সময়চিত্র-তাঁরা কোথায় যাবেন? by আসিফ নজরুল
আমার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে অনেক দিন ধরে পড়ে আছে একটি চিঠি। যতবার ড্রয়ার খুলি, মনে পড়ে সেই চিঠির কথা। আমি একবার পড়েছি তা। আর পড়ার শক্তি পাই না। চিঠিটি একজন হতভাগ্য মায়ের। তিনি চিকিৎসকদের নির্মম অবহেলায় হারিয়েছেন তাঁর প্রাণোচ্ছল মেয়ে ঝুমুরকে। সেই শোকে কয়েক মাসের মধ্যে মারা গেছেন তাঁর স্বামী।
সন্তানহারা-বিধবা এই নারীর নাম রওশন আখতার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের বড় দেওয়ানপাড়া থেকে তিনি চিঠি লিখে জানিয়েছেন তাঁর হূদয়ছেঁড়া বেদনার কাহিনি। তিনি এর বিচার চান। আমাকে ভাই ডেকে কিছু একটা করতে বলেছেন।
তিনি জানেন না, আমার মতো নগণ্য মানুষের আসলে কিছু করার নেই। তাঁদের বেদনার প্রতিকার করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রের কর্ণধারদের। কিন্তু এই রাষ্ট্র ব্যস্ত সংবিধান কাটাছেঁড়া-পুনর্মুদ্রণ, পুনঃ সংশোধন নিয়ে। এই রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা ব্যস্ত আগামী দিনে কীভাবে ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতায় যাওয়া যাবে, সেই প্রতিযোগিতায়। এই রাষ্ট্রের মেধা-চিন্তা-চেতনা নিয়োজিত ধর্ম, জাতীয়তা আর নেতাদের অবদানকেন্দ্রিক বিতর্কে। কিংবা অন্য কোনো উৎপাদন আর জনকল্যাণবিছিন্ন ইস্যুতে।
ঝুমুরের মা হয়তো এটিও জানেন না যে এই রাষ্ট্রের প্রভুরা সামান্য নাক-কানের যন্ত্রণা হলে চিকিৎসার জন্য ছুটে যান ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর বা আমেরিকায়। তাঁদের খাবার বিদেশ থেকে আমদানীকৃত, তাঁদের সন্তান পড়াশোনার জন্য বিদেশে প্রেরিত, তাঁদের টাকা-পয়সা জমা থাকে বিদেশের ব্যাংকে, তাঁদের চিকিৎসা চলে বিদেশে। বাংলাদেশ গোল্লায় গেলেও কিছু আসে-যায় না তাঁদের। অপচিকিৎসায় সরাইলের কিশোরীর মৃত্যু তো তুচ্ছ এখানে!
২.
ঝুমুরের পুরো নাম জান্নাতুল ফেরদৌস ঝুমুর। তুখোড় মেধাবী এই মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্থানীয় চিকিৎসকেরা বললেন, তাঁর অ্যালার্জি হয়েছে। কিন্তু চর্মরোগের চিকিৎসক পরীক্ষা করে বলেন, তাঁর ডেঙ্গু। এ পর্যায়ে ঢাকায় একটি সরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করানো হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে বেসরকারি একটি ক্লিনিকে তাঁকে নেওয়া হয়। সেখানে আরও খারাপ অবস্থা হলে অন্য কোথাও নিতে চাইলে ক্লিনিক থেকে বাধা দেওয়া হয়। তিন ‘শ্রেষ্ঠ’ হাসপাতালের (ঢাকা মেডিকেল, হলি ফ্যামিলি, সলিমুল্লাহ্) তিনজন চিকিৎসকের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। তাঁরা রোগনির্ণয় হয়েছে—এই মর্মে আশ্বাস দিয়ে ওষুধ খেতে দেন।
তার পরের বর্ণনা ঝুমুরের মায়ের চিঠি থেকে দিচ্ছি। ‘ওষুধ খাওয়ার পর আমার মেয়ে বিকটভাবে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। কিন্তু ঘাতক ডাক্তারদের আর পাওয়া যায়নি। ফোনে অনেক চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি। আইসিইউতে থাকাকালীন একটিবারও ঘাতক ডাক্তাররা আমার মেয়েকে দেখতে আসেনি। তারপর অত্যন্ত দুঃখের সহিত জানাতে হচ্ছে যে আইসিইউতে তিন দিন থাকার পর আমার প্রাণপ্রিয়, অত্যন্ত আদরের, আমার কলিজার টুকরা ঝুমুর এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেয়।’ ঝুমুরের মা লিখেছেন, ‘আমার মেয়েকে বাসের সিটে বসিয়ে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তাররা চিকিৎসা করে তাকে কবরে পাঠিয়ে দিয়েছে!’
আমি বিশ্বাস করি, ঝুমুরের মায়ের মতো অভিজ্ঞতা বহু মানুষের হয়েছে। বহু মানুষ তাঁদের স্বজন হারিয়েছেন চিকিৎসকদের অবহেলা, অজ্ঞানতা আর ভুল চিকিৎসার কারণে। বহু মানুষ অপচিকিৎসার শিকার হয়েছেন চিকিৎসক নামধারী প্রতারকদের হাতে। কিছুদিন আগেই আমরা জেনেছি, রাজধানীর একটি খ্যাতনামা হাসপাতালে ভুয়া সনদ ব্যবহার করে অনেক দিন ধরে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন একজন প্রতারক। সেই হাসপাতালে কাজ করার জন্য তাঁকে চিকিৎসক হিসেবে কোনো সার্টিফিকেট বা প্রমাণ পর্যন্ত দাখিল করতে হয়নি। প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত না হলে তাঁর অপচিকিৎসায় প্রাণ দিতে হতো বা ক্ষতিগ্রস্ত হতে হতো আরও বহু সাধারণ মানুষকে। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র একজন প্রতারক যদি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পরিচয়ে বছরের পর বছর কাজ করে যেতে পারেন, তাহলে দেশের অন্যান্য জায়গায় কী অবস্থা, তা সহজেই অনুমেয়।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চিকিৎসকদের কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার ঘটনা। রাজধানীর বাইরে সরকারি চিকিৎসকেরা কর্মস্থলে যান না—এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। আর রাজধানীর ভেতরে রোগী ফেলে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দেখি আমরা ক্ষমতাসীন দলগুলোর সুবিধাভোগী চিকিৎসক সংগঠনগুলোকে!
কোথাও যেন কোনো প্রতিকার নেই! সামান্য ভুল চিকিৎসার কারণে মোটা অঙ্কের জরিমানা আর বড় ধরনের অবহেলার কারণে কারাদণ্ড এবং চিকিৎসক সদন বাতিলের বহু ঘটনা ঘটে উন্নত বিশ্বে। প্রাতিষ্ঠানিক গাফিলতি হলে বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয় সেখানে। চিকিৎসাসেবার মান নির্ধারণ, সেই মান বাস্তবায়নে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, চিকিৎসকের সনদ পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে নবায়নকরণ, নিয়মিত তদারকি ও পরিদর্শন, রোগীদের অভিযোগ বিবেচনায় নেওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগসহ নানা পদ্ধতি রয়েছে সেখানে। কর্মস্থলে নিয়মিত অনুপস্থিতি বা ভুয়া সনদে চিকিৎসাকাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা কল্পনা করা যায় না সেখানে। চিকিৎসকের পাশাপাশি নার্স ও চিকিৎসাকর্মীদের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিকরণের অব্যাহত প্রচেষ্টাও চালানো হয় সেখানে। দূরের বিশ্ব নয়, আমাদের প্রতিবেশী ভারতে, এমনকি খোদ কলকাতায় চিকিৎসাসেবা যে স্তরে পৌঁছেছে, তার ধারেকাছে যেতে পারেনি দু-চারটি ব্যতিক্রম বাদে আমাদের কোনো চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান।
৩.
অন্য দেশ যে পেরেছে, তার অন্যতম কারণ চিকিৎসকদের পেশাদারি আর দায়িত্বশীলতা। এগুলো নিশ্চিত করা যায় পেশাজীবীদের কাজের জবাবদিহি নির্ধারণ করে দিয়ে। অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশে এই জবাবদিহি বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের। চিকিৎসকদের জন্য এ প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে ১৯৮০ সালের মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল অ্যাক্ট (পরে ২০১০ সালে সংশোধিত) অনুসারে গঠিত মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল। কাউন্সিল প্রণীত কোড অব মেডিকেল এথিক্স-এ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ পেশাদারি, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এর ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে কোনো রোগীর প্রতি কর্তব্যকর্মে অবহেলার জন্য চিকিৎসক হিসেবে নিবন্ধন বাতিলের বিধান রয়েছে। অনিবন্ধিত কোনো চিকিৎসককে চিকিৎসা করতে দিলে জড়িতদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কর্তব্যকর্মে অবহেলার জন্য চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে, এমন ঘটনা খুব বিরল বাংলাদেশে। এ কাজটি যথাযথভাবে করার জন্য যে তদারকি ক্ষমতা, দক্ষতা ও কাঠামো প্রয়োজন, তা পর্যাপ্তভাবে নেই কাউন্সিলের। তা ছাড়া এর তদন্ত কমিটিতে চিকিৎসকদের বাইরে কেউ থাকেন না বলে তদন্ত অনেক সময় সুষ্ঠুভাবে হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। আমার পরিচিত কিছু চিকিৎসক জানিয়েছেন, কাউন্সিল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এত দুর্বল যে বহু চিকিৎসক এতে নিবন্ধনের তোয়াক্কা না করে বা নিবন্ধন নবায়ন না করে অবাধে কাজ করে যাচ্ছেন অনেক বছর ধরে। ভুয়া চিকিৎসক, কর্তব্যকর্মে গুরুতর অবহেলা, আইন লঙ্ঘনের ঘটনা কাউন্সিলের নজরে পড়ে কেবল পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখির পর। এর পরিচিতি এত সীমাবদ্ধ যে রোগীদের প্রায় কারোরই এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর সুযোগ আছে, তা জানা নেই।
এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরকারি হাসপাতালগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি চাকরিবিধিসহ বিভিন্ন আইন রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালের জন্য রয়েছে ১৯৮২ সালের মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স। এসব আইনের অধীনে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা যা-ও আছে, তা শিথিল হয়ে পড়েছে দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব আর অনৈতিক স্বার্থচক্রের কারণে।
বাকি থাকে হাসপাতালের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা। এটিও অদক্ষ এবং অকার্যকর, অনেক ক্ষেত্রে এমনকি অস্তিত্বহীন। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ডা. রুবাইয়ুল মোর্শেদ আমার বহু দিনের পরিচিত। তিনি প্রায়ই বলেন, এ দেশে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। তাঁর ভাষায়, এ দেশে চিকিৎসক আছে, চিকিৎসা নেই; চিকিৎসা সরঞ্জাম আছে, তার কোনো রক্ষণাবেক্ষণ নেই; ওষুধ আছে, তার কোনো সুষ্ঠু ব্যবহার নেই। নানা কারণে আরও কিছু ভালো ও দায়িত্ববান চিকিৎসককে চিনি আমি। তাঁদের অনেকের আক্ষেপ একই ধরনের।
৪.
ঝুমুরের মা তাহলে কোথায় যাবেন? তিনি বিচার চান। ফৌজদারি আইনের ৩০৪(এ) ধারায় কারও অবহেলায় অন্য কারও মৃত্যু হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। আমার জানামতে, নিকট অতীতে কোনো চিকিৎসক এ ধারায় কারাদণ্ডে দণ্ডিত হননি। দরিদ্র মানুষের পক্ষে তো দূরের কথা, অবস্থাবান কারও পক্ষেও ব্যয়বহুল ও অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ বিচার-প্রক্রিয়ায় আগ্রহী হওয়ার কথা না এসব ক্ষেত্রে।
ঝুমুরের মায়েদের জন্য আসলে তাই কোনো প্রতিকার নেই। তাঁরাই আমাদের দেশের সাধারণ নাগরিক। চিকিৎসা আমাদের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা হিসেবে স্বীকৃত। সংবিধান অনুসারে এটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন দূরের কথা, এ নিয়ে আমরা কোনো দিন কি আমাদের জনপ্রতিনিধিদেরই দেখেছি সংসদে সোচ্চার হতে?
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।তিনি জানেন না, আমার মতো নগণ্য মানুষের আসলে কিছু করার নেই। তাঁদের বেদনার প্রতিকার করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রের কর্ণধারদের। কিন্তু এই রাষ্ট্র ব্যস্ত সংবিধান কাটাছেঁড়া-পুনর্মুদ্রণ, পুনঃ সংশোধন নিয়ে। এই রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা ব্যস্ত আগামী দিনে কীভাবে ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতায় যাওয়া যাবে, সেই প্রতিযোগিতায়। এই রাষ্ট্রের মেধা-চিন্তা-চেতনা নিয়োজিত ধর্ম, জাতীয়তা আর নেতাদের অবদানকেন্দ্রিক বিতর্কে। কিংবা অন্য কোনো উৎপাদন আর জনকল্যাণবিছিন্ন ইস্যুতে।
ঝুমুরের মা হয়তো এটিও জানেন না যে এই রাষ্ট্রের প্রভুরা সামান্য নাক-কানের যন্ত্রণা হলে চিকিৎসার জন্য ছুটে যান ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর বা আমেরিকায়। তাঁদের খাবার বিদেশ থেকে আমদানীকৃত, তাঁদের সন্তান পড়াশোনার জন্য বিদেশে প্রেরিত, তাঁদের টাকা-পয়সা জমা থাকে বিদেশের ব্যাংকে, তাঁদের চিকিৎসা চলে বিদেশে। বাংলাদেশ গোল্লায় গেলেও কিছু আসে-যায় না তাঁদের। অপচিকিৎসায় সরাইলের কিশোরীর মৃত্যু তো তুচ্ছ এখানে!
২.
ঝুমুরের পুরো নাম জান্নাতুল ফেরদৌস ঝুমুর। তুখোড় মেধাবী এই মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্থানীয় চিকিৎসকেরা বললেন, তাঁর অ্যালার্জি হয়েছে। কিন্তু চর্মরোগের চিকিৎসক পরীক্ষা করে বলেন, তাঁর ডেঙ্গু। এ পর্যায়ে ঢাকায় একটি সরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করানো হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে বেসরকারি একটি ক্লিনিকে তাঁকে নেওয়া হয়। সেখানে আরও খারাপ অবস্থা হলে অন্য কোথাও নিতে চাইলে ক্লিনিক থেকে বাধা দেওয়া হয়। তিন ‘শ্রেষ্ঠ’ হাসপাতালের (ঢাকা মেডিকেল, হলি ফ্যামিলি, সলিমুল্লাহ্) তিনজন চিকিৎসকের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। তাঁরা রোগনির্ণয় হয়েছে—এই মর্মে আশ্বাস দিয়ে ওষুধ খেতে দেন।
তার পরের বর্ণনা ঝুমুরের মায়ের চিঠি থেকে দিচ্ছি। ‘ওষুধ খাওয়ার পর আমার মেয়ে বিকটভাবে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। কিন্তু ঘাতক ডাক্তারদের আর পাওয়া যায়নি। ফোনে অনেক চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি। আইসিইউতে থাকাকালীন একটিবারও ঘাতক ডাক্তাররা আমার মেয়েকে দেখতে আসেনি। তারপর অত্যন্ত দুঃখের সহিত জানাতে হচ্ছে যে আইসিইউতে তিন দিন থাকার পর আমার প্রাণপ্রিয়, অত্যন্ত আদরের, আমার কলিজার টুকরা ঝুমুর এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেয়।’ ঝুমুরের মা লিখেছেন, ‘আমার মেয়েকে বাসের সিটে বসিয়ে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তাররা চিকিৎসা করে তাকে কবরে পাঠিয়ে দিয়েছে!’
আমি বিশ্বাস করি, ঝুমুরের মায়ের মতো অভিজ্ঞতা বহু মানুষের হয়েছে। বহু মানুষ তাঁদের স্বজন হারিয়েছেন চিকিৎসকদের অবহেলা, অজ্ঞানতা আর ভুল চিকিৎসার কারণে। বহু মানুষ অপচিকিৎসার শিকার হয়েছেন চিকিৎসক নামধারী প্রতারকদের হাতে। কিছুদিন আগেই আমরা জেনেছি, রাজধানীর একটি খ্যাতনামা হাসপাতালে ভুয়া সনদ ব্যবহার করে অনেক দিন ধরে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন একজন প্রতারক। সেই হাসপাতালে কাজ করার জন্য তাঁকে চিকিৎসক হিসেবে কোনো সার্টিফিকেট বা প্রমাণ পর্যন্ত দাখিল করতে হয়নি। প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত না হলে তাঁর অপচিকিৎসায় প্রাণ দিতে হতো বা ক্ষতিগ্রস্ত হতে হতো আরও বহু সাধারণ মানুষকে। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র একজন প্রতারক যদি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পরিচয়ে বছরের পর বছর কাজ করে যেতে পারেন, তাহলে দেশের অন্যান্য জায়গায় কী অবস্থা, তা সহজেই অনুমেয়।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চিকিৎসকদের কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার ঘটনা। রাজধানীর বাইরে সরকারি চিকিৎসকেরা কর্মস্থলে যান না—এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। আর রাজধানীর ভেতরে রোগী ফেলে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দেখি আমরা ক্ষমতাসীন দলগুলোর সুবিধাভোগী চিকিৎসক সংগঠনগুলোকে!
কোথাও যেন কোনো প্রতিকার নেই! সামান্য ভুল চিকিৎসার কারণে মোটা অঙ্কের জরিমানা আর বড় ধরনের অবহেলার কারণে কারাদণ্ড এবং চিকিৎসক সদন বাতিলের বহু ঘটনা ঘটে উন্নত বিশ্বে। প্রাতিষ্ঠানিক গাফিলতি হলে বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয় সেখানে। চিকিৎসাসেবার মান নির্ধারণ, সেই মান বাস্তবায়নে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, চিকিৎসকের সনদ পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে নবায়নকরণ, নিয়মিত তদারকি ও পরিদর্শন, রোগীদের অভিযোগ বিবেচনায় নেওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগসহ নানা পদ্ধতি রয়েছে সেখানে। কর্মস্থলে নিয়মিত অনুপস্থিতি বা ভুয়া সনদে চিকিৎসাকাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা কল্পনা করা যায় না সেখানে। চিকিৎসকের পাশাপাশি নার্স ও চিকিৎসাকর্মীদের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিকরণের অব্যাহত প্রচেষ্টাও চালানো হয় সেখানে। দূরের বিশ্ব নয়, আমাদের প্রতিবেশী ভারতে, এমনকি খোদ কলকাতায় চিকিৎসাসেবা যে স্তরে পৌঁছেছে, তার ধারেকাছে যেতে পারেনি দু-চারটি ব্যতিক্রম বাদে আমাদের কোনো চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান।
৩.
অন্য দেশ যে পেরেছে, তার অন্যতম কারণ চিকিৎসকদের পেশাদারি আর দায়িত্বশীলতা। এগুলো নিশ্চিত করা যায় পেশাজীবীদের কাজের জবাবদিহি নির্ধারণ করে দিয়ে। অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশে এই জবাবদিহি বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের। চিকিৎসকদের জন্য এ প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে ১৯৮০ সালের মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল অ্যাক্ট (পরে ২০১০ সালে সংশোধিত) অনুসারে গঠিত মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল। কাউন্সিল প্রণীত কোড অব মেডিকেল এথিক্স-এ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ পেশাদারি, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এর ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে কোনো রোগীর প্রতি কর্তব্যকর্মে অবহেলার জন্য চিকিৎসক হিসেবে নিবন্ধন বাতিলের বিধান রয়েছে। অনিবন্ধিত কোনো চিকিৎসককে চিকিৎসা করতে দিলে জড়িতদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কর্তব্যকর্মে অবহেলার জন্য চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে, এমন ঘটনা খুব বিরল বাংলাদেশে। এ কাজটি যথাযথভাবে করার জন্য যে তদারকি ক্ষমতা, দক্ষতা ও কাঠামো প্রয়োজন, তা পর্যাপ্তভাবে নেই কাউন্সিলের। তা ছাড়া এর তদন্ত কমিটিতে চিকিৎসকদের বাইরে কেউ থাকেন না বলে তদন্ত অনেক সময় সুষ্ঠুভাবে হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। আমার পরিচিত কিছু চিকিৎসক জানিয়েছেন, কাউন্সিল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এত দুর্বল যে বহু চিকিৎসক এতে নিবন্ধনের তোয়াক্কা না করে বা নিবন্ধন নবায়ন না করে অবাধে কাজ করে যাচ্ছেন অনেক বছর ধরে। ভুয়া চিকিৎসক, কর্তব্যকর্মে গুরুতর অবহেলা, আইন লঙ্ঘনের ঘটনা কাউন্সিলের নজরে পড়ে কেবল পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখির পর। এর পরিচিতি এত সীমাবদ্ধ যে রোগীদের প্রায় কারোরই এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর সুযোগ আছে, তা জানা নেই।
এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরকারি হাসপাতালগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি চাকরিবিধিসহ বিভিন্ন আইন রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালের জন্য রয়েছে ১৯৮২ সালের মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স। এসব আইনের অধীনে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা যা-ও আছে, তা শিথিল হয়ে পড়েছে দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব আর অনৈতিক স্বার্থচক্রের কারণে।
বাকি থাকে হাসপাতালের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা। এটিও অদক্ষ এবং অকার্যকর, অনেক ক্ষেত্রে এমনকি অস্তিত্বহীন। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ডা. রুবাইয়ুল মোর্শেদ আমার বহু দিনের পরিচিত। তিনি প্রায়ই বলেন, এ দেশে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। তাঁর ভাষায়, এ দেশে চিকিৎসক আছে, চিকিৎসা নেই; চিকিৎসা সরঞ্জাম আছে, তার কোনো রক্ষণাবেক্ষণ নেই; ওষুধ আছে, তার কোনো সুষ্ঠু ব্যবহার নেই। নানা কারণে আরও কিছু ভালো ও দায়িত্ববান চিকিৎসককে চিনি আমি। তাঁদের অনেকের আক্ষেপ একই ধরনের।
৪.
ঝুমুরের মা তাহলে কোথায় যাবেন? তিনি বিচার চান। ফৌজদারি আইনের ৩০৪(এ) ধারায় কারও অবহেলায় অন্য কারও মৃত্যু হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। আমার জানামতে, নিকট অতীতে কোনো চিকিৎসক এ ধারায় কারাদণ্ডে দণ্ডিত হননি। দরিদ্র মানুষের পক্ষে তো দূরের কথা, অবস্থাবান কারও পক্ষেও ব্যয়বহুল ও অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ বিচার-প্রক্রিয়ায় আগ্রহী হওয়ার কথা না এসব ক্ষেত্রে।
ঝুমুরের মায়েদের জন্য আসলে তাই কোনো প্রতিকার নেই। তাঁরাই আমাদের দেশের সাধারণ নাগরিক। চিকিৎসা আমাদের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা হিসেবে স্বীকৃত। সংবিধান অনুসারে এটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন দূরের কথা, এ নিয়ে আমরা কোনো দিন কি আমাদের জনপ্রতিনিধিদেরই দেখেছি সংসদে সোচ্চার হতে?
No comments