সহজিয়া কড়চা-বাঙালি—দাস ও দ্রোহী by সৈয়দ আবুল মকসুদ
একেক কালে একেক গোত্রকে গাল খেতে হয়। যাদের ধনবল কম, জনবল কম, বাহুবল কম, তারাই গাল খায়। চোখ লাল করে, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে গাল পাড়ে যারা, তারা প্রবল ক্ষমতাশালী। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করায় মুসলিম লীগ সরকারের কেউ কেউ বলতে লাগলেন, ওসব নীলক্ষেত ব্যারাকের কিছু ‘মিসকিনের’ কাজ।
ওরা পাকিস্তানের সংহতি নষ্ট করতে চায়। পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। বাংলা হলো হিন্দুদের ভাষা। ওটা পাকিস্তানে চলবে না। ওর হরফগুলোও দেখতে অবিকল সংস্কৃতির মতো। নীলক্ষেতের মিসকিনদের কেউ মেডিকেল ব্যারাকের কাছে রক্ত দিলেন। বিপুলসংখ্যক অতিথি হলেন গিয়ে নাজিমউদ্দিন রোডের প্রকাণ্ড পাঁচিলঘেরা বাড়িটিতে।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পাকিস্তানকে যখন তার শাসকেরা ইঙ্গো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে বন্ধক দিচ্ছিলেন, তখন মওলানা ভাসানী, খান আবদুল গাফফার খান প্রমুখ গঠন করেন একটি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল: ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (সংক্ষেপে ন্যাপ)। এবার দুই লীগের নেতারাই সমস্বরে বললেন, এই দলের নেতারা হলেন পাকিস্তানের ‘রাজনৈতিক এতিম’। তাঁরা ‘ভারতের দালাল’। তাঁদের দল ন্যাপ হলো ‘নেহরু এইডেড পার্টি’। সেদিন যাঁরা এসব কথা বলেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই ছাব্বিশে মার্চ রাত পোহানোর আগেই ভারতের সীমান্ত বরাবর গিয়ে লাইন দেন।
এরপর যাই উনিশ শ ছেষট্টিতে। লাহোর সম্মেলনে উত্থাপিত হলো একটি ছয় দফা দাবিনামা। উত্থাপনকারী শেখ মুজিবুর রহমান। কেন্দ্র ও প্রদেশের দুই খান সাহেবই একবাক্যে বললেন: ওটা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র। শেখ মুজিব ষড়যন্ত্রকারী, এক নম্বর রাষ্ট্রদ্রোহী। তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলাব। যাঁরা বললেন, তাঁদের চেয়ে বেশি দেশপ্রেমিক পাকওয়াতানে আর কেউ আছে, তা স্বীকার করতে তাঁরা নারাজ।
তারপর একাত্তর। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হিংস্র এক সেনাবাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিরোধ গড়ে তুললেন, তাঁদের ইয়াহিয়া, টিক্কা, ফরমানরা নাম দিলেন ‘কতিপয় দুষ্কৃতকারী’। সেদিনের সেই দুষ্কৃতকারীদের জন্যই আজ আমরা একটি সংবিধান পেয়েছি এবং ১৪টি সংশোধনীও এনেছি। ১৫ নম্বরটি কয়েক দিনের মধ্যেই পেতে যাচ্ছি। ওই দুষ্কৃতকারীদের কারণেই অনেকে জ্ঞানপীঠ ত্যাগ করে রাজনীতির পিঠে সওয়ার হয়ে প্রতিমন্ত্রী পর্যন্ত হতে পেরেছেন।
গণতান্ত্রিক সমাজে ও রাষ্ট্রে নাগরিকেরা ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার রাখে। সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। সমর্থন করার অধিকার তো রয়েছেই। কেউ সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা বা বিরোধিতা করলে তাকেও নিন্দা ও প্রতিবাদ করার অধিকার সরকারপক্ষের কারও আছে। কিন্তু বিরোধিতাকারীদের বাপ-মায়ের দেওয়া নামটা বিকৃত করার অভদ্রতা কোনো পদমর্যাদারই কারও নেই। প্রত্যেক প্রতিমন্ত্রীকে শপথ নিতে হয়। সেখানে ‘রাগ বিরাগের বশবর্তী’ না হওয়ার অঙ্গীকার থাকে। যেকোনো রকম শপথ ভঙ্গ করা জঘন্য অপরাধ।
কোনো কোনো মানুষের জীবনে দৈবক্রমে এমন সময় কখনো আসে যখন সে মনে করে—‘কি হনু রে’। তাই যার নাম আনু, তাকে মনে করেন ‘মানু’। আনুকে মানু, কানু, ঝানু যেকোনো নামেই যদি কেউ ডাকেন, কার কী করার আছে? তবে নিজের পরিবারের সদস্যদের সামনে ওই সব নামে ডাকা এক কথা আর সংসদকক্ষ উত্তাল করা আর এক কথা। ভেংচি কাটা আর এক কথা। বাড়ির ড্রয়িংরুম আর সংসদকক্ষ এক জিনিস নয়। দ্বিতীয়টি খুবই ব্যয়বহুল জায়গা। ওখানে এক মিনিট কথা বললে অনেক টাকা খরচ হয়। ওই টাকা জনগণ দেয়, কোনো রাজনৈতিক দল নয়।
অপরকে অপমান করার স্পৃহা ও প্রতিভা বাঙালির অপার। প্রতিপক্ষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মধ্যে তার আনন্দ অশেষ। যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ান, তিনি সমুদ্রবক্ষে তেল-গ্যাসের চুক্তি সম্পর্কে কিছুই বোঝেন না—এ কথা বাংলাদেশের কোনো নিরক্ষরও বিশ্বাস করবেন না। গত আড়াই বছরে বাংলাদেশের বন ও পরিবেশের ক্ষেত্রে যে বিপর্যয় ঘটেছে, সে সম্পর্কেই অর্থনীতির অধ্যাপকদের আন্দোলনে নামা উচিত ছিল। তা না করে তাঁরা সমুদ্রের স্বচ্ছ পানি ঘোলা করছেন। অধ্যাপক ও ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বুঝতে পারেননি, সমুদ্রের পানি বেশি ঘোলা করতে গেলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওখানে হাঙর, তিমি ও অক্টোপাস আছে।
কোনো এনজিওর কর্তা হিসেবে নয়, নিজের গরজেই ২০-২২ বছর ধরে বাংলাদেশের পরিবেশ, নদনদী, গাছপালা, ফলমূল ও খাবারে বিষ প্রভৃতি নিয়ে কিঞ্চিৎ কাজ করছি। ভারতের পরিবেশমন্ত্রী হিসেবে মানেকা গান্ধীকে দিল্লি বা কমল নাথকে কলকাতায় কাজ করতে দেখেছি। পরিবেশ ও জলবায়ুসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গিয়ে আমাদের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদল কী ভূমিকাটা পালন করে, তার দু-একটি ভিডিও কেউ আমাকে দেখিয়েছেন। আমাদের সমস্যাটা কী, তা সমাধানে কী করতে হবে এবং তার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের কী চাওয়ার আছে, তা পরিষ্কার করে ইংরেজিতে বোঝানোর ক্ষমতা বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতাদের নেই। ঢাকায় স্ক্যানডিনেভিয়ান এক দেশের এক কর্মকর্তা এ রকমই অভিযোগ করলেন।
দেশ-বিদেশ ঘুরে বড় বড় হোটেলে অবস্থান করে দেশের সেবা করা এক কথা, আর দেশের মধ্যে রোদ-বৃষ্টিতে জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলন করা আরেক কথা। ওই আন্দোলন যাঁরা করেন তাঁরা বিশাল বিত্তের মালিক নন। তাঁদের যুক্তরাজ্য, আমেরিকা বা কানাডায় বাড়িঘর ধনসম্পদ নেই। তবে তাঁদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান ‘টোকাইদের’ চেয়ে ভালো। অবশ্য বাংলাদেশের নন-ফরমাল অর্থনীতিতে বহু টোকাইয়ের অবদানও বহু বিখ্যাতর চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের তেল-গ্যাস নিয়ে যাঁরা আন্দোলন করেন তাঁদের যখন টোকাই বলা হয় পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে, তাতে তাঁদের মন খারাপ করার কারণ নেই। কারণ, অর্থনৈতিক বিবেচনায় বহু প্রতিমন্ত্রীর তুলনায় তাঁরা টোকাইই বটে।
টোকাইরা অতি নিরীহ প্রাণী। গায়ের জোর বলতে কিছুই তাদের নেই। জোর যেটুকু তা আছে গলায়। কিন্তু যখন দেখি সেই গুটিকয় নিরীহ প্রাণীকেও রাষ্ট্রযন্ত্র ভয় করছে, তখন রাষ্ট্রটির জন্যই করুণা হয়। চল্লিশ বছরের সেরা চুক্তিটি স্বাক্ষরের আগে প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয় কমিটির এক মানববন্ধন ছিল। ওই দিনই জাদুঘরের সামনে ছিল আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের এক মানববন্ধন কল্পনা চাকমার অপহরণের বার্ষিকী উপলক্ষে। জাদুঘরের সামনে মানববন্ধনে অংশ নিয়ে আমি আর আমাদের বন্ধু সাংবাদিক সেলিম সামাদ প্রেসক্লাবের সামনের মানববন্ধনে যোগ দিতে যাই। গিয়ে তাজ্জব হলাম।
কয়েকজন মানুষ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চুক্তির বিরোধিতা করে বক্তৃতা দিচ্ছেন। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীর চেয়ে পুলিশের সংখ্যা চার গুণ। গোটা তোপখানা এলাকায় পুলিশ। তার চেয়েও মজার ব্যাপার, প্রকাণ্ড এক জলকামান প্রেসক্লাবের ফটকে। সে কামানের নল তাক করা তেল-গ্যাসের লোকদের দিকে।
যেদিন চুক্তি স্বাক্ষর হয়, সেদিন বাংলাদেশের তাপমাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। অসহ্য গুমোট। সবাই ঘেমে ভিজে গেছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা সৌজন্যবশত সালাম দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁকে ঠাট্টা করে বললাম, কামান থেকে পানি যদি মারেনই, ঠান্ডা পানি ছিটাবেন। যে গরম।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা সরকারের অবশ্যদায়িত্ব। কিন্তু হাস্যকর মনে হয় তখনই যখন দেখি যে সমাবেশে জনা চারেক আনসার রাখাই যথেষ্ট, সেখানে বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন। চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক দিন আগে জাতীয় কমিটির এক মিছিলে বিনা উসকানিতে কোনো এক দৈব নির্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা রেহনুমা আহমেদের মাথা ইটের আঘাতে এমনভাবে ফাটানো হয় যে তাঁর পুরো শরীর ভিজে যায় রক্তে। আহত হন আরও কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে নারীও রয়েছেন।
বাংলাদেশে সরকারের সমালোচনা করা যত সহজ, সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্টদের সমালোচনা করা তত সহজ নয়। ওতে প্রগতিশীলতা থাকে না। নারীর অধিকার, নারীর মর্যাদা প্রভৃতি শব্দ প্রতি মিনিটে বাংলাদেশে যতবার উচ্চারিত হয়, সারা দুনিয়ায় এক মাসেও তা হয় না। বাংলাদেশে নারীর ক্যাটাগরি আছে। মোশরেফা মিশু, রেহনুমা আহমেদ, পোশাকশিল্পের মেয়েরা বা সড়কের পাশে ইট ভাঙে বা খাদের মধ্যে মাটি কাটে যে নারী, তারা নারী নয়। রেহনুমা সাম্রাজ্যবাদীদের উচ্ছিষ্টভোগী নন। সুতরাং তাঁর মাথা ফাটলে কিছু যায় আসে না। রেহনুমা ছাড়া আর কারও মাথা ফাটা তো দূরের কথা পুলিশ একটা খোঁচা দিলে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, অনশন প্রভৃতির চোটে জনগণ চোখে ধুলা দেখত। সম্পাদকীয় ও তার পাশের পাতায় প্রকাশিত হতো রাশি রাশি রচনা।
একজন টোকাইয়ের যতটা দেশপ্রেম আছে, আমার দেশপ্রেম তার চেয়ে বেশি—এমন হাস্যকর দাবি করতে পারি না। কয়েক বছর আগে কানাডার এক নির্বাচনের সময় এক নেতা তাঁর প্রতিপক্ষের দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করলে তুলকালাম কাণ্ড বেধে যায়। তাঁকে করজোড়ে জাতির সামনে মাফ চাইতে হয়। আমাদের দেশের অবস্থা ভিন্ন। এখানে প্রতিপক্ষকে আজেবাজে গালাগাল করলেও কিছু যায় আসে না। তবে দেশপ্রেম শুধু সরকারি লোকদের বুকের খাঁচায় জমা আছে, আর কারও মধ্যে বিশেষ নেই—এ কথা মানতে পারি না।
জনগণ তার দেশপ্রেমের কথা মুখ দিয়ে বলে না, ও নিয়ে তারা ভাবেও না, কিন্তু দেশের স্বার্থটা নিয়ে তারা ভাবিত। তারা যত জ্ঞানগম্যশূন্য মানুষই হোক, একটা বিচারবোধ তাদের মধ্যে আছে এবং তা দিয়ে তারা মাপতে পারে—কোন মানুষগুলো দেশের স্বার্থে কাজ করছে আর কারা নিজের স্বার্থে বিদেশি প্রভুর ভৃত্যের কাজ করছে।
এই যে তেল-গ্যাস, কয়লা প্রভৃতির ব্যাপারে নানা রকম চুক্তির মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে, এসব ব্যাপারে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করছি, জনগণের আবেগ-অনুভূতি তুলে ধরার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা রহস্যময় নীরবতা অবলম্বন করেছেন। মিডিয়ার একটি অংশ কোন পক্ষ অবলম্বন করছে, তা বোঝার মতো সাবালকত্ব বাংলার মানুষ অর্জন করেছে। সংবাদমাধ্যমের তরুণ সাংবাদিকদের একটি বড় অংশ যাঁরা কোনো বিদেশি শক্তির কাছে নিজেদের বিক্রি করেননি, তাঁরা আড়ালে আমাকে বলেন, স্যার, দেশের জন্য তো কিছু করতে পারছি না। ওদের অসহায় দেশপ্রেমের কাছে মাথা নত করি। নিজেকে ধিক্কার দিই। চল্লিশ বছরে কিছুই করতে পারিনি। ওদের কেউ কেউ একদিন পারবেন।
বাংলার মানুষ অসাংবিধানিক স্বৈরশাসনকে ঘৃণা করে, সাংবিধানিক স্বৈরাচারকে অপছন্দ করে, গণতান্ত্রিক শাসনটাই তারা চায়। আমরা ষাট, সত্তর ও আশির দশকে—সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পূর্ব পর্যন্ত—দেশে দেশে সামরিক শাসকদের দেখেছি। কেউ মার্কিনপন্থী, কেউ রুশপন্থী। এককেন্দ্রিক নতুন বিশ্বব্যবস্থায় আর এক নতুন শাসকশ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে। তাঁরা হলেন ইরাকে নূরি আল মালিকি, আফগানিস্তানে হামিদ কারজাই এবং পাকিস্তানে আসিফ আলী জারদারি। মালিকি-কারজাই-জারদারিবাদীদের অনুসারী মানুষের সংখ্যা আমাদের মধ্যশ্রেণীর নাগরিক সমাজের মধ্যেও আজ ক্রমবর্ধমান। গভীর হতাশার কারণ সেখানেই।
তার পরও সব হতাশারও একটা শেষ আছে। সেখান থেকে আশাবাদের শুরু। বাংলাদেশ ইরাক নয়, আফগানিস্তান নয়, পাকিস্তান নয়। বাংলার মানুষের রাজনৈতিক ঐতিহ্য বিরাট ও দীর্ঘ। তিতুমীর, সুভাষ বসু, সূর্য সেনদের কথা সবাই জানেন। একেবারে হালে এ দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ভাসানী-মুজিবের মতো নেতা। তবে চিরকালই বাংলার মাটিতে দাস ও দ্রোহী সহ-অবস্থান করে। জনস্বার্থে ও ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করা দ্রোহীদের জয়—যত দেরিতেই হোক—অবশ্যম্ভাবী।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পাকিস্তানকে যখন তার শাসকেরা ইঙ্গো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে বন্ধক দিচ্ছিলেন, তখন মওলানা ভাসানী, খান আবদুল গাফফার খান প্রমুখ গঠন করেন একটি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল: ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (সংক্ষেপে ন্যাপ)। এবার দুই লীগের নেতারাই সমস্বরে বললেন, এই দলের নেতারা হলেন পাকিস্তানের ‘রাজনৈতিক এতিম’। তাঁরা ‘ভারতের দালাল’। তাঁদের দল ন্যাপ হলো ‘নেহরু এইডেড পার্টি’। সেদিন যাঁরা এসব কথা বলেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই ছাব্বিশে মার্চ রাত পোহানোর আগেই ভারতের সীমান্ত বরাবর গিয়ে লাইন দেন।
এরপর যাই উনিশ শ ছেষট্টিতে। লাহোর সম্মেলনে উত্থাপিত হলো একটি ছয় দফা দাবিনামা। উত্থাপনকারী শেখ মুজিবুর রহমান। কেন্দ্র ও প্রদেশের দুই খান সাহেবই একবাক্যে বললেন: ওটা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র। শেখ মুজিব ষড়যন্ত্রকারী, এক নম্বর রাষ্ট্রদ্রোহী। তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলাব। যাঁরা বললেন, তাঁদের চেয়ে বেশি দেশপ্রেমিক পাকওয়াতানে আর কেউ আছে, তা স্বীকার করতে তাঁরা নারাজ।
তারপর একাত্তর। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হিংস্র এক সেনাবাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিরোধ গড়ে তুললেন, তাঁদের ইয়াহিয়া, টিক্কা, ফরমানরা নাম দিলেন ‘কতিপয় দুষ্কৃতকারী’। সেদিনের সেই দুষ্কৃতকারীদের জন্যই আজ আমরা একটি সংবিধান পেয়েছি এবং ১৪টি সংশোধনীও এনেছি। ১৫ নম্বরটি কয়েক দিনের মধ্যেই পেতে যাচ্ছি। ওই দুষ্কৃতকারীদের কারণেই অনেকে জ্ঞানপীঠ ত্যাগ করে রাজনীতির পিঠে সওয়ার হয়ে প্রতিমন্ত্রী পর্যন্ত হতে পেরেছেন।
গণতান্ত্রিক সমাজে ও রাষ্ট্রে নাগরিকেরা ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার রাখে। সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। সমর্থন করার অধিকার তো রয়েছেই। কেউ সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা বা বিরোধিতা করলে তাকেও নিন্দা ও প্রতিবাদ করার অধিকার সরকারপক্ষের কারও আছে। কিন্তু বিরোধিতাকারীদের বাপ-মায়ের দেওয়া নামটা বিকৃত করার অভদ্রতা কোনো পদমর্যাদারই কারও নেই। প্রত্যেক প্রতিমন্ত্রীকে শপথ নিতে হয়। সেখানে ‘রাগ বিরাগের বশবর্তী’ না হওয়ার অঙ্গীকার থাকে। যেকোনো রকম শপথ ভঙ্গ করা জঘন্য অপরাধ।
কোনো কোনো মানুষের জীবনে দৈবক্রমে এমন সময় কখনো আসে যখন সে মনে করে—‘কি হনু রে’। তাই যার নাম আনু, তাকে মনে করেন ‘মানু’। আনুকে মানু, কানু, ঝানু যেকোনো নামেই যদি কেউ ডাকেন, কার কী করার আছে? তবে নিজের পরিবারের সদস্যদের সামনে ওই সব নামে ডাকা এক কথা আর সংসদকক্ষ উত্তাল করা আর এক কথা। ভেংচি কাটা আর এক কথা। বাড়ির ড্রয়িংরুম আর সংসদকক্ষ এক জিনিস নয়। দ্বিতীয়টি খুবই ব্যয়বহুল জায়গা। ওখানে এক মিনিট কথা বললে অনেক টাকা খরচ হয়। ওই টাকা জনগণ দেয়, কোনো রাজনৈতিক দল নয়।
অপরকে অপমান করার স্পৃহা ও প্রতিভা বাঙালির অপার। প্রতিপক্ষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মধ্যে তার আনন্দ অশেষ। যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ান, তিনি সমুদ্রবক্ষে তেল-গ্যাসের চুক্তি সম্পর্কে কিছুই বোঝেন না—এ কথা বাংলাদেশের কোনো নিরক্ষরও বিশ্বাস করবেন না। গত আড়াই বছরে বাংলাদেশের বন ও পরিবেশের ক্ষেত্রে যে বিপর্যয় ঘটেছে, সে সম্পর্কেই অর্থনীতির অধ্যাপকদের আন্দোলনে নামা উচিত ছিল। তা না করে তাঁরা সমুদ্রের স্বচ্ছ পানি ঘোলা করছেন। অধ্যাপক ও ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বুঝতে পারেননি, সমুদ্রের পানি বেশি ঘোলা করতে গেলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওখানে হাঙর, তিমি ও অক্টোপাস আছে।
কোনো এনজিওর কর্তা হিসেবে নয়, নিজের গরজেই ২০-২২ বছর ধরে বাংলাদেশের পরিবেশ, নদনদী, গাছপালা, ফলমূল ও খাবারে বিষ প্রভৃতি নিয়ে কিঞ্চিৎ কাজ করছি। ভারতের পরিবেশমন্ত্রী হিসেবে মানেকা গান্ধীকে দিল্লি বা কমল নাথকে কলকাতায় কাজ করতে দেখেছি। পরিবেশ ও জলবায়ুসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গিয়ে আমাদের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদল কী ভূমিকাটা পালন করে, তার দু-একটি ভিডিও কেউ আমাকে দেখিয়েছেন। আমাদের সমস্যাটা কী, তা সমাধানে কী করতে হবে এবং তার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের কী চাওয়ার আছে, তা পরিষ্কার করে ইংরেজিতে বোঝানোর ক্ষমতা বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতাদের নেই। ঢাকায় স্ক্যানডিনেভিয়ান এক দেশের এক কর্মকর্তা এ রকমই অভিযোগ করলেন।
দেশ-বিদেশ ঘুরে বড় বড় হোটেলে অবস্থান করে দেশের সেবা করা এক কথা, আর দেশের মধ্যে রোদ-বৃষ্টিতে জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলন করা আরেক কথা। ওই আন্দোলন যাঁরা করেন তাঁরা বিশাল বিত্তের মালিক নন। তাঁদের যুক্তরাজ্য, আমেরিকা বা কানাডায় বাড়িঘর ধনসম্পদ নেই। তবে তাঁদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান ‘টোকাইদের’ চেয়ে ভালো। অবশ্য বাংলাদেশের নন-ফরমাল অর্থনীতিতে বহু টোকাইয়ের অবদানও বহু বিখ্যাতর চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের তেল-গ্যাস নিয়ে যাঁরা আন্দোলন করেন তাঁদের যখন টোকাই বলা হয় পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে, তাতে তাঁদের মন খারাপ করার কারণ নেই। কারণ, অর্থনৈতিক বিবেচনায় বহু প্রতিমন্ত্রীর তুলনায় তাঁরা টোকাইই বটে।
টোকাইরা অতি নিরীহ প্রাণী। গায়ের জোর বলতে কিছুই তাদের নেই। জোর যেটুকু তা আছে গলায়। কিন্তু যখন দেখি সেই গুটিকয় নিরীহ প্রাণীকেও রাষ্ট্রযন্ত্র ভয় করছে, তখন রাষ্ট্রটির জন্যই করুণা হয়। চল্লিশ বছরের সেরা চুক্তিটি স্বাক্ষরের আগে প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয় কমিটির এক মানববন্ধন ছিল। ওই দিনই জাদুঘরের সামনে ছিল আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের এক মানববন্ধন কল্পনা চাকমার অপহরণের বার্ষিকী উপলক্ষে। জাদুঘরের সামনে মানববন্ধনে অংশ নিয়ে আমি আর আমাদের বন্ধু সাংবাদিক সেলিম সামাদ প্রেসক্লাবের সামনের মানববন্ধনে যোগ দিতে যাই। গিয়ে তাজ্জব হলাম।
কয়েকজন মানুষ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চুক্তির বিরোধিতা করে বক্তৃতা দিচ্ছেন। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীর চেয়ে পুলিশের সংখ্যা চার গুণ। গোটা তোপখানা এলাকায় পুলিশ। তার চেয়েও মজার ব্যাপার, প্রকাণ্ড এক জলকামান প্রেসক্লাবের ফটকে। সে কামানের নল তাক করা তেল-গ্যাসের লোকদের দিকে।
যেদিন চুক্তি স্বাক্ষর হয়, সেদিন বাংলাদেশের তাপমাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। অসহ্য গুমোট। সবাই ঘেমে ভিজে গেছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা সৌজন্যবশত সালাম দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁকে ঠাট্টা করে বললাম, কামান থেকে পানি যদি মারেনই, ঠান্ডা পানি ছিটাবেন। যে গরম।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা সরকারের অবশ্যদায়িত্ব। কিন্তু হাস্যকর মনে হয় তখনই যখন দেখি যে সমাবেশে জনা চারেক আনসার রাখাই যথেষ্ট, সেখানে বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন। চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক দিন আগে জাতীয় কমিটির এক মিছিলে বিনা উসকানিতে কোনো এক দৈব নির্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা রেহনুমা আহমেদের মাথা ইটের আঘাতে এমনভাবে ফাটানো হয় যে তাঁর পুরো শরীর ভিজে যায় রক্তে। আহত হন আরও কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে নারীও রয়েছেন।
বাংলাদেশে সরকারের সমালোচনা করা যত সহজ, সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্টদের সমালোচনা করা তত সহজ নয়। ওতে প্রগতিশীলতা থাকে না। নারীর অধিকার, নারীর মর্যাদা প্রভৃতি শব্দ প্রতি মিনিটে বাংলাদেশে যতবার উচ্চারিত হয়, সারা দুনিয়ায় এক মাসেও তা হয় না। বাংলাদেশে নারীর ক্যাটাগরি আছে। মোশরেফা মিশু, রেহনুমা আহমেদ, পোশাকশিল্পের মেয়েরা বা সড়কের পাশে ইট ভাঙে বা খাদের মধ্যে মাটি কাটে যে নারী, তারা নারী নয়। রেহনুমা সাম্রাজ্যবাদীদের উচ্ছিষ্টভোগী নন। সুতরাং তাঁর মাথা ফাটলে কিছু যায় আসে না। রেহনুমা ছাড়া আর কারও মাথা ফাটা তো দূরের কথা পুলিশ একটা খোঁচা দিলে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, অনশন প্রভৃতির চোটে জনগণ চোখে ধুলা দেখত। সম্পাদকীয় ও তার পাশের পাতায় প্রকাশিত হতো রাশি রাশি রচনা।
একজন টোকাইয়ের যতটা দেশপ্রেম আছে, আমার দেশপ্রেম তার চেয়ে বেশি—এমন হাস্যকর দাবি করতে পারি না। কয়েক বছর আগে কানাডার এক নির্বাচনের সময় এক নেতা তাঁর প্রতিপক্ষের দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করলে তুলকালাম কাণ্ড বেধে যায়। তাঁকে করজোড়ে জাতির সামনে মাফ চাইতে হয়। আমাদের দেশের অবস্থা ভিন্ন। এখানে প্রতিপক্ষকে আজেবাজে গালাগাল করলেও কিছু যায় আসে না। তবে দেশপ্রেম শুধু সরকারি লোকদের বুকের খাঁচায় জমা আছে, আর কারও মধ্যে বিশেষ নেই—এ কথা মানতে পারি না।
জনগণ তার দেশপ্রেমের কথা মুখ দিয়ে বলে না, ও নিয়ে তারা ভাবেও না, কিন্তু দেশের স্বার্থটা নিয়ে তারা ভাবিত। তারা যত জ্ঞানগম্যশূন্য মানুষই হোক, একটা বিচারবোধ তাদের মধ্যে আছে এবং তা দিয়ে তারা মাপতে পারে—কোন মানুষগুলো দেশের স্বার্থে কাজ করছে আর কারা নিজের স্বার্থে বিদেশি প্রভুর ভৃত্যের কাজ করছে।
এই যে তেল-গ্যাস, কয়লা প্রভৃতির ব্যাপারে নানা রকম চুক্তির মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে, এসব ব্যাপারে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করছি, জনগণের আবেগ-অনুভূতি তুলে ধরার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা রহস্যময় নীরবতা অবলম্বন করেছেন। মিডিয়ার একটি অংশ কোন পক্ষ অবলম্বন করছে, তা বোঝার মতো সাবালকত্ব বাংলার মানুষ অর্জন করেছে। সংবাদমাধ্যমের তরুণ সাংবাদিকদের একটি বড় অংশ যাঁরা কোনো বিদেশি শক্তির কাছে নিজেদের বিক্রি করেননি, তাঁরা আড়ালে আমাকে বলেন, স্যার, দেশের জন্য তো কিছু করতে পারছি না। ওদের অসহায় দেশপ্রেমের কাছে মাথা নত করি। নিজেকে ধিক্কার দিই। চল্লিশ বছরে কিছুই করতে পারিনি। ওদের কেউ কেউ একদিন পারবেন।
বাংলার মানুষ অসাংবিধানিক স্বৈরশাসনকে ঘৃণা করে, সাংবিধানিক স্বৈরাচারকে অপছন্দ করে, গণতান্ত্রিক শাসনটাই তারা চায়। আমরা ষাট, সত্তর ও আশির দশকে—সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পূর্ব পর্যন্ত—দেশে দেশে সামরিক শাসকদের দেখেছি। কেউ মার্কিনপন্থী, কেউ রুশপন্থী। এককেন্দ্রিক নতুন বিশ্বব্যবস্থায় আর এক নতুন শাসকশ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে। তাঁরা হলেন ইরাকে নূরি আল মালিকি, আফগানিস্তানে হামিদ কারজাই এবং পাকিস্তানে আসিফ আলী জারদারি। মালিকি-কারজাই-জারদারিবাদীদের অনুসারী মানুষের সংখ্যা আমাদের মধ্যশ্রেণীর নাগরিক সমাজের মধ্যেও আজ ক্রমবর্ধমান। গভীর হতাশার কারণ সেখানেই।
তার পরও সব হতাশারও একটা শেষ আছে। সেখান থেকে আশাবাদের শুরু। বাংলাদেশ ইরাক নয়, আফগানিস্তান নয়, পাকিস্তান নয়। বাংলার মানুষের রাজনৈতিক ঐতিহ্য বিরাট ও দীর্ঘ। তিতুমীর, সুভাষ বসু, সূর্য সেনদের কথা সবাই জানেন। একেবারে হালে এ দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ভাসানী-মুজিবের মতো নেতা। তবে চিরকালই বাংলার মাটিতে দাস ও দ্রোহী সহ-অবস্থান করে। জনস্বার্থে ও ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করা দ্রোহীদের জয়—যত দেরিতেই হোক—অবশ্যম্ভাবী।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments