময় ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নাজায়েজ কাজ আর নাজায়েজ নেই। এখন প্রতিটি মসজিদই অন্তত একটি মাইক পাওয়ার জন্য আগ্রহ দেখিয়ে থাকে। একটি রাজনৈতিক দলকে একসময় পরিবার পরিকল্পনাসংক্রান্ত সাইনবোর্ড ভাঙতে দেখেছি। তারাও বিজ্ঞানমনস্ক হবে। কলেরার জন্য একসময় পানি পড়া, তাবিজ ছিল গ্রামবাসীর ভরসা। আজ আর কাউকে পানি পড়া দিয়ে তুষ্ট রাখা যাবে না। গ্যালিলিও ও কোপার্নিকাসের প্রতি তৎকালীন পোপরা যে ভূমিকা রেখেছিলেন, সে জন্য পরে তাঁরা অনুশোচনা করেছেন, ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। কাজেই বিজ্ঞানকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুবে আলম আপনাকে ধন্যবাদ।
No comments