প্রাকৃতিক সম্পদ-গ্যাস চুক্তিটি প্রকাশ করুন by বদরূল ইমাম
দেশের মূল্যবান গ্যাসসম্পদ নিয়ে ভাবেন ও জাতীয় স্বার্থে তা সুরক্ষা করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন—এমন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত অধ্যাপক সরকারি গ্যাসনীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারী দলের নেতৃত্ব দিতে নামলে পুলিশ লাঠির বাড়ি দিয়ে তাঁর পা ভেঙে ফেলে। সরকারি মহল নিজেদের এ বাড়াবাড়িমূলক কর্মে বিব্রত বোধ করে পরবর্তী সময়ে আহত
অধ্যাপককে সমবেদনা জানাতে হাসপাতালে প্রতিনিধি পাঠায়। সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে। সম্প্রতি সরকারের সঙ্গে মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপসের গভীর সাগরবক্ষে গ্যাস অনুসন্ধান চুক্তি স্বাক্ষরের প্রেক্ষাপটে আবার বিরোধীপক্ষ রাজপথ উত্তেজিত করার পরিকল্পনা করেছে। বিরোধীপক্ষ বলছে, এ চুক্তিতে বাংলাদেশের প্রাপ্য মাত্র ২০ শতাংশ গ্যাস, গ্যাস রপ্তানি অবধারিতও জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত। সরকারপক্ষ বলছে, চুক্তিতে বাংলাদেশের প্রাপ্য গ্যাস ৮০ শতাংশ পর্যন্ত, গ্যাস রপ্তানি হবে নাও জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত। দুই পক্ষের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে সাধারণ জনগণ বিভ্রান্ত। তাই প্রশ্ন, কনোকোফিলিপসের সঙ্গে চুক্তিপত্রে প্রকৃতপক্ষে কী লেখা হয়েছে?
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গ্যাসসংকট কাটিয়ে উঠতে সাগরবক্ষে অনুসন্ধান কার্যক্রম সম্প্রসারিত করার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রে কয়েক বছর ধরে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমার যে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে আসছে, তাতে তারা বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলও অন্তর্ভুক্ত করে। ভারত ও মিয়ানমারের আগ্রাসী গ্যাস অনুসন্ধান কর্মকাণ্ডকে রুখতে বাংলাদেশ তার কার্যক্রম শুরু করতে ইতিমধ্যে দেরি করে ফেলেছে। এ কার্যক্রমে যোগ্য বিদেশি তেল কোম্পানিকে নিয়োজিত করা একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত মনে করা যেতে পারে। অনেকে মনে করেন, বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম না চালিয়ে বরং দেশি কোম্পানিকে দিয়ে তা করানো যুক্তিযুক্ত। এটি অবশ্যই সঠিক, যেখানে অনুসন্ধানের ঝুঁকি নেই বা ঝুঁকি গ্রহণযোগ্যভাবে কম। কিন্তু সমুদ্রবক্ষে, বিশেষ করে গভীর সমুদ্র ভূতাত্ত্বিকভাবে অজ্ঞাত, তাই ঝুঁকি অনেক বেশি এবং অনুসন্ধানও বহুগুণে ব্যয়সাপেক্ষ। এখানে গ্যাস অনুসন্ধানে সরকারি অর্থ বিনিয়োগ সংগত নয়।
এ চিত্র কেবল বাংলাদেশের একার নয়, বিশ্বব্যাপী ধনী-দরিদ্র সব দেশই তার মূল্যবান তেল-গ্যাসসম্পদ আহরণে নিজস্ব জাতীয় কোম্পানি ছাড়াও বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোকে নিয়োগ করে থাকে। বিদেশি তেল কোম্পানিগুলো আর্থিক, কারিগরি দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনা কর্মকাণ্ডে বিপুলভাবে ক্ষমতাবান, রাজনৈতিক প্রভাব খাটাতে সুদক্ষ এবং ব্যবসায় নিজস্ব স্বার্থ রক্ষায় সুচতুর। প্রকৃতপক্ষে তেল কোম্পানিগুলো পুঁজিবাদী বিশ্বের কর্মকাণ্ডের সাক্ষাৎ ধ্বজাধরা বটে। তথাপি ভিয়েতনাম, চীন বা অন্য একাধিক কমিউনিস্ট দেশেও বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোকে তাদের নিজ নিজ দেশে ব্যাপকভাবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োগ করে থাকে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে সরকার প্রডাকশন শেয়ারিং কনট্রাক্ট বা পিএসসির আওতায় অনুসন্ধান চুক্তিগুলো করে থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশে এ ধরনের চুক্তি করতে যে মডেলটি প্রণীত হয়, তা মডেল পিএসসি-২০০৮ নামে পরিচিত এবং এটি দেশে আগেকার পিএসসি চুক্তির মডেলকে পরিমার্জন করে করা হয়েছে।
মডেল পিএসসি-২০০৮ নথিটি পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে দিয়ে রাখার ফলে যে কেউ এটি দেখতে, পড়তে বা কপি করতে পারেন। বিরোধীপক্ষ মডেল পিএসসির উপধারা ১৫.৫.১-এর সূত্র উল্লেখ করে বলছে, ‘উপধারা ১৫.৫.৪, ১৫.৫.৫ এবং ১৫.৬ সাপেক্ষে কোম্পানি পুরো প্রাকৃতিক গ্যাসকে তরলীকরণ করে এলএনজি হিসেবে রপ্তানি করতে পারবে।’ একই সঙ্গে উপধারা ১৫.৫.৪-এর সূত্রে তারা বলছে, ‘যে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাগরবক্ষের গ্যাসক্ষেত্র থেকে নিজস্ব গ্যাস পরিবহনব্যবস্থা (সাগরের তলে পাইপলাইন) তৈরি করে নিতে পারবে, সে ক্ষেত্রে সে তার গ্যাস-অংশ (খরচ উশুল গ্যাস ও লভ্যাংশ গ্যাস) নিতে পারবে, কিন্তু তার পরিমাণ কখনো ২০ শতাংশের বেশি হবে না।’
এদিকে সরকার বলছে, ১৫.৫.১ ধারায় রপ্তানি অনুমোদন লিখিত করে থাকলেও অন্য ধারায় তা প্রকৃতপক্ষে আটকে যাবে। কারণ, ১৫.৬ ধারা অনুযায়ী কোম্পানি বাংলাদেশের প্রাপ্য লভ্যাংশ গ্যাস ছাড়াও কোম্পানির গ্যাস-অংশ পুরোটাই প্রথমে বাংলাদেশের কাছে বিক্রির প্রস্তাব করতে বাধ্য থাকবে। বাংলাদেশ ছয় মাসের মধ্যে কোম্পানির গ্যাস-অংশ কিনে নিতে সম্মতি না জানালে কোম্পানি বাংলাদেশের ভেতর তৃতীয় পক্ষের কাছে তা বিক্রি করতে পারবে। তবে গ্যাস কিনতে পেট্রোবাংলার ‘প্রথম অসম্মতি’ সাপেক্ষেই কোম্পানি অন্যথায় তা বিক্রি করতে পারবে।
সরকারপক্ষ বলছে, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গ্যাসের চাহিদার প্রেক্ষাপটে বর্তমানে ও ভবিষ্যতে যেকোনো সময়ে দেশের নিজস্ব গ্যাস সরবরাহ চাহিদার তুলনায় কম থাকবে। তা ছাড়া অন্য জ্বালানি সম্পদের অভাব তো রয়েছেই। ভবিষ্যতে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে সরকার ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এলএনজি (তরলীকৃত গ্যাস) আমদানির উদ্যোগ নিচ্ছে। অধিকন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে গ্যাস আমদানি করার সুযোগ খুঁজছে, যদিও সম্প্রতি মিয়ানমার বাংলাদেশের কাছে তার গ্যাস বিক্রি করার প্রস্তাবে রাজি হয়নি এবং বিষয়টি ভবিষ্যতে বিবেচনার জন্য রেখেছে। এ অবস্থায় দেশের কোনো উৎস থেকে গ্যাস নেওয়ার সুযোগ হয়ে থাকলে তা গ্রহণ না করার প্রশ্নই ওঠে না। চুক্তি অনুযায়ী বিদেশি তেল কোম্পানি তার উৎপাদিত গ্যাস প্রথমে বাংলাদেশের কাছে সরবরাহের প্রস্তাব করবে এবং বাংলাদেশ তাতে রাজি হবে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং বিদেশি তেল কোম্পানির পক্ষে গ্যাস রপ্তানি করার কোনো সুযোগ হবে না।
প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে বাংলাদেশে গ্যাস উৎপাদনরত বিদেশি কোম্পানিগুলো একই প্রকার চুক্তির অধীনে কর্মরত আছে, যাতে এলএনজি করে গ্যাস রপ্তানি অনুমোদিত, তবে তা পেট্রোবাংলার গ্যাস কিনতে ‘প্রথম অসম্মতি’ সাপেক্ষে। কিন্তু বর্তমান গ্যাসসংকটের প্রেক্ষাপটে পেট্রোবাংলার পক্ষে বিদেশি কোম্পানির গ্যাস না কেনার কোনো অবকাশ নেই; বরং পেট্রোবাংলা বিদেশি কোম্পানিকে গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি করার সুপারিশ দিয়ে থাকে। আর ভবিষ্যতে যে এ চিত্রের পরিবর্তন ঘটবে না, তার সম্ভাবনাই বেশি।
বিরোধীপক্ষ ও সরকারপক্ষ উভয়েই মডেল পিএসসি-২০০৮-এর সূত্রে কথা বললে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আসছে কেন? মডেল পিএসসি-২০০৮-তে বিভ্রান্তিটা কোথায়? একজন সাধারণ পাঠক ওপরে উল্লিখিত ১৫.৫.৪ ধারার সঙ্গে ১৫.৬ ধারাটি মেলাতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন। ১৫.৫.৪ ধারা অনুযায়ী কোম্পানি যদি বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ গ্যাস কেবল বাংলাদেশের নিজস্ব নির্মিত পরিবহনব্যবস্থা সাপেক্ষে সরবরাহ করে, তবে ১৫.৬ ধারা অনুযায়ী উৎপাদিত সব গ্যাস (কোম্পানির গ্যাস-অংশসহ) পেট্রোবাংলার কাছে বিক্রির প্রস্তাবের বাধ্যবাধকতার অর্থ কী হতে পারে? সে ক্ষেত্রে গ্যাস পরিবহনের ব্যবস্থাপনার কী হবে? মডেল পিএসসি-২০০৮-এর অপর এক উপধারার সূত্রে সরকারপক্ষ বলছে, কোম্পানি গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করে দেবে, যার খরচ সে বাংলাদেশ থেকে খরচ উশুল গ্যাস হিসেবে তুলে নেবে। কিন্তু কথা হলো, যদি সরকার পাইপলাইন না বানায় তবে রপ্তানির লক্ষ্যে গ্যাসকে এলএনজি করার জন্য কোম্পানিকে গ্যাস ভূখণ্ডে নিয়ে আসতে হবে। তারা নিশ্চয়ই গভীর বিক্ষুব্ধ সাগরে ভাসমান এলএনজি উৎপাদন প্ল্যান্ট স্থাপন করবে না, এমন উদাহরণও কোথাও নেই। মডেল পিএসসিতে বিষয়গুলো খোলাসা করে উল্লেখ না থাকলেও কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিপত্রে তা থেকে থাকবে।
মডেল পিএসসিতে আরেকটি মূল বিষয় উল্লেখ নেই তা হলো, গ্যাস ভাগাভাগির হিসাবটি। আর এটিই বিরোধী ও সরকারপক্ষের দেওয়া বক্তব্যের অন্যতম অসম অংশ। বাংলাদেশ প্রকৃতই উৎপাদিত গ্যাসের কতটা নিজের অংশ হিসেবে পাবে ও কোম্পানি কতটা গ্যাস নেবে? এ নিয়ে বিরোধীদের বক্তব্য, বাংলাদেশ পাবে ২০ শতাংশ, কোম্পানি পাবে ৮০ শতাংশ। সরকারপক্ষ বলছে, তা নয়, বরং বাংলাদেশ পাবে ন্যূনতম ৫৫ শতাংশ আর উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা বেড়ে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ। মোট কথা, একদিকে বিরোধীপক্ষ, অন্যদিকে সরকারপক্ষ, মাঝখানে মডেল পিএসসি—এ তিনটি সূত্রের চাপে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। পত্রিকার পাতায় এপক্ষ-ওপক্ষের বক্তব্য জেনে ও শুনে এ বিভান্তি মিটবে না; বরং তা জট খাবে—সে আশঙ্কাই বেশি। তাই এ মুহূর্তে জনগণের সামনে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতে হলে চুক্তিপত্রটি প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ভূগর্ভে পাওয়া সমুদয় খনিজ তথা গ্যাসসম্পদের মালিক দেশের জনগণ। তাই এই গ্যাস কীভাবে ব্যবহূত হবে, তা জানা জনগণের মৌলিক অধিকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা জনগণের সামনে হাজির করেনি। সুতরাং বিদেশি তেল কোম্পানির সঙ্গে কী চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো, কোন ধারা দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে বা কোনটি তা বিঘ্নিত করতে পারে, এর বিবেচনার জন্য ব্যাখ্যা সরকারকেই উপস্থাপন করতে হবে। সরকার চুক্তিটি জনগণের জ্ঞাতার্থে সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে পারে। অন্যথায় অন্তত সংসদে খোলামেলা আলোচনার জন্য তা উপস্থাপন করতে পারে। এটি হবে জনগণের মধ্যে জন্মানো বিভ্রান্তি ও অসন্তোষ মেটানোর সর্বোত্তম পন্থা।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গ্যাসসংকট কাটিয়ে উঠতে সাগরবক্ষে অনুসন্ধান কার্যক্রম সম্প্রসারিত করার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রে কয়েক বছর ধরে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমার যে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে আসছে, তাতে তারা বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলও অন্তর্ভুক্ত করে। ভারত ও মিয়ানমারের আগ্রাসী গ্যাস অনুসন্ধান কর্মকাণ্ডকে রুখতে বাংলাদেশ তার কার্যক্রম শুরু করতে ইতিমধ্যে দেরি করে ফেলেছে। এ কার্যক্রমে যোগ্য বিদেশি তেল কোম্পানিকে নিয়োজিত করা একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত মনে করা যেতে পারে। অনেকে মনে করেন, বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম না চালিয়ে বরং দেশি কোম্পানিকে দিয়ে তা করানো যুক্তিযুক্ত। এটি অবশ্যই সঠিক, যেখানে অনুসন্ধানের ঝুঁকি নেই বা ঝুঁকি গ্রহণযোগ্যভাবে কম। কিন্তু সমুদ্রবক্ষে, বিশেষ করে গভীর সমুদ্র ভূতাত্ত্বিকভাবে অজ্ঞাত, তাই ঝুঁকি অনেক বেশি এবং অনুসন্ধানও বহুগুণে ব্যয়সাপেক্ষ। এখানে গ্যাস অনুসন্ধানে সরকারি অর্থ বিনিয়োগ সংগত নয়।
এ চিত্র কেবল বাংলাদেশের একার নয়, বিশ্বব্যাপী ধনী-দরিদ্র সব দেশই তার মূল্যবান তেল-গ্যাসসম্পদ আহরণে নিজস্ব জাতীয় কোম্পানি ছাড়াও বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোকে নিয়োগ করে থাকে। বিদেশি তেল কোম্পানিগুলো আর্থিক, কারিগরি দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনা কর্মকাণ্ডে বিপুলভাবে ক্ষমতাবান, রাজনৈতিক প্রভাব খাটাতে সুদক্ষ এবং ব্যবসায় নিজস্ব স্বার্থ রক্ষায় সুচতুর। প্রকৃতপক্ষে তেল কোম্পানিগুলো পুঁজিবাদী বিশ্বের কর্মকাণ্ডের সাক্ষাৎ ধ্বজাধরা বটে। তথাপি ভিয়েতনাম, চীন বা অন্য একাধিক কমিউনিস্ট দেশেও বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোকে তাদের নিজ নিজ দেশে ব্যাপকভাবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োগ করে থাকে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে সরকার প্রডাকশন শেয়ারিং কনট্রাক্ট বা পিএসসির আওতায় অনুসন্ধান চুক্তিগুলো করে থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশে এ ধরনের চুক্তি করতে যে মডেলটি প্রণীত হয়, তা মডেল পিএসসি-২০০৮ নামে পরিচিত এবং এটি দেশে আগেকার পিএসসি চুক্তির মডেলকে পরিমার্জন করে করা হয়েছে।
মডেল পিএসসি-২০০৮ নথিটি পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে দিয়ে রাখার ফলে যে কেউ এটি দেখতে, পড়তে বা কপি করতে পারেন। বিরোধীপক্ষ মডেল পিএসসির উপধারা ১৫.৫.১-এর সূত্র উল্লেখ করে বলছে, ‘উপধারা ১৫.৫.৪, ১৫.৫.৫ এবং ১৫.৬ সাপেক্ষে কোম্পানি পুরো প্রাকৃতিক গ্যাসকে তরলীকরণ করে এলএনজি হিসেবে রপ্তানি করতে পারবে।’ একই সঙ্গে উপধারা ১৫.৫.৪-এর সূত্রে তারা বলছে, ‘যে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাগরবক্ষের গ্যাসক্ষেত্র থেকে নিজস্ব গ্যাস পরিবহনব্যবস্থা (সাগরের তলে পাইপলাইন) তৈরি করে নিতে পারবে, সে ক্ষেত্রে সে তার গ্যাস-অংশ (খরচ উশুল গ্যাস ও লভ্যাংশ গ্যাস) নিতে পারবে, কিন্তু তার পরিমাণ কখনো ২০ শতাংশের বেশি হবে না।’
এদিকে সরকার বলছে, ১৫.৫.১ ধারায় রপ্তানি অনুমোদন লিখিত করে থাকলেও অন্য ধারায় তা প্রকৃতপক্ষে আটকে যাবে। কারণ, ১৫.৬ ধারা অনুযায়ী কোম্পানি বাংলাদেশের প্রাপ্য লভ্যাংশ গ্যাস ছাড়াও কোম্পানির গ্যাস-অংশ পুরোটাই প্রথমে বাংলাদেশের কাছে বিক্রির প্রস্তাব করতে বাধ্য থাকবে। বাংলাদেশ ছয় মাসের মধ্যে কোম্পানির গ্যাস-অংশ কিনে নিতে সম্মতি না জানালে কোম্পানি বাংলাদেশের ভেতর তৃতীয় পক্ষের কাছে তা বিক্রি করতে পারবে। তবে গ্যাস কিনতে পেট্রোবাংলার ‘প্রথম অসম্মতি’ সাপেক্ষেই কোম্পানি অন্যথায় তা বিক্রি করতে পারবে।
সরকারপক্ষ বলছে, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গ্যাসের চাহিদার প্রেক্ষাপটে বর্তমানে ও ভবিষ্যতে যেকোনো সময়ে দেশের নিজস্ব গ্যাস সরবরাহ চাহিদার তুলনায় কম থাকবে। তা ছাড়া অন্য জ্বালানি সম্পদের অভাব তো রয়েছেই। ভবিষ্যতে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে সরকার ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এলএনজি (তরলীকৃত গ্যাস) আমদানির উদ্যোগ নিচ্ছে। অধিকন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে গ্যাস আমদানি করার সুযোগ খুঁজছে, যদিও সম্প্রতি মিয়ানমার বাংলাদেশের কাছে তার গ্যাস বিক্রি করার প্রস্তাবে রাজি হয়নি এবং বিষয়টি ভবিষ্যতে বিবেচনার জন্য রেখেছে। এ অবস্থায় দেশের কোনো উৎস থেকে গ্যাস নেওয়ার সুযোগ হয়ে থাকলে তা গ্রহণ না করার প্রশ্নই ওঠে না। চুক্তি অনুযায়ী বিদেশি তেল কোম্পানি তার উৎপাদিত গ্যাস প্রথমে বাংলাদেশের কাছে সরবরাহের প্রস্তাব করবে এবং বাংলাদেশ তাতে রাজি হবে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং বিদেশি তেল কোম্পানির পক্ষে গ্যাস রপ্তানি করার কোনো সুযোগ হবে না।
প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে বাংলাদেশে গ্যাস উৎপাদনরত বিদেশি কোম্পানিগুলো একই প্রকার চুক্তির অধীনে কর্মরত আছে, যাতে এলএনজি করে গ্যাস রপ্তানি অনুমোদিত, তবে তা পেট্রোবাংলার গ্যাস কিনতে ‘প্রথম অসম্মতি’ সাপেক্ষে। কিন্তু বর্তমান গ্যাসসংকটের প্রেক্ষাপটে পেট্রোবাংলার পক্ষে বিদেশি কোম্পানির গ্যাস না কেনার কোনো অবকাশ নেই; বরং পেট্রোবাংলা বিদেশি কোম্পানিকে গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি করার সুপারিশ দিয়ে থাকে। আর ভবিষ্যতে যে এ চিত্রের পরিবর্তন ঘটবে না, তার সম্ভাবনাই বেশি।
বিরোধীপক্ষ ও সরকারপক্ষ উভয়েই মডেল পিএসসি-২০০৮-এর সূত্রে কথা বললে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আসছে কেন? মডেল পিএসসি-২০০৮-তে বিভ্রান্তিটা কোথায়? একজন সাধারণ পাঠক ওপরে উল্লিখিত ১৫.৫.৪ ধারার সঙ্গে ১৫.৬ ধারাটি মেলাতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন। ১৫.৫.৪ ধারা অনুযায়ী কোম্পানি যদি বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ গ্যাস কেবল বাংলাদেশের নিজস্ব নির্মিত পরিবহনব্যবস্থা সাপেক্ষে সরবরাহ করে, তবে ১৫.৬ ধারা অনুযায়ী উৎপাদিত সব গ্যাস (কোম্পানির গ্যাস-অংশসহ) পেট্রোবাংলার কাছে বিক্রির প্রস্তাবের বাধ্যবাধকতার অর্থ কী হতে পারে? সে ক্ষেত্রে গ্যাস পরিবহনের ব্যবস্থাপনার কী হবে? মডেল পিএসসি-২০০৮-এর অপর এক উপধারার সূত্রে সরকারপক্ষ বলছে, কোম্পানি গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করে দেবে, যার খরচ সে বাংলাদেশ থেকে খরচ উশুল গ্যাস হিসেবে তুলে নেবে। কিন্তু কথা হলো, যদি সরকার পাইপলাইন না বানায় তবে রপ্তানির লক্ষ্যে গ্যাসকে এলএনজি করার জন্য কোম্পানিকে গ্যাস ভূখণ্ডে নিয়ে আসতে হবে। তারা নিশ্চয়ই গভীর বিক্ষুব্ধ সাগরে ভাসমান এলএনজি উৎপাদন প্ল্যান্ট স্থাপন করবে না, এমন উদাহরণও কোথাও নেই। মডেল পিএসসিতে বিষয়গুলো খোলাসা করে উল্লেখ না থাকলেও কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিপত্রে তা থেকে থাকবে।
মডেল পিএসসিতে আরেকটি মূল বিষয় উল্লেখ নেই তা হলো, গ্যাস ভাগাভাগির হিসাবটি। আর এটিই বিরোধী ও সরকারপক্ষের দেওয়া বক্তব্যের অন্যতম অসম অংশ। বাংলাদেশ প্রকৃতই উৎপাদিত গ্যাসের কতটা নিজের অংশ হিসেবে পাবে ও কোম্পানি কতটা গ্যাস নেবে? এ নিয়ে বিরোধীদের বক্তব্য, বাংলাদেশ পাবে ২০ শতাংশ, কোম্পানি পাবে ৮০ শতাংশ। সরকারপক্ষ বলছে, তা নয়, বরং বাংলাদেশ পাবে ন্যূনতম ৫৫ শতাংশ আর উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা বেড়ে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ। মোট কথা, একদিকে বিরোধীপক্ষ, অন্যদিকে সরকারপক্ষ, মাঝখানে মডেল পিএসসি—এ তিনটি সূত্রের চাপে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। পত্রিকার পাতায় এপক্ষ-ওপক্ষের বক্তব্য জেনে ও শুনে এ বিভান্তি মিটবে না; বরং তা জট খাবে—সে আশঙ্কাই বেশি। তাই এ মুহূর্তে জনগণের সামনে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতে হলে চুক্তিপত্রটি প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ভূগর্ভে পাওয়া সমুদয় খনিজ তথা গ্যাসসম্পদের মালিক দেশের জনগণ। তাই এই গ্যাস কীভাবে ব্যবহূত হবে, তা জানা জনগণের মৌলিক অধিকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা জনগণের সামনে হাজির করেনি। সুতরাং বিদেশি তেল কোম্পানির সঙ্গে কী চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো, কোন ধারা দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে বা কোনটি তা বিঘ্নিত করতে পারে, এর বিবেচনার জন্য ব্যাখ্যা সরকারকেই উপস্থাপন করতে হবে। সরকার চুক্তিটি জনগণের জ্ঞাতার্থে সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে পারে। অন্যথায় অন্তত সংসদে খোলামেলা আলোচনার জন্য তা উপস্থাপন করতে পারে। এটি হবে জনগণের মধ্যে জন্মানো বিভ্রান্তি ও অসন্তোষ মেটানোর সর্বোত্তম পন্থা।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments