গ্যাস অংশীদারি চুক্তি-আমরা পারব না’—এই হীনম্মন্যতাই বড় বাধা by আনু মুহাম্মদ
১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সময়কালে দেশের গ্যাস-সংকট জিইয়ে রেখে মার্কিন কোম্পানির মালিকানায় ভারতে গ্যাস রপ্তানির পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা ছিল। কতিপয় মন্ত্রী, আমলা ও কনসালট্যান্ট সব ভুতুড়ে তথ্য দিয়ে দেশবাসীকে বোকা বানাতে দিনকে রাত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে’, ‘গ্যাস রপ্তানি করলে উন্নয়নের জোয়ারে দেশ
ভেসে যাবে’ ইত্যাদি। মার্কিন-ভারত দূতাবাস, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বহু সংস্থা এই প্রচারণায় তখন শামিল হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন ও দায়িত্বশীল বিশেষজ্ঞদের দৃঢ় মোকাবিলা এবং জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে লংমার্চসহ ধারাবাহিক আন্দোলনের কারণে প্রতিদিন ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস রপ্তানির এই অপচেষ্টা ভণ্ডুল হয়ে যায়। তারা এই কাজে সক্ষম হলে দেশে গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংকট কী ভয়ংকর চেহারা নিত, তা চিন্তা করাও ভীতিকর। সে সময় যাঁরা ভুতুড়ে তথ্য দিয়ে দেশের সর্বনাশ করতে উদ্যত হয়েছিলেন, তাঁদের কোনো শাস্তি হয়নি। বরং পরে অনেকে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন। তাঁদেরই অনেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রপ্তানিমুখী উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি-২০০৮) প্রণয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ২০০৮ থেকেই এই পিএসসির অসংগতি, জাতীয় স্বার্থবিরোধী ধারা এবং এর বিপদ সম্পর্কে দেশের শীর্ষস্থানীয় জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করেছেন। জাতীয় কমিটি শুরু থেকেই যুক্তি, তথ্য, বিশ্লেষণসহ এর প্রতিবাদ করে এসেছে।
কিন্তু এসব তথ্য, যুক্তি, বিশ্লেষণ অগ্রাহ্য করে এই পিএসসি-২০০৮-এর কাঠামোতেই বাংলাদেশ সরকার ১৬ জুন বঙ্গোপসাগরের দুটো ব্লকের (১০ ও ১১) গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য কনোকোফিলিপস নামের একটি মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেছে। চুক্তির কারণে (১) ১৫.৫.৪ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ যদি সমুদ্রের ১৭৫ মাইল দূরের গ্যাসক্ষেত্র পর্যন্ত প্রয়োজনীয় পরিবহনব্যবস্থা (পাইপলাইন) স্থাপন করে, তাহলে পেট্রোবাংলা তার অংশের প্রফিট গ্যাস রাখার অধিকারপ্রাপ্ত হবে। তবে তা কোনোমতেই মোট প্রাপ্ত গ্যাসের ২০ শতাংশের বেশি নয়। অর্থাৎ ৮০ শতাংশের মালিকানা কস্ট রিকভারি ও প্রফিট শেয়ারিং নানা কূটচালের মাধ্যমে কনোকোফিলিপসের হাতেই থাকবে, এটা নিশ্চিত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, যে পাইপলাইন তৈরি করে বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য গ্যাস আনতে হবে, তার খরচ (৩৫০ মিলিয়ন ডলার) কনোকোফিলিপসের প্রাথমিক বিনিয়োগের (১১০ মিলিয়ন ডলার) তিন গুণেরও বেশি। (২) ১৫.৫.১, ১৫.৫.৪, ১৫.৫.৫, ১৫.৬ ধারায় বর্ণিত শর্ত সাপেক্ষে কনোকোফিলিপস ১৫.৫.২ ধারায় বর্ণিত হিসাব অনুসারে চুক্তিকৃত এলাকায় উৎপাদিত বাংলাদেশের অংশসহ যেকোনো পরিমাণ ‘মার্কেটেবল গ্যাস’ এলএনজি (তরলায়িত) করে রপ্তানির অধিকার পাবে। (৩) কনোকোফিলিপস বাংলাদেশকে গ্যাস কেনার আহ্বান জানাবে ঠিক, কিন্তু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নূরুল ইসলাম তাঁর এক লেখায় (‘পিএসসিতে ৮০ শতাংশ গ্যাস রপ্তানির সুযোগ দেশের স্বার্থবিরোধী’, প্রথম আলো, ৭ জুলাই ২০০৯) সব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, যে দামে কনোকোফিলিপস গ্যাস রপ্তানি করতে পারবে, তা বাংলাদেশে তাদের গ্যাস বিক্রির দামের কমপক্ষে প্রায় তিন গুণ হবে। এ অবস্থায় গ্যাস রপ্তানির এ ধরনের লাভজনক প্রস্তাব অনুমোদনে তারা যা করা দরকার তাই করবে। (৪) কেয়ার্ন এনার্জি দেখিয়েছে, কীভাবে অবাধে খরচ ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি দেখিয়ে গ্যাসের পুরো মালিকানা নিয়ে নিতে হয়। সানটোস ও শেভরনের সাম্প্রতিক তৎপরতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাদের কাছ থেকে আমাদের গ্যাসের ক্রয়মূল্য বাড়ছে, সামনে আরও বাড়বে। সুতরাং গভীর সমুদ্র থেকে কনোকোফিলিপস আমাদের গ্যাস সেই দামেই বিক্রি করতে রাজি হবে, যার খরচ আমদানিমূল্য থেকেও বেশি হবে। তখন ‘উন্নয়ন সহযোগী’ আর কনসালট্যান্টরা রপ্তানির পক্ষেই প্রচারণায় লিপ্ত হবেন। (৫) রপ্তানির চাপ তৈরি হবে আরও এই কারণে যে, ১৫.৪ ধারা অনুযায়ী সাধারণভাবে অনুমোদিত সীমার (প্রমাণিত মজুদের ৭.৫ শতাংশ) অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলনে কোম্পানিকে অধিকার দেওয়া আছে। অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করলে এই পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব যে, বাংলাদেশ এটা কিনতে পারবে না, অতএব রপ্তানিই যৌক্তিক হয়ে দাঁড়াবে।
১৯৯৩-৯৪ সাল থেকে বাংলাদেশের জাতীয় সংস্থাকে ক্রমান্বয়ে প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে একের পর এক বিদেশি কোম্পানির হাতে স্থলভাগের সমৃদ্ধ ব্লকগুলো তুলে দেওয়া হয়। এর পেছনে যে দুটো যুক্তি প্রধান ছিল, সেগুলো কনোকোফিলিপসের সঙ্গে সাম্প্রতিক চুক্তির পেছনেও আমরা শুনতে পাই। এগুলো হলো: ১. পুঁজির অভাব এবং ২. দক্ষতা ও প্রযুক্তির অভাব। কিন্তু গত দুই দশকের তথ্য বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির কারণে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে ৩০ গুণ বেশি দামে বৈদেশিক মুদ্রায় আমাদের নিজেদেরই গ্যাস কিনতে হয়েছে। এর ফলে যত টাকার অভাব বলে বিদেশি কোম্পানির হাতে গ্যাসসম্পদ তুলে দেওয়া হলো, তার প্রায় দশ গুণ বেশি, প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা এখন ভর্তুকি দিতে হয় প্রতিবছর।
দ্বিতীয়ত, দক্ষতার কথা বলে আনা হলেও মার্কিন ও কানাডীয় কোম্পানির হাতেই মাগুরছড়া ও টেংরাটিলায় দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে ধ্বংস হয়েছে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এর আন্তর্জাতিক বাজারদর এখন প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সরকারের পর সরকার গেছে। কেউ এই ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। এই অভিজ্ঞতার মুখেই আমরা কনোকোফিলিপস সম্পর্কে ভীতিকর তথ্য পাচ্ছি। কনোকো ও ফিলিপস এক হওয়ার আগেও তাদের দুর্ঘটনার রেকর্ড ছিল। পরেও তা অব্যাহত আছে। ২০০৪ ও ২০০৬ সালের পর ২০০৮ সালে তারা দুটি বড় দুর্ঘটনা ঘটায়। সর্বশেষটি আলাস্কায়, এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ব্লোআউট। এ রকম একটি কোম্পানির হাতে বঙ্গোপসাগরের দুটি গ্যাসব্লক তুলে দেওয়ায় ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়ল শুধু ওই দুটি ব্লক নয়, বঙ্গোপসাগরের বিশাল সম্পদ ও প্রাণবৈচিত্র্যও।
অনেকে বলছেন, এর বিকল্প কী ছিল? ভারত-মিয়ানমার তাদের অংশে অনুসন্ধান শুরু করেছে, আমরা না করলে তো বিপদ। বাস্তবে যা ঘটল, এই চুক্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে ভারত ও মিয়ানমারের দাবি মেনে নেওয়া হলো আর বাংলাদেশের অংশ তুলে দেওয়া হলো মার্কিন কোম্পানির হাতে। অনেকে বলছেন, আমাদের তো ক্ষমতা নেই, প্রযুক্তি নেই, পুঁজি নেই। এই প্রচারণাও হীনম্মন্যতা, দখলদারি বিস্তারের প্রধান অবলম্বন। আগেই দেখিয়েছি, প্রাপ্তির তুলনায় পুঁজির পরিমাণ নগণ্য। প্রযুক্তি বা দক্ষ জনশক্তির অভাব পূরণে সাবকন্ট্রাক্ট দেওয়া বা প্রবাসী বা বিদেশি বিশেষজ্ঞ কাজে লাগানোয় কোনো অসুবিধা নেই। বাংলাদেশ তার মালিকানায় জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বেই যদি এই কাজ শুরু করত, তাহলে প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হতো। এই গ্যাস নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির নতুন জীবন দান করত, দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কম থাকত, জ্বালানি ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো, সর্বোপরি হীনম্মন্যতা থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ তার প্রতিষ্ঠান ও দক্ষ জনশক্তির ভিত্তি নির্মাণ করতে পারত।
বাংলাদেশে বিদ্যমান গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংকট, বাসভাড়াসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান হারে গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বৃদ্ধি, শিল্প খাতে সংকট, কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, খনিজ সম্পদ ঘিরে দেশি-বিদেশি মাফিয়া গোষ্ঠীর তৎপরতা বৃদ্ধির পেছনে বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি এবং আরও দখলি স্বত্ব প্রতিষ্ঠার অপতৎপরতাই দায়ী। সরকার পরিবর্তন হয়, কিন্তু জাতীয় স্বার্থবিরোধী নীতি ও চুক্তির ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো অনৈক্য দেখা যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, রাশিয়াসহ দেশি-বিদেশি লুটেরাগোষ্ঠী বাংলাদেশকে ভাগবণ্টন করে নেবে আর দেশের মানুষ দারিদ্র্য এবং গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে বিপর্যস্ত হবে—এটা আমরা মেনে নিতে পারি না।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
কিন্তু এসব তথ্য, যুক্তি, বিশ্লেষণ অগ্রাহ্য করে এই পিএসসি-২০০৮-এর কাঠামোতেই বাংলাদেশ সরকার ১৬ জুন বঙ্গোপসাগরের দুটো ব্লকের (১০ ও ১১) গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য কনোকোফিলিপস নামের একটি মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেছে। চুক্তির কারণে (১) ১৫.৫.৪ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ যদি সমুদ্রের ১৭৫ মাইল দূরের গ্যাসক্ষেত্র পর্যন্ত প্রয়োজনীয় পরিবহনব্যবস্থা (পাইপলাইন) স্থাপন করে, তাহলে পেট্রোবাংলা তার অংশের প্রফিট গ্যাস রাখার অধিকারপ্রাপ্ত হবে। তবে তা কোনোমতেই মোট প্রাপ্ত গ্যাসের ২০ শতাংশের বেশি নয়। অর্থাৎ ৮০ শতাংশের মালিকানা কস্ট রিকভারি ও প্রফিট শেয়ারিং নানা কূটচালের মাধ্যমে কনোকোফিলিপসের হাতেই থাকবে, এটা নিশ্চিত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, যে পাইপলাইন তৈরি করে বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য গ্যাস আনতে হবে, তার খরচ (৩৫০ মিলিয়ন ডলার) কনোকোফিলিপসের প্রাথমিক বিনিয়োগের (১১০ মিলিয়ন ডলার) তিন গুণেরও বেশি। (২) ১৫.৫.১, ১৫.৫.৪, ১৫.৫.৫, ১৫.৬ ধারায় বর্ণিত শর্ত সাপেক্ষে কনোকোফিলিপস ১৫.৫.২ ধারায় বর্ণিত হিসাব অনুসারে চুক্তিকৃত এলাকায় উৎপাদিত বাংলাদেশের অংশসহ যেকোনো পরিমাণ ‘মার্কেটেবল গ্যাস’ এলএনজি (তরলায়িত) করে রপ্তানির অধিকার পাবে। (৩) কনোকোফিলিপস বাংলাদেশকে গ্যাস কেনার আহ্বান জানাবে ঠিক, কিন্তু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নূরুল ইসলাম তাঁর এক লেখায় (‘পিএসসিতে ৮০ শতাংশ গ্যাস রপ্তানির সুযোগ দেশের স্বার্থবিরোধী’, প্রথম আলো, ৭ জুলাই ২০০৯) সব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, যে দামে কনোকোফিলিপস গ্যাস রপ্তানি করতে পারবে, তা বাংলাদেশে তাদের গ্যাস বিক্রির দামের কমপক্ষে প্রায় তিন গুণ হবে। এ অবস্থায় গ্যাস রপ্তানির এ ধরনের লাভজনক প্রস্তাব অনুমোদনে তারা যা করা দরকার তাই করবে। (৪) কেয়ার্ন এনার্জি দেখিয়েছে, কীভাবে অবাধে খরচ ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি দেখিয়ে গ্যাসের পুরো মালিকানা নিয়ে নিতে হয়। সানটোস ও শেভরনের সাম্প্রতিক তৎপরতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাদের কাছ থেকে আমাদের গ্যাসের ক্রয়মূল্য বাড়ছে, সামনে আরও বাড়বে। সুতরাং গভীর সমুদ্র থেকে কনোকোফিলিপস আমাদের গ্যাস সেই দামেই বিক্রি করতে রাজি হবে, যার খরচ আমদানিমূল্য থেকেও বেশি হবে। তখন ‘উন্নয়ন সহযোগী’ আর কনসালট্যান্টরা রপ্তানির পক্ষেই প্রচারণায় লিপ্ত হবেন। (৫) রপ্তানির চাপ তৈরি হবে আরও এই কারণে যে, ১৫.৪ ধারা অনুযায়ী সাধারণভাবে অনুমোদিত সীমার (প্রমাণিত মজুদের ৭.৫ শতাংশ) অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলনে কোম্পানিকে অধিকার দেওয়া আছে। অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করলে এই পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব যে, বাংলাদেশ এটা কিনতে পারবে না, অতএব রপ্তানিই যৌক্তিক হয়ে দাঁড়াবে।
১৯৯৩-৯৪ সাল থেকে বাংলাদেশের জাতীয় সংস্থাকে ক্রমান্বয়ে প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে একের পর এক বিদেশি কোম্পানির হাতে স্থলভাগের সমৃদ্ধ ব্লকগুলো তুলে দেওয়া হয়। এর পেছনে যে দুটো যুক্তি প্রধান ছিল, সেগুলো কনোকোফিলিপসের সঙ্গে সাম্প্রতিক চুক্তির পেছনেও আমরা শুনতে পাই। এগুলো হলো: ১. পুঁজির অভাব এবং ২. দক্ষতা ও প্রযুক্তির অভাব। কিন্তু গত দুই দশকের তথ্য বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির কারণে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে ৩০ গুণ বেশি দামে বৈদেশিক মুদ্রায় আমাদের নিজেদেরই গ্যাস কিনতে হয়েছে। এর ফলে যত টাকার অভাব বলে বিদেশি কোম্পানির হাতে গ্যাসসম্পদ তুলে দেওয়া হলো, তার প্রায় দশ গুণ বেশি, প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা এখন ভর্তুকি দিতে হয় প্রতিবছর।
দ্বিতীয়ত, দক্ষতার কথা বলে আনা হলেও মার্কিন ও কানাডীয় কোম্পানির হাতেই মাগুরছড়া ও টেংরাটিলায় দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে ধ্বংস হয়েছে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এর আন্তর্জাতিক বাজারদর এখন প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সরকারের পর সরকার গেছে। কেউ এই ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। এই অভিজ্ঞতার মুখেই আমরা কনোকোফিলিপস সম্পর্কে ভীতিকর তথ্য পাচ্ছি। কনোকো ও ফিলিপস এক হওয়ার আগেও তাদের দুর্ঘটনার রেকর্ড ছিল। পরেও তা অব্যাহত আছে। ২০০৪ ও ২০০৬ সালের পর ২০০৮ সালে তারা দুটি বড় দুর্ঘটনা ঘটায়। সর্বশেষটি আলাস্কায়, এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ব্লোআউট। এ রকম একটি কোম্পানির হাতে বঙ্গোপসাগরের দুটি গ্যাসব্লক তুলে দেওয়ায় ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়ল শুধু ওই দুটি ব্লক নয়, বঙ্গোপসাগরের বিশাল সম্পদ ও প্রাণবৈচিত্র্যও।
অনেকে বলছেন, এর বিকল্প কী ছিল? ভারত-মিয়ানমার তাদের অংশে অনুসন্ধান শুরু করেছে, আমরা না করলে তো বিপদ। বাস্তবে যা ঘটল, এই চুক্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে ভারত ও মিয়ানমারের দাবি মেনে নেওয়া হলো আর বাংলাদেশের অংশ তুলে দেওয়া হলো মার্কিন কোম্পানির হাতে। অনেকে বলছেন, আমাদের তো ক্ষমতা নেই, প্রযুক্তি নেই, পুঁজি নেই। এই প্রচারণাও হীনম্মন্যতা, দখলদারি বিস্তারের প্রধান অবলম্বন। আগেই দেখিয়েছি, প্রাপ্তির তুলনায় পুঁজির পরিমাণ নগণ্য। প্রযুক্তি বা দক্ষ জনশক্তির অভাব পূরণে সাবকন্ট্রাক্ট দেওয়া বা প্রবাসী বা বিদেশি বিশেষজ্ঞ কাজে লাগানোয় কোনো অসুবিধা নেই। বাংলাদেশ তার মালিকানায় জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বেই যদি এই কাজ শুরু করত, তাহলে প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হতো। এই গ্যাস নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির নতুন জীবন দান করত, দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কম থাকত, জ্বালানি ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো, সর্বোপরি হীনম্মন্যতা থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ তার প্রতিষ্ঠান ও দক্ষ জনশক্তির ভিত্তি নির্মাণ করতে পারত।
বাংলাদেশে বিদ্যমান গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংকট, বাসভাড়াসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান হারে গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বৃদ্ধি, শিল্প খাতে সংকট, কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, খনিজ সম্পদ ঘিরে দেশি-বিদেশি মাফিয়া গোষ্ঠীর তৎপরতা বৃদ্ধির পেছনে বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি এবং আরও দখলি স্বত্ব প্রতিষ্ঠার অপতৎপরতাই দায়ী। সরকার পরিবর্তন হয়, কিন্তু জাতীয় স্বার্থবিরোধী নীতি ও চুক্তির ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো অনৈক্য দেখা যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, রাশিয়াসহ দেশি-বিদেশি লুটেরাগোষ্ঠী বাংলাদেশকে ভাগবণ্টন করে নেবে আর দেশের মানুষ দারিদ্র্য এবং গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে বিপর্যস্ত হবে—এটা আমরা মেনে নিতে পারি না।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments