ভূমিগ্রাস-ভারতে কৃষকবিরোধী যুদ্ধ by বন্দনা শিবা
ভূমিই জীবন। তৃতীয় বিশ্বের কৃষক ও আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার বুনিয়াদ হলো ভূমি। বিশ্ব অর্থনীতিতেও এটা সবচেয়ে অপরিহার্য সম্পদ হয়ে উঠছে। বিশ্বায়নের সম্পদের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংঘর্ষের প্রধান উৎস হিসেবে হাজির হয়েছে ভূমি। ভারতের ৬৫ শতাংশ মানুষ ভূমির ওপর নির্ভরশীল।
একই সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতিরও (যা ফাটকাবাজির অর্থব্যবস্থা ও সীমাহীন ভোগবাদ দ্বারা চালিত) ভূমি চাই খনির জন্য, কারখানার জন্য, শহর, মহাসড়ক ও জৈব জ্বালানি আবাদের জন্য। বিশ্বে ফাটকাবাজির অর্থনীতি প্রকৃত পণ্য ও সেবার মূল্যের চেয়ে কয়েক শ গুণ বড়।
বণিক পুঁজি বিনিয়োগ চায় আর চায় বিনিয়োগের বিপরীতে বিপুল প্রাপ্তি। এ জন্য পৃথিবীর তাবৎ জিনিসকে পণ্যে পরিণত করা আবশ্যক হয়—ভূমি ও পানি, বৃক্ষ ও জিন, অণুুজীব ও স্তন্যপায়ী সবাইকে। ভূমির পণ্যায়ন ভারতে করপোরেটের ভূমিগ্রাসে উৎসাহ জোগাচ্ছে। কাজটি সম্পাদিত হচ্ছে বিশেষ বাণিজ্য অঞ্চল (ইপিজেড) তৈরি এবং আবাসন খাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের হাত ধরে।
দুনিয়ার বেশির ভাগ মানুষের কাছে ভূমি হলো, ‘তেরা মাদ্রে’, ‘মাদার আর্থ’, ‘ভূমি’, ‘ধরতি মা’। ভূমিই মানুষের পরিচয়, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ভিত্তি। ভূমির সঙ্গে বন্ধন আমাদের ধরিত্রীর সঙ্গেই বন্ধন। তৃতীয় বিশ্বের ৭৫ শতাংশ মানুষ ভূমির ওপর, ভূমির সহায়তায় বাঁচে। ধরিত্রীই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জীবিকাদাতা: গ্লোবাল সাউথের অধিবাসীদের ৭৫ শতাংশ সম্পদের উৎস ভূমি।
বলপ্রয়োগে জোর করে ভূমি দখলের ওপর দাঁড়িয়েছিল উপনিবেশীকরণ। আর এখন বিশ্বায়নের রূপে যে পুনঃ উপনিবেশীকরণ চলছে তা ভারত, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় বিপুল ভূমিগ্রাসের পথে চালিত করছে। ফাটকা বিনিয়োগের জন্য, অসম, অপরিকল্পিত ফাটকা নগর গড়ে তোলার জন্য, খনি ও কারখানা স্থাপনের জন্য, মহাসড়ক ও দ্রুতগমনপথ নির্মাণের জন্য ভূমিগ্রাসের ঘটনা ঘটছে। কৃষকদের ঋণের ফাঁদে ফেলে, আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়ে তাদের কাছ থেকে ভূমি গ্রাস করা হচ্ছে।
ভারতের ভূমিপ্রশ্ন: ভারতে ভূমিগ্রাসের রাস্তা সহজ হয়েছে ঔপনিবেশিক ভূমি অধিগ্রহণ আইন, ১৮৯৪ এবং নয়া উদারবাদী নীতিমালার মাধ্যমে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া—এই দুইয়ের বিষাক্ত মিশ্রণের দ্বারা। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে লাগামহীন লোভ ও শোষণমূলক ব্যবস্থার শাসন। সেই পথ সুগম হয়েছে পুলিশি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ঔপনিবেশিক রাজবৈরী আইন ব্যবহারের দ্বারা। রাজবৈরী আইনে জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ানো জাতিবিরোধী কাজ হিসেবে বিবেচিত।
ভূমিকে পণ্যে পরিণত করতে বহু বছর ধরে কাজ করে চলেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের ১৯৯১ সালের কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি ভূমি সংস্কারকে আগাগোড়া উল্টে দেয়; খনি-খনন, সড়ক ও বন্দরের বিধিনিষেধ তুলে দেয়। জোত যার জমি তার হাতে রাখার স্বাধীন ভারতের বিধান উল্টে দেওয়া হলেও ১৮৯৪ সালের ভূমি অধিগ্রহণ আইন স্পর্শও করা হয়নি। তাই রাষ্ট্র জোর করে বলপ্রয়োগে কৃষক ও ট্রাইবাল জনগণের কাছ থেকে ভূমি অধিগ্রহণ করে বেসরকারি ফাটকাবাজ, আবাসনশিল্প করপোরেশন, খনি কোম্পানি ও শিল্পের হাতে তুলে দিতে পারে।
আগাপাছতলা সারা ভারতে, উত্তর প্রদেশের ভাট্টা থেকে ওডিশার জগৎসিংহপুর হয়ে মহারাষ্ট্রের জৈতাপুর—সবখানে সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে আমাদের কৃষক, আমাদের অন্নদাতাদের বিরুদ্ধে, তাদের উর্বর ফসলি জমি গ্রাস করার জন্য।
তাদের হাতিয়ার ঔপনিবেশিক ভূমি অধিগ্রহণ আইন—এই একই হাতিয়ার ব্যবহার করেছে বিদেশি শাসকেরা, ভারতীয় অধিবাসীদের বিরুদ্ধে। আইনটি প্রণয়নের সময় ১৮৯৪ সালে বিদেশি শাসকেরা যেমন আচরণ করেছে, ঠিক একইভাবে আচরণ করছে সরকার—বলপ্রয়োগে ভূমি দখল করছে করপোরেশনগুলোর মুনাফার স্বার্থে। উত্তর প্রদেশে যমুনা দ্রুতগমনপথের কাজে জয়পি ইনফ্রাটেক, ওডিশায় পসকো এবং জৈতাপুরে আরিভা নিজস্ব মুনাফার জন্য ভূমি গ্রাস করছে, কোনো দিক থেকে তা জনগণের স্বার্থে নয়। আজ দেশে অবাধে ঘটছে এসব।
ভারত রাষ্ট্রের গণতন্ত্র, আমাদের শান্তি ও আমাদের প্রতিবেশ, আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা ও গ্রামীণ জীবিকার ওপর এসব ভূমিযুদ্ধের ভয়ানক প্রভাব আছে। প্রতিবেশগতভাবে ও গণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়ে ভারতকে টিকে থাকতে হলে এসব ভূমি যুদ্ধের অবসান ঘটাতেই হবে।
ওডিশা সরকার জগৎসিংহপুরে যখন জনগণের ভূমি নিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন রাহুল গান্ধী উত্তর প্রদেশের ভাট্টায় একই ধরনের ঘটনায় জানান দিলেন জোরপূর্বক ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান। (জগৎসিংপুরের জনতা ২০০৫ সাল থেকে ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে) পরিবেশমন্ত্রী জয়রাম রমেশ স্বীকার করেছেন, পেসকো প্রকল্প পাস করার সবুজ সংকেত তিনি দিয়েছিলেন (খবর অনুযায়ী) প্রচণ্ড চাপে পড়ে। প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘কার চাপে?’ ভূমির প্রশ্নে এই দৃশ্যমান দ্বিমুখী নীতি থামাতেই হবে।
ভূমি বলাৎকার: উত্তর প্রদেশের বৃহত্তর নয়ডার ভাট্টা পারসুয়ালে প্রায় ছয় হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছে অবকাঠামোবিষয়ক কোম্পানি জয়প্রকাশ অ্যাসোসিয়েটস, বিলাসবহুল শহর ও খেলাধুলার কেন্দ্র নির্মাণ করার জন্য (ফর্মুলা ওয়াল রেসট্রেকও যার অন্তর্ভুক্ত)। এগুলো তারা করছে যমুনা দ্রুতগমনপথ নির্মাণের আড়ালে। ১৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্রুতগমনপথ নির্মাণের জন্য এক হাজার ২২৫টি গ্রামের ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এই অন্যায় ভূমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদ করেছেন কৃষকেরা। প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন চারজন। আর ৭ মে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে বহু কৃষক আহত হন। ভারতের অন্নসংস্থানের এই হূৎপিণ্ডে সরকার যদি ভূমিযুদ্ধ অব্যাহত রাখে, তবে শান্তির কোনো সম্ভাবনাই নেই। ভূমিবিচ্ছেদের ক্ষতিপূরণ অর্থ দিয়ে হয় না, কোনোভাবেই হয় না। যেমন বলেছেন অশীতিপর বৃদ্ধ কৃষক পরশুরাম (যমুনা দ্রুতগমনপথের জন্য ভূমি হারিয়েছেন তিনি), ‘আপনি কোনো দিন বুঝবেন না ভূমিহীন হয়ে গেলে কেমন লাগে।’
ভূমি অধিগ্রহণ আইন ব্যবহার করে সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ভূমি নিয়ে নেওয়ার সময় কৃষকদের প্রতি বর্গমিটার ভূমির জন্য দেয় ৩০০ রুপি (৬ ডলার) অথচ ডেভেলপার প্রতি বর্গমিটার জায়গা বেচে ছয় লাখ রুপিতে (১৩,৪৫০ ডলার)। অর্থাৎ দাম বেড়ে যায় দুই লাখ গুণ। এভাবেই মুনাফা। দারিদ্র্য, অধিকারহীনতা ও সংঘর্ষ ঘটতে সাহায্য করে এই ভূমিগ্রাস ও মুনাফা।
একইভাবে ১৮ এপ্রিল মহারাষ্ট্রের জৈতাপুরে পারমাণবিক জ্বালানি পার্কের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। প্রস্তাবিত পার্কটি একটি ছোট বন্দর শহরের পার্শ্ববর্তী গ্রামে নির্মাণের প্রস্তাব ছিল। পুলিশি নৃশংসতায় একজনের মৃত্যু ঘটে, গুরুতর আহত হয় আটজন। জৈতাপুর পারমাণবিক কেন্দ্র হবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ। এটি নির্মাণের দায়িত্বে আছে ফরাসি কোম্পানি আরিভা। ফুকুশিমা বিপর্যয়ের পর প্রতিবাদ তীব্রতর হয়েছে, পাশাপাশি তীব্রতর হয়েছে সরকারের একগুঁয়েমিও।
এখন একই ধরনের পরিস্থিতি দানা বাঁধতে শুরু করেছে ওডিশার জগৎসিংপুরে। সেখানে ভারতের বৃহত্তম প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পসকো স্টিল প্রকল্পের শরিকানা সংরক্ষণের জন্য সংবিধানবিরোধী ভূমি অধিগ্রহণে সহায়তা দিতে ২০ ব্যাটালিয়ন সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। এই ভূমিগ্রাস সহজ করার জন্য সরকার প্রতিদিন ৪০টি পান খামার ধ্বংসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। প্রতি একর জমিতে পান চাষ করে কৃষকেরা প্রতিবছর আয় করেন চার লাখ রুপি (নয় হাজার ডলার)। গত পাঁচ বছরে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ চালানোর সময়ে পসকোবিরোধী আন্দোলন বহুবার রাষ্ট্রীয় সহিংসতার শিকার হয়েছে। এবার এ আন্দোলন আরেক দফা, হয়তো চূড়ান্ত অহিংস ও গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই প্রতিরোধ এমন এক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে রাষ্ট্র করপোরেটের মুনাফার জন্য অগণতান্ত্রিক ভূমিগ্রাসের পথ সহজ করতে বলপ্রয়োগ করে, যথাযথ প্রক্রিয়া ও জনগণের সাংবিধানিক অধিকারকে পাশ কাটিয়ে যায়।
এসব ভূমিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার গণতন্ত্রের জমিন ধ্বংস করছে। ভূমি ও উন্নয়নের ব্যাপারে জনগণ ও পঞ্চায়েতের গণতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সংবিধানস্বীকৃত হলেও সরকার তাদের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে অশ্রদ্ধা করছে। পসকো প্রকল্পে এটা স্পষ্ট হয়েছে। সেখানে তিনটি পঞ্চায়েত তাদের ভূমি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
বলপ্রয়োগ ও জীবন-জীবিকা ধ্বংসের যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, এটা শুধু গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্যই নয়, ভারতীয় জাতিরাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্যও বিপজ্জনক। আজ ভারত নিজেকে বর্ধনশীল বা সমৃদ্ধিময় অর্থনীতি দাবি করতে পারে, অথচ তার ৪০ শতাংশ সন্তানের খাবার জোগাতে পারে না—এ যে জাতীয় লজ্জার ব্যাপার।
সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের সাক্ষী হিসেবে ভূমি কনক্রিটের জঙ্গল বানানোর ক্ষেত্র নয়, এটা মানুষের অস্তিত্বের মৌলিক প্রয়োজন খাদ্য ও পানির উৎস। তাই, খুব স্পষ্ট যে, সংশোধিত ভূমি অধিগ্রহণ আইনের মাধ্যমে ভূমিগ্রাসের নীতি নয়, আজ ভারতের দরকার ভূমি সংরক্ষণ আইন, যে আইন জরুরি বাস্তুসংস্থান (যেমন উর্বর গাঙ্গেয় সমতল ও উপকূলবর্তী অঞ্চল) সংরক্ষণ করবে, এদের প্রতিবেশগত ভূমিকা ও খাদ্যনিরাপত্তায় অবদানের জন্য।
বেসরকারি করপোরেশনগুলো আজকের জমিদার হয়ে উঠছে। এদের হাতে উর্বর জমি তুলে দেওয়ার পেছনে কোনো জনস্বার্থের দোহাই দেওয়া যায় না। ব্যক্তিগত খাতে বহুবিদ মহা-মহাসড়ক ও দ্রুতগমনপথ নির্মাণকে চালানো যায় না অপরিহার্য অবকাঠামো হিসেবে। ভারতের জন্য আসলেই যে অবকাঠামো প্রয়োজন তা হলো প্রতিবেশগত অবকাঠামো; খাদ্যনিরাপত্তা ও পানিনিরাপত্তার জন্য। কনক্রিট ও কারখানার তলে আমাদের খাদ্যশস্য উৎপাদনের উর্বরা জমি কবর দেওয়ার মানে দেশের ভবিষ্যৎই কবর দেওয়া।
আল-জাজিরা ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ড. বন্দনা শিবা: ভারতীয় প্রকৃতিবিদ, প্রতিবেশ-নারীবাদী, দার্শনিক, অধিকারকর্মী ও লেখক।
বণিক পুঁজি বিনিয়োগ চায় আর চায় বিনিয়োগের বিপরীতে বিপুল প্রাপ্তি। এ জন্য পৃথিবীর তাবৎ জিনিসকে পণ্যে পরিণত করা আবশ্যক হয়—ভূমি ও পানি, বৃক্ষ ও জিন, অণুুজীব ও স্তন্যপায়ী সবাইকে। ভূমির পণ্যায়ন ভারতে করপোরেটের ভূমিগ্রাসে উৎসাহ জোগাচ্ছে। কাজটি সম্পাদিত হচ্ছে বিশেষ বাণিজ্য অঞ্চল (ইপিজেড) তৈরি এবং আবাসন খাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের হাত ধরে।
দুনিয়ার বেশির ভাগ মানুষের কাছে ভূমি হলো, ‘তেরা মাদ্রে’, ‘মাদার আর্থ’, ‘ভূমি’, ‘ধরতি মা’। ভূমিই মানুষের পরিচয়, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ভিত্তি। ভূমির সঙ্গে বন্ধন আমাদের ধরিত্রীর সঙ্গেই বন্ধন। তৃতীয় বিশ্বের ৭৫ শতাংশ মানুষ ভূমির ওপর, ভূমির সহায়তায় বাঁচে। ধরিত্রীই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জীবিকাদাতা: গ্লোবাল সাউথের অধিবাসীদের ৭৫ শতাংশ সম্পদের উৎস ভূমি।
বলপ্রয়োগে জোর করে ভূমি দখলের ওপর দাঁড়িয়েছিল উপনিবেশীকরণ। আর এখন বিশ্বায়নের রূপে যে পুনঃ উপনিবেশীকরণ চলছে তা ভারত, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় বিপুল ভূমিগ্রাসের পথে চালিত করছে। ফাটকা বিনিয়োগের জন্য, অসম, অপরিকল্পিত ফাটকা নগর গড়ে তোলার জন্য, খনি ও কারখানা স্থাপনের জন্য, মহাসড়ক ও দ্রুতগমনপথ নির্মাণের জন্য ভূমিগ্রাসের ঘটনা ঘটছে। কৃষকদের ঋণের ফাঁদে ফেলে, আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়ে তাদের কাছ থেকে ভূমি গ্রাস করা হচ্ছে।
ভারতের ভূমিপ্রশ্ন: ভারতে ভূমিগ্রাসের রাস্তা সহজ হয়েছে ঔপনিবেশিক ভূমি অধিগ্রহণ আইন, ১৮৯৪ এবং নয়া উদারবাদী নীতিমালার মাধ্যমে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া—এই দুইয়ের বিষাক্ত মিশ্রণের দ্বারা। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে লাগামহীন লোভ ও শোষণমূলক ব্যবস্থার শাসন। সেই পথ সুগম হয়েছে পুলিশি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ঔপনিবেশিক রাজবৈরী আইন ব্যবহারের দ্বারা। রাজবৈরী আইনে জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ানো জাতিবিরোধী কাজ হিসেবে বিবেচিত।
ভূমিকে পণ্যে পরিণত করতে বহু বছর ধরে কাজ করে চলেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের ১৯৯১ সালের কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি ভূমি সংস্কারকে আগাগোড়া উল্টে দেয়; খনি-খনন, সড়ক ও বন্দরের বিধিনিষেধ তুলে দেয়। জোত যার জমি তার হাতে রাখার স্বাধীন ভারতের বিধান উল্টে দেওয়া হলেও ১৮৯৪ সালের ভূমি অধিগ্রহণ আইন স্পর্শও করা হয়নি। তাই রাষ্ট্র জোর করে বলপ্রয়োগে কৃষক ও ট্রাইবাল জনগণের কাছ থেকে ভূমি অধিগ্রহণ করে বেসরকারি ফাটকাবাজ, আবাসনশিল্প করপোরেশন, খনি কোম্পানি ও শিল্পের হাতে তুলে দিতে পারে।
আগাপাছতলা সারা ভারতে, উত্তর প্রদেশের ভাট্টা থেকে ওডিশার জগৎসিংহপুর হয়ে মহারাষ্ট্রের জৈতাপুর—সবখানে সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে আমাদের কৃষক, আমাদের অন্নদাতাদের বিরুদ্ধে, তাদের উর্বর ফসলি জমি গ্রাস করার জন্য।
তাদের হাতিয়ার ঔপনিবেশিক ভূমি অধিগ্রহণ আইন—এই একই হাতিয়ার ব্যবহার করেছে বিদেশি শাসকেরা, ভারতীয় অধিবাসীদের বিরুদ্ধে। আইনটি প্রণয়নের সময় ১৮৯৪ সালে বিদেশি শাসকেরা যেমন আচরণ করেছে, ঠিক একইভাবে আচরণ করছে সরকার—বলপ্রয়োগে ভূমি দখল করছে করপোরেশনগুলোর মুনাফার স্বার্থে। উত্তর প্রদেশে যমুনা দ্রুতগমনপথের কাজে জয়পি ইনফ্রাটেক, ওডিশায় পসকো এবং জৈতাপুরে আরিভা নিজস্ব মুনাফার জন্য ভূমি গ্রাস করছে, কোনো দিক থেকে তা জনগণের স্বার্থে নয়। আজ দেশে অবাধে ঘটছে এসব।
ভারত রাষ্ট্রের গণতন্ত্র, আমাদের শান্তি ও আমাদের প্রতিবেশ, আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা ও গ্রামীণ জীবিকার ওপর এসব ভূমিযুদ্ধের ভয়ানক প্রভাব আছে। প্রতিবেশগতভাবে ও গণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়ে ভারতকে টিকে থাকতে হলে এসব ভূমি যুদ্ধের অবসান ঘটাতেই হবে।
ওডিশা সরকার জগৎসিংহপুরে যখন জনগণের ভূমি নিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন রাহুল গান্ধী উত্তর প্রদেশের ভাট্টায় একই ধরনের ঘটনায় জানান দিলেন জোরপূর্বক ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান। (জগৎসিংপুরের জনতা ২০০৫ সাল থেকে ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে) পরিবেশমন্ত্রী জয়রাম রমেশ স্বীকার করেছেন, পেসকো প্রকল্প পাস করার সবুজ সংকেত তিনি দিয়েছিলেন (খবর অনুযায়ী) প্রচণ্ড চাপে পড়ে। প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘কার চাপে?’ ভূমির প্রশ্নে এই দৃশ্যমান দ্বিমুখী নীতি থামাতেই হবে।
ভূমি বলাৎকার: উত্তর প্রদেশের বৃহত্তর নয়ডার ভাট্টা পারসুয়ালে প্রায় ছয় হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছে অবকাঠামোবিষয়ক কোম্পানি জয়প্রকাশ অ্যাসোসিয়েটস, বিলাসবহুল শহর ও খেলাধুলার কেন্দ্র নির্মাণ করার জন্য (ফর্মুলা ওয়াল রেসট্রেকও যার অন্তর্ভুক্ত)। এগুলো তারা করছে যমুনা দ্রুতগমনপথ নির্মাণের আড়ালে। ১৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্রুতগমনপথ নির্মাণের জন্য এক হাজার ২২৫টি গ্রামের ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এই অন্যায় ভূমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদ করেছেন কৃষকেরা। প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন চারজন। আর ৭ মে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে বহু কৃষক আহত হন। ভারতের অন্নসংস্থানের এই হূৎপিণ্ডে সরকার যদি ভূমিযুদ্ধ অব্যাহত রাখে, তবে শান্তির কোনো সম্ভাবনাই নেই। ভূমিবিচ্ছেদের ক্ষতিপূরণ অর্থ দিয়ে হয় না, কোনোভাবেই হয় না। যেমন বলেছেন অশীতিপর বৃদ্ধ কৃষক পরশুরাম (যমুনা দ্রুতগমনপথের জন্য ভূমি হারিয়েছেন তিনি), ‘আপনি কোনো দিন বুঝবেন না ভূমিহীন হয়ে গেলে কেমন লাগে।’
ভূমি অধিগ্রহণ আইন ব্যবহার করে সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ভূমি নিয়ে নেওয়ার সময় কৃষকদের প্রতি বর্গমিটার ভূমির জন্য দেয় ৩০০ রুপি (৬ ডলার) অথচ ডেভেলপার প্রতি বর্গমিটার জায়গা বেচে ছয় লাখ রুপিতে (১৩,৪৫০ ডলার)। অর্থাৎ দাম বেড়ে যায় দুই লাখ গুণ। এভাবেই মুনাফা। দারিদ্র্য, অধিকারহীনতা ও সংঘর্ষ ঘটতে সাহায্য করে এই ভূমিগ্রাস ও মুনাফা।
একইভাবে ১৮ এপ্রিল মহারাষ্ট্রের জৈতাপুরে পারমাণবিক জ্বালানি পার্কের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। প্রস্তাবিত পার্কটি একটি ছোট বন্দর শহরের পার্শ্ববর্তী গ্রামে নির্মাণের প্রস্তাব ছিল। পুলিশি নৃশংসতায় একজনের মৃত্যু ঘটে, গুরুতর আহত হয় আটজন। জৈতাপুর পারমাণবিক কেন্দ্র হবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ। এটি নির্মাণের দায়িত্বে আছে ফরাসি কোম্পানি আরিভা। ফুকুশিমা বিপর্যয়ের পর প্রতিবাদ তীব্রতর হয়েছে, পাশাপাশি তীব্রতর হয়েছে সরকারের একগুঁয়েমিও।
এখন একই ধরনের পরিস্থিতি দানা বাঁধতে শুরু করেছে ওডিশার জগৎসিংপুরে। সেখানে ভারতের বৃহত্তম প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পসকো স্টিল প্রকল্পের শরিকানা সংরক্ষণের জন্য সংবিধানবিরোধী ভূমি অধিগ্রহণে সহায়তা দিতে ২০ ব্যাটালিয়ন সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। এই ভূমিগ্রাস সহজ করার জন্য সরকার প্রতিদিন ৪০টি পান খামার ধ্বংসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। প্রতি একর জমিতে পান চাষ করে কৃষকেরা প্রতিবছর আয় করেন চার লাখ রুপি (নয় হাজার ডলার)। গত পাঁচ বছরে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ চালানোর সময়ে পসকোবিরোধী আন্দোলন বহুবার রাষ্ট্রীয় সহিংসতার শিকার হয়েছে। এবার এ আন্দোলন আরেক দফা, হয়তো চূড়ান্ত অহিংস ও গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই প্রতিরোধ এমন এক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে রাষ্ট্র করপোরেটের মুনাফার জন্য অগণতান্ত্রিক ভূমিগ্রাসের পথ সহজ করতে বলপ্রয়োগ করে, যথাযথ প্রক্রিয়া ও জনগণের সাংবিধানিক অধিকারকে পাশ কাটিয়ে যায়।
এসব ভূমিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার গণতন্ত্রের জমিন ধ্বংস করছে। ভূমি ও উন্নয়নের ব্যাপারে জনগণ ও পঞ্চায়েতের গণতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সংবিধানস্বীকৃত হলেও সরকার তাদের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে অশ্রদ্ধা করছে। পসকো প্রকল্পে এটা স্পষ্ট হয়েছে। সেখানে তিনটি পঞ্চায়েত তাদের ভূমি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
বলপ্রয়োগ ও জীবন-জীবিকা ধ্বংসের যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, এটা শুধু গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্যই নয়, ভারতীয় জাতিরাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্যও বিপজ্জনক। আজ ভারত নিজেকে বর্ধনশীল বা সমৃদ্ধিময় অর্থনীতি দাবি করতে পারে, অথচ তার ৪০ শতাংশ সন্তানের খাবার জোগাতে পারে না—এ যে জাতীয় লজ্জার ব্যাপার।
সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের সাক্ষী হিসেবে ভূমি কনক্রিটের জঙ্গল বানানোর ক্ষেত্র নয়, এটা মানুষের অস্তিত্বের মৌলিক প্রয়োজন খাদ্য ও পানির উৎস। তাই, খুব স্পষ্ট যে, সংশোধিত ভূমি অধিগ্রহণ আইনের মাধ্যমে ভূমিগ্রাসের নীতি নয়, আজ ভারতের দরকার ভূমি সংরক্ষণ আইন, যে আইন জরুরি বাস্তুসংস্থান (যেমন উর্বর গাঙ্গেয় সমতল ও উপকূলবর্তী অঞ্চল) সংরক্ষণ করবে, এদের প্রতিবেশগত ভূমিকা ও খাদ্যনিরাপত্তায় অবদানের জন্য।
বেসরকারি করপোরেশনগুলো আজকের জমিদার হয়ে উঠছে। এদের হাতে উর্বর জমি তুলে দেওয়ার পেছনে কোনো জনস্বার্থের দোহাই দেওয়া যায় না। ব্যক্তিগত খাতে বহুবিদ মহা-মহাসড়ক ও দ্রুতগমনপথ নির্মাণকে চালানো যায় না অপরিহার্য অবকাঠামো হিসেবে। ভারতের জন্য আসলেই যে অবকাঠামো প্রয়োজন তা হলো প্রতিবেশগত অবকাঠামো; খাদ্যনিরাপত্তা ও পানিনিরাপত্তার জন্য। কনক্রিট ও কারখানার তলে আমাদের খাদ্যশস্য উৎপাদনের উর্বরা জমি কবর দেওয়ার মানে দেশের ভবিষ্যৎই কবর দেওয়া।
আল-জাজিরা ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ড. বন্দনা শিবা: ভারতীয় প্রকৃতিবিদ, প্রতিবেশ-নারীবাদী, দার্শনিক, অধিকারকর্মী ও লেখক।
No comments