প্রতিরোধের মার্চ-গণহত্যা এড়াতেই মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা by কামাল হোসেন
একাত্তরের মার্চে প্রেসিডেন্ট ভবনে পাকিস্তানিদের সঙ্গে অন্তিম পর্বের আলোচনা চলছিল। বঙ্গবন্ধুর সহযোগী হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এইচ এম কামরুজ্জামান, মনসুর আলী ও আমি ছিলাম। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষে ছিলেন তাঁর উপদেষ্টা সাবেক আইনমন্ত্রী বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল পীরজাদা এবং সামরিক বাহিনীর জজ অ্যাডভোকেট জেনারেল কর্নেল হাসান।
ওই আলোচনার শুরুতেই ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটাই প্রাধান্য পায়। যদিও এলএফওর অধীনে ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মুখ্য শর্ত ছিল একটি নতুন সংবিধান তৈরি করা। কিন্তু বিশ্বাস ও আস্থার সংকট আগাগোড়া লেপ্টে ছিল।
আলোচনা যখন চলছিল, তখন পাকিস্তানের কোনো সংবিধান ছিল না। তাই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আলোকে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করার আগ পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তীকালীন শাসনব্যবস্থা দাঁড় করানোর লক্ষ্যে কথাবার্তা শুরু হয়। আমার জানা ছিল, বিচারপতি কর্নেলিয়াস বিশিষ্ট আইনবিদ এ কে ব্রোহিকে পছন্দ করতেন। তাই আমরাও আশা করি, তাঁর কাছ থেকে অভিমত নেওয়া হোক। ব্রোহি অভিমত দিয়েছিলেন যে সংবিধান তৈরির আগেই সামরিক আইন তুলে ক্ষমতা হস্তান্তর করা সম্ভব। বাহ্যত আলোচনা সঠিকভাবেই শুরু হয়েছিল। আলোচনার কাঠামো ছয় দফার ভিত্তিতে আমরা সাজিয়েছিলাম। প্রথমেই কথা হলো প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং দেশের দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়—এই তিনটি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে। আর কোনো কিছুই কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এমনকি বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ও আলাদাভাবে সংরক্ষিত হবে। পূর্ব পাকিস্তান যত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে, তা কেন্দ্রে যাবে না, ঢাকায় জমা হবে। শুধু প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় পরিচালনার জন্য যৌথ তহবিল গঠন করা হবে।
উভয় পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে খসড়া প্রস্তুত হলো। এরপর দফাওয়ারি আলোচনা এগিয়ে যেতে থাকে। অর্থনৈতিক বিষয়গুলো ভাগাভাগি করা নিয়েও আলোচনা চলে যেমন—কর আদায়ে দুই অংশে দুই রকম বিধান থাকবে। অভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে কিছু থাকবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভাগ হবে। এসব আলোচনা আমরা চালাচ্ছিলাম ঠিকই, কিন্তু কোনো অবস্থায়ই কারও স্বস্তি ছিল না। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার ঘাটতি ছিল না। কারণ, পাকিস্তানিরা মার্চের আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল। সেনা আনা চলছিল প্রতিদিন। নির্বাচনে যাওয়ার আগে থেকেই মানুষের মধ্যে বলাবলি ছিল, নির্বাচনে হেরে গেলে ইয়াহিয়া কি নির্বিঘ্নে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন, নাকি মরণকামড় দেবেন? আমরা যখন আলোচনা করছিলাম, এটা কি কালক্ষেপণ হচ্ছে, নাকি শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, সেই প্রশ্ন ছিল। অসহযোগ আন্দোলন দানা বাঁধছিল।
অ্যাডমিরাল সৈয়দ মোহাম্মদ আহসান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। তিনি গোড়া থেকে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। মার্চের শুরুতেই তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর পাঠিয়েছিলেন যে তিনি কথা বলতে চান। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বঙ্গবন্ধু আমাকে পাঠিয়েছিলেন। গিয়ে শুনলাম তিনি পদত্যাগ করতে চান। বঙ্গবন্ধু তা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি আমাকে বলে দিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু চান, আপনি যেন পদত্যাগ না করেন। এটা তিনি বলেছিলেন এ জন্য যে এই একজন ভদ্রলোক অবশিষ্ট ছিলেন, যাঁকে আমরা বিশ্বাস করতে পারতাম। অ্যাডমিরাল আহসানকে বঙ্গবন্ধুর তরফ থেকে আরও জানালাম, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি যেন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি না করা হয়। তিনি আমার সামনেই ইয়াহিয়ার কাছে ফোন করলেন। সম্ভবত ফোন ধরেছিলেন প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব। তিনি অ্যাডমিরাল আহসানকে জানালেন, প্রেসিডেন্টকে এখন ফোন দেওয়া যাচ্ছে না। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের পরে বাসায় পৌঁছাতে না-পৌঁছাতেই শুনলাম, অ্যাডমিরাল আহসানকে গভর্নরের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাঁর পরিবর্তে নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন টিক্কা খান। সুতরাং, আলোচনা চললেও ৭ মার্চের পরে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছিল।
অর্থনৈতিক বিষয়গুলো কী করে মীমাংসিত হবে, সে বিষয়টি গুরুত্ব পায়। অধ্যাপক রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান, নূরুল ইসলামকে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিতে বলেছিলাম। পাকিস্তানের পক্ষে অর্থসচিব কামরুল ইসলাম, পরিকল্পনা কমিশনের এম এম আহমেদ ও ড. সারতাজ আজিজের অংশ নেওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে একদিন ভুট্টো ঢাকায় এলেন। সে সময় তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক তখন হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধু একদিন প্রেসিডেন্ট হাউসে ঢুকছিলেন, তখন ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। ভুট্টো তাঁকে প্রেসিডেন্ট হাউস চত্বরের বাগানে নিয়ে যান। সেখানে তাঁদের মধ্যে অল্প সময়ে কিছু কথাবার্তা হয়। ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, তাঁর কাছে খবর আছে, গ্রামাঞ্চলের ৮০-৯০ ভাগ মানুষ সাচ্চা মুসলমান। তাঁরা অখণ্ড পাকিস্তানের সংহতির পক্ষে। বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, জনমত ইতিমধ্যে যেভাবে সংগঠিত হয়েছে, তাতে ছয় দফার ভিত্তিতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এর চেয়ে কম কিছুতে জনগণ শান্ত হবে না। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে বেরিয়ে আমাদের কাছে বিষয়টি বলেছিলেন। তাঁদের মধ্যকার এই আলোচনার বিষয়টি ভুট্টো ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বরের লেখা দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডি বইয়ে উল্লেখ করেছেন।
এরপরে গাজীপুরে সশস্ত্র প্রতিরোধের ঘটনা ঘটল। ইয়াহিয়া তখন ঢাকায়। ইয়াহিয়া তাঁর লাল চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘আমি ক্ষুব্ধ ও অবাক হয়েছি। সামরিক বাহিনীর ওপর তারা হাত তুলেছে।’ আমরা ২৩ মার্চ গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে প্রেসিডেন্ট হাউসে গিয়েছি। পীরজাদা বললেন, তোমরা অবিভক্ত পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথাবার্তা বলছ, এখন পতাকা উড়িয়ে বৈঠকে যোগ দিতে এসেছ। সেদিন ছিল পাকিস্তান দিবস। ২৪ মার্চেও আমরা কিন্তু সমঝোতার খসড়া নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আমরা বলেছিলাম, পাকিস্তানের নাম হতে হবে দ্য কনফেডারেশন অব পাকিস্তান। পাকিস্তানি পক্ষ বলেছিল, এটা নতুন প্রস্তাব। বিচারপতি কর্নেলিয়াস অবশ্য বলেছিলেন, ইউনিয়ন অব পাকিস্তান হতে পারে। ২৫-৩০ পৃষ্ঠার একটি খসড়া নিয়ে আমরা যখন ঘষামাজা করছিলাম, তখন ইয়াহিয়ার দল ২৫ মার্চে ইতিহাসের বর্বরোচিত গণহত্যা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছিল।
শেষ বৈঠকে কর্নেলিয়াস বলেছিলেন, আমার সঙ্গে তিনি এ নিয়ে পরে কথা বলবেন। তবে পীরজাদা তাঁকে থামিয়ে দিলেন। পীরজাদার শেষ সংলাপটি ছিল, খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পরে ড. কামাল হোসেনকে তিনি জানিয়ে দেবেন। আমি তখন ৩ সার্কিট হাউসের (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট) নিচতলায় ভাড়া থাকতাম। কর্নেলিয়াস থাকতেন মূল সার্কিট হাউসের মসজিদসংলগ্ন বাড়িতে।
২৫ মার্চ ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে সন্ধ্যা সাতটায় বিদায় নিয়েছিলাম। পরে তাজউদ্দীন আহমদ, আমীরুল ইসলাম ও আমি রাত সাড়ে ৯টা-১০টার দিকে আবারও ৩২ নম্বরে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের দেখে বললেন, তোমরা এখানে কেন। কারণ, তিনি তখন ভেবেছিলেন, আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছি। তো আজ এ কথা বলতে হয় যে মার্চের আলোচনা কার্যত স্বাধীনতার দিকেই অগ্রসর হচ্ছিল। কারণ, ছয় দফার কমে কোনো কিছুই আমরা আলোচনা করিনি। ছয় দফা না হয় এক দফা, সে কথা আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। এমনকি একজন তরুণ হিসেবে ১৯৬৯ সালের সভা-সমাবেশেও বলেছি, ছয় দফা না হয় এক দফা। আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে বঙ্গবন্ধু গণহত্যা এড়াতেই মার্চের আলোচনা চালিয়ে যেতে রাজি হয়েছিলেন। যে মুহূর্ত থেকে আক্রমণ, সে মুহূর্ত থেকেই স্বাধীনতা—সেটাই ছিল তাঁর অন্তরের কথা।
ড. কামাল হোসেন: সভাপতি গণফোরাম ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
আলোচনা যখন চলছিল, তখন পাকিস্তানের কোনো সংবিধান ছিল না। তাই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আলোকে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করার আগ পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তীকালীন শাসনব্যবস্থা দাঁড় করানোর লক্ষ্যে কথাবার্তা শুরু হয়। আমার জানা ছিল, বিচারপতি কর্নেলিয়াস বিশিষ্ট আইনবিদ এ কে ব্রোহিকে পছন্দ করতেন। তাই আমরাও আশা করি, তাঁর কাছ থেকে অভিমত নেওয়া হোক। ব্রোহি অভিমত দিয়েছিলেন যে সংবিধান তৈরির আগেই সামরিক আইন তুলে ক্ষমতা হস্তান্তর করা সম্ভব। বাহ্যত আলোচনা সঠিকভাবেই শুরু হয়েছিল। আলোচনার কাঠামো ছয় দফার ভিত্তিতে আমরা সাজিয়েছিলাম। প্রথমেই কথা হলো প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং দেশের দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়—এই তিনটি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে। আর কোনো কিছুই কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এমনকি বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ও আলাদাভাবে সংরক্ষিত হবে। পূর্ব পাকিস্তান যত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে, তা কেন্দ্রে যাবে না, ঢাকায় জমা হবে। শুধু প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় পরিচালনার জন্য যৌথ তহবিল গঠন করা হবে।
উভয় পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে খসড়া প্রস্তুত হলো। এরপর দফাওয়ারি আলোচনা এগিয়ে যেতে থাকে। অর্থনৈতিক বিষয়গুলো ভাগাভাগি করা নিয়েও আলোচনা চলে যেমন—কর আদায়ে দুই অংশে দুই রকম বিধান থাকবে। অভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে কিছু থাকবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভাগ হবে। এসব আলোচনা আমরা চালাচ্ছিলাম ঠিকই, কিন্তু কোনো অবস্থায়ই কারও স্বস্তি ছিল না। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার ঘাটতি ছিল না। কারণ, পাকিস্তানিরা মার্চের আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল। সেনা আনা চলছিল প্রতিদিন। নির্বাচনে যাওয়ার আগে থেকেই মানুষের মধ্যে বলাবলি ছিল, নির্বাচনে হেরে গেলে ইয়াহিয়া কি নির্বিঘ্নে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন, নাকি মরণকামড় দেবেন? আমরা যখন আলোচনা করছিলাম, এটা কি কালক্ষেপণ হচ্ছে, নাকি শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, সেই প্রশ্ন ছিল। অসহযোগ আন্দোলন দানা বাঁধছিল।
অ্যাডমিরাল সৈয়দ মোহাম্মদ আহসান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। তিনি গোড়া থেকে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। মার্চের শুরুতেই তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর পাঠিয়েছিলেন যে তিনি কথা বলতে চান। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বঙ্গবন্ধু আমাকে পাঠিয়েছিলেন। গিয়ে শুনলাম তিনি পদত্যাগ করতে চান। বঙ্গবন্ধু তা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি আমাকে বলে দিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু চান, আপনি যেন পদত্যাগ না করেন। এটা তিনি বলেছিলেন এ জন্য যে এই একজন ভদ্রলোক অবশিষ্ট ছিলেন, যাঁকে আমরা বিশ্বাস করতে পারতাম। অ্যাডমিরাল আহসানকে বঙ্গবন্ধুর তরফ থেকে আরও জানালাম, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি যেন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি না করা হয়। তিনি আমার সামনেই ইয়াহিয়ার কাছে ফোন করলেন। সম্ভবত ফোন ধরেছিলেন প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব। তিনি অ্যাডমিরাল আহসানকে জানালেন, প্রেসিডেন্টকে এখন ফোন দেওয়া যাচ্ছে না। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের পরে বাসায় পৌঁছাতে না-পৌঁছাতেই শুনলাম, অ্যাডমিরাল আহসানকে গভর্নরের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাঁর পরিবর্তে নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন টিক্কা খান। সুতরাং, আলোচনা চললেও ৭ মার্চের পরে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছিল।
অর্থনৈতিক বিষয়গুলো কী করে মীমাংসিত হবে, সে বিষয়টি গুরুত্ব পায়। অধ্যাপক রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান, নূরুল ইসলামকে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিতে বলেছিলাম। পাকিস্তানের পক্ষে অর্থসচিব কামরুল ইসলাম, পরিকল্পনা কমিশনের এম এম আহমেদ ও ড. সারতাজ আজিজের অংশ নেওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে একদিন ভুট্টো ঢাকায় এলেন। সে সময় তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক তখন হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধু একদিন প্রেসিডেন্ট হাউসে ঢুকছিলেন, তখন ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। ভুট্টো তাঁকে প্রেসিডেন্ট হাউস চত্বরের বাগানে নিয়ে যান। সেখানে তাঁদের মধ্যে অল্প সময়ে কিছু কথাবার্তা হয়। ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, তাঁর কাছে খবর আছে, গ্রামাঞ্চলের ৮০-৯০ ভাগ মানুষ সাচ্চা মুসলমান। তাঁরা অখণ্ড পাকিস্তানের সংহতির পক্ষে। বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, জনমত ইতিমধ্যে যেভাবে সংগঠিত হয়েছে, তাতে ছয় দফার ভিত্তিতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এর চেয়ে কম কিছুতে জনগণ শান্ত হবে না। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে বেরিয়ে আমাদের কাছে বিষয়টি বলেছিলেন। তাঁদের মধ্যকার এই আলোচনার বিষয়টি ভুট্টো ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বরের লেখা দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডি বইয়ে উল্লেখ করেছেন।
এরপরে গাজীপুরে সশস্ত্র প্রতিরোধের ঘটনা ঘটল। ইয়াহিয়া তখন ঢাকায়। ইয়াহিয়া তাঁর লাল চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘আমি ক্ষুব্ধ ও অবাক হয়েছি। সামরিক বাহিনীর ওপর তারা হাত তুলেছে।’ আমরা ২৩ মার্চ গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে প্রেসিডেন্ট হাউসে গিয়েছি। পীরজাদা বললেন, তোমরা অবিভক্ত পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথাবার্তা বলছ, এখন পতাকা উড়িয়ে বৈঠকে যোগ দিতে এসেছ। সেদিন ছিল পাকিস্তান দিবস। ২৪ মার্চেও আমরা কিন্তু সমঝোতার খসড়া নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আমরা বলেছিলাম, পাকিস্তানের নাম হতে হবে দ্য কনফেডারেশন অব পাকিস্তান। পাকিস্তানি পক্ষ বলেছিল, এটা নতুন প্রস্তাব। বিচারপতি কর্নেলিয়াস অবশ্য বলেছিলেন, ইউনিয়ন অব পাকিস্তান হতে পারে। ২৫-৩০ পৃষ্ঠার একটি খসড়া নিয়ে আমরা যখন ঘষামাজা করছিলাম, তখন ইয়াহিয়ার দল ২৫ মার্চে ইতিহাসের বর্বরোচিত গণহত্যা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছিল।
শেষ বৈঠকে কর্নেলিয়াস বলেছিলেন, আমার সঙ্গে তিনি এ নিয়ে পরে কথা বলবেন। তবে পীরজাদা তাঁকে থামিয়ে দিলেন। পীরজাদার শেষ সংলাপটি ছিল, খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পরে ড. কামাল হোসেনকে তিনি জানিয়ে দেবেন। আমি তখন ৩ সার্কিট হাউসের (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট) নিচতলায় ভাড়া থাকতাম। কর্নেলিয়াস থাকতেন মূল সার্কিট হাউসের মসজিদসংলগ্ন বাড়িতে।
২৫ মার্চ ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে সন্ধ্যা সাতটায় বিদায় নিয়েছিলাম। পরে তাজউদ্দীন আহমদ, আমীরুল ইসলাম ও আমি রাত সাড়ে ৯টা-১০টার দিকে আবারও ৩২ নম্বরে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের দেখে বললেন, তোমরা এখানে কেন। কারণ, তিনি তখন ভেবেছিলেন, আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছি। তো আজ এ কথা বলতে হয় যে মার্চের আলোচনা কার্যত স্বাধীনতার দিকেই অগ্রসর হচ্ছিল। কারণ, ছয় দফার কমে কোনো কিছুই আমরা আলোচনা করিনি। ছয় দফা না হয় এক দফা, সে কথা আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। এমনকি একজন তরুণ হিসেবে ১৯৬৯ সালের সভা-সমাবেশেও বলেছি, ছয় দফা না হয় এক দফা। আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে বঙ্গবন্ধু গণহত্যা এড়াতেই মার্চের আলোচনা চালিয়ে যেতে রাজি হয়েছিলেন। যে মুহূর্ত থেকে আক্রমণ, সে মুহূর্ত থেকেই স্বাধীনতা—সেটাই ছিল তাঁর অন্তরের কথা।
ড. কামাল হোসেন: সভাপতি গণফোরাম ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
No comments