কালের পুরাণ-ভারতীয় সেনাপ্রধানের ‘বঙ্গদর্শন’ ও ‘কামান’ কূটনীতি by সোহরাব হাসান
ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল বিজয় কুমার সিংয়ের সফরটি কি গতানুগতিক ছিল, নাকি এর বাড়তি তাৎপর্য আছে? সফরের আগে বিএনপি মিলিটারি একাডেমিতে তাঁর মার্চিং প্যারেডে যোগদান ও অভিবাদন গ্রহণ নিয়ে খানিকটা উত্তাপ ছড়ানোর চেষ্টা করেও সুবিধা করতে পারেনি। দেশের প্রশিক্ষণার্থী সেনারা কুচকাওয়াজের সময় বিদেশি সেনা কর্মকর্তাকে অভিবাদন জানালে সার্বভৌমত্ব চলে যায়—এই ধারণা অমূলক।
বিজয় কুমার সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সঙ্গে একটি আবেগ জড়িত। ১৯৭১ সালে তিনি রাজপুত রেজিমেন্টে জুনিয়র অফিসার থাকাকালে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, নিজে লাকসাম, ফেনী, বিলোনিয়া ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশে আসার সময় ভারতীয় এই সেনাপ্রধান সেই আবেগের বিষয়টি ভুলে যাননি। তিনি উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহূত দুটি কামান। এখানে ভারতীয় সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদুল মুবীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এসব সাক্ষাতে কী আলোচনা হয়েছে, আমরা জানি না। তবে এটুকু জানি, কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরের আগে সেনাপ্রধানের এই সফর নিছক শুভেচ্ছামূলক নয়। মিলিটারি টু মিলিটারি সম্পর্কের বাইরে এর ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্যও আছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের কৌশলগত সম্পর্কের মোড় পরিবর্তন হয় ২০০৮ সালে দুই দেশের সেনাপ্রধানের সফর বিনিময়ের মাধ্যমে। সে সময়ে ভারতের সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল দীপক কাপুর এবং বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল মইন উ আহমেদ। তাঁদের এই সফর নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা হয়। বিশেষ করে, সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদকে ভারতীয় সেনাবাহিনী ছয়টি ঘোড়া উপহার দেওয়ায় গণমাধ্যম এটিকে ‘ঘোড়া কূটনীতি’ বলে অভিহিত করেছিল। এবার ভারতীয় সেনাপ্রধান দুটি কামান নিয়ে এসেছেন। একে কি আমরা ‘কামান কূটনীতি’ বলব?
সে সময়ে ভারতের নিরাপত্তা ও সামরিক বিশ্লেষক সুবাশ কমিলা লিখেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ার ভেতরে তুলনামূলক স্থিতিশীলতার দিক থেকে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ অধিকতর প্রতিশ্রুতিশীল। তাই, ভারতের নীতি প্রণয়ন কর্তৃপক্ষ, কূটনীতিক ও কৌশলগত বিষয়াদির বিশারদদের কৌশলগত ও রাজনৈতিক মনোযোগের জায়গাতে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে। বাংলাদেশ-ভারত কৌশলগত অংশীদারির লক্ষ্যে ভারতের কর্মকাণ্ড ও পদক্ষেপসমূহ বাংলাদেশকে তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, বাংলাদেশের ভেতরে সেই ধারণা যেন কোনোভাবেই না জন্মায়।
আমরাও মনে করি, সেটি ভারতের জন্য মারাত্মক ভুল হবে। ভারতকে বৈরী ভাবলে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা একই ভুল করবেন। প্রতিবেশী দুটি দেশের মধ্যে সমস্যা থাকবে এবং তার সমাধানও খুঁজে বের করতে হবে। ভারত বৃহৎ রাষ্ট্র হওয়ায় প্রতিবেশীদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা ও ভীতি থাকা অস্বাভাবিক নয়। সেই শঙ্কা কাটাতে ভারতকেই উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। ভারত যে ছোট প্রতিবেশীদের ওপর দাদাগিরি ফলাতে চায় না, সেটি শুধু কথায় নয়, কাজেও প্রমাণ দিতে হবে। আবার প্রতিবেশীদেরও সন্দেহের তীরটি সব সময় ভারতের দিকে তাক করে রাখা হীনম্মন্যতারই পরিচয়। প্রতিবেশী ভালো হোক মন্দ হোক, তাকে অস্বীকার করা যায় না।
২.
১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক অংশীদারের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক গড়ে উঠলেও সেই অংশীদারি সমানভাবে চলেনি। বেশির ভাগ সময়ই নানা কারণে টানাপোড়েন লেগে ছিল। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অপরিপক্ব কূটনীতির পাশাপাশি ভারতের অনুদারতাও কম দায়ী নয়।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, ভারতের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং কূটনীতিক মহল প্রতিবেশী বলতে পাকিস্তানকেই বোঝেন। সেখানে যুদ্ধ, বোমা, অন্তর্ঘাত সত্ত্বেও শান্তি আলোচনা থেমে থাকে না। কাশ্মীর ছাড়া পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে কোনো বিরোধ নেই, কিংবা পানিবণ্টনের সমস্যাটিও অনেক আগে তারা মিটিয়ে ফেলেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে সমস্যাগুলো ঝুলে আছে। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া না হয় ক্ষমতার স্বার্থে ভারতবিরোধী রাজনীতি করেছেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার সরকার নিরাপত্তার ব্যাপারে ভারতের যে উদ্বেগ ছিল, বলা যায়, তার পনেরো আনাই দূর করেছেন। যে জন্য ভারত সরকার এখন আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠক করতে পেরেছে। রাজনৈতিক ঝুঁকি সত্ত্বেও শেখ হাসিনা ভারতকে ট্রানজিট দিতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে প্রত্যাশিত প্রতিদান এখনো পাওয়া যায়নি। এ জন্য ভারতের আমলাতন্ত্র, না অন্য কেউ দায়ী, সেটি বাংলাদেশের দেখার কথা নয়। আন্তর্জাতিক কূটনীতির মূল কথা হলো ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে’। একতরফা সম্পর্ক হয় না।
গত মে মাসে নয়াদিল্লিতে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কূটনীতিকদের সঙ্গে আলাপ করে এই ধারণা হয়েছে যে ভারত চাইলে সীমান্ত সমস্যা কয়েক মাসেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে, কমানো যেতে পারে বাণিজ্য বৈষম্যও। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কোনো দেশ অন্য দেশে জোর করে বাজার সৃষ্টি করতে পারে না। বাংলাদেশের যেসব পণ্যের চাহিদা ভারতের বাজারে আছে, সেগুলোও নানা রকম আইনি জটিলতায় আটকে দেওয়া বন্ধুত্বের পরিচায়ক নয়। যেমন বন্ধুত্বের পরিচায়ক নয় অন্য দেশের হয়ে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় ও মদদ দেওয়া।
ভারত ও চীন—বৃহৎ দুই দেশের পাশে বাংলাদেশ অত্যন্ত ছোট। অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিতে দুর্বল। সে ক্ষেত্রে আমরা বৃহৎ শক্তিদ্বয়ের যুদ্ধের ক্ষেত্র হতে চাই না। আমরা চাই দুই দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক ভালো থাক। সমঅংশীদারির ভিত্তিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত নির্মিত হোক। প্রশ্ন হলো, সেটি করার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দক্ষতা নেতৃত্বের আছে কি না? কিংবা সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রনীতিরও পরিবর্তন ঘটবে কি না?
কয়েক দিন আগে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে আমরা ভারতবিরোধী নই এবং ভারতের সঙ্গে সমঅংশীদারির ভিত্তিতে সুসম্পর্ক চাই বলে যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা নয়াদিল্লির নীতিনির্ধারকদের আশ্বস্ত করতে না পারলেও দেশের অভ্যন্তরে ভারতবিরোধী বেলুনটি ফুটো করে দিয়েছে। একসময় আঙ্গরপোতা-দহগ্রামে লংমার্চ করা এবং ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী শফিউল আলম প্রধানও চুপচাপ।
কেউ কেউ দাবি করছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবে। এ তত্ত্ব এখন অচল। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ আসবে কেন? ভারতের সঙ্গে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া—দুই দেশেরই সুসম্পর্ক আছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মাত্রা নিশ্চয়ই বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের মাত্রা দিয়ে নির্ধারিত হওয়া উচিত নয়। ভারত ও চীন যদি সামরিক জান্তাশাসিত মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে পারে, বাংলাদেশ কেন একযোগে দুই দেশের সঙ্গে সদ্ভাব রাখতে পারবে না? আমাদের কেন ভারতের বন্ধুত্বের বিনিময়ে চীনকে কিংবা চীনের মৈত্রীর বিনিময়ে ভারতকে শত্রু করতে হবে?
গত নভেম্বরে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ আবদুল মুবীন ভারত সফর করেন। জেনারেল বিজয় কুমার ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান থাকতেই বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেন। সে সময় বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ সামরিক মহড়ারও সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া দিলেও দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সঙ্গে এই মহড়া হচ্ছে না। আগের সরকারগুলোর ভারতবিরোধী মনোভাবের কারণেই এটি হয়নি। এমনকি গত বিএনপির পাঁচ বছরের মেয়াদে ভারতের কোনো সেনাপ্রধানও বাংলাদেশে শুভেচ্ছা সফরে আসেননি। ভারতে যাননি বাংলাদেশের সেনাপ্রধানও। ২০০৮ সালে দীপক কাপুরের ও জেনারেল মইনের সফর বিনিময়ের মধ্য দিয়ে দুই দলের সামরিক সহযোগিতার বরফ গলতে শুরু করে। তখন বাংলাদেশে সেনানিয়ন্ত্রিত সরকার ছিল। জেনারেল মইনের ভারত সফর কেবল সামরিক সহযোগিতার মধ্যে সীমিত ছিল না। গোটা দিল্লির রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই সফরকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন।
৩.
China's string of pearls strategy around India in tatters নিবন্ধে পি চাক্কো জোশেফ লিখেছেন, ভারতবেষ্টিত মিয়ানমার, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মরিশাস, সিসিলি ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে চীন এ অঞ্চলে তার ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট রয়েছে। একইভাবে পাকিস্তান ছাড়া অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতেরও মোটামুটি সদ্ভাব আছে। প্রতিবেশীদের নিয়ে দুই উদীয়মান পরাশক্তির মধ্যে যে ঠান্ডা লড়াই আছে, আমরা তার শরিক হতে যাব না, বরং উভয়ের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নেব। সেটাই সফল কূটনীতি।
বাংলাদেশ সম্পর্কে ওই নিবন্ধে বলা হয়: ‘২০০৯ সালের আগে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সরকার ও সেনাবাহিনী ছিল, যার পুরো সুযোগ চীন নিয়েছে।’ ২০০৯ সালে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ও সেনাবাহিনী ভারতের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন। এর অর্থ এই নয় যে এখন আমাদের চীনের বিরোধিতা করতে হবে।
ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান বিজয় কুমার সিং যখন বাংলাদেশে শুভেচ্ছা সফরে আসেন, সেই মুহূর্তে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির চীন সফর নিছক কাকতালীয় নয়। গত আড়াই বছরে হাসিনা সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে, তবে পররাষ্ট্রনীতিতে যে সফল হয়েছে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। অন্তত বাংলাদেশকে এখন কেউ জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্য মনে করে না। বর্তমান সরকারের জঙ্গিবিরোধী অভিযানকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোও।
বিএনপির সরকার পূর্বমুখী কূটনীতি প্রসারিত করার কথা বললেও থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিনকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নিয়ে আসা ছাড়া কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি। বরং বিএনপির সহজাত মিত্র বলে পরিচিত গণচীনকে ক্ষুব্ধ করেছিল ঢাকায় তাইওয়ানের বাণিজ্য মিশন খুলে। তা ছাড়া চীনের পররাষ্ট্রনীতি আদর্শের স্থলে বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মীকে বরাবর অগ্রাধিকার দিত, এখন তার মাত্রা বেড়েছে মাত্র।
৪.
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার রক্ষাকবচ কী? ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক করে চীনের সঙ্গে সখ্য ও চীনের সঙ্গে বৈরী করে ভারতের সঙ্গে সখ্য? না, এর কোনোটাই নয়। প্রতিটি দেশই নিজের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত হবে এশিয়ার দুই বৃহৎ শক্তির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা। আমাদের পুবে বা পশ্চিমে হেলে পড়লে চলবে না। কেউ যেন ভাবতে না পারে, আমরা তাদের দ্বারা ব্যবহূত হতে পারি। আয়তনে ছোট ও সামরিক শক্তিতে দুর্বল হলেও বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ হতে পারে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেতুবন্ধ। তবে যেকোনো দেশের শক্তি হলো তার জনগণ, জাতীয় মতৈক্য, বিশেষ করে, পররাষ্ট্রনীতিতে জাতি বিভক্ত থাকলে বহিঃশক্তি তার সুযোগ নিতে চাইবে। নিচ্ছেও। কেবল পঁচাত্তর-উত্তর নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিভক্ত ছিল। এখনো আছে। সে বিভক্তি এতটাই প্রকট যে চিরবৈরী ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনা হলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কথা হয় না। আমাদের নেতানেত্রীরা খাল কেটে কুমির আনতে কিংবা অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করতে নিজের পায়ে কুড়াল মারতেও দ্বিধা করেন না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
বাংলাদেশ ও ভারতের কৌশলগত সম্পর্কের মোড় পরিবর্তন হয় ২০০৮ সালে দুই দেশের সেনাপ্রধানের সফর বিনিময়ের মাধ্যমে। সে সময়ে ভারতের সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল দীপক কাপুর এবং বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল মইন উ আহমেদ। তাঁদের এই সফর নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা হয়। বিশেষ করে, সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদকে ভারতীয় সেনাবাহিনী ছয়টি ঘোড়া উপহার দেওয়ায় গণমাধ্যম এটিকে ‘ঘোড়া কূটনীতি’ বলে অভিহিত করেছিল। এবার ভারতীয় সেনাপ্রধান দুটি কামান নিয়ে এসেছেন। একে কি আমরা ‘কামান কূটনীতি’ বলব?
সে সময়ে ভারতের নিরাপত্তা ও সামরিক বিশ্লেষক সুবাশ কমিলা লিখেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ার ভেতরে তুলনামূলক স্থিতিশীলতার দিক থেকে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ অধিকতর প্রতিশ্রুতিশীল। তাই, ভারতের নীতি প্রণয়ন কর্তৃপক্ষ, কূটনীতিক ও কৌশলগত বিষয়াদির বিশারদদের কৌশলগত ও রাজনৈতিক মনোযোগের জায়গাতে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে। বাংলাদেশ-ভারত কৌশলগত অংশীদারির লক্ষ্যে ভারতের কর্মকাণ্ড ও পদক্ষেপসমূহ বাংলাদেশকে তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, বাংলাদেশের ভেতরে সেই ধারণা যেন কোনোভাবেই না জন্মায়।
আমরাও মনে করি, সেটি ভারতের জন্য মারাত্মক ভুল হবে। ভারতকে বৈরী ভাবলে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা একই ভুল করবেন। প্রতিবেশী দুটি দেশের মধ্যে সমস্যা থাকবে এবং তার সমাধানও খুঁজে বের করতে হবে। ভারত বৃহৎ রাষ্ট্র হওয়ায় প্রতিবেশীদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা ও ভীতি থাকা অস্বাভাবিক নয়। সেই শঙ্কা কাটাতে ভারতকেই উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। ভারত যে ছোট প্রতিবেশীদের ওপর দাদাগিরি ফলাতে চায় না, সেটি শুধু কথায় নয়, কাজেও প্রমাণ দিতে হবে। আবার প্রতিবেশীদেরও সন্দেহের তীরটি সব সময় ভারতের দিকে তাক করে রাখা হীনম্মন্যতারই পরিচয়। প্রতিবেশী ভালো হোক মন্দ হোক, তাকে অস্বীকার করা যায় না।
২.
১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক অংশীদারের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক গড়ে উঠলেও সেই অংশীদারি সমানভাবে চলেনি। বেশির ভাগ সময়ই নানা কারণে টানাপোড়েন লেগে ছিল। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অপরিপক্ব কূটনীতির পাশাপাশি ভারতের অনুদারতাও কম দায়ী নয়।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, ভারতের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং কূটনীতিক মহল প্রতিবেশী বলতে পাকিস্তানকেই বোঝেন। সেখানে যুদ্ধ, বোমা, অন্তর্ঘাত সত্ত্বেও শান্তি আলোচনা থেমে থাকে না। কাশ্মীর ছাড়া পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে কোনো বিরোধ নেই, কিংবা পানিবণ্টনের সমস্যাটিও অনেক আগে তারা মিটিয়ে ফেলেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে সমস্যাগুলো ঝুলে আছে। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া না হয় ক্ষমতার স্বার্থে ভারতবিরোধী রাজনীতি করেছেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার সরকার নিরাপত্তার ব্যাপারে ভারতের যে উদ্বেগ ছিল, বলা যায়, তার পনেরো আনাই দূর করেছেন। যে জন্য ভারত সরকার এখন আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠক করতে পেরেছে। রাজনৈতিক ঝুঁকি সত্ত্বেও শেখ হাসিনা ভারতকে ট্রানজিট দিতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে প্রত্যাশিত প্রতিদান এখনো পাওয়া যায়নি। এ জন্য ভারতের আমলাতন্ত্র, না অন্য কেউ দায়ী, সেটি বাংলাদেশের দেখার কথা নয়। আন্তর্জাতিক কূটনীতির মূল কথা হলো ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে’। একতরফা সম্পর্ক হয় না।
গত মে মাসে নয়াদিল্লিতে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কূটনীতিকদের সঙ্গে আলাপ করে এই ধারণা হয়েছে যে ভারত চাইলে সীমান্ত সমস্যা কয়েক মাসেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে, কমানো যেতে পারে বাণিজ্য বৈষম্যও। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কোনো দেশ অন্য দেশে জোর করে বাজার সৃষ্টি করতে পারে না। বাংলাদেশের যেসব পণ্যের চাহিদা ভারতের বাজারে আছে, সেগুলোও নানা রকম আইনি জটিলতায় আটকে দেওয়া বন্ধুত্বের পরিচায়ক নয়। যেমন বন্ধুত্বের পরিচায়ক নয় অন্য দেশের হয়ে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় ও মদদ দেওয়া।
ভারত ও চীন—বৃহৎ দুই দেশের পাশে বাংলাদেশ অত্যন্ত ছোট। অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিতে দুর্বল। সে ক্ষেত্রে আমরা বৃহৎ শক্তিদ্বয়ের যুদ্ধের ক্ষেত্র হতে চাই না। আমরা চাই দুই দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক ভালো থাক। সমঅংশীদারির ভিত্তিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত নির্মিত হোক। প্রশ্ন হলো, সেটি করার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দক্ষতা নেতৃত্বের আছে কি না? কিংবা সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রনীতিরও পরিবর্তন ঘটবে কি না?
কয়েক দিন আগে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে আমরা ভারতবিরোধী নই এবং ভারতের সঙ্গে সমঅংশীদারির ভিত্তিতে সুসম্পর্ক চাই বলে যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা নয়াদিল্লির নীতিনির্ধারকদের আশ্বস্ত করতে না পারলেও দেশের অভ্যন্তরে ভারতবিরোধী বেলুনটি ফুটো করে দিয়েছে। একসময় আঙ্গরপোতা-দহগ্রামে লংমার্চ করা এবং ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী শফিউল আলম প্রধানও চুপচাপ।
কেউ কেউ দাবি করছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবে। এ তত্ত্ব এখন অচল। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ আসবে কেন? ভারতের সঙ্গে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া—দুই দেশেরই সুসম্পর্ক আছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মাত্রা নিশ্চয়ই বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের মাত্রা দিয়ে নির্ধারিত হওয়া উচিত নয়। ভারত ও চীন যদি সামরিক জান্তাশাসিত মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে পারে, বাংলাদেশ কেন একযোগে দুই দেশের সঙ্গে সদ্ভাব রাখতে পারবে না? আমাদের কেন ভারতের বন্ধুত্বের বিনিময়ে চীনকে কিংবা চীনের মৈত্রীর বিনিময়ে ভারতকে শত্রু করতে হবে?
গত নভেম্বরে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ আবদুল মুবীন ভারত সফর করেন। জেনারেল বিজয় কুমার ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান থাকতেই বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেন। সে সময় বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ সামরিক মহড়ারও সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া দিলেও দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সঙ্গে এই মহড়া হচ্ছে না। আগের সরকারগুলোর ভারতবিরোধী মনোভাবের কারণেই এটি হয়নি। এমনকি গত বিএনপির পাঁচ বছরের মেয়াদে ভারতের কোনো সেনাপ্রধানও বাংলাদেশে শুভেচ্ছা সফরে আসেননি। ভারতে যাননি বাংলাদেশের সেনাপ্রধানও। ২০০৮ সালে দীপক কাপুরের ও জেনারেল মইনের সফর বিনিময়ের মধ্য দিয়ে দুই দলের সামরিক সহযোগিতার বরফ গলতে শুরু করে। তখন বাংলাদেশে সেনানিয়ন্ত্রিত সরকার ছিল। জেনারেল মইনের ভারত সফর কেবল সামরিক সহযোগিতার মধ্যে সীমিত ছিল না। গোটা দিল্লির রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই সফরকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন।
৩.
China's string of pearls strategy around India in tatters নিবন্ধে পি চাক্কো জোশেফ লিখেছেন, ভারতবেষ্টিত মিয়ানমার, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মরিশাস, সিসিলি ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে চীন এ অঞ্চলে তার ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট রয়েছে। একইভাবে পাকিস্তান ছাড়া অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতেরও মোটামুটি সদ্ভাব আছে। প্রতিবেশীদের নিয়ে দুই উদীয়মান পরাশক্তির মধ্যে যে ঠান্ডা লড়াই আছে, আমরা তার শরিক হতে যাব না, বরং উভয়ের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নেব। সেটাই সফল কূটনীতি।
বাংলাদেশ সম্পর্কে ওই নিবন্ধে বলা হয়: ‘২০০৯ সালের আগে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সরকার ও সেনাবাহিনী ছিল, যার পুরো সুযোগ চীন নিয়েছে।’ ২০০৯ সালে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ও সেনাবাহিনী ভারতের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন। এর অর্থ এই নয় যে এখন আমাদের চীনের বিরোধিতা করতে হবে।
ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান বিজয় কুমার সিং যখন বাংলাদেশে শুভেচ্ছা সফরে আসেন, সেই মুহূর্তে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির চীন সফর নিছক কাকতালীয় নয়। গত আড়াই বছরে হাসিনা সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে, তবে পররাষ্ট্রনীতিতে যে সফল হয়েছে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। অন্তত বাংলাদেশকে এখন কেউ জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্য মনে করে না। বর্তমান সরকারের জঙ্গিবিরোধী অভিযানকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোও।
বিএনপির সরকার পূর্বমুখী কূটনীতি প্রসারিত করার কথা বললেও থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিনকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নিয়ে আসা ছাড়া কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি। বরং বিএনপির সহজাত মিত্র বলে পরিচিত গণচীনকে ক্ষুব্ধ করেছিল ঢাকায় তাইওয়ানের বাণিজ্য মিশন খুলে। তা ছাড়া চীনের পররাষ্ট্রনীতি আদর্শের স্থলে বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মীকে বরাবর অগ্রাধিকার দিত, এখন তার মাত্রা বেড়েছে মাত্র।
৪.
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার রক্ষাকবচ কী? ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক করে চীনের সঙ্গে সখ্য ও চীনের সঙ্গে বৈরী করে ভারতের সঙ্গে সখ্য? না, এর কোনোটাই নয়। প্রতিটি দেশই নিজের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত হবে এশিয়ার দুই বৃহৎ শক্তির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা। আমাদের পুবে বা পশ্চিমে হেলে পড়লে চলবে না। কেউ যেন ভাবতে না পারে, আমরা তাদের দ্বারা ব্যবহূত হতে পারি। আয়তনে ছোট ও সামরিক শক্তিতে দুর্বল হলেও বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ হতে পারে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেতুবন্ধ। তবে যেকোনো দেশের শক্তি হলো তার জনগণ, জাতীয় মতৈক্য, বিশেষ করে, পররাষ্ট্রনীতিতে জাতি বিভক্ত থাকলে বহিঃশক্তি তার সুযোগ নিতে চাইবে। নিচ্ছেও। কেবল পঁচাত্তর-উত্তর নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিভক্ত ছিল। এখনো আছে। সে বিভক্তি এতটাই প্রকট যে চিরবৈরী ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনা হলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কথা হয় না। আমাদের নেতানেত্রীরা খাল কেটে কুমির আনতে কিংবা অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করতে নিজের পায়ে কুড়াল মারতেও দ্বিধা করেন না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments