সময়ের প্রতিধ্বনি-সমুদ্রসীমা : ভারত এখন বড় চ্যালেঞ্জ by মোস্তফা কামাল

মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্র জয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বর্তমান সরকারের একটা বড় সাফল্য। এই অসামান্য অবদানের জন্য বর্তমান সরকারকে অভিনন্দন। অভিনন্দন ডা. দীপু মনিকেও। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার তিন বছর পর দীপু মনি মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা ইস্যুতে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সেই সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিরলস প্রচেষ্টা ছিল। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র জয়ের মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক গুণ বেড়ে গেল।
এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আলাদা সেল 'আনক্লোজ' গঠন করে। এর দায়িত্ব দেওয়া হয় সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ব্যারিস্টার এ কে এইচ মোরশেদকে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন নিয়ে গবেষণা করেন এবং সরকারের করণীয় কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে প্রস্তাব পেশ করেন। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। উভয় দেশের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও হয়। পরে বিষয়টি ঝুলে যায়। বলা হয়, হাতে অনেক সময় আছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা তখন থেকেই বলে আসছিলেন, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টিকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আবার তৎপর হয়ে ওঠে। এই ইস্যুতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে প্রস্তুত করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন বিশেষজ্ঞ খুরশিদ আলমকে আনক্লোজ সেলের প্রধান করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। সমুদ্র আইন বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতাও নেওয়া হয়।
তবে বর্তমান সরকার দ্বিপক্ষীয়ভাবেই সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিল এবং মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে কয়েকটি বৈঠকও করেছিল। কিন্তু বৈঠকে কোনো মীমাংসায় পেঁৗছা সম্ভব হয়নি। কোনো পক্ষই সমুদ্রের ওপর তাদের দাবি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়নি। বরং বাংলাদেশের আগেই ভারত ও মিয়ানমার সমুদ্রের ওপর তাদের দাবি জাতিসংঘে পেশ করে। বাধ্য হয়েই বাংলাদেশও জাতিসংঘে দাবি উত্থাপন করে। স্থলভাগ থেকে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন এবং কন্টিনেন্টাল সেলফসহ ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশের বলে দাবি করা হয়। বাংলাদেশের দাবির সপক্ষে জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত 'ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল' অব দ্য সি'তে যুক্তি উপস্থাপন করে বাংলাদেশ পক্ষ। মিয়ানমারও তাদের দাবির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে। উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক পর্যালোচনা করে ১৪ মার্চ তার রায় ঘোষণা করেন আদালত। সেই রায়ে বাংলাদেশের দাবিটি যে যৌক্তিক ছিল তা প্রমাণিত হয়।
বলা যায়, দেশের স্বার্থ রক্ষায় বর্তমান সরকার অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে। দেশের স্বার্থে সরকারের ভূমিকা এমনই হওয়া উচিত। সরকারের এই অবদানের কথা বাঙালি জাতি স্মরণে রাখবে। আমরা জানি যে, মিয়ানমারও সমুদ্রসীমার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের যুক্তিতর্কের কাছে তারা হেরে গেছে। আর এর ফলে বাংলাদেশের আয়তনও অনেক বেড়ে গেছে। এখন আর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বরাবর সমুদ্র বক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশের কোনো বাধা থাকল না। এখন বাংলাদেশের উচিত হবে অতি দ্রুত সমুদ্র বক্ষে সম্পদ আহরণের উদ্যোগ নেওয়া।
একই সঙ্গে বলতে চাই, এখন সরকারের উচিত ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের ওপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। মনে রাখতে হবে, মিয়ানমারের চেয়ে ভারতের কর্মকর্তারা অনেক বেশি দক্ষ ও অভিজ্ঞ। তাদের সঙ্গে যুক্তিতর্কে টিকে থাকা এবং নিজেদের দাবি আদায় করা অত্যন্ত কঠিন কাজ এবং একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জটি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। এ জন্য আরো ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে হবে।
সমুদ্রসীমা ইস্যুতে ভারত প্রথম দিকে বাংলাদেশকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও মিয়ানমারের সঙ্গে বিজয় লাভের পর ভারত এখন বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাচ্ছে। ভারতের ঢাকায় নিযুক্ত হাই কমিশনার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের কাছে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছেন। এটা বাংলাদেশের এক ধরনের নৈতিক বিজয় বলে মনে করি। এখন বাংলাদেশকে আরো বেশি কৌশলী হতে হবে।
ভারত নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পেরেছে যে বাংলাদেশকে আর ছোট করে দেখার উপায় নেই। আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশ তার দাবির সপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বিজয় লাভের এই অভিজ্ঞতাকে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় কাজে লাগাবে। ভারত কোনো কারণে হেরে গেলে তা লজ্জাজনক হবে। তাই আগেভাগেই আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটি মিটিয়ে ফেলতে চায় ভারত। ভারতের এই আগ্রহের নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ আছে কি না তাও খতিয়ে দেখতে হবে।
তবে এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি আবারও পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছেন। ভারতীয় হাই কমিশনারের প্রস্তাব পাওয়ার পর তিনি আবেগে গদ গদ না হয়ে অত্যন্ত যুক্তিনির্ভর বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আলোচনা চলতে পারে, তবে মামলা প্রত্যাহার করে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। আমরাও তা মনে করি। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চলতে পারে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিতে হবে।
ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা ইস্যুতে রায় হবে ২০১৪ সালে। এর আগে উভয় পক্ষের বক্তব্য উপস্থাপন করতে হবে। নিশ্চয়ই বাংলাদেশ সেই প্রস্তুতিও নিচ্ছে। তবে আমাদের বিশ্বাস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের সঙ্গে যে বিজয় লাভ করেছে, ভারতের কাছ থেকেও অনুরূপ বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হবে। আর এতে সফল হলে বাংলাদেশের আয়তন আরো অনেক বাড়বে। এ কাজে বিরোধী দলের সহযোগিতা থাকা উচিত বলে মনে করি।
তার পরও গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই : অবশেষে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সংসদ অধিবেশনে যোগদান করেছে। প্রথম দিনই কয়েকজন সংসদ সদস্যের অশালীন বক্তব্যে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে অধিবেশন কক্ষ। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সুশিক্ষিত সংসদ সদস্যরা মারমুখী হয়ে ওঠেন। তার পরও উভয় দলের সদস্যদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে সংসদ অধিবেশন। রাজনীতিতে এক ধরনের স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করে। বিরোধী দলের সদস্যরা সংসদ বর্জন না করলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে অনিশ্চয়তা রয়েছে তাও দ্রুতই কেটে যাবে বলে আমরা আশা করছি। আমরা চাই না, কোনো রাজনৈতিক দলের হটকারী সিদ্ধান্তের কারণে আবার দেশের শাসন ক্ষমতায় 'তৃতীয় শক্তি' জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসুক। গণতন্ত্র আবার বিপন্ন হোক।
সংসদে অশালীন বক্তব্য, ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড বহুকাল আগে থেকেই চলে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে যা ঘটেছে তা নতুন কিছু নয়। আগেও হাতাহাতি, চেয়ার ছোড়াছুড়ি, অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেছেন আমাদের সম্মানিত সংসদ সদস্যরা। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এর অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে। বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের লোকসভায়, জাপানের পার্লামেন্ট অধিবেশনে সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মধ্যে মারামারি, রক্তারক্তি পর্যন্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়ার মতো গণতান্ত্রিক দেশেও অসংসদীয় ঘটনা অহরহই ঘটছে। তাই বলে আমাদের সুশিক্ষিত সংসদ সদস্যরা অশালীন বক্তব্য দিয়েই যাবেন আর তা আমরা সমর্থন করে যাব। আমরা যেকোনো মূল্যে সংসদকে কার্যকর দেখতে চাই। সংসদ সব সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠুক, সেই প্রত্যাশাই আমরা করছি।
উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংকট যে নেই তা নয়। সেসব সমস্যা নিয়ে তারা রাজনীতির মাঠ গরম করে না। সংসদে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। তারা দিনের পর দিন সংসদ বয়কট করছে না, সংসদকে অকার্যকর করছে না। প্রকৃত অর্থেই সংসদকে সব সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দু মনে করে। এ কারণেই ওই সব দেশে গণতন্ত্র শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।
আমাদের দেশের সংসদ সদস্যরা সদস্যপদ টিকিয়ে রাখা এবং বেতন-ভাতাদি নিশ্চিত করার জন্য সংসদে যান। ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া, শুল্কমুক্ত সুবিধায় দামি গাড়ি আমদানি, উপজেলায় নিজেদের কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা একাট্টা। কিন্তু দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারা পুরোপুরি দ্বিধাবিভক্ত। আমাদের সংসদ সদস্যদের অবস্থাটা এমন যে দেশের গণতন্ত্র গোল্লায় যাক তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু নিজেদের স্বার্থ ঠিক থাকতে হবে। আবার তারা গণতন্ত্র চান, যদি নিজেরা ক্ষমতায় থাকেন। এ কারণেই দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো মজবুত হতে পারছে না। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতার কারণে গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খাচ্ছে।
অতীতে দেখা গেছে, নির্বাচনের পরপরই পরাজিত দল কারচুপির অভিযোগ তুলে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিজয়ী হলে নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ, আর পরাজিত হলে কারচুপির অভিযোগ করেই শুরু হয় সরকারবিরোধী আন্দোলন। 'এক মুহূর্তও সময় দেওয়া হবে না', কিংবা 'সরকারকে টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামানো হবে'_এমন বক্তব্য নেতা-নেত্রীদের মুখ থেকে আমরা অনেক শুনেছি। এখন পর্যন্ত কোনো পরাজিত দলই নিজেদের পরাজয় মেনে নেয়নি এবং বিজয়ী দলকে অভিনন্দন জানায়নি। সরকারকে সহযোগিতা করার রেওয়াজ তো শুরুই হয়নি।
আমাদের রাজনীতিকদেরও গণতন্ত্রের সেই রীতি-রেওয়াজ রপ্ত করতে হবে। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রই হচ্ছে সহনশীলতা ও পরমতসহিষ্ণুতা। অথচ আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে এর বড় অভাব। তারা মুখে বেশি বেশি গণতন্ত্রের বুলি আওড়ান, আর ভেতরে ভেতরে স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা পোষণ করেন। যাঁরা সরকারে যান তাঁরা বিরোধী পক্ষের সমালোচনা সহ্যই করতে পারেন না। সমালোচকের টুঁটি চেপে ধরার প্রবণতা খুব বেশি দেখা যায়। এই প্রবণতা থেকেই বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হয় না। তাদের ওপর হামলা আর মামলায় জড়িয়ে ঘায়েল করা হয়। গণতন্ত্রের লেবাসে স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ আমরা আর দেখতে চাই না।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.