সাক্ষাৎকার-সমুদ্রে সীমানা চিহ্নিত, এখন সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ জরুরি by রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ খুরশেদ আলম
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : শেখ রোকন সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিজয়ে অন্যতম নিয়ামক ভূমিকা রাখার কারণে দেশ-বিদেশে আলোচিত নাম রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ খুরশেদ আলম (অব.) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সত্তরের দশকের শুরুতে ভারতের কোচিনস্থ ইন্ডিয়ান নেভাল একাডেমি থেকে রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক লাভ করে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ১৯৭৪-৭৬ সালে ভারত থেকেই প্রথম শ্রেণী পেয়ে সমাপ্ত করেছেন নেভাল প্রফেশনাল কোর্স। ইতালিতে প্রথম শ্রেণী পেয়েছেন টেলিকমিউনিকেশন কোর্সে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করা সংক্রান্ত আলোচনায় তাকে বাংলাদেশের দলনেতা নির্বাচিত করা হয়। ২০০২ সালে তাকে নৌবাহিনী থেকে অবসর প্রদান করা হয়। ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সাল থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সাউথইস্টে সমুদ্র বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে অধ্যাপনা করেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি এবং ন্যাশনাল মেরিটাইম ফাউন্ডেশন, ঢাকার সদস্য খুরশেদ আলম ২০০৪ সালে 'বাংলাদেশ মেরিটাইম চ্যালেঞ্জেস ইন দি টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি' শীর্ষক সাড়া জাগানো বই রচনা করেন। এ ছাড়াও তার রয়েছে ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দি ল' অব দি সি-থ্রি, ল' অব দি সি অ্যান্ড ইটস ইম্পিক্লেশন ফর বাংলাদেশ, রিজিওনাল মেরিটাইম কো-অপারেশন আন্ডার দি সার্ক, আসিয়ান রিজিওনাল কো-অপারেশনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা
সমকাল : কেমন করে যুক্ত হলেন সমুদ্র জয়ের অভিযানে?
খুরশেদ আলম : সত্তরের দশকের শেষ দিকে ভারতের সঙ্গে তালপট্টি দ্বীপ নিয়ে বিরোধের সময় ১৩০ টনের ছোট একটি গানবোটের কমান্ডে ছিলাম আমি। আর প্রতিপক্ষের ছিল ১১০০ টনের চারটি যুদ্ধজাহাজ, যার প্রতিটিতে ৪-৫টি কামান। আমাদের ভরসা কেবল একটি কামান। জুনিয়র অফিসার হিসেবে সেখানে এক মাস অবস্থানকালে বুঝতে পারি, প্রধানত অর্থনৈতিক কারণে নৌবাহিনীতে তাদের সমকক্ষতা অর্জন করা দুরূহ হবে। সাগরের দ্বীপে তাদের দখলও সরানো যাবে না। শক্তিবলে নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত পন্থায় ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে ন্যায্য অধিকার আদায়ের পথ অনুসন্ধানে সে সময় থেকেই আমি লেগে পড়ি। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় সংসদে টেরিটরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট পাস করেন। এ যুগান্তকারী ও দূরদর্শী আইনে বঙ্গোপসাগর এবং এর সম্পদের ওপর ১২ নটিক্যাল মাইল টেরিটরিয়াল সি, ২০০ কিলোমিটার এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক এলাকা এবং মহীসোপানে বাংলাদেশের অধিকার ঘোষণা করা হয়। ভারত ও মিয়ানমার স্বাধীনতা আগে পেলেও তাদের সাগর-সীমানা ধরে এ দাবি উত্থাপনের কাজটি করেছে আরও পরে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের এ উপলব্ধি আমাকে বঙ্গোপসাগর নিয়ে কাজ করতে আরও অনুপ্রেরণা জোগায়।
সমকাল : জাতিসংঘে আমাদের সমুদ্রসীমার দাবি তো পেশ হয়েছে অনেক পরে। বিলম্ব হলো কীভাবে?
খুরশেদ আলম : ১৯৮২ সালে সমুদ্র আইন বিষয়ক নতুন জাতিসংঘ কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে। ওই অনুষ্ঠানে দু'জন রাষ্ট্রদূত, নৌবাহিনী প্রধানসহ আমি নিজেও ছিলাম। কিন্তু পরবর্তী সরকারগুলো কেন যেন সেটা অনুস্বাক্ষর করেনি। আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সরকার মন্ত্রিসভার শেষ বৈঠকে রেটিফাই করে। ১২ জুলাই ২০০১। তারপর যে পরিস্থিতি উদ্ভব হয় তা হচ্ছে, কনভেনশনে বলা আছে, ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে যদি মহীসোপান চাই, রেটিফিকেশন-পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে মহীসোপানের দাবি তথ্য-উপাত্ত, যুক্তিসহকারে জাতিসংঘে পেশ করতে হবে। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে আমি যখন দায়িত্ব নিলাম, ততদিনে নয় বছর শেষ হয়ে গেছে। ওই এক-দেড় বছরের মধ্যে সব তথ্য-উপাত্ত, নথিপত্র প্রস্তুত করতে হবে এবং প্রমাণ করতে হবে যে, বাংলাদেশের উপকূল থেকে সমুদ্রের তলদেশে একই ধরনের সেডিমেন্ট অব্যাহত রয়েছে। এটা প্রমাণ করার জন্য সিসমিক ও বেজমেন্ট সার্ভে করা দরকার। আগে আমাদের দেশে কখনও সিসমিক সার্ভে হয়নি। উপযুক্ত জাহাজও নেই, তা ভাড়া করতে হবে। আমি অনেকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে দেখলাম এ জন্য প্রায় ৮০ কোটি টাকা লাগে। মাননীয় মন্ত্রী প্রস্তাবটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যান। তখন বাজেট পাস হয়ে গেছে; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বিশেষ ব্যবস্থায় ওই অর্থের ব্যবস্থা করলেন। বরাদ্দ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিলাম। কারণ সার্ভের জন্য কেবল একটি সিজন ছিল_ ২০০৯ সালের ডিসেম্বর থেকে মার্চ ২০১০। এর মধ্যে করতে না পারলে জাতিসংঘে যথাসময়ে দাবি পেশ করা যাবে না। আমরা ডাচ সরকারকে কাজটি করে দেওয়ার অনুরোধ জানালাম। তাদের একটি জাহাজ তখন প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ফিরছিল। ২০১০ সালের মার্চে সার্ভে সম্পন্ন হয়। আমরা প্রমাণ করলাম বাংলাদেশের মাটি ও বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকার তলদেশ একই উপাদানে গঠিত। এ সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নৌবাহিনীর জন্য বিএনএস অনুসন্ধান নামে একটি জরিপ জাহাজ কিনে দেন। পরে আমরা সব তথ্য-উপাত্ত জাতিসংঘের একজন কমিশনারকে দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নিলাম। পরে ২০১১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আমরা দাবিনামা পেশ করি।
সমকাল : বিষয়টি আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে গেল কোন প্রেক্ষাপটে?
খুরশেদ আলম : আপনাদের মনে আছে, সরকার সমুদ্রবক্ষে ২৮টি তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ব্লক করেছিল। সেগুলোর টেন্ডারও আহ্বান করা হলো। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কনোকোফিলিপস বেশ কিছু ব্লক পেয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার বলল এর ১৭টি ব্লক তাদের সীমানায়। আর ভারত দাবি করল ১০টি। আমাদের থাকল মাত্র একটি ব্লক। আসলে আমরা সমুদ্রসীমা নির্ধারণ না করেই ব্লক ঘোষণা করেছিলাম। এটা আন্তর্জাতিক আইনসম্মত কাজ হয়নি। মিয়ানমার ও ভারতের দাবি অনুযায়ী আমাদের সমুদ্রসীমা ১৩০ মাইলের মধ্যে আটকে গেল। ইতিমধ্যে বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তখন বিষয়টি চিন্তা-ভাবনা হলো। আমাকে বলা হলো তেল-গ্যাস ও মৎস্যসম্পদ সমৃদ্ধ এত বড় এলাকা দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করে সুরাহা হবে না। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। বাংলাদেশের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আমাদের আন্তর্জাতিক আদালতেই যেতে হবে। আপনারা প্রস্তুতি নিন। আমরা তখন আরবিট্রেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকলাম।
সমকাল : কতদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন? বিষয়টি তো কড়া গোপনীয়তার মধ্যে ছিল।
খুরশেদ আলম : আমাদের লেগেছে চার-পাঁচ মাস। হ্যাঁ, কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করেছি আমরা। অনেকে অভিযোগ করে থাকেন, বাংলাদেশে কোনো কিছু গোপন থাকে না। আশঙ্কা ছিল যে আদালতে যাওয়ার বিষয়টিও সাধারণ মানুষ জেনে যাবে। আমরা সেটা হতে দিইনি। বিষয়টি যদি ভারত বা মিয়ানমার জানতে পারত তাহলে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার আশঙ্কা ছিল। এমন নজির রয়েছে। তাতে করে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ছাড়া আমাদের আর উপায় থাকত না। ২০০৯ সালের অক্টোবরে হেগে অবস্থিত সমুদ্রসীমা বিষয়ক স্থায়ী আদালতে আমরা ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিয়ে অভিযোগ দায়ের করি।
সমকাল : ভারত ও মিয়ানমার আমাদের এসব প্রস্তুতির ব্যাপারে কোন পর্যায়ে এসে জানতে পারে?
খুরশেদ আলম : প্রথম দিকে জানত না। একেবারে শেষ মুহূর্তে আমরা তাদের জানিয়েছি। তারা বাধা দেওয়ারও চেষ্টা করেছে; কিন্তু কাজ হয়নি। ভারত মহীসোপানের দাবি জানিয়েছে ২০০৯ সালে। মিয়ানমার তারও আগে, ২০০৮ সালে। আমরা যদি ২০০১-০৭ সালের মধ্যে দাবি জানাতাম, তাহলে সিদ্ধান্ত এতদিনে পেয়ে যেতাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে সময় সরকার জরিপও চালায়নি।
সমকাল : আমরা দেখলাম, বাংলাদেশ-মিয়ানমার মামলা হেগের আদালত থেকে জার্মানির হামবুর্গের আদালতে স্থানান্তর হয়েছিল বোধহয় মিয়ানমারের প্রস্তাবে। তারা কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন? আপনার কী মনে হয়?
খুরশেদ আলম : হ্যাঁ, প্রস্তাবটা মিয়ানমারের দিক থেকেই ছিল। তারাই ইটলসে যাওয়ার কথা বলেছিল। আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না। জাতিসংঘ স্থায়ী আদালতে যে কোনো পক্ষই এককভাবে যেতে পারে। কিন্তু ইটলসে যেতে হলে উভয় পক্ষের সম্মতি প্রয়োজন হয়। আর মিয়ানমারের দিক থেকে বোধহয় হিসাব ছিল যে হেগের আদালতে তারা সুবিধা করতে পারবে না। কারণ তারা ছিল তখনও একঘরে। সেখানে মাত্র পাঁচজন বিচারপতি। আর হামবুর্গে ২২-২৩ জন বিচারপতি। সেখানে কারও পক্ষে কারসাজি করা কঠিন হবে।
সমকাল : রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল কোন কোন দিক বিবেচনা করেছেন?
খুরশেদ আলম : ট্রাইব্যুনাল তিনটি পর্যায়ে বিবেচনা করেছেন। প্রথম হচ্ছে টেরিটোরিয়াল সি। ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত টেরিটোরিয়াল সির সীমানা নির্ধারণের ব্যাপারে ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের ঐকমত্য হয়েছিল। পরে বিষয়টি ফাইলে পড়ে ছিল, পরবর্তী সরকারগুলো এটাকে আর চুক্তিতে পরিণত করেনি। ফলে আদালতে গিয়ে মিয়ানমার বলল, এটা তো সম্মত কার্যবিবরণী মাত্র। তারা এটা আর মানেন না। ইতিমধ্যে জাতিসংঘেও নতুন কনভেনশন হয়েছে। মিয়ানমার চেয়েছিল ৬ মাইল হোক। আমরা ১২ মাইল অথবা ১৯৭৪ সালের ঐকমত্য বলবৎ চেয়েছি। দু'পক্ষই যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছে। শেষ পর্যন্ত আদালত '৭৪ সালের দলিল না মানলেও সমদূরত্ব নীতিতে ১২ মাইল টেরিটোরিয়াল সি নির্ধারণ করে দেয়। সেটা অবশ্য '৭৪ সালের সীমানারই অনুরূপ। বরং আমাদের কিছুটা লাভই হয়েছে।
আদালতের দ্বিতীয় বিবেচনা ছিল এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন। মিয়ানমার বলেছিল, তোমাদের আঁকাবাঁকা উপকূল রেখার জন্য তো আমরা দায়ী নই। ফলে সমদূরত্ব পদ্ধতিতে সীমানা নির্ধারণ হতে হবে। আমরা বলেছি, উপকূল আঁকাবাঁকার জন্য তো আমরাও দায়ী নই। প্রকৃতির ব্যাপার। আদালতকে বাংলাদেশের প্রতি ন্যায়বিচার করতে হবে। জার্মানি নিজেই তো ডেনমার্কের বিরুদ্ধে মামলায় ইকুইটির কথা বলেছে। আদালত আমাদের যুক্তি মেনেছেন। তৃতীয় বিষয় ছিল মহীসোপান। এটা একটু জটিল। কারণ আমাদের ২০০ মাইল এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন শেষ হওয়ার পর যেখানে মহীসোপান শুরু হবে, সেখানে মিয়ানমারের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন ঢুকে গেছে। সামান্য জায়গা, ৪০-৫০ বর্গকিলোমিটার। আবার মিয়ানমার বলল, মহীসোপানের বিষয়টি এখন নিষ্পত্তি হবে না। কারণ বাংলাদেশ মাত্র ২০১১ সালে তাদের দাবি জাতিসংঘে পেশ করেছে। আদালতও বললেন, এখন এটার সমাধান দেওয়া যাবে না। আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা উদ্ধৃত করে বললাম, বিধাতার রাত-দিন নেই, তার অনেক সময়। কিন্তু আমরা মরণশীল মানুষ। আমাদের তো কাজ শেষ করতে হবে। সমাধান একটা দিতেই হবে। তখন আদালত মহীসোপানের সীমানার দিক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ভারতের সঙ্গে নিষ্পত্তির পর সেটা চূড়ান্ত হবে। মিয়ানমারের ইকোনমিক জোনের যে অংশ আমাদের মহীসোপানে ঢুকে গেছে, সেখানকার তলদেশ হবে বাংলাদেশের আর পানি হবে মিয়ানমারের।
সমকাল : মিয়ানমার-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা অংশে এখন আমাদের কী করার আছে?
খুরশেদ আলম : জ্বালানি মন্ত্রণালয়, মৎস্যসম্পদ মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সেটা ঠিক করবে। নৌ-টহল বৃদ্ধি করা হবে কি-না ঠিক করবে। সমুদ্রে শক্তি বাড়াতে হবে। কারণ আমাদের দু'পাশেই শক্তিশালী দেশ রয়েছে। সম্পদ কীভাবে কাজে লাগাতে পারি, সে ব্যাপারে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিতে হবে। জ্বালানি ও মাছ ছাড়াও পলিমেটালিক সালফাইডসহ কপার, ম্যাগনেশিয়াম, নিকেল সংগ্রহ করা যাবে। দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান খনিজ পদার্থ আহরণ নিয়ে ভাবতে হবে।
সমকাল : কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে মিয়ানমার এই রায় বাস্তবায়নে সহযোগিতা না-ও করতে পারে? এটা কতটা সত্য?
খুরশেদ আলম : না, মিয়ানমার মেনে নিয়েছে। সরকারিভাবে জানিয়েছে। আসলে মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো অপশন নেই। আপিলের সুযোগ নেই। আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক দেশকে আদালতে যেতে হয়েছে এবং রায় মেনে নিতে হয়েছে।
সমকাল : ভারতের সঙ্গে আমাদের বিরোধের বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে হেগের আদালতে। হামবুর্গের আদালতের সঙ্গে এর কি কোনো পার্থক্য রয়েছে।
খুরশেদ আলম : কিছু পার্থক্য রয়েছে। হামবুর্গে ২৩ জন বিচারক, হেগে ৫ জন। এখানে বিচারকদের বেতন-ভাতা দেয় জাতিসংঘ। সেখানে দিতে হবে বাদী ও বিবাদীকে। জুরিসডিকশনের কোনো পার্থক্য নেই। তবে হেগের বিচার প্রক্রিয়া হামবুর্গের চেয়ে দীর্ঘতর। ইটলসে ছয় মাস লাগলে, সেখানে এক বছর লেগে যায়।
সমকাল : ভারতের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ের জন্য আমাদের প্রস্তুতি কেমন?
খুরশেদ আলম : আমরা ইতিমধ্যে সব তথ্য-উপাত্ত, যুক্তি আদালতে পেশ করেছি। ভারত তাদের পাল্টা যুক্তি দেবে এ বছর। আমাদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি নেই। তারপরও সমুদ্র আইন নিয়ে যারা চিন্তা-ভাবনা করেন, তাদের সবাইকে আমরা অনুরোধ জানাব আমাদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য। তাতে করে আমাদের আইনি লড়াই আরও শক্তিশালী হবে।
সমকাল : হামবুর্গের আদালতের রায় কি হেগের আদালতে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করবে না? কারণ বিচার কাজের ক্ষেত্রে তো নজির অনুসন্ধান করা হয়।
খুরশেদ আলম : আমরা ইতিবাচক রায়ই আশা করি। এই আদালতেরই তিনজন বিচারক সেখানে রয়েছেন। আমরা আশা করছি, বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমাও ইকুইটির ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।
সমকাল : মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তির পর ভারত তো এখন দ্বিপক্ষীয় আলোচনার প্রস্তাব দিচ্ছে।
খুরশেদ আলম : এ ব্যাপারে সোমবার মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, আদালত থেকে মামলা প্রত্যাহারের প্রশ্নই আসে না। তবে আলোচনার জন্য আমাদের দরজা সবসময় খোলা।
সমকাল : আপনাকে এবং আপনার সহকর্মীদের অভিনন্দন জানাই। আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
খুরশেদ আলম : ধন্যবাদ, সমকালের জন্যও শুভেচ্ছা রইল।
সমকাল : কেমন করে যুক্ত হলেন সমুদ্র জয়ের অভিযানে?
খুরশেদ আলম : সত্তরের দশকের শেষ দিকে ভারতের সঙ্গে তালপট্টি দ্বীপ নিয়ে বিরোধের সময় ১৩০ টনের ছোট একটি গানবোটের কমান্ডে ছিলাম আমি। আর প্রতিপক্ষের ছিল ১১০০ টনের চারটি যুদ্ধজাহাজ, যার প্রতিটিতে ৪-৫টি কামান। আমাদের ভরসা কেবল একটি কামান। জুনিয়র অফিসার হিসেবে সেখানে এক মাস অবস্থানকালে বুঝতে পারি, প্রধানত অর্থনৈতিক কারণে নৌবাহিনীতে তাদের সমকক্ষতা অর্জন করা দুরূহ হবে। সাগরের দ্বীপে তাদের দখলও সরানো যাবে না। শক্তিবলে নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত পন্থায় ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে ন্যায্য অধিকার আদায়ের পথ অনুসন্ধানে সে সময় থেকেই আমি লেগে পড়ি। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় সংসদে টেরিটরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট পাস করেন। এ যুগান্তকারী ও দূরদর্শী আইনে বঙ্গোপসাগর এবং এর সম্পদের ওপর ১২ নটিক্যাল মাইল টেরিটরিয়াল সি, ২০০ কিলোমিটার এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক এলাকা এবং মহীসোপানে বাংলাদেশের অধিকার ঘোষণা করা হয়। ভারত ও মিয়ানমার স্বাধীনতা আগে পেলেও তাদের সাগর-সীমানা ধরে এ দাবি উত্থাপনের কাজটি করেছে আরও পরে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের এ উপলব্ধি আমাকে বঙ্গোপসাগর নিয়ে কাজ করতে আরও অনুপ্রেরণা জোগায়।
সমকাল : জাতিসংঘে আমাদের সমুদ্রসীমার দাবি তো পেশ হয়েছে অনেক পরে। বিলম্ব হলো কীভাবে?
খুরশেদ আলম : ১৯৮২ সালে সমুদ্র আইন বিষয়ক নতুন জাতিসংঘ কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে। ওই অনুষ্ঠানে দু'জন রাষ্ট্রদূত, নৌবাহিনী প্রধানসহ আমি নিজেও ছিলাম। কিন্তু পরবর্তী সরকারগুলো কেন যেন সেটা অনুস্বাক্ষর করেনি। আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সরকার মন্ত্রিসভার শেষ বৈঠকে রেটিফাই করে। ১২ জুলাই ২০০১। তারপর যে পরিস্থিতি উদ্ভব হয় তা হচ্ছে, কনভেনশনে বলা আছে, ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে যদি মহীসোপান চাই, রেটিফিকেশন-পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে মহীসোপানের দাবি তথ্য-উপাত্ত, যুক্তিসহকারে জাতিসংঘে পেশ করতে হবে। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে আমি যখন দায়িত্ব নিলাম, ততদিনে নয় বছর শেষ হয়ে গেছে। ওই এক-দেড় বছরের মধ্যে সব তথ্য-উপাত্ত, নথিপত্র প্রস্তুত করতে হবে এবং প্রমাণ করতে হবে যে, বাংলাদেশের উপকূল থেকে সমুদ্রের তলদেশে একই ধরনের সেডিমেন্ট অব্যাহত রয়েছে। এটা প্রমাণ করার জন্য সিসমিক ও বেজমেন্ট সার্ভে করা দরকার। আগে আমাদের দেশে কখনও সিসমিক সার্ভে হয়নি। উপযুক্ত জাহাজও নেই, তা ভাড়া করতে হবে। আমি অনেকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে দেখলাম এ জন্য প্রায় ৮০ কোটি টাকা লাগে। মাননীয় মন্ত্রী প্রস্তাবটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যান। তখন বাজেট পাস হয়ে গেছে; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বিশেষ ব্যবস্থায় ওই অর্থের ব্যবস্থা করলেন। বরাদ্দ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিলাম। কারণ সার্ভের জন্য কেবল একটি সিজন ছিল_ ২০০৯ সালের ডিসেম্বর থেকে মার্চ ২০১০। এর মধ্যে করতে না পারলে জাতিসংঘে যথাসময়ে দাবি পেশ করা যাবে না। আমরা ডাচ সরকারকে কাজটি করে দেওয়ার অনুরোধ জানালাম। তাদের একটি জাহাজ তখন প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ফিরছিল। ২০১০ সালের মার্চে সার্ভে সম্পন্ন হয়। আমরা প্রমাণ করলাম বাংলাদেশের মাটি ও বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকার তলদেশ একই উপাদানে গঠিত। এ সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নৌবাহিনীর জন্য বিএনএস অনুসন্ধান নামে একটি জরিপ জাহাজ কিনে দেন। পরে আমরা সব তথ্য-উপাত্ত জাতিসংঘের একজন কমিশনারকে দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নিলাম। পরে ২০১১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আমরা দাবিনামা পেশ করি।
সমকাল : বিষয়টি আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে গেল কোন প্রেক্ষাপটে?
খুরশেদ আলম : আপনাদের মনে আছে, সরকার সমুদ্রবক্ষে ২৮টি তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ব্লক করেছিল। সেগুলোর টেন্ডারও আহ্বান করা হলো। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কনোকোফিলিপস বেশ কিছু ব্লক পেয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার বলল এর ১৭টি ব্লক তাদের সীমানায়। আর ভারত দাবি করল ১০টি। আমাদের থাকল মাত্র একটি ব্লক। আসলে আমরা সমুদ্রসীমা নির্ধারণ না করেই ব্লক ঘোষণা করেছিলাম। এটা আন্তর্জাতিক আইনসম্মত কাজ হয়নি। মিয়ানমার ও ভারতের দাবি অনুযায়ী আমাদের সমুদ্রসীমা ১৩০ মাইলের মধ্যে আটকে গেল। ইতিমধ্যে বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তখন বিষয়টি চিন্তা-ভাবনা হলো। আমাকে বলা হলো তেল-গ্যাস ও মৎস্যসম্পদ সমৃদ্ধ এত বড় এলাকা দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করে সুরাহা হবে না। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। বাংলাদেশের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আমাদের আন্তর্জাতিক আদালতেই যেতে হবে। আপনারা প্রস্তুতি নিন। আমরা তখন আরবিট্রেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকলাম।
সমকাল : কতদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন? বিষয়টি তো কড়া গোপনীয়তার মধ্যে ছিল।
খুরশেদ আলম : আমাদের লেগেছে চার-পাঁচ মাস। হ্যাঁ, কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করেছি আমরা। অনেকে অভিযোগ করে থাকেন, বাংলাদেশে কোনো কিছু গোপন থাকে না। আশঙ্কা ছিল যে আদালতে যাওয়ার বিষয়টিও সাধারণ মানুষ জেনে যাবে। আমরা সেটা হতে দিইনি। বিষয়টি যদি ভারত বা মিয়ানমার জানতে পারত তাহলে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার আশঙ্কা ছিল। এমন নজির রয়েছে। তাতে করে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ছাড়া আমাদের আর উপায় থাকত না। ২০০৯ সালের অক্টোবরে হেগে অবস্থিত সমুদ্রসীমা বিষয়ক স্থায়ী আদালতে আমরা ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিয়ে অভিযোগ দায়ের করি।
সমকাল : ভারত ও মিয়ানমার আমাদের এসব প্রস্তুতির ব্যাপারে কোন পর্যায়ে এসে জানতে পারে?
খুরশেদ আলম : প্রথম দিকে জানত না। একেবারে শেষ মুহূর্তে আমরা তাদের জানিয়েছি। তারা বাধা দেওয়ারও চেষ্টা করেছে; কিন্তু কাজ হয়নি। ভারত মহীসোপানের দাবি জানিয়েছে ২০০৯ সালে। মিয়ানমার তারও আগে, ২০০৮ সালে। আমরা যদি ২০০১-০৭ সালের মধ্যে দাবি জানাতাম, তাহলে সিদ্ধান্ত এতদিনে পেয়ে যেতাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে সময় সরকার জরিপও চালায়নি।
সমকাল : আমরা দেখলাম, বাংলাদেশ-মিয়ানমার মামলা হেগের আদালত থেকে জার্মানির হামবুর্গের আদালতে স্থানান্তর হয়েছিল বোধহয় মিয়ানমারের প্রস্তাবে। তারা কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন? আপনার কী মনে হয়?
খুরশেদ আলম : হ্যাঁ, প্রস্তাবটা মিয়ানমারের দিক থেকেই ছিল। তারাই ইটলসে যাওয়ার কথা বলেছিল। আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না। জাতিসংঘ স্থায়ী আদালতে যে কোনো পক্ষই এককভাবে যেতে পারে। কিন্তু ইটলসে যেতে হলে উভয় পক্ষের সম্মতি প্রয়োজন হয়। আর মিয়ানমারের দিক থেকে বোধহয় হিসাব ছিল যে হেগের আদালতে তারা সুবিধা করতে পারবে না। কারণ তারা ছিল তখনও একঘরে। সেখানে মাত্র পাঁচজন বিচারপতি। আর হামবুর্গে ২২-২৩ জন বিচারপতি। সেখানে কারও পক্ষে কারসাজি করা কঠিন হবে।
সমকাল : রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল কোন কোন দিক বিবেচনা করেছেন?
খুরশেদ আলম : ট্রাইব্যুনাল তিনটি পর্যায়ে বিবেচনা করেছেন। প্রথম হচ্ছে টেরিটোরিয়াল সি। ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত টেরিটোরিয়াল সির সীমানা নির্ধারণের ব্যাপারে ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের ঐকমত্য হয়েছিল। পরে বিষয়টি ফাইলে পড়ে ছিল, পরবর্তী সরকারগুলো এটাকে আর চুক্তিতে পরিণত করেনি। ফলে আদালতে গিয়ে মিয়ানমার বলল, এটা তো সম্মত কার্যবিবরণী মাত্র। তারা এটা আর মানেন না। ইতিমধ্যে জাতিসংঘেও নতুন কনভেনশন হয়েছে। মিয়ানমার চেয়েছিল ৬ মাইল হোক। আমরা ১২ মাইল অথবা ১৯৭৪ সালের ঐকমত্য বলবৎ চেয়েছি। দু'পক্ষই যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছে। শেষ পর্যন্ত আদালত '৭৪ সালের দলিল না মানলেও সমদূরত্ব নীতিতে ১২ মাইল টেরিটোরিয়াল সি নির্ধারণ করে দেয়। সেটা অবশ্য '৭৪ সালের সীমানারই অনুরূপ। বরং আমাদের কিছুটা লাভই হয়েছে।
আদালতের দ্বিতীয় বিবেচনা ছিল এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন। মিয়ানমার বলেছিল, তোমাদের আঁকাবাঁকা উপকূল রেখার জন্য তো আমরা দায়ী নই। ফলে সমদূরত্ব পদ্ধতিতে সীমানা নির্ধারণ হতে হবে। আমরা বলেছি, উপকূল আঁকাবাঁকার জন্য তো আমরাও দায়ী নই। প্রকৃতির ব্যাপার। আদালতকে বাংলাদেশের প্রতি ন্যায়বিচার করতে হবে। জার্মানি নিজেই তো ডেনমার্কের বিরুদ্ধে মামলায় ইকুইটির কথা বলেছে। আদালত আমাদের যুক্তি মেনেছেন। তৃতীয় বিষয় ছিল মহীসোপান। এটা একটু জটিল। কারণ আমাদের ২০০ মাইল এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন শেষ হওয়ার পর যেখানে মহীসোপান শুরু হবে, সেখানে মিয়ানমারের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন ঢুকে গেছে। সামান্য জায়গা, ৪০-৫০ বর্গকিলোমিটার। আবার মিয়ানমার বলল, মহীসোপানের বিষয়টি এখন নিষ্পত্তি হবে না। কারণ বাংলাদেশ মাত্র ২০১১ সালে তাদের দাবি জাতিসংঘে পেশ করেছে। আদালতও বললেন, এখন এটার সমাধান দেওয়া যাবে না। আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা উদ্ধৃত করে বললাম, বিধাতার রাত-দিন নেই, তার অনেক সময়। কিন্তু আমরা মরণশীল মানুষ। আমাদের তো কাজ শেষ করতে হবে। সমাধান একটা দিতেই হবে। তখন আদালত মহীসোপানের সীমানার দিক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ভারতের সঙ্গে নিষ্পত্তির পর সেটা চূড়ান্ত হবে। মিয়ানমারের ইকোনমিক জোনের যে অংশ আমাদের মহীসোপানে ঢুকে গেছে, সেখানকার তলদেশ হবে বাংলাদেশের আর পানি হবে মিয়ানমারের।
সমকাল : মিয়ানমার-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা অংশে এখন আমাদের কী করার আছে?
খুরশেদ আলম : জ্বালানি মন্ত্রণালয়, মৎস্যসম্পদ মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সেটা ঠিক করবে। নৌ-টহল বৃদ্ধি করা হবে কি-না ঠিক করবে। সমুদ্রে শক্তি বাড়াতে হবে। কারণ আমাদের দু'পাশেই শক্তিশালী দেশ রয়েছে। সম্পদ কীভাবে কাজে লাগাতে পারি, সে ব্যাপারে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিতে হবে। জ্বালানি ও মাছ ছাড়াও পলিমেটালিক সালফাইডসহ কপার, ম্যাগনেশিয়াম, নিকেল সংগ্রহ করা যাবে। দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান খনিজ পদার্থ আহরণ নিয়ে ভাবতে হবে।
সমকাল : কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে মিয়ানমার এই রায় বাস্তবায়নে সহযোগিতা না-ও করতে পারে? এটা কতটা সত্য?
খুরশেদ আলম : না, মিয়ানমার মেনে নিয়েছে। সরকারিভাবে জানিয়েছে। আসলে মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো অপশন নেই। আপিলের সুযোগ নেই। আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক দেশকে আদালতে যেতে হয়েছে এবং রায় মেনে নিতে হয়েছে।
সমকাল : ভারতের সঙ্গে আমাদের বিরোধের বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে হেগের আদালতে। হামবুর্গের আদালতের সঙ্গে এর কি কোনো পার্থক্য রয়েছে।
খুরশেদ আলম : কিছু পার্থক্য রয়েছে। হামবুর্গে ২৩ জন বিচারক, হেগে ৫ জন। এখানে বিচারকদের বেতন-ভাতা দেয় জাতিসংঘ। সেখানে দিতে হবে বাদী ও বিবাদীকে। জুরিসডিকশনের কোনো পার্থক্য নেই। তবে হেগের বিচার প্রক্রিয়া হামবুর্গের চেয়ে দীর্ঘতর। ইটলসে ছয় মাস লাগলে, সেখানে এক বছর লেগে যায়।
সমকাল : ভারতের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ের জন্য আমাদের প্রস্তুতি কেমন?
খুরশেদ আলম : আমরা ইতিমধ্যে সব তথ্য-উপাত্ত, যুক্তি আদালতে পেশ করেছি। ভারত তাদের পাল্টা যুক্তি দেবে এ বছর। আমাদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি নেই। তারপরও সমুদ্র আইন নিয়ে যারা চিন্তা-ভাবনা করেন, তাদের সবাইকে আমরা অনুরোধ জানাব আমাদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য। তাতে করে আমাদের আইনি লড়াই আরও শক্তিশালী হবে।
সমকাল : হামবুর্গের আদালতের রায় কি হেগের আদালতে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করবে না? কারণ বিচার কাজের ক্ষেত্রে তো নজির অনুসন্ধান করা হয়।
খুরশেদ আলম : আমরা ইতিবাচক রায়ই আশা করি। এই আদালতেরই তিনজন বিচারক সেখানে রয়েছেন। আমরা আশা করছি, বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমাও ইকুইটির ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।
সমকাল : মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তির পর ভারত তো এখন দ্বিপক্ষীয় আলোচনার প্রস্তাব দিচ্ছে।
খুরশেদ আলম : এ ব্যাপারে সোমবার মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, আদালত থেকে মামলা প্রত্যাহারের প্রশ্নই আসে না। তবে আলোচনার জন্য আমাদের দরজা সবসময় খোলা।
সমকাল : আপনাকে এবং আপনার সহকর্মীদের অভিনন্দন জানাই। আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
খুরশেদ আলম : ধন্যবাদ, সমকালের জন্যও শুভেচ্ছা রইল।
No comments