স্থানীয় সরকার-ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন: এরপর কী? by বদিউল আলম মজুমদার
গত এপ্রিল মাসে প্রথম পর্বের প্রায় ৬০০ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচন এখন চলছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মোট চার হাজার ৫০১টি ইউনিয়নের প্রায় সবগুলোরই নির্বাচন শেষ হবে। কিন্তু এরপর কী?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্য ও এর ভূমিকা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্য ও এর ভূমিকা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান মূলত চারটি ভূমিকা পালন করে থাকে। এগুলো হলো: ‘ডেমোক্রেটিক ডেফিসিট’ বা গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা দূর করা, সেবা প্রদান করা, অর্থনৈতিক উন্নয়নসম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।
উইনস্টন চার্চিল একবার বলেছিলেন, গণতন্ত্র হলো সবচেয়ে খারাপ ধরনের সরকারপদ্ধতি, আমরা অন্য যেসব পদ্ধতির চেষ্টা করেছিলাম সেগুলোর তুলনায়। প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র, যার চর্চা আমরা বর্তমানে করছি, এটি একটি আদর্শ ব্যবস্থা নয়। কারণ, এর অনেকগুলো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের অভাব, স্বচ্ছতা-জবাবদিহির চর্চার অভাব, সমাজের অবহেলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তির অভাব ইত্যাদি হলো এসব সীমাবদ্ধতার অংশ। একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা, সত্যিকারের ‘গ্রাসরুট ডেমোক্রেসি’ বা তৃণমূলের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এসব সমস্যার অনেকগুলোরই কার্যকর সমাধান করা যেতে পারে।
তৃণমূলের গণতন্ত্র, যাকে দরিদ্রদের গণতন্ত্র বলা যায়, গণতন্ত্রকে গভীরতা প্রদান করে। এর মাধ্যমেই গণতন্ত্রের সত্যিকারের ‘গণতন্ত্রায়ণ’ হতে পারে। আর এ কারণেই আমাদের সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে প্রশাসনের সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে একটি স্বশাসিত ও সমান্তরাল স্থানীয় সরকারব্যবস্থা কায়েম করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। তাই ইউনিয়ন পরিষদকে কার্যকর করার মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যা বিরাজমান প্রতিনিধিত্বশীল বিকল্প থেকে নিঃসন্দেহে উন্নততর। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার ছাড়া গণতন্ত্র পরিপূর্ণতা লাভ করে না।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, বিশেষত ইউনিয়ন পরিষদ জনগণের দোরগোড়ার সরকার। এর মাধ্যমে জনগণের অর্থবহ অংশগ্রহণ ছাড়া যেসব সেবা তাদের প্রাপ্য, তা তাদের কাছে কার্যকরভাবে পৌঁছানো যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের কাছে জনগণের কাঙ্ক্ষিত ও প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের মতো সম্পদ নেই। তাই সেবা প্রদানের ভূমিকাকে ফলপ্রসূ করতে হলে সরকারকে ইউনিয়ন পরিষদে অধিক অর্থ ও জনসম্পদ হস্তান্তর করতে হবে। বিশেষত হস্তান্তর করতে হবে গ্রামপর্যায়ে, যাঁরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ইত্যাদি সেবা প্রদান করেন সেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অর্থনৈতিক উন্নয়নসম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নও স্থানীয় সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু এ কাজটি করার জন্যও তাদের প্রয়োজনীয় সম্পদ নেই। তবে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা তৃণমূলের নেতা এবং তাঁরা তাঁদের অনুঘটকসুলভ নেতৃত্ব ব্যবহার করে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে যৌতুক, বাল্যবিবাহ ও নিরক্ষরতা দূরীকরণ; বিদ্যালয়ে গমন, পুষ্টিসচেতনতা সৃষ্টি, পরিবেশদূষণসহ অনেক সামাজিক সমস্যা অল্প কিংবা বিনা খরচেই সমাধান করতে পারেন। অর্থাৎ তাঁরা জন-অংশগ্রহণের মাধ্যমে উন্নয়নকে সত্যিকারের আন্দোলনে পরিণত করতে পারেন।
মনে রাখা প্রয়োজন, মানুষ যেসব সমস্যার সম্মুখীন, তার অধিকাংশই স্থানীয় এবং এগুলোর সমাধানও স্থানীয়। ‘সাবসিডিয়ারিটি’ তত্ত্ব অনুযায়ী, যেসব সমস্যা সর্বাধিক নিম্নস্তরের স্থানীয় সরকারের সহযোগিতায় সমাধান করা যায় না, সেগুলো তার ওপরের স্তরে, বাকিগুলো তারও ওপরের স্তরে, এরপর বাকিগুলো আরও ওপরের স্তরে সমাধান হওয়া আবশ্যক। এমন পদ্ধতিতে সেবা প্রদান ও উন্নয়ন কার্যক্রমে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তর হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই সত্যিকারের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ সৃষ্টি করতে হলে ক্ষমতা, দায়দায়িত্ব ও সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণের কোনো বিকল্প নেই, বিশেষত ইউনিয়ন পরিষদের কাছে। আরও বিকল্প নেই এসব প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করার।
স্বচ্ছতা-জবাবদিহির চর্চা, বিশেষত জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা সম্ভব তৃণমূল তথা ইউনিয়ন পর্যায় থেকেই। আর এর মাধ্যমেই সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ইউনিয়ন পরিষদের গুরুত্ব অপরিসীম।
নতুন ইউনিয়ন পরিষদ আইনে পরিষদের সেবা প্রদান, উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ভূমিকাকে কার্যকর করার লক্ষ্যে ওয়ার্ডসভার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বস্তুত জনগণের, বিশেষত বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সৃষ্ট ওয়ার্ডসভার বিধান একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ইনস্টিটিউশনাল ইনোভেশন’ বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ভাবন। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জারি করা ইউনিয়ন পরিষদ অধ্যাদেশে এটি প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাই নবনির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের একটি অন্যতম দায়িত্ব হওয়া উচিত ওয়ার্ডসভাকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করা।
প্রসঙ্গত, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তাভাবনা (আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৫) গ্রন্থে দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে এ ধরনের সভায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। তিনি স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে ‘উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এর কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার-কাঠামোর কর্মকাণ্ড আরও দক্ষভাবে পরিচালিত হবে যদি গ্রামপর্যায়ে সব গ্রামবাসীকে নিয়ে উন্মুক্ত গ্রাম-সভা প্রভৃতি নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে দরিদ্রদের কার্যকর অংশগ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়’ (পৃ. ২৩-২৪)।
উল্লেখ্য, মোটা দাগে ওয়ার্ডসভার তিনটি দায়িত্ব রয়েছে। প্রথমত, জনগণের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সামাজিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের ‘ক্যাম্পেইন’ বা প্রচারাভিযানের আয়োজন করা। দ্বিতীয়ত, হিসাব-নিকাশ বুঝিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে জনগণের কাছে স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় সব সরকারি প্রকল্পেরকতগুলো মানদণ্ড, যেমন—প্রতিবন্ধিতা, ভূমিহীনতা, বৈধব্য ইত্যাদির আলোকে উপকারভোগী নির্ধারণ করা।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন একটি অংশগ্রহণমূলক, দায়বদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তকরণমূলক গণতন্ত্রচর্চা এবং ব্যাপকভিত্তিক উন্নয়ন অর্জনের এক অপূর্ব সুযোগের সৃষ্টি করে দিয়েছে। প্রায় ৬০ হাজার তৃণমূলের নেতৃত্বকে, যাঁদের অধিকাংশই তরুণ ও উচ্চশিক্ষিত, এ গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত ও ক্ষমতায়িত করা যায়। এর জন্য অবশ্য প্রয়োজন হবে নীতিনির্ধারক ও অন্য স্বার্থসংশ্লিষ্টদের প্রথাগত চিন্তার বাইরে আসা এবং নির্বাচনের পরপরই জরুরি ভিত্তিতে একটি সৃজনশীল সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা।
প্রস্তাবিত সক্ষমতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমের লক্ষ্য হতে হবে দুটি—নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, একই সঙ্গে পুরো কমিউনিটির সচেতনতা ও যোগ্যতার স্তর উন্নয়ন। প্রায় অধিকাংশ নবনির্বাচিত প্রতিনিধিই রাজনৈতিক কর্মী এবং তাঁরা প্রথমবারের মতো নির্বাচিত। তাঁদের অধিকাংশেরই কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সামান্যতম অভিজ্ঞতাও নেই। তাই চ্যালেঞ্জ হবে তাঁদের, বিশেষত নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের নির্বাহী দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত করা, যাতে তাঁরা মৌলিক ব্যবস্থাপনা এবং হিসাব সংরক্ষণের নীতিমালা অনুসরণ করে তাঁদের ইউনিয়ন পরিষদগুলো পরিচালনা করতে পারেন। আর এ জন্য প্রয়োজন হবে তাঁদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ প্রদান ও নিয়মিত ফলোআপ। এর জন্য আরও প্রয়োজন হবে যথাযথ সফটওয়্যার তৈরি ও তা ব্যবহারের কারিগরি সহায়তা। প্রশিক্ষণের আরেকটি লক্ষ্য হতে হবে তাঁদের নেতৃত্বের বিকাশ, যাতে তাঁরা পরিবর্তনের রূপকার হতে পারেন। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাঁদের অবশ্যই বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধান সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা অর্জন করতে হবে।
প্রশিক্ষণে আধুনিক ‘স্ট্র্যাটেজিক প্লানিং’ বা কৌশলগত পরিকল্পনা-পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে নবনির্বাচিতরা তাঁদের এলাকার জনগণের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ফলপ্রসূতার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালনে সক্ষম হন। তাঁদের আগামী পাঁচ বছরের জন্য কৌশলগত লক্ষ্য নির্ধারণে এবং এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ একটি কৌশলগত লক্ষ্য হতে পারে ওয়ার্ডসভা কার্যকর করা। আরেকটি কৌশলগত লক্ষ্য হতে পারে ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য’ বা এমডিজিভিত্তিক একটি পাঁচসালা উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা, যার ভিত্তিতে সব ভবিষ্যৎ উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে। এ ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়নের ফলে মূল্যবান সম্পদের অপচয় রোধ হবে। অন্য আরেকটি কৌশলগত লক্ষ্য হতে পারে বার্ষিক ভিত্তিতে অংশগ্রহণমূলক বাজেট প্রণয়ন। কৌশলগত পরিকল্পনার একটি আকর্ষণীয় দিক হলো, এর মাধ্যমে পুরো কার্যক্রমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে।
কমিউনিটির সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্য হবে সেখানকার জনগণের, বিশেষত নারী ও অন্য সুবিধাবঞ্চিতদের সচেতনতা ও সক্ষমতার স্তর এমন পর্যায়ে নেওয়া, যাতে তারা ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রমে ফলপ্রসূভাবে অংশগ্রহণ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কার্যক্রমের জন্য দায়বদ্ধ করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, নারীরা পারিবারিক কল্যাণের অধিকাংশ দায়িত্ব পালন করেন, কিন্তু তাঁরা প্রয়োজনীয় তথ্য, সম্পদ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তাই তাঁরা যাতে এলাকার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন, সে লক্ষ্যে তাঁদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা আবশ্যক।
নারীসহ সমাজের সাধারণ জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে তাঁদের ক্ষমতায়িত করতে হবে এমন চেতনার ভিত্তিতে যে তাঁরা ‘নাগরিক’ এবং নাগরিক হিসেবে তাঁদের অনেক অধিকার রয়েছে, রয়েছে কিছু সুস্পষ্ট দায়িত্ব। এর জন্য আরও প্রয়োজন হবে এলাকায় কিছু সমাজসচেতন ব্যক্তিকে ক্ষমতায়িত করা, যাঁরা জনগণকে উজ্জীবিত ও সংগঠিত করতে পারবেন। আর ‘উজ্জীবকদের’ দ্বারা এ ধরনের সংগঠিতকরণের অন্যতম লক্ষ্য হবে পিছিয়ে পড়া জনগণের ওয়ার্ডসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের অন্যান্য কার্যক্রমে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে কমিউনিটির সক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ তার যথার্থ ভূমিকা রাখতে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের ইউনিয়নের জনগণের জীবনমানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারবেন না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ এবং সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
উইনস্টন চার্চিল একবার বলেছিলেন, গণতন্ত্র হলো সবচেয়ে খারাপ ধরনের সরকারপদ্ধতি, আমরা অন্য যেসব পদ্ধতির চেষ্টা করেছিলাম সেগুলোর তুলনায়। প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র, যার চর্চা আমরা বর্তমানে করছি, এটি একটি আদর্শ ব্যবস্থা নয়। কারণ, এর অনেকগুলো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের অভাব, স্বচ্ছতা-জবাবদিহির চর্চার অভাব, সমাজের অবহেলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তির অভাব ইত্যাদি হলো এসব সীমাবদ্ধতার অংশ। একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা, সত্যিকারের ‘গ্রাসরুট ডেমোক্রেসি’ বা তৃণমূলের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এসব সমস্যার অনেকগুলোরই কার্যকর সমাধান করা যেতে পারে।
তৃণমূলের গণতন্ত্র, যাকে দরিদ্রদের গণতন্ত্র বলা যায়, গণতন্ত্রকে গভীরতা প্রদান করে। এর মাধ্যমেই গণতন্ত্রের সত্যিকারের ‘গণতন্ত্রায়ণ’ হতে পারে। আর এ কারণেই আমাদের সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে প্রশাসনের সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে একটি স্বশাসিত ও সমান্তরাল স্থানীয় সরকারব্যবস্থা কায়েম করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। তাই ইউনিয়ন পরিষদকে কার্যকর করার মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যা বিরাজমান প্রতিনিধিত্বশীল বিকল্প থেকে নিঃসন্দেহে উন্নততর। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার ছাড়া গণতন্ত্র পরিপূর্ণতা লাভ করে না।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, বিশেষত ইউনিয়ন পরিষদ জনগণের দোরগোড়ার সরকার। এর মাধ্যমে জনগণের অর্থবহ অংশগ্রহণ ছাড়া যেসব সেবা তাদের প্রাপ্য, তা তাদের কাছে কার্যকরভাবে পৌঁছানো যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের কাছে জনগণের কাঙ্ক্ষিত ও প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের মতো সম্পদ নেই। তাই সেবা প্রদানের ভূমিকাকে ফলপ্রসূ করতে হলে সরকারকে ইউনিয়ন পরিষদে অধিক অর্থ ও জনসম্পদ হস্তান্তর করতে হবে। বিশেষত হস্তান্তর করতে হবে গ্রামপর্যায়ে, যাঁরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ইত্যাদি সেবা প্রদান করেন সেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অর্থনৈতিক উন্নয়নসম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নও স্থানীয় সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু এ কাজটি করার জন্যও তাদের প্রয়োজনীয় সম্পদ নেই। তবে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা তৃণমূলের নেতা এবং তাঁরা তাঁদের অনুঘটকসুলভ নেতৃত্ব ব্যবহার করে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে যৌতুক, বাল্যবিবাহ ও নিরক্ষরতা দূরীকরণ; বিদ্যালয়ে গমন, পুষ্টিসচেতনতা সৃষ্টি, পরিবেশদূষণসহ অনেক সামাজিক সমস্যা অল্প কিংবা বিনা খরচেই সমাধান করতে পারেন। অর্থাৎ তাঁরা জন-অংশগ্রহণের মাধ্যমে উন্নয়নকে সত্যিকারের আন্দোলনে পরিণত করতে পারেন।
মনে রাখা প্রয়োজন, মানুষ যেসব সমস্যার সম্মুখীন, তার অধিকাংশই স্থানীয় এবং এগুলোর সমাধানও স্থানীয়। ‘সাবসিডিয়ারিটি’ তত্ত্ব অনুযায়ী, যেসব সমস্যা সর্বাধিক নিম্নস্তরের স্থানীয় সরকারের সহযোগিতায় সমাধান করা যায় না, সেগুলো তার ওপরের স্তরে, বাকিগুলো তারও ওপরের স্তরে, এরপর বাকিগুলো আরও ওপরের স্তরে সমাধান হওয়া আবশ্যক। এমন পদ্ধতিতে সেবা প্রদান ও উন্নয়ন কার্যক্রমে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তর হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই সত্যিকারের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ সৃষ্টি করতে হলে ক্ষমতা, দায়দায়িত্ব ও সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণের কোনো বিকল্প নেই, বিশেষত ইউনিয়ন পরিষদের কাছে। আরও বিকল্প নেই এসব প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করার।
স্বচ্ছতা-জবাবদিহির চর্চা, বিশেষত জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা সম্ভব তৃণমূল তথা ইউনিয়ন পর্যায় থেকেই। আর এর মাধ্যমেই সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ইউনিয়ন পরিষদের গুরুত্ব অপরিসীম।
নতুন ইউনিয়ন পরিষদ আইনে পরিষদের সেবা প্রদান, উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ভূমিকাকে কার্যকর করার লক্ষ্যে ওয়ার্ডসভার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বস্তুত জনগণের, বিশেষত বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সৃষ্ট ওয়ার্ডসভার বিধান একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ইনস্টিটিউশনাল ইনোভেশন’ বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ভাবন। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জারি করা ইউনিয়ন পরিষদ অধ্যাদেশে এটি প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাই নবনির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের একটি অন্যতম দায়িত্ব হওয়া উচিত ওয়ার্ডসভাকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করা।
প্রসঙ্গত, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তাভাবনা (আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৫) গ্রন্থে দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে এ ধরনের সভায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। তিনি স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে ‘উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এর কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার-কাঠামোর কর্মকাণ্ড আরও দক্ষভাবে পরিচালিত হবে যদি গ্রামপর্যায়ে সব গ্রামবাসীকে নিয়ে উন্মুক্ত গ্রাম-সভা প্রভৃতি নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে দরিদ্রদের কার্যকর অংশগ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়’ (পৃ. ২৩-২৪)।
উল্লেখ্য, মোটা দাগে ওয়ার্ডসভার তিনটি দায়িত্ব রয়েছে। প্রথমত, জনগণের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সামাজিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের ‘ক্যাম্পেইন’ বা প্রচারাভিযানের আয়োজন করা। দ্বিতীয়ত, হিসাব-নিকাশ বুঝিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে জনগণের কাছে স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় সব সরকারি প্রকল্পেরকতগুলো মানদণ্ড, যেমন—প্রতিবন্ধিতা, ভূমিহীনতা, বৈধব্য ইত্যাদির আলোকে উপকারভোগী নির্ধারণ করা।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন একটি অংশগ্রহণমূলক, দায়বদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তকরণমূলক গণতন্ত্রচর্চা এবং ব্যাপকভিত্তিক উন্নয়ন অর্জনের এক অপূর্ব সুযোগের সৃষ্টি করে দিয়েছে। প্রায় ৬০ হাজার তৃণমূলের নেতৃত্বকে, যাঁদের অধিকাংশই তরুণ ও উচ্চশিক্ষিত, এ গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত ও ক্ষমতায়িত করা যায়। এর জন্য অবশ্য প্রয়োজন হবে নীতিনির্ধারক ও অন্য স্বার্থসংশ্লিষ্টদের প্রথাগত চিন্তার বাইরে আসা এবং নির্বাচনের পরপরই জরুরি ভিত্তিতে একটি সৃজনশীল সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা।
প্রস্তাবিত সক্ষমতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমের লক্ষ্য হতে হবে দুটি—নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, একই সঙ্গে পুরো কমিউনিটির সচেতনতা ও যোগ্যতার স্তর উন্নয়ন। প্রায় অধিকাংশ নবনির্বাচিত প্রতিনিধিই রাজনৈতিক কর্মী এবং তাঁরা প্রথমবারের মতো নির্বাচিত। তাঁদের অধিকাংশেরই কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সামান্যতম অভিজ্ঞতাও নেই। তাই চ্যালেঞ্জ হবে তাঁদের, বিশেষত নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের নির্বাহী দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত করা, যাতে তাঁরা মৌলিক ব্যবস্থাপনা এবং হিসাব সংরক্ষণের নীতিমালা অনুসরণ করে তাঁদের ইউনিয়ন পরিষদগুলো পরিচালনা করতে পারেন। আর এ জন্য প্রয়োজন হবে তাঁদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ প্রদান ও নিয়মিত ফলোআপ। এর জন্য আরও প্রয়োজন হবে যথাযথ সফটওয়্যার তৈরি ও তা ব্যবহারের কারিগরি সহায়তা। প্রশিক্ষণের আরেকটি লক্ষ্য হতে হবে তাঁদের নেতৃত্বের বিকাশ, যাতে তাঁরা পরিবর্তনের রূপকার হতে পারেন। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাঁদের অবশ্যই বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধান সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা অর্জন করতে হবে।
প্রশিক্ষণে আধুনিক ‘স্ট্র্যাটেজিক প্লানিং’ বা কৌশলগত পরিকল্পনা-পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে নবনির্বাচিতরা তাঁদের এলাকার জনগণের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ফলপ্রসূতার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালনে সক্ষম হন। তাঁদের আগামী পাঁচ বছরের জন্য কৌশলগত লক্ষ্য নির্ধারণে এবং এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ একটি কৌশলগত লক্ষ্য হতে পারে ওয়ার্ডসভা কার্যকর করা। আরেকটি কৌশলগত লক্ষ্য হতে পারে ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য’ বা এমডিজিভিত্তিক একটি পাঁচসালা উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা, যার ভিত্তিতে সব ভবিষ্যৎ উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে। এ ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়নের ফলে মূল্যবান সম্পদের অপচয় রোধ হবে। অন্য আরেকটি কৌশলগত লক্ষ্য হতে পারে বার্ষিক ভিত্তিতে অংশগ্রহণমূলক বাজেট প্রণয়ন। কৌশলগত পরিকল্পনার একটি আকর্ষণীয় দিক হলো, এর মাধ্যমে পুরো কার্যক্রমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে।
কমিউনিটির সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্য হবে সেখানকার জনগণের, বিশেষত নারী ও অন্য সুবিধাবঞ্চিতদের সচেতনতা ও সক্ষমতার স্তর এমন পর্যায়ে নেওয়া, যাতে তারা ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রমে ফলপ্রসূভাবে অংশগ্রহণ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কার্যক্রমের জন্য দায়বদ্ধ করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, নারীরা পারিবারিক কল্যাণের অধিকাংশ দায়িত্ব পালন করেন, কিন্তু তাঁরা প্রয়োজনীয় তথ্য, সম্পদ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তাই তাঁরা যাতে এলাকার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন, সে লক্ষ্যে তাঁদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা আবশ্যক।
নারীসহ সমাজের সাধারণ জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে তাঁদের ক্ষমতায়িত করতে হবে এমন চেতনার ভিত্তিতে যে তাঁরা ‘নাগরিক’ এবং নাগরিক হিসেবে তাঁদের অনেক অধিকার রয়েছে, রয়েছে কিছু সুস্পষ্ট দায়িত্ব। এর জন্য আরও প্রয়োজন হবে এলাকায় কিছু সমাজসচেতন ব্যক্তিকে ক্ষমতায়িত করা, যাঁরা জনগণকে উজ্জীবিত ও সংগঠিত করতে পারবেন। আর ‘উজ্জীবকদের’ দ্বারা এ ধরনের সংগঠিতকরণের অন্যতম লক্ষ্য হবে পিছিয়ে পড়া জনগণের ওয়ার্ডসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের অন্যান্য কার্যক্রমে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে কমিউনিটির সক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ তার যথার্থ ভূমিকা রাখতে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের ইউনিয়নের জনগণের জীবনমানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারবেন না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ এবং সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments