গদ্যকার্টুন-আপনি কি সফল হতে চান? by আনিসুল হক
আপনি কি ছাপোষা জীবন যাপন করছেন? জীবনটা হোস্টেলের ডালের মতো পানসে লাগছে? কোনো চার্ম নেই। আজ সিঙ্গাপুর তো কাল কুয়ালালামপুর করতে পারছেন না। আজিমপুর টু মিরপুর করেই দিন কাটছে। দুপুরবেলা রুটি-ভাজি গিলতে কষ্ট হচ্ছে! বিকেলের বিলাসিতা মোড়ের দোকানের ডালপুরি?
ওয়েস্টিনে ব্রেকফাস্ট তো সোনারগাঁওয়ে ডিনার হচ্ছে না? লাস ভেগাসে গিয়ে হাজার হাজার ডলার ওড়ানোর মুরোদ নেই? কিন্তু স্বপ্ন আছে? হাজার কোটি টাকার মালিক হতে চান? কিন্তু ব্যাংকে কোনো অ্যাকাউন্টই নেই?
আপনাকেই আমরা খুঁজছি। বছর ঘোরার আগেই এক শ কোটি টাকা। দুই বছরের মাথায় হাজার কোটি টাকার মালিক হতে পারবেন আপনি। বউয়ের গয়না বিক্রি করুন। কিছু টাকা নিয়ে আসুন। ঢাকায় একটা বাড়ি ভাড়া করতে হবে। লাখ দুয়েক টাকা তো বিনিয়োগ করতেই হবে। একেবারে কিছুই খাটাবেন না, তা কী করে হয়। মাথাটা তো খাটাতেই হবে, কিছু টাকাও। লাখ কয়েক টাকা বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিন, এক মাসের মাথায় শোধ করে দিতে পারবেন। একটা অফিস নিয়েছেন? এবার একটা কাগজ নিন। এটাতে মানচিত্র আঁকুন। ইচ্ছেমতো আঁকুন। নাম দিন ‘পূর্বাচল চাঁদের দেশ প্রকল্প’। মানচিত্রটা কিসের? চারকোনা করে কতগুলো ঘর আঁকুন। সেক্টর এক। রাস্তা এক। তার দুধারে প্লট। তারপর রাস্তা দুই। তার দুধারে প্লট। তিন কাঠা। পাঁচ কাঠা। ইচ্ছেমতো আঁকুন। লেক আঁকুন। লেকভিউ প্লট। ১০ কাঠা। এক হাজারটা প্লট আঁকুন। দুই হাজার প্লট আঁকুন। এবার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিন। বর্ষা উপলক্ষে কদমবাহার ছাড়। কাঠাপ্রতি তিন লাখ টাকা ছাড়। বুকিং দিলেই রঙিন টেলিভিশন। এক লাখ টাকা বুকিং। তারপর মাসে মাসে কাঠাপ্রতি কুড়ি হাজার টাকা কিস্তি। পাঁচ বছর ধরে দেওয়া যাবে। হইহই কাণ্ড রইরই ব্যাপার।
এরপর ঢাকার বাইরে কোনো একটা ধানখেতের চাষির কাছ থেকে ধানখেতে সাইনবোর্ড লাগানোর অনুমতিটা কিনে নিন। চাষি মাসে মাসে এক হাজার টাকা করে পাবেন। এই হলো আপনার সাইট। তাতে সাইনবোর্ড লাগান ‘পূর্বাচল চাঁদের দেশ প্রকল্প’। বাইশ শতকের আবাসভূমি। জমি বিক্রি শুরু হয়ে গেল। টাকা আসতে শুরু করেছে? ১০০ জন বুকিং দিয়েছেন? ব্যস, পকেটে এক কোটি টাকা এসেছে। সামনের মাসে আবার এক কোটি টাকা আসবে। এবার বিজ্ঞাপনের মহড়া বাড়িয়ে দিন। প্রকল্প এলাকায় পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে এক বিঘা জমি কিনেও ফেলুন। ব্যস, আর কিছু না। দাগ দেওয়া প্লট বিক্রি করতে থাকুন। টাকা আর টাকা। টাকা মানে সম্মান। টাকা মানে নিরাপত্তা। এক হাজার প্লট বিক্রি হয়েছে? ৫০০ কোটি টাকা আপনার পকেটে। এবার আপনি কিছু প্লট ক্রেতাকে বুঝিয়ে দিন। হ্যাঁ, বিভিন্ন ঘাটে কিছু টাকাপয়সা তো আপনাকে খরচ করতেই হবে। ক্রেতারা যদি দল বেঁধে ঘেরাও করতে আসে? আসবে না। কত প্লটই তো বিক্রি হয়েছে। কত ক্রেতা বুঝে পেয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও কত বেশিসংখ্যক ক্রেতা বুঝে পায়নি। তাই বলে কি প্লটের ব্যবসা থেমে আছে? সব কোম্পানি মিলে যত প্লট বিক্রি করেছে, তার মোট জমির পরিমাণ ৫৫ হাজার ১২৬ বর্গমাইলের বেশি না কম, এটা একটা প্রশ্ন বটে। তবে আমাদের প্রকল্পের নাম যেহেতু ‘পূর্বাচল চাঁদের দেশ প্রকল্প’, সেহেতু আমাদের সেই দুর্ভাবনা না করলেও চলবে। দেশে জমি না পেলে আমরা চাঁদের জমি বিক্রি করব।
এ ব্যবসায় কোনো লস নেই। আপনার হাতে যখন টাকা আসবে, তখন আইনের হাত আপনার কাছে লম্বা মনে হবে না। টাকা আপনাকে সব দেবে। দেবে মান-সম্মান-নিরাপত্তা। দেবে প্রভাব-প্রতিপত্তি। আপনি তখন ধরাকে সরা জ্ঞান করে সরার দই খাবেন। পৃথিবীটা কার বশ? অবশ্যই টাকার। পত্রিকা-টেলিভিশনে আপনার বিজ্ঞাপন বেরুচ্ছে, কেউ আপনার বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দ করবে না। নেতাদের আপনি চাঁদা দেবেন। তাঁরা আপনার প্রকল্পের নকশার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে ফিতা কাটবেন। আমার মতো কবি-সাহিত্যিকেরা আপনার মতো দেশসেবক-জনসেবক উদ্যোক্তাদের কীর্তি বন্দনা করে কবিতা লিখবে। কলাম লিখবে। আমরা বলব, আপনি কর্মসংস্থান করেছেন। আপনি এ দেশের বাসস্থান সমস্যার সমাধানে যে অবদান রাখছেন, তার কোনো তুলনা নেই। আপনি চাইলে আপনার নামে পদক প্রবর্তন করতে পারেন—‘আক্কেল আলী অনন্য বুদ্ধিজীবী পদক’। বছরে একবার বড় অনুষ্ঠান করে সেই পদক তুলে দিতে পারেন দেশের সবচেয়ে অগ্রগণ্য কোনো বুদ্ধিজীবীর হাতে। সবাই ধন্য ধন্য করবে।
আপনি এখন অনেক বড়লোক। আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমি আপনাকে পরামর্শ দিতেও এখন ভয় পাচ্ছি। আমার এই লেখার মাধ্যমে আমি যে বেয়াদবি করেছি, আপনি আশা করি তা নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন। সাফল্য এখন আপনার করতলে। আপনি সুখী হোন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আপনাকেই আমরা খুঁজছি। বছর ঘোরার আগেই এক শ কোটি টাকা। দুই বছরের মাথায় হাজার কোটি টাকার মালিক হতে পারবেন আপনি। বউয়ের গয়না বিক্রি করুন। কিছু টাকা নিয়ে আসুন। ঢাকায় একটা বাড়ি ভাড়া করতে হবে। লাখ দুয়েক টাকা তো বিনিয়োগ করতেই হবে। একেবারে কিছুই খাটাবেন না, তা কী করে হয়। মাথাটা তো খাটাতেই হবে, কিছু টাকাও। লাখ কয়েক টাকা বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিন, এক মাসের মাথায় শোধ করে দিতে পারবেন। একটা অফিস নিয়েছেন? এবার একটা কাগজ নিন। এটাতে মানচিত্র আঁকুন। ইচ্ছেমতো আঁকুন। নাম দিন ‘পূর্বাচল চাঁদের দেশ প্রকল্প’। মানচিত্রটা কিসের? চারকোনা করে কতগুলো ঘর আঁকুন। সেক্টর এক। রাস্তা এক। তার দুধারে প্লট। তারপর রাস্তা দুই। তার দুধারে প্লট। তিন কাঠা। পাঁচ কাঠা। ইচ্ছেমতো আঁকুন। লেক আঁকুন। লেকভিউ প্লট। ১০ কাঠা। এক হাজারটা প্লট আঁকুন। দুই হাজার প্লট আঁকুন। এবার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিন। বর্ষা উপলক্ষে কদমবাহার ছাড়। কাঠাপ্রতি তিন লাখ টাকা ছাড়। বুকিং দিলেই রঙিন টেলিভিশন। এক লাখ টাকা বুকিং। তারপর মাসে মাসে কাঠাপ্রতি কুড়ি হাজার টাকা কিস্তি। পাঁচ বছর ধরে দেওয়া যাবে। হইহই কাণ্ড রইরই ব্যাপার।
এরপর ঢাকার বাইরে কোনো একটা ধানখেতের চাষির কাছ থেকে ধানখেতে সাইনবোর্ড লাগানোর অনুমতিটা কিনে নিন। চাষি মাসে মাসে এক হাজার টাকা করে পাবেন। এই হলো আপনার সাইট। তাতে সাইনবোর্ড লাগান ‘পূর্বাচল চাঁদের দেশ প্রকল্প’। বাইশ শতকের আবাসভূমি। জমি বিক্রি শুরু হয়ে গেল। টাকা আসতে শুরু করেছে? ১০০ জন বুকিং দিয়েছেন? ব্যস, পকেটে এক কোটি টাকা এসেছে। সামনের মাসে আবার এক কোটি টাকা আসবে। এবার বিজ্ঞাপনের মহড়া বাড়িয়ে দিন। প্রকল্প এলাকায় পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে এক বিঘা জমি কিনেও ফেলুন। ব্যস, আর কিছু না। দাগ দেওয়া প্লট বিক্রি করতে থাকুন। টাকা আর টাকা। টাকা মানে সম্মান। টাকা মানে নিরাপত্তা। এক হাজার প্লট বিক্রি হয়েছে? ৫০০ কোটি টাকা আপনার পকেটে। এবার আপনি কিছু প্লট ক্রেতাকে বুঝিয়ে দিন। হ্যাঁ, বিভিন্ন ঘাটে কিছু টাকাপয়সা তো আপনাকে খরচ করতেই হবে। ক্রেতারা যদি দল বেঁধে ঘেরাও করতে আসে? আসবে না। কত প্লটই তো বিক্রি হয়েছে। কত ক্রেতা বুঝে পেয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও কত বেশিসংখ্যক ক্রেতা বুঝে পায়নি। তাই বলে কি প্লটের ব্যবসা থেমে আছে? সব কোম্পানি মিলে যত প্লট বিক্রি করেছে, তার মোট জমির পরিমাণ ৫৫ হাজার ১২৬ বর্গমাইলের বেশি না কম, এটা একটা প্রশ্ন বটে। তবে আমাদের প্রকল্পের নাম যেহেতু ‘পূর্বাচল চাঁদের দেশ প্রকল্প’, সেহেতু আমাদের সেই দুর্ভাবনা না করলেও চলবে। দেশে জমি না পেলে আমরা চাঁদের জমি বিক্রি করব।
এ ব্যবসায় কোনো লস নেই। আপনার হাতে যখন টাকা আসবে, তখন আইনের হাত আপনার কাছে লম্বা মনে হবে না। টাকা আপনাকে সব দেবে। দেবে মান-সম্মান-নিরাপত্তা। দেবে প্রভাব-প্রতিপত্তি। আপনি তখন ধরাকে সরা জ্ঞান করে সরার দই খাবেন। পৃথিবীটা কার বশ? অবশ্যই টাকার। পত্রিকা-টেলিভিশনে আপনার বিজ্ঞাপন বেরুচ্ছে, কেউ আপনার বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দ করবে না। নেতাদের আপনি চাঁদা দেবেন। তাঁরা আপনার প্রকল্পের নকশার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে ফিতা কাটবেন। আমার মতো কবি-সাহিত্যিকেরা আপনার মতো দেশসেবক-জনসেবক উদ্যোক্তাদের কীর্তি বন্দনা করে কবিতা লিখবে। কলাম লিখবে। আমরা বলব, আপনি কর্মসংস্থান করেছেন। আপনি এ দেশের বাসস্থান সমস্যার সমাধানে যে অবদান রাখছেন, তার কোনো তুলনা নেই। আপনি চাইলে আপনার নামে পদক প্রবর্তন করতে পারেন—‘আক্কেল আলী অনন্য বুদ্ধিজীবী পদক’। বছরে একবার বড় অনুষ্ঠান করে সেই পদক তুলে দিতে পারেন দেশের সবচেয়ে অগ্রগণ্য কোনো বুদ্ধিজীবীর হাতে। সবাই ধন্য ধন্য করবে।
আপনি এখন অনেক বড়লোক। আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমি আপনাকে পরামর্শ দিতেও এখন ভয় পাচ্ছি। আমার এই লেখার মাধ্যমে আমি যে বেয়াদবি করেছি, আপনি আশা করি তা নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন। সাফল্য এখন আপনার করতলে। আপনি সুখী হোন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments