একটি বাড়ি একটি খামার-একটি সফল উদ্যোগ হতে পারত
'এ জগতে হায় সেই বেশি চায় যার আছে ভূরি ভূরি'_ সচ্ছলতা সত্ত্বেও নতুন সম্পদ করায়ত্ত করতে বিত্তবান কেমন কূটকৌশল ও অপনীতির আশ্রয় নেয় তা 'দুই বিঘা জমি' কবিতায় দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিত্তবাসনার ভয়ঙ্কর ব্যাধিতে আচ্ছন্ন হয়ে ধনীরা যে শুধু নির্ধনের সামান্য জমি কেড়ে নেয় তা নয়, তাকে চোর সাব্যস্ত করে শাস্তি দিতেও
কুণ্ঠাবোধ করে না। এ যুগে এ ব্যাধি কত দূর বিস্তৃত হয়েছে তার কিছু চিত্র মিলবে মঙ্গলবারের সমকালে প্রকাশিত 'একটি বাড়ি একটি খামার' প্রকল্প নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। কবিতার মতো জমি গ্রাসের ঘটনা এ ক্ষেত্রে ঘটেনি বটে, কিন্তু দরিদ্রের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার ঘটনা যে ঘটেছে তা নিশ্চিত। দারিদ্র্য নিরসনের জন্য সরকারের একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোগ হিসেবেই প্রচলিত ছিল_ একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প। ২০০৯ সালে অতি দরিদ্রদের জন্য গৃহীত এ প্রকল্পে বরাদ্দ ধরা হয়েছিল এক হাজার ১৯২ কোটি টাকা। পরে ২০১১ সালের জুনে বরাদ্দ বাড়ানো হয় ৩০০ কোটি টাকা। প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও খরচ হয়েছে ৩০৩ কোটি টাকা। ২০০৯ থেকে ২০১৩ মেয়াদে কার্যকর এ প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল এক হাজার ৯৩২টি ইউনিয়নের ১০ লাখ পরিবারকে প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা। প্রকল্পের মাধ্যমে গরিবদের মধ্যে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, খাসজমি, টিন ও ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের মাধ্যমে তাদের স্বনির্ভর করার পরিকল্পনা ছিল। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় শেষ দিকে পেঁৗছানোর পর দেখা যাচ্ছে, লক্ষ্যমাত্রার এক-তৃতীয়াংশ পরিবারও এর আওতায় আসেনি। কাগজে-কলমে সাফল্য এক-তৃতীয়াংশ হলেও বাস্তবে সাফল্যের দেখা মেলা ভার। কেননা, প্রকল্পটি গরিবদের অবস্থা উন্নয়নের জন্য নেওয়া হলেও এতে উন্নয়ন ঘটেছে অবস্থাপন্নদের। সমকালের প্রতিবেদনে সারাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়নের যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, গরিবের নামে বরাদ্দ হলেও গরিবের কাছে তা পেঁৗছায়নি। বরাদ্দ গিয়েছে শাসক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের কাছে, যাদের অধিকাংশই অবস্থাপন্ন। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সরকারি অর্থ বরাদ্দ নিয়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা শুধু যে গরিবদের বঞ্চিত করেছেন তা নয়। তারা সরকারের একটি ভালো উদ্যোগকেও ব্যর্থ করে দিয়েছেন। জনকল্যাণের প্রকল্পটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ায় সুনামের স্থানে দুর্নাম জুটেছে। তারও চেয়ে বড় কথা, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে জনসেবার যে আদর্শ থাকার কথা তার ভয়াবহ ব্যত্যয় ঘটেছে। তবে শুধু মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের দোষারোপ করে লাভ নেই। ২০০৯ সালে প্রকল্পটি গৃহীত হওয়ার পর একে সফল করে তুলতে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া প্রয়োজন ছিল। সফল হতে এটি হতে পারত দারিদ্র্য নিরসনে একটি অনুসরণীয় মডেল। কিন্তু দুর্নীতি, দলপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি একে লজ্জাজনক একটি পরিণতি দিয়েছে। প্রকল্পের সীমিত সাফল্য দূরের কথা, গরিবের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প নিয়ে সারাদেশে নানামুখী অভিযোগ, সমালোচনা থাকলেও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এখনও এ বিষয়ে অসচেতন। কীভাবে এত কিছুর পরও তারা প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতি বিষয়ে ওয়াকিবহাল না থাকতে পারেন? আমরা মনে করি, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের যে মহৎ উদ্দেশ্য ছিল তা কেন মুখ থুবড়ে পড়ল সেটি তদন্ত করে দেখা দরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিটি পর্যায়ে তদারক করে গাফিলতিগুলো বের করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের যে অল্প সময় আছে তা কাজে লাগিয়ে প্রকৃত গরিবদের অবস্থা উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে। বাকি অর্থেও যদি দলীয় কর্মীদের তোষণ করা হয় তবে এ প্রকল্পটি দারিদ্র্য দূর না করে লজ্জাই বাড়িয়ে তুলবে।
No comments