চলতি পথে-গোধূলির ম্লান আলোতেও by দীপংকর চন্দ
বহু পথ অতিক্রম করে বাস এসে থামল পঞ্চগড়। বহুল প্রচলিত মত অনুসারে, পাঁচটি বিখ্যাত গড়ের সুস্পষ্ট অবস্থানের কারণেই এ অঞ্চলের নাম হয়েছে পঞ্চগড়। কী নাম সেই গড়গুলোর? রুহিয়া মোড়ের কাছে একটা টং-দোকানের সামনে বসে চা খেতে খেতে প্রশ্ন করলাম কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দাকে।
তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাঁচটি গড়ের নাম জানালেন—ভিতরগড়, মীরগড়, হোসেনগড়, রাজনগড় ও দেবগড়। নামগুলো শুনতে শুনতে হঠাৎ একটা ইচ্ছে জাগল আমাদের মনে। আচ্ছা, এই গড়গুলোর মধ্যে যেকোনো একটি গড় পরিদর্শনে গেলে কেমন হয়? বেশ ভালো হয় নিশ্চয়ই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোন গড়টি দেখতে যাব আমরা। ভিতরগড়? হ্যাঁ। ভিতরগড় দেখতে গেলেও তো মন্দ হয় না! কিন্তু কোথায় ভিতরগড়? ভাবলাম আমরা এবং রাত্রিবাসের সময় জানলাম, ভিতরগড়ের অবস্থান পঞ্চগড় থানা সদর থেকে খুব একটা দূরে নয়। অতএব পরদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার আগেই শুরু হলো আমাদের ভিতরগড়-যাত্রা।
পঞ্চগড় সদর থেকে তেঁতুলিয়াগামী বাসে চেপে বসলাম প্রথমেই। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর পৌঁছালাম বোর্ড অফিস। বাস থেকে নামতেই পরিচয় হলো মো. শহীদুল ইসলামের সঙ্গে। কৃষিজাত পণ্যের ব্যবসা করেন তিনি। ব্যবসাসংক্রান্ত কাজে এসেছিলেন এখানে। কাজ শেষ। তাই এবার বাড়ি ফিরবেন শহীদুল ইসলাম। তাঁর বাড়ি পঞ্চগড় জেলার কাজিরহাটে। কাজিরহাট জায়গাটি ভিতরগড়ের একেবারে কাছেই। আমাদের গন্তব্যস্থল ‘ভিতরগড়’ শুনেই সহযাত্রার প্রস্তাব দিলেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই সাশ্রয়ী এ প্রস্তাবে সম্মত হলাম আমরা। সানন্দে সঙ্গী হলাম শহীদুল ইসলামের। রিকশাভ্যানে পথচলা শুরু হলো এরপর। চলতে চলতে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হলো উভয় পক্ষে। সেই সূত্রে উঠে এল জীবনের নানা গল্প। গল্প বলার একপর্যায়ে শহীদুল ইসলাম জানালেন তাঁর শৈশবের কথা। জানালেন, বাড়ি কাজিরহাট হলেও ভিতরগড়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর শৈশবের অধিকাংশ স্মৃতি। অতীতের সেই স্মৃতিগুলো তাড়িত করল শহীদুল ইসলামের প্রবহমান বর্তমানকে। আবেগের আতিশয্যে কাজিরহাট নামা হলো না তাঁর কোনোভাবেই। বাড়ি পেছনে ফেলে আমাদের সঙ্গে ভিতরগড় চললেন তিনি, শৈশবের রঙিন স্মৃতিঘেরা এলাকায় বহুদিন পর একটি বিকেল কাটাতে।
ভিতরগড় মূলত একটি প্রাচীন দুর্গনগর। বাংলাদেশে যে কটি গড়ের সন্ধান মিলেছে আজ অবধি, তার মধ্যে মহাস্থানগড় প্রাচীনতম দুর্গনগর হিসেবে বিবেচিত হলেও আয়তনের দিক থেকে ভিতরগড় দুর্গনগরই সম্ভবত সর্ববৃহৎ। উল্লেখযোগ্য কিছু সূত্রমতে, এককালে প্রায় ১২ বর্গমাইলজুড়ে ছিল এই গড়ের বিস্তৃতি। যত দূর জানা যায়, ভিতরগড় দুর্গ নির্মাণের সঙ্গে কামরূপের শূদ্রবংশীয় রাজা দেবেশ্বরের বংশজাত পৃথু রাজার নাম সম্পৃক্ত। আনুমানিক ষষ্ঠ শতকের শেষার্ধে সম্রাট হর্ষবর্ধনের সময় কামরূপের কোনো এক যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে রাজা পৃথুর আগমন ঘটে এই এলাকায়। এখানে তিনি গড় নির্মাণ করেন, স্থাপন করেন নতুন রাজ্য। ১৮০৯ সালে ড. বুকানন হেমিলটন পরিদর্শন করেছিলেন এই গড়টি। তাঁর বর্ণনানুসারে মোট চারটি অভ্যন্তরীণ গড়ের সমন্বয়ে গঠিত ছিল ভিতরগড় দুর্গনগর। গড়গুলোর অবস্থান ছিল একটি অপরটির ভেতর। সবচেয়ে ভেতরের গড়ে নির্মিত হয়েছিল রাজা পৃথুর প্রাসাদ। তবে সেসব কীর্তি এখন দৃশ্যমান তো নয়ই, অনুধাবনযোগ্যও নয় মোটেই। প্রাচীন সেই নিদর্শনগুলো বিদীর্ণ আজ কালের আঘাতে। বিস্তীর্ণ এলাকার নিচে চাপা পড়েছে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যেতে যেতে শহীদুল ইসলাম জানালেন ভিতরগড়ের নানা বৃত্তান্ত। আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনলাম তাঁর কথা, তারপর প্রশ্ন করলাম, ‘তাহলে আমাদের দেখার মতো কী রয়েছে এখন ভিতরগড়ে?’ প্রশ্ন শুনে শহীদুল ইসলাম একটু ভাবলেন; তারপর আনমনে বললেন, ‘গড়ের ভেতর অবস্থিত বিশাল একটা দিঘি রয়েছে এখনো। লোকে সেটাকে মহারাজার দিঘি নামেই ডাকে।’
আশ্চর্য! বুকাননের বর্ণনার সঙ্গে তো হুবহু মিলে যাচ্ছে শহীদুল ইসলামের কথা! ভিতরগড় রাজপ্রাসাদের সন্নিকটেই একটা সুবিশাল দিঘির কথা উল্লেখ করেছিলেন বুকানন। এটিই কি তবে সেই প্রাচীন দিঘি? ভাবতে ভাবতে জঙ্গলাকীর্ণ এক টিলাভূমির সামনে পৌঁছে গেলাম আমরা। এবার ভ্যান থামানোর নির্দেশ দিলেন শহীদুল ইসলাম। জানালেন, আমরা এখানেই নামব। আচ্ছা সে না হয় নামলাম, কিন্তু দিঘি কই? মহারাজার দিঘি? কথার উত্তর না দিয়ে বিপৎসংকুল সেই টিলাভূমির ওপর উঠতে লাগলেন শহীদুল ইসলাম। উপায়ান্তর না দেখে চোখ-কান বন্ধ করে তাঁকে অনুসরণ করলাম আমরা। অনুসরণের একপর্যায়ে অমরাবতীর আলোয় যেন উদ্ভাসিত হলো মর্ত্যলোক! চারদিক পরিবেষ্টিত টিলাভূমির মাঝখানে উদয় হলো অনিন্দ্যসুন্দর একটি দিঘি! মহারাজার দিঘি!
মহাকালের সুনির্দিষ্ট নিয়মে ভিতরগড়ের সুপ্রাচীন জনপদ প্রলয়তাড়িত হলেও খুব বেশি আঁচড় কি লেগেছে মহারাজার দিঘির গায়ে? স্থানীয় অধিবাসীদের ভাষ্যে, ‘লেগেছে অবশ্যই।’ কিন্তু দিঘির রূপ-সৌন্দর্য যতটুকু অবশিষ্ট আছে এখনো, তাতেই যে বিমুগ্ধ আমরা, বিমোহিত গোধূলির ম্লান আলোতেও!
দীপংকর চন্দ
পঞ্চগড় সদর থেকে তেঁতুলিয়াগামী বাসে চেপে বসলাম প্রথমেই। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর পৌঁছালাম বোর্ড অফিস। বাস থেকে নামতেই পরিচয় হলো মো. শহীদুল ইসলামের সঙ্গে। কৃষিজাত পণ্যের ব্যবসা করেন তিনি। ব্যবসাসংক্রান্ত কাজে এসেছিলেন এখানে। কাজ শেষ। তাই এবার বাড়ি ফিরবেন শহীদুল ইসলাম। তাঁর বাড়ি পঞ্চগড় জেলার কাজিরহাটে। কাজিরহাট জায়গাটি ভিতরগড়ের একেবারে কাছেই। আমাদের গন্তব্যস্থল ‘ভিতরগড়’ শুনেই সহযাত্রার প্রস্তাব দিলেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই সাশ্রয়ী এ প্রস্তাবে সম্মত হলাম আমরা। সানন্দে সঙ্গী হলাম শহীদুল ইসলামের। রিকশাভ্যানে পথচলা শুরু হলো এরপর। চলতে চলতে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হলো উভয় পক্ষে। সেই সূত্রে উঠে এল জীবনের নানা গল্প। গল্প বলার একপর্যায়ে শহীদুল ইসলাম জানালেন তাঁর শৈশবের কথা। জানালেন, বাড়ি কাজিরহাট হলেও ভিতরগড়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর শৈশবের অধিকাংশ স্মৃতি। অতীতের সেই স্মৃতিগুলো তাড়িত করল শহীদুল ইসলামের প্রবহমান বর্তমানকে। আবেগের আতিশয্যে কাজিরহাট নামা হলো না তাঁর কোনোভাবেই। বাড়ি পেছনে ফেলে আমাদের সঙ্গে ভিতরগড় চললেন তিনি, শৈশবের রঙিন স্মৃতিঘেরা এলাকায় বহুদিন পর একটি বিকেল কাটাতে।
ভিতরগড় মূলত একটি প্রাচীন দুর্গনগর। বাংলাদেশে যে কটি গড়ের সন্ধান মিলেছে আজ অবধি, তার মধ্যে মহাস্থানগড় প্রাচীনতম দুর্গনগর হিসেবে বিবেচিত হলেও আয়তনের দিক থেকে ভিতরগড় দুর্গনগরই সম্ভবত সর্ববৃহৎ। উল্লেখযোগ্য কিছু সূত্রমতে, এককালে প্রায় ১২ বর্গমাইলজুড়ে ছিল এই গড়ের বিস্তৃতি। যত দূর জানা যায়, ভিতরগড় দুর্গ নির্মাণের সঙ্গে কামরূপের শূদ্রবংশীয় রাজা দেবেশ্বরের বংশজাত পৃথু রাজার নাম সম্পৃক্ত। আনুমানিক ষষ্ঠ শতকের শেষার্ধে সম্রাট হর্ষবর্ধনের সময় কামরূপের কোনো এক যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে রাজা পৃথুর আগমন ঘটে এই এলাকায়। এখানে তিনি গড় নির্মাণ করেন, স্থাপন করেন নতুন রাজ্য। ১৮০৯ সালে ড. বুকানন হেমিলটন পরিদর্শন করেছিলেন এই গড়টি। তাঁর বর্ণনানুসারে মোট চারটি অভ্যন্তরীণ গড়ের সমন্বয়ে গঠিত ছিল ভিতরগড় দুর্গনগর। গড়গুলোর অবস্থান ছিল একটি অপরটির ভেতর। সবচেয়ে ভেতরের গড়ে নির্মিত হয়েছিল রাজা পৃথুর প্রাসাদ। তবে সেসব কীর্তি এখন দৃশ্যমান তো নয়ই, অনুধাবনযোগ্যও নয় মোটেই। প্রাচীন সেই নিদর্শনগুলো বিদীর্ণ আজ কালের আঘাতে। বিস্তীর্ণ এলাকার নিচে চাপা পড়েছে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যেতে যেতে শহীদুল ইসলাম জানালেন ভিতরগড়ের নানা বৃত্তান্ত। আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনলাম তাঁর কথা, তারপর প্রশ্ন করলাম, ‘তাহলে আমাদের দেখার মতো কী রয়েছে এখন ভিতরগড়ে?’ প্রশ্ন শুনে শহীদুল ইসলাম একটু ভাবলেন; তারপর আনমনে বললেন, ‘গড়ের ভেতর অবস্থিত বিশাল একটা দিঘি রয়েছে এখনো। লোকে সেটাকে মহারাজার দিঘি নামেই ডাকে।’
আশ্চর্য! বুকাননের বর্ণনার সঙ্গে তো হুবহু মিলে যাচ্ছে শহীদুল ইসলামের কথা! ভিতরগড় রাজপ্রাসাদের সন্নিকটেই একটা সুবিশাল দিঘির কথা উল্লেখ করেছিলেন বুকানন। এটিই কি তবে সেই প্রাচীন দিঘি? ভাবতে ভাবতে জঙ্গলাকীর্ণ এক টিলাভূমির সামনে পৌঁছে গেলাম আমরা। এবার ভ্যান থামানোর নির্দেশ দিলেন শহীদুল ইসলাম। জানালেন, আমরা এখানেই নামব। আচ্ছা সে না হয় নামলাম, কিন্তু দিঘি কই? মহারাজার দিঘি? কথার উত্তর না দিয়ে বিপৎসংকুল সেই টিলাভূমির ওপর উঠতে লাগলেন শহীদুল ইসলাম। উপায়ান্তর না দেখে চোখ-কান বন্ধ করে তাঁকে অনুসরণ করলাম আমরা। অনুসরণের একপর্যায়ে অমরাবতীর আলোয় যেন উদ্ভাসিত হলো মর্ত্যলোক! চারদিক পরিবেষ্টিত টিলাভূমির মাঝখানে উদয় হলো অনিন্দ্যসুন্দর একটি দিঘি! মহারাজার দিঘি!
মহাকালের সুনির্দিষ্ট নিয়মে ভিতরগড়ের সুপ্রাচীন জনপদ প্রলয়তাড়িত হলেও খুব বেশি আঁচড় কি লেগেছে মহারাজার দিঘির গায়ে? স্থানীয় অধিবাসীদের ভাষ্যে, ‘লেগেছে অবশ্যই।’ কিন্তু দিঘির রূপ-সৌন্দর্য যতটুকু অবশিষ্ট আছে এখনো, তাতেই যে বিমুগ্ধ আমরা, বিমোহিত গোধূলির ম্লান আলোতেও!
দীপংকর চন্দ
No comments