দূরদেশ-ওবামার সিদ্ধান্তে কোনো পক্ষই খুশি নয় by আলী রীয়াজ
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ঘোষণায় তাঁর সমর্থক ও সমালোচক—কেউই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেননি। আগামী এক বছরে মোট ৩৩ হাজার সেনা প্রত্যাহার করার পরিকল্পনা মার্কিন সেনাধ্যক্ষরা খুব উৎসাহের সঙ্গে অনুমোদন করেননি বলেই গণমাধ্যমের খবর।
তাঁরা আরও কম সেনা প্রত্যাহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন। অন্যদিকে দেশের উদারনৈতিক রাজনীতিবিদেরা এই সেনা প্রত্যাহারকে মনে করছেন, আকারে অত্যন্ত ছোট। বিস্ময়কর হলেও সত্য, প্রেসিডেন্টের সমালোচক রক্ষণশীলরাও মনে করেন যে আফগানিস্তান যুদ্ধ অবসানে যতটা দ্রুততার সঙ্গে সক্রিয় হওয়া দরকার, প্রেসিডেন্ট ওবামা তা করছেন না। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে এই ৩৩ হাজার সেনা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট। মনে রাখা দরকার যে ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সময় সেখানে মোট ৩৪ হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন ছিল এবং এখন সেখানে সর্বমোট প্রায় ৯৭ হাজার সেনা রয়েছে। ফলে প্রেসিডেন্ট ওবামার শাসনামলে যত সেনা আফগানিস্তানে পাঠানো হয়েছে, তার প্রায় অর্ধেক ফেরত আনার ঘোষণা দিলেন।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট ওবামার এ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ধীরগতিতে হলেও আফগানিস্তান থেকে মার্কিনদের সরে আসার প্রক্রিয়ার সূচনা হলো। তদুপরি ওবামার বক্তৃতায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে ‘রাজনৈতিক সমাধান’ ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
আফগানিস্তানের যুদ্ধ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সমাধান সামরিক নয়, রাজনৈতিক। এ কথা বহুবার বলা হয়েছে এবং কমবেশি আমরা সবাই জানি। এ কথাও নতুন নয় যে বিদেশি সেনাদের উপস্থিতি আফগানিস্তানে স্থিতিশীল রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার অনুকূল নয়। আফগানিস্তানবিষয়ক আলোচনায় পাঁচ-সাত বছর ধরে এ কথাগুলো বলা হলেও রাজনৈতিক সমাধান কী এবং কীভাবে তা অর্জন করা সম্ভব, সে বিষয়ে বিশদ ও অনুপুঙ্খ আলোচনায় বিশ্লেষকেরা খুব বেশি অগ্রসর হন না। কেননা, পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে সমাধানের তাগিদ দেওয়া যতটা সহজ, সমাধানের পথ বর্ণনা করা ততটাই কঠিন। ওবামার বক্তৃতার পর এ আলোচনা জোরদার হবে বলে আশা করা যায়।
আফগানিস্তানের পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের তিনটি দিক রয়েছে—অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক। অনেক ক্ষেত্রেই এই তিনটি দিক এত বেশি পরস্পরবিরোধী যে একটি ক্ষেত্রে সহজ সমাধান অন্য দিকগুলোকে অসম্ভব করে তুলবে। অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক সমাধানের প্রধান ভিত্তি হতে হবে সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং ক্ষমতার বণ্টন। দেশটির ভৌগোলিক ও জাতিগোষ্ঠীগত বিভক্তির কথা বাদ দিলেও যে প্রশ্নটি বড় হয়ে ওঠে তা হলো, ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ‘তালেবান’ নেতৃত্ব ও তাদের সমর্থকদের ভূমিকা। এক দশক ধরে তালেবান আন্তর্জাতিক সৈন্যবাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করে আসছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আফগানিস্তানের সমাজে তালেবানের প্রতি সমর্থন রয়েছে। তার আকার না জানা থাকলেও তাদের বাদ দিয়ে কোনো সমাধান যে সম্ভব নয়, এটা উপলব্ধি করেই যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে তাদের সঙ্গে আলোচনা করছে। কিন্তু তালেবান কোনো একটি একক নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী নয়। তালেবান বলে গণমাধ্যমে যাদের বর্ণনা করা হয়, তাদের তিনটি ক্ষমতাকেন্দ্র রয়েছে: পাকিস্তানের কোয়েটাভিত্তিক গোষ্ঠী, যা ‘কোয়েটা শুরা’ বলে পরিচিত, জালালউদ্দিন ও সিরাজউদ্দিন হাক্কানির নেতৃত্বাধীন ‘হাক্কানি নেটওয়ার্ক’ এবং গুলবদ্দিন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বাধীন হেজব-ই-ইসলামি। এদের মধ্যে বিভিন্ন রকম মতভেদ রয়েছে। তবে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো যে কোনো ধরনের সমঝোতার অর্থ তালেবানের কিছু কিছু দাবি মেনে নেওয়া, তাদের কিছু লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথ করে দেওয়া। তালেবানের স্বল্প সময়ের প্রশাসনের অভিজ্ঞতা ও গত এক দশকের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে নারীদের অধিকার, মানবাধিকার, শরিয়ার ব্যাখ্যা, পোশাক, শিক্ষা, আচরণ ইত্যাদি কিছু বিষয়ে তালেবানকে ছাড় দেওয়ার অর্থ হবে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার পথগুলো অনেকাংশেই বন্ধ করে দেওয়া। যদিও তালেবানের কোনো কোনো অংশ দাবি করছে যে গত ১০ বছরে তারা পরিবর্তিত হয়েছে এবং তারা আর এসব বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থার পক্ষে নয়। কিন্তু তার নিশ্চয়তা বিধান না করা গেলেও কি তালেবানের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন? অন্যদিকে তাদের বাদ দিয়ে কোনো রাজনৈতিক সমাধানই যে অভ্যন্তরীণভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না, তা বলা বাহুল্য।
আফগানিস্তানে যেকোনো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমাধানের সময় মনে রাখতে হবে যে পাকিস্তান আফগানিস্তানকে তার ‘পেছনের উঠোন’ বলে মনে করে। পাকিস্তানের এই নীতি নতুন নয় এবং সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে সমর্থন ও পরে সরাসরি তালেবান সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল আফগানিস্তানের ওপর পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ প্রভাব বহাল রাখা। এক দশক ধরে পাকিস্তান যে একাধারে তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, সেটারও কারণ একই। পাকিস্তানের ধারণা এবং যার পক্ষে যথেষ্ট পরিমাণে প্রমাণ রয়েছে যে আফগানিস্তানের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ওপর ভারতের প্রভাব রয়েছে। ভারতের লক্ষ্য হচ্ছে, আফগানিস্তানে এমন কোনো সরকার প্রতিষ্ঠা হতে না দেওয়া, যা পাকিস্তানের ‘পুতুল সরকার’-এ পরিণত হয়। ভারত সংগত কারণেই মনে করে যে তালেবানের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন হওয়ার অর্থ হলো ভারতবিরোধী আফগানিস্তান তৈরি করা। গত এক দশকে আফগানিস্তানে ভারতের আর্থিক ও রাজনৈতিক বিনিয়োগ এত বেশি যে তার জন্য এখন কোনো রকম নিশ্চয়তা ছাড়া পাকিস্তানের প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আফগানিস্তানের আরেক প্রতিবেশী ইরান যদিও চায় না যে তালেবান শক্তিশালী হোক, কিন্তু ইরানি নেতারা চান যে যুক্তরাষ্ট্র ‘পরাজিত’ হোক। ইরানের জন্য স্থিতিশীল আফগানিস্তান বেশি প্রয়োজন। তারা পাকিস্তান ও ভারত—যেকোনো দেশের প্রভাবই মানতে রাজি, তবে তুলনামূলকভাবে ভারতের প্রভাবই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তার অর্থ হলো, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত কারজাই (বা এ-জাতীয় অন্য কোনো) সরকার সমর্থন করা। ফলে ইরানের আফগানিস্তান-নীতি খানিকটা অস্পষ্ট।
সহজ করে বললে, এই অঞ্চলের তিনটি প্রধান শক্তি—পাকিস্তান, ভারত ও ইরান চায় আফগানিস্তানের রাজনৈতিক সমাধান যেন কোনো অবস্থাতেই দীর্ঘমেয়াদি তাদের স্বার্থের প্রতিকূল না যায়।
আন্তর্জাতিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ আফগানিস্তানকে বিবেচনা করে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার আলোকে। তালেবান ও আল-কায়েদার ঘনিষ্ঠতা থেকেই গোটা পরিস্থিতির উদ্ভব—এ কথা ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ওবামা তাঁর বক্তৃতার শুরুতেই তা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
যদিও ২০০১ সালের তুলনায় আল-কায়েদা এখন দুর্বল ও অসংগঠিত, বিশেষত আফগানিস্তানে আল-কায়েদার উপস্থিতি সীমিত। প্রশ্ন হচ্ছে, ভবিষ্যতে পাকিস্তানকেন্দ্রিক আল-কায়েদার সমর্থকেরা আফগানিস্তানে প্রত্যাবর্তন করবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ তালেবান ও অন্য যেকোনো রাজনৈতিক শক্তির কাছ থেকে এ নিশ্চয়তাই আশা করে। তালেবানের একাংশ আল-কায়েদার সঙ্গে আর যুক্ত থাকতে চায় না বলে যেসব তথ্য জানা যায়, তার ওপর নির্ভর করা কতটা বাস্তবোচিত? যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র চায় তালেবান স্পষ্ট করে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করুক, তাদের নিন্দা করুক এবং ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্ক না গড়ার নিশ্চয়তা দিক। এযাবৎ তার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি, অন্ততপক্ষে প্রকাশ্যে তার কোনো লক্ষণ তালেবান দেখায়নি।
পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে, তার শিগগিরই সমাধান হবে না। পাশাপাশি পাকিস্তানের ভেতর পাকিস্তানি তালেবান সমর্থকদের যে প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। পাকিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য তা হুমকিস্বরূপ। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে এমন কোনো রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণ করবে না, যা পারমাণবিক শক্তিধর একটি দেশের ভবিষ্যৎকেই সংকটাপন্ন করে তোলে। আফগানিস্তানের রাজনৈতিক সমাধানের সঙ্গে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি যে যুক্ত, সেটা প্রেসিডেন্ট ওবামা পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আফগানিস্তান পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের পথে এই পরস্পরবিরোধী প্রবণতার মুখেই প্রেসিডেন্ট ওবামা মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। মার্কিন সেনা হ্রাসের পাশাপাশি শিগগিরই অন্যান্য দেশ, বিশেষত ব্রিটেন তাদের সেনাসংখ্যা কমাবে বলেই ধারণা করা যায়। তদুপরি ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ বিদেশি সেনাদের সরিয়ে আফগান কর্তৃপক্ষের হাতে সব দায়িত্ব তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে ন্যাটো। এই মুহূর্তে সেনা হ্রাসের সংখ্যা ছোট হলেও তা এ প্রক্রিয়ার সূচনা করছে। কিন্তু আগামী আড়াই বছরের মধ্যে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, স্থিতিশীল কোনো রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।
ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট ওবামার এ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ধীরগতিতে হলেও আফগানিস্তান থেকে মার্কিনদের সরে আসার প্রক্রিয়ার সূচনা হলো। তদুপরি ওবামার বক্তৃতায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে ‘রাজনৈতিক সমাধান’ ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
আফগানিস্তানের যুদ্ধ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সমাধান সামরিক নয়, রাজনৈতিক। এ কথা বহুবার বলা হয়েছে এবং কমবেশি আমরা সবাই জানি। এ কথাও নতুন নয় যে বিদেশি সেনাদের উপস্থিতি আফগানিস্তানে স্থিতিশীল রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার অনুকূল নয়। আফগানিস্তানবিষয়ক আলোচনায় পাঁচ-সাত বছর ধরে এ কথাগুলো বলা হলেও রাজনৈতিক সমাধান কী এবং কীভাবে তা অর্জন করা সম্ভব, সে বিষয়ে বিশদ ও অনুপুঙ্খ আলোচনায় বিশ্লেষকেরা খুব বেশি অগ্রসর হন না। কেননা, পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে সমাধানের তাগিদ দেওয়া যতটা সহজ, সমাধানের পথ বর্ণনা করা ততটাই কঠিন। ওবামার বক্তৃতার পর এ আলোচনা জোরদার হবে বলে আশা করা যায়।
আফগানিস্তানের পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের তিনটি দিক রয়েছে—অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক। অনেক ক্ষেত্রেই এই তিনটি দিক এত বেশি পরস্পরবিরোধী যে একটি ক্ষেত্রে সহজ সমাধান অন্য দিকগুলোকে অসম্ভব করে তুলবে। অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক সমাধানের প্রধান ভিত্তি হতে হবে সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং ক্ষমতার বণ্টন। দেশটির ভৌগোলিক ও জাতিগোষ্ঠীগত বিভক্তির কথা বাদ দিলেও যে প্রশ্নটি বড় হয়ে ওঠে তা হলো, ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ‘তালেবান’ নেতৃত্ব ও তাদের সমর্থকদের ভূমিকা। এক দশক ধরে তালেবান আন্তর্জাতিক সৈন্যবাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করে আসছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আফগানিস্তানের সমাজে তালেবানের প্রতি সমর্থন রয়েছে। তার আকার না জানা থাকলেও তাদের বাদ দিয়ে কোনো সমাধান যে সম্ভব নয়, এটা উপলব্ধি করেই যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে তাদের সঙ্গে আলোচনা করছে। কিন্তু তালেবান কোনো একটি একক নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী নয়। তালেবান বলে গণমাধ্যমে যাদের বর্ণনা করা হয়, তাদের তিনটি ক্ষমতাকেন্দ্র রয়েছে: পাকিস্তানের কোয়েটাভিত্তিক গোষ্ঠী, যা ‘কোয়েটা শুরা’ বলে পরিচিত, জালালউদ্দিন ও সিরাজউদ্দিন হাক্কানির নেতৃত্বাধীন ‘হাক্কানি নেটওয়ার্ক’ এবং গুলবদ্দিন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বাধীন হেজব-ই-ইসলামি। এদের মধ্যে বিভিন্ন রকম মতভেদ রয়েছে। তবে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো যে কোনো ধরনের সমঝোতার অর্থ তালেবানের কিছু কিছু দাবি মেনে নেওয়া, তাদের কিছু লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথ করে দেওয়া। তালেবানের স্বল্প সময়ের প্রশাসনের অভিজ্ঞতা ও গত এক দশকের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে নারীদের অধিকার, মানবাধিকার, শরিয়ার ব্যাখ্যা, পোশাক, শিক্ষা, আচরণ ইত্যাদি কিছু বিষয়ে তালেবানকে ছাড় দেওয়ার অর্থ হবে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার পথগুলো অনেকাংশেই বন্ধ করে দেওয়া। যদিও তালেবানের কোনো কোনো অংশ দাবি করছে যে গত ১০ বছরে তারা পরিবর্তিত হয়েছে এবং তারা আর এসব বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থার পক্ষে নয়। কিন্তু তার নিশ্চয়তা বিধান না করা গেলেও কি তালেবানের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন? অন্যদিকে তাদের বাদ দিয়ে কোনো রাজনৈতিক সমাধানই যে অভ্যন্তরীণভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না, তা বলা বাহুল্য।
আফগানিস্তানে যেকোনো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমাধানের সময় মনে রাখতে হবে যে পাকিস্তান আফগানিস্তানকে তার ‘পেছনের উঠোন’ বলে মনে করে। পাকিস্তানের এই নীতি নতুন নয় এবং সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে সমর্থন ও পরে সরাসরি তালেবান সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল আফগানিস্তানের ওপর পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ প্রভাব বহাল রাখা। এক দশক ধরে পাকিস্তান যে একাধারে তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, সেটারও কারণ একই। পাকিস্তানের ধারণা এবং যার পক্ষে যথেষ্ট পরিমাণে প্রমাণ রয়েছে যে আফগানিস্তানের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ওপর ভারতের প্রভাব রয়েছে। ভারতের লক্ষ্য হচ্ছে, আফগানিস্তানে এমন কোনো সরকার প্রতিষ্ঠা হতে না দেওয়া, যা পাকিস্তানের ‘পুতুল সরকার’-এ পরিণত হয়। ভারত সংগত কারণেই মনে করে যে তালেবানের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন হওয়ার অর্থ হলো ভারতবিরোধী আফগানিস্তান তৈরি করা। গত এক দশকে আফগানিস্তানে ভারতের আর্থিক ও রাজনৈতিক বিনিয়োগ এত বেশি যে তার জন্য এখন কোনো রকম নিশ্চয়তা ছাড়া পাকিস্তানের প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আফগানিস্তানের আরেক প্রতিবেশী ইরান যদিও চায় না যে তালেবান শক্তিশালী হোক, কিন্তু ইরানি নেতারা চান যে যুক্তরাষ্ট্র ‘পরাজিত’ হোক। ইরানের জন্য স্থিতিশীল আফগানিস্তান বেশি প্রয়োজন। তারা পাকিস্তান ও ভারত—যেকোনো দেশের প্রভাবই মানতে রাজি, তবে তুলনামূলকভাবে ভারতের প্রভাবই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তার অর্থ হলো, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত কারজাই (বা এ-জাতীয় অন্য কোনো) সরকার সমর্থন করা। ফলে ইরানের আফগানিস্তান-নীতি খানিকটা অস্পষ্ট।
সহজ করে বললে, এই অঞ্চলের তিনটি প্রধান শক্তি—পাকিস্তান, ভারত ও ইরান চায় আফগানিস্তানের রাজনৈতিক সমাধান যেন কোনো অবস্থাতেই দীর্ঘমেয়াদি তাদের স্বার্থের প্রতিকূল না যায়।
আন্তর্জাতিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ আফগানিস্তানকে বিবেচনা করে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার আলোকে। তালেবান ও আল-কায়েদার ঘনিষ্ঠতা থেকেই গোটা পরিস্থিতির উদ্ভব—এ কথা ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ওবামা তাঁর বক্তৃতার শুরুতেই তা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
যদিও ২০০১ সালের তুলনায় আল-কায়েদা এখন দুর্বল ও অসংগঠিত, বিশেষত আফগানিস্তানে আল-কায়েদার উপস্থিতি সীমিত। প্রশ্ন হচ্ছে, ভবিষ্যতে পাকিস্তানকেন্দ্রিক আল-কায়েদার সমর্থকেরা আফগানিস্তানে প্রত্যাবর্তন করবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ তালেবান ও অন্য যেকোনো রাজনৈতিক শক্তির কাছ থেকে এ নিশ্চয়তাই আশা করে। তালেবানের একাংশ আল-কায়েদার সঙ্গে আর যুক্ত থাকতে চায় না বলে যেসব তথ্য জানা যায়, তার ওপর নির্ভর করা কতটা বাস্তবোচিত? যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র চায় তালেবান স্পষ্ট করে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করুক, তাদের নিন্দা করুক এবং ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্ক না গড়ার নিশ্চয়তা দিক। এযাবৎ তার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি, অন্ততপক্ষে প্রকাশ্যে তার কোনো লক্ষণ তালেবান দেখায়নি।
পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে, তার শিগগিরই সমাধান হবে না। পাশাপাশি পাকিস্তানের ভেতর পাকিস্তানি তালেবান সমর্থকদের যে প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। পাকিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য তা হুমকিস্বরূপ। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে এমন কোনো রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণ করবে না, যা পারমাণবিক শক্তিধর একটি দেশের ভবিষ্যৎকেই সংকটাপন্ন করে তোলে। আফগানিস্তানের রাজনৈতিক সমাধানের সঙ্গে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি যে যুক্ত, সেটা প্রেসিডেন্ট ওবামা পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আফগানিস্তান পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের পথে এই পরস্পরবিরোধী প্রবণতার মুখেই প্রেসিডেন্ট ওবামা মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। মার্কিন সেনা হ্রাসের পাশাপাশি শিগগিরই অন্যান্য দেশ, বিশেষত ব্রিটেন তাদের সেনাসংখ্যা কমাবে বলেই ধারণা করা যায়। তদুপরি ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ বিদেশি সেনাদের সরিয়ে আফগান কর্তৃপক্ষের হাতে সব দায়িত্ব তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে ন্যাটো। এই মুহূর্তে সেনা হ্রাসের সংখ্যা ছোট হলেও তা এ প্রক্রিয়ার সূচনা করছে। কিন্তু আগামী আড়াই বছরের মধ্যে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, স্থিতিশীল কোনো রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।
ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments