বর্ষা নিয়ে একটি নীরস রচনা
এখন বর্ষাকাল। সবচেয়ে রোমান্টিক ঋতু। ঝুমবৃষ্টিতে (আসলে খটখটে রোদে), ঝরো ঝরো বাদলদিনে, নিজের ল্যাপটপের সামনে বসে বর্ষা আর বৃষ্টি নিয়ে এই রচনাটি লিখেছেন রাজীব হাসান বর্ষা আর বৃষ্টিকে কে না ভালোবাসে? এমন বে-রোমান্টিক এই তল্লাটে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একে তো বর্ষা-বৃষ্টি—দুই বোনই দারুণ সুন্দর, তার ওপর তাদের বাবা আবার বিরাট ধনী!
ফলে আমাদের মহল্লায় ওরা যেদিন প্রথম এল, সেদিন থেকেই আমাদের আড্ডার ভেন্যু পাড়ার ক্রিকেট মাঠের বদলে হয়ে গেল বর্ষা-বৃষ্টিদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল হয়তো উঠতি কিছু দুর্দান্ত প্রতিভাবান সাকিব-তামিম হারাল, কিন্তু ‘পাড়াতো অর্থনীতি’তে একটা গতিও তৈরি হলো একই সঙ্গে। বর্ষাদের বাড়ির ঠিক সামনেই করিম মিয়া খুলে বসলেন তাঁর চায়ের স্টল। কোত্থেকে যেন একটা ভাঙাচোরা (আক্ষরিক অর্থেই ভাঙা এবং চোরা মানে চুরি করে আনা) ক্যারম বোর্ডও জুটে গেল।
ক্যারম খেলতে যে হাতের মাসল ফোলাতে হয়, বুকডন দেওয়ারও দরকার পড়ে—এই তথ্য অনেকেরই অজানা ছিল। বাড়ির ব্যালকনিতে দুই বোনের ছায়া দেখা দেওয়া মাত্রই সবার মধ্যে বুকোডনোটোমাইসিন আর মাসলোস্টোফিয়াস ম্যানিয়া নামের অদ্ভুত দুটি রোগের লক্ষ্মণ দেখা দিতে শুরু করল। সবাই তখন ক্যারম ফেলে নেমে যায় বুকডন দেওয়া কিংবা মাসল ফোলানোর প্রতিযোগিতায়।
মূল সমস্যা দেখা দিল অন্য জায়গায়। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ (আমাদের মনশের স্যার বলতেন ‘আদম স্মিথ’ এবং এ কারণে তাঁর নামও হয়ে গিয়েছিল মণ-সের) সেই কবে বলে গেছেন, চাহিদার তুলনায় সম্পদ বড়ই অপ্রতুল। আমরাও খেয়াল করে দেখলাম, ওরা মাত্র দু-বোন। আর আমরা বন্ধুবান্ধব মিলে পাঁচজন। বর্ষা-বৃষ্টি তো আর দ্রৌপদী নয়, আমরাও নই পঞ্চপাণ্ডব। ফলে অবধারিতভাবে আমাদের মধ্যে কুরুক্ষেত্র বেঁধে গেল।
সবচেয়ে গলায় গলায় পিরিত ছিল আদনান আর অয়নের মধ্যে। একদিন আবহাওয়া অফিসের গলির মাথায় দুজনকেই ভীষণ তর্কযুদ্ধে লিপ্ত অবস্থায় আবিষ্কার করলাম আমরা। অয়ন বলছে, ‘আর একটা কথা যদি বলিস, তোর ঠ্যাং ভাইঙ্গা যদি হাতত ধরায়া না দেই...।’ অয়নরা বিক্রমপুরী হলেও রংপুরে আছে বহুদিন ধরে। ফলে অধিক উত্তেজনা ওর মধ্যে সংক্রমিত হলে বিক্রমপুরি ভাষার সঙ্গে রংপুরি ভাষা মিশে যায়। ভুরুঙ্গামারীর আদনান খাস রংপুরি ভাষায় তার পাল্টা জবাব দিল, ‘খালি গায়োত একনা ফুঁ দিয়া দ্যাখ, এক ঘুসি মারি শ্লা তোক ঢাকাত পাঠে দিম।’
অন্য সময় হলে দুই বন্ধুর এই মুখোমুখি অবস্থান আমাদের বিচলিত করত। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আমরা খুশিই হলাম। এই দুজন যদি পারস্পরিক আক্রমণে শহীদ হয়ে যায়, প্রতিদ্বন্দ্বী অন্তত দুজন কমে। হায়, ব্রিটিশরা সেই কবেই আমাদের শিখিয়ে গিয়েছিল ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’!
এই তত্ত্ব সবচেয়ে ভালো উপলব্ধি করেছিল রকেট। ফলে মোক্ষম চালটা একদিন সেই চালল। আমার কানে রাহাতের নামে বিস্তর কথা ঢালল তপ্ত সিসার মতো, ওদিকে রাহাতের কান ভারী হলো আমার নামে প্রচুর অকথা-কুকথায়। দেয়ার ইজ নো রুল ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার। রকেটের হিসাব পরিষ্কার, দুটো ফুলের সুবাস সে একাই পেতে চায়। এই চাল ধরে ফেললাম আমরা। ফলে একদিন চারজনের যৌথ প্রযোজনায় জুম্মাপাড়ার টেকনিক্যাল কলেজের পুকুরে আচ্ছামতো চুবিয়ে আনা হলো রকেটকে। লেলিয়ে দেওয়া হলো রাহাতদের বাড়ির পোষা পাগলা কুত্তাটাকেও। কুকুর আর পুকুর—এই দুটো জিনিসকে রকেট খুবই ডরায়।
ফলাফল আগের অবস্থানেই গিয়ে দাঁড়াল। এক দিকে দুই, অন্য দিকে পাঁচ। ফলাফল শূন্য দশমিক চার। এবার ঘি তুলতে সবাইকে আঙুল বাঁকাতেই হলো। বর্ষা-বৃষ্টির বাবা এলজিইডির কর্মকর্তা। ফলে নিতান্ত অনিচ্ছাতেও প্রচুর ঘুষ তাঁকে খেতে হয়। প্রতিদিন নয়টা-পাঁচটায় প্রচুর ঘুষ গিলে এসে আত্মদগ্ধ অনুশোচনায় তিনি পাপ পরিষ্কার করতে প্রার্থনা করতে যান। রাহাত আর আদনানকেও মসজিদমুখী হতে দেখা গেল। সেই সঙ্গে চলল নিয়ম করে বর্ষার বাবাকে দিনে সাতবার সালাম দেওয়া।
অয়ন, রকেট আর আমার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হলো। আমরা নিলাম ভিন্ন পথ। দরবেশ বাবার পানপড়া নাকি অব্যর্থ দাওয়াই। এই পানপড়া বর্ষা-বৃষ্টিকে খাইয়ে দিলেই কেল্লা ফতে! সিদ্ধান্ত হলো, আমাদের যে দুজনের পান বর্ষা-বৃষ্টি খাবে, সে দুজনই পেয়ে যাবে প্রেম করার লাইসেন্স।
নির্ধারিত দিনে পানপড়া নিয়ে আমরা হাজির হলাম বর্ষাদের বাসায়। কপাল এতটাই খারাপ, ধরা পড়ে গেলাম তার মায়ের কাছে। এ ধরনের স্নায়ুবিক উত্তেজনার মুহূর্তে আমার মতো দুর্বল চিত্তের লোক সব সময়ই ভজকট পাকিয়ে ফেলে। এবারও তা-ই হলো। ঘটনার এক পর্যায়ে আতঙ্কিত আমি বলে বসলাম, ‘আন্টি, আমরা আসলে আপনার জন্য পান নিয়ে এসেছি।’ বলেই নিজের পকেট থেকে পানটা বের করে তুলে দিলাম তাঁর হাতে। বাধ্য হয়েই অয়ন আর রকেটও তা-ই করল।
পর সমাচার, সেই তিনটা পান বর্ষার মা, বর্ষার নানি এবং তাদের বাড়ির বুয়া খেয়েছিল বলে বিশ্বস্ত সূত্রের খবর।
(লেখাটা আসলে এখানেই শেষ। কিন্তু রস+আলোর সম্পাদক সিমু নাসের ফোন করে বললেন, ‘আরে দূর, আপনার মাথার র্যাম স্লো নাকি! আপনাকে না বললাম বৃষ্টি আর বর্ষা নিয়া লেখা দিতে? আরে, বৃষ্টি বোঝেন না? রেইন, রেইন!’ বুঝলাম, কিন্তু অনেক ‘ল্যাটে’! ফলে ওপরের লেখাটি বাতিল বলে গণ্য হলো।)
ক্যারম খেলতে যে হাতের মাসল ফোলাতে হয়, বুকডন দেওয়ারও দরকার পড়ে—এই তথ্য অনেকেরই অজানা ছিল। বাড়ির ব্যালকনিতে দুই বোনের ছায়া দেখা দেওয়া মাত্রই সবার মধ্যে বুকোডনোটোমাইসিন আর মাসলোস্টোফিয়াস ম্যানিয়া নামের অদ্ভুত দুটি রোগের লক্ষ্মণ দেখা দিতে শুরু করল। সবাই তখন ক্যারম ফেলে নেমে যায় বুকডন দেওয়া কিংবা মাসল ফোলানোর প্রতিযোগিতায়।
মূল সমস্যা দেখা দিল অন্য জায়গায়। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ (আমাদের মনশের স্যার বলতেন ‘আদম স্মিথ’ এবং এ কারণে তাঁর নামও হয়ে গিয়েছিল মণ-সের) সেই কবে বলে গেছেন, চাহিদার তুলনায় সম্পদ বড়ই অপ্রতুল। আমরাও খেয়াল করে দেখলাম, ওরা মাত্র দু-বোন। আর আমরা বন্ধুবান্ধব মিলে পাঁচজন। বর্ষা-বৃষ্টি তো আর দ্রৌপদী নয়, আমরাও নই পঞ্চপাণ্ডব। ফলে অবধারিতভাবে আমাদের মধ্যে কুরুক্ষেত্র বেঁধে গেল।
সবচেয়ে গলায় গলায় পিরিত ছিল আদনান আর অয়নের মধ্যে। একদিন আবহাওয়া অফিসের গলির মাথায় দুজনকেই ভীষণ তর্কযুদ্ধে লিপ্ত অবস্থায় আবিষ্কার করলাম আমরা। অয়ন বলছে, ‘আর একটা কথা যদি বলিস, তোর ঠ্যাং ভাইঙ্গা যদি হাতত ধরায়া না দেই...।’ অয়নরা বিক্রমপুরী হলেও রংপুরে আছে বহুদিন ধরে। ফলে অধিক উত্তেজনা ওর মধ্যে সংক্রমিত হলে বিক্রমপুরি ভাষার সঙ্গে রংপুরি ভাষা মিশে যায়। ভুরুঙ্গামারীর আদনান খাস রংপুরি ভাষায় তার পাল্টা জবাব দিল, ‘খালি গায়োত একনা ফুঁ দিয়া দ্যাখ, এক ঘুসি মারি শ্লা তোক ঢাকাত পাঠে দিম।’
অন্য সময় হলে দুই বন্ধুর এই মুখোমুখি অবস্থান আমাদের বিচলিত করত। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আমরা খুশিই হলাম। এই দুজন যদি পারস্পরিক আক্রমণে শহীদ হয়ে যায়, প্রতিদ্বন্দ্বী অন্তত দুজন কমে। হায়, ব্রিটিশরা সেই কবেই আমাদের শিখিয়ে গিয়েছিল ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’!
এই তত্ত্ব সবচেয়ে ভালো উপলব্ধি করেছিল রকেট। ফলে মোক্ষম চালটা একদিন সেই চালল। আমার কানে রাহাতের নামে বিস্তর কথা ঢালল তপ্ত সিসার মতো, ওদিকে রাহাতের কান ভারী হলো আমার নামে প্রচুর অকথা-কুকথায়। দেয়ার ইজ নো রুল ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার। রকেটের হিসাব পরিষ্কার, দুটো ফুলের সুবাস সে একাই পেতে চায়। এই চাল ধরে ফেললাম আমরা। ফলে একদিন চারজনের যৌথ প্রযোজনায় জুম্মাপাড়ার টেকনিক্যাল কলেজের পুকুরে আচ্ছামতো চুবিয়ে আনা হলো রকেটকে। লেলিয়ে দেওয়া হলো রাহাতদের বাড়ির পোষা পাগলা কুত্তাটাকেও। কুকুর আর পুকুর—এই দুটো জিনিসকে রকেট খুবই ডরায়।
ফলাফল আগের অবস্থানেই গিয়ে দাঁড়াল। এক দিকে দুই, অন্য দিকে পাঁচ। ফলাফল শূন্য দশমিক চার। এবার ঘি তুলতে সবাইকে আঙুল বাঁকাতেই হলো। বর্ষা-বৃষ্টির বাবা এলজিইডির কর্মকর্তা। ফলে নিতান্ত অনিচ্ছাতেও প্রচুর ঘুষ তাঁকে খেতে হয়। প্রতিদিন নয়টা-পাঁচটায় প্রচুর ঘুষ গিলে এসে আত্মদগ্ধ অনুশোচনায় তিনি পাপ পরিষ্কার করতে প্রার্থনা করতে যান। রাহাত আর আদনানকেও মসজিদমুখী হতে দেখা গেল। সেই সঙ্গে চলল নিয়ম করে বর্ষার বাবাকে দিনে সাতবার সালাম দেওয়া।
অয়ন, রকেট আর আমার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হলো। আমরা নিলাম ভিন্ন পথ। দরবেশ বাবার পানপড়া নাকি অব্যর্থ দাওয়াই। এই পানপড়া বর্ষা-বৃষ্টিকে খাইয়ে দিলেই কেল্লা ফতে! সিদ্ধান্ত হলো, আমাদের যে দুজনের পান বর্ষা-বৃষ্টি খাবে, সে দুজনই পেয়ে যাবে প্রেম করার লাইসেন্স।
নির্ধারিত দিনে পানপড়া নিয়ে আমরা হাজির হলাম বর্ষাদের বাসায়। কপাল এতটাই খারাপ, ধরা পড়ে গেলাম তার মায়ের কাছে। এ ধরনের স্নায়ুবিক উত্তেজনার মুহূর্তে আমার মতো দুর্বল চিত্তের লোক সব সময়ই ভজকট পাকিয়ে ফেলে। এবারও তা-ই হলো। ঘটনার এক পর্যায়ে আতঙ্কিত আমি বলে বসলাম, ‘আন্টি, আমরা আসলে আপনার জন্য পান নিয়ে এসেছি।’ বলেই নিজের পকেট থেকে পানটা বের করে তুলে দিলাম তাঁর হাতে। বাধ্য হয়েই অয়ন আর রকেটও তা-ই করল।
পর সমাচার, সেই তিনটা পান বর্ষার মা, বর্ষার নানি এবং তাদের বাড়ির বুয়া খেয়েছিল বলে বিশ্বস্ত সূত্রের খবর।
(লেখাটা আসলে এখানেই শেষ। কিন্তু রস+আলোর সম্পাদক সিমু নাসের ফোন করে বললেন, ‘আরে দূর, আপনার মাথার র্যাম স্লো নাকি! আপনাকে না বললাম বৃষ্টি আর বর্ষা নিয়া লেখা দিতে? আরে, বৃষ্টি বোঝেন না? রেইন, রেইন!’ বুঝলাম, কিন্তু অনেক ‘ল্যাটে’! ফলে ওপরের লেখাটি বাতিল বলে গণ্য হলো।)
No comments