গোধূলির ছায়াপথে-সবচেয়ে সুন্দর গ্রামের ছবি by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
এক ভদ্রলোক এসেছেন আমেরিকার ডালাস থেকে। মা-বাবা বাঙালি, সাতচল্লিশের আগেই চলে গেছেন আমেরিকায়। ছেলেটির বয়স ৩৫। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়ান। সে বাংলা বলতে পারে, লিখতে নয়। সে শুনেছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ বাংলাদেশ। দেখতে চায় সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম।
শ্রীমঙ্গলের পাহাড়ের ঢালুতে একটি গ্রাম। সবুজ আর অক্সিজেনে ভরা, ওখানকার সবচেয়ে সুন্দর ধামাইল গান ও ধামাইল নাচ, যার একটি সেন্টারও আছে। বলল, আমেরিকার সবকিছু দেখা হয়ে গেছে। স্বীকার করল, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর যতগুলো জায়গা আছে, তার মধ্যে প্রথম শ্রীমঙ্গল। জিজ্ঞেস করলাম কেন। এককথায় উত্তর দিল, পৃথিবীর কোনো গ্রামে ধামাইলের মতো সুন্দর নাচ নেই, সুন্দর গান নেই। অথচ বাংলাদেশেই অনেকে ধামাইল চেনেন না। গুরুসদয় দত্ত বাংলার লোকনৃত্য ও লোকসংগীতের খোঁজে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়ে অবশেষে বলেছেন, বাংলার ব্রতনৃত্য, ব্রতসংগীতের মতো এত সাবলীল, এত হূদয়গ্রাহী আর কোনো গান হয় না। আনন্দের কথা, ধামাইল নাচ এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে একটি সংস্থা। তারা আমাকে লিখেছেন, ‘আপনি তো আমাদের লোক। কই, আমাদের কথা তো কোনো দিন লেখেননি।’
আগেও বলেছি, এখনো বলছি, ধামাইল নাচ ও গানের আন্দোলনে পল্লিবাংলা নেচে ওঠে। কয়েকটি মেয়ে একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে তালে তালে গেয়ে ওঠে এই গান। এই গান ও নাচ আমি ৩০ বছর ধরে টেলিভিশনে দেখিয়ে এসেছি। বলেছি, এগুলো হিন্দু রমণীর গান, ওরা চলে গেলে এই গান আর কেউ গাইবে না। আমার দেখে ভালো লাগছে যে সুমনকুমার দাশ সবশুদ্ধ ৬৬৩টি গান সংগ্রহ করে ছাপিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের ধামাইল গান নামের বইয়ে। বন্দনা, গৌররূপ, বাঁশি পর্যায়ের ২৪৩টি গান, জলভরা পর্যায়ে ৮০টি গান, জামাইস্নান, কন্যা সাজানো ও বোঝানো পর্যায়ে ১৪০টি গান এবং অন্যান্য পর্যায়ে আরও ২০০টি ছাপিয়ে দিয়েছেন, যা আর কোনো দিনই হারিয়ে যাবে না। কৃষ্ণ, রাধা, বসুদেব, দেবকি, ব্রহ্মা, অদ্বৈত, শ্রীহরি, চন্দ্রধর, রামকৃষ্ণ, দ্রৌপদী, নন্দ, যশোদা, চন্দ্রাবলী, রাম, সীতা, হনুমান, কংস—এঁরা সবাই আছেন। পর্ববিন্যাস ১৬ রকমের। এ আসরে যাঁরা একবার গেছেন, তাঁরা সেখানে বারবার যাবেন। কারণ, সোজা-সরল সুর, গাওয়ার ভঙ্গি সহজ এবং গল্পগুলো মনকাড়া।
‘আইলা না আইলা না প্রেমের নগরে/ মোমের দীপ জ্বালাইয়া পোহাই সারারাতিরে’। মুসলমান গীদাল লিখছেন: ‘উচাটন করে যেন আমার মনে/ আবদুল আজিজে কয় রাইত পোহাইল/ আইল না বন্ধু শ্যামরায়রে’।
বিচ্ছেদি গানের কথা বলা হয়েছে অনেক। ধামাইল বিচ্ছেদির মূল ঘাঁটি। রাধা কুঞ্জ সাজিয়ে প্রাণপুরুষ কৃষ্ণের জন্য বসে থাকেন। নাম: ‘কুঞ্জ সাজানো গান’। ‘স্বপন’ গানগুলো কৃষ্ণের স্বপনের গান। কৃষ্ণ না থাকলে কী হবে, তার স্বপ্ন আছে। ব্যাকুল রাধা চোখ বন্ধ করলেই কৃষ্ণকে দেখতে পান। স্বপনের গান কৃষ্ণকেই স্পর্শ করা। চন্দ্রার কুঞ্জ অপরূপ, যে দেখেনি সে কল্পনাও করতে পারবে না। কবি কুঞ্জ সাজিয়েছেন মনের মতো করে। চন্দ্রা রূপের বাহার দেখিয়ে, কৃষ্ণকে প্রলোভন দেখিয়ে তাঁর কুঞ্জতে আটকিয়ে রাখেন। কৃষ্ণও রাধার কুঞ্জে না গিয়ে চন্দ্রার কুঞ্জে গমন করে সময় কাটান। শুধু গান আর গান। এর পর ‘মানভঞ্জন’। চন্দ্রার কুঞ্জে রাত কাটানোর জন্য রাধা অভিমানে কৃষ্ণের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। কৃষ্ণ ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে থাকেন, এটাই ‘মানভঞ্জনের গান’। অবশেষে রাধার মান ভাঙলে রাধা-কৃষ্ণের মিলনে এর সমাপ্তি। কখনো একে বলা হয় ‘সাক্ষাৎ’, কখনো ‘মহারাস’। এর পরও আছে ‘সাক্ষাৎ ক্ষেদ’, যেখানে পাই প্রেমিকার উদ্বেলিত সংলাপ, যাতে আছে মান-অভিমান সবই। চিরতরে রাধার কাছ থেকে কৃষ্ণ বিদায় নিয়ে চলে যান মথুরায়। এ গানের নাম ‘বিদায়’।
ধামাইল গানের প্রচলিত পর্ব ছাড়াও দেখতে পাই সচেতনতামূলক গান। কখনো রাতের শেষ ভাগে ‘প্রভাতি’ ধামাইল শিল্পীরা গেয়ে থাকেন। অঞ্চলভেদে নামেরও ভেদ আছে।
সিলেটে মুসলমানরা বেশ কড়া হলে কি হবে, ধামাইল গান ও মালজুড়া গান বলতে অজ্ঞান। কারণ হলো এককালে পাত্রপাত্রীর স্বজন পরিবারে কেউ যখন ‘নাইওর’ হয়ে আসতেন, তখন সেই গ্রামে আনন্দের উপকরণের মধ্যে ছিল ধামাইল ও মালজুড়া। কবি শুভেন্দু ইমাম, সম্পাদক শাহেদ মোহাম্মদ আলী, শিক্ষক কৃষ্ণকান্ত তালুকদার, শিলচরের কবি সুব্রত পাল, সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদী বাংলাদেশের ধামাইল গান নিয়ে এনেছেন সুলিখিত প্রবন্ধ। সায়মন জাকারিয়া তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে দিয়েছেন যে আলোকচিত্রগুলো, বিশেষ করে, ধামাইল গানের পরিবেশনায় আলোকচিত্র নম্বর ১০, ১১, ১২, ১৩ এবং ১৪, যেকোনো আর্কাইভে সংরক্ষিত হওয়ার মতো।
আসামের করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, শিলচরে কয়েকবার গিয়েছি। সিলেটে এসে তাঁরা প্রথমে খোঁজ করেন ধামাইল ও মালজুড়া গানের। আমার মতে, শত-সহস্র ট্যুরিস্ট শুধু শ্রীমঙ্গলে আসবেন এই গান ও নাচ দেখতে। পৃথিবীর কোথাও এত সুন্দর নাচ ও গান দেখা যায় না। যেগুলো বানানো নয়, পল্লির আসল অন্তরের উপাদান দিয়ে প্রস্তুত।
গ্রাম সুন্দর হয় না শুধু নদীতীর দিয়ে সবুজ বনানী অথবা কলাগাছের অনন্ত সারির লাবণ্যে, সুন্দর হয় যদি সেই ছায়াঘেরা বাড়িগুলো থেকে বেরিয়ে আসে লাবণ্যময়ীরা, আর বিয়ের আসর মেতে ওঠে ধামাইল গানের হিল্লোলে ও ছন্দে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net
আগেও বলেছি, এখনো বলছি, ধামাইল নাচ ও গানের আন্দোলনে পল্লিবাংলা নেচে ওঠে। কয়েকটি মেয়ে একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে তালে তালে গেয়ে ওঠে এই গান। এই গান ও নাচ আমি ৩০ বছর ধরে টেলিভিশনে দেখিয়ে এসেছি। বলেছি, এগুলো হিন্দু রমণীর গান, ওরা চলে গেলে এই গান আর কেউ গাইবে না। আমার দেখে ভালো লাগছে যে সুমনকুমার দাশ সবশুদ্ধ ৬৬৩টি গান সংগ্রহ করে ছাপিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের ধামাইল গান নামের বইয়ে। বন্দনা, গৌররূপ, বাঁশি পর্যায়ের ২৪৩টি গান, জলভরা পর্যায়ে ৮০টি গান, জামাইস্নান, কন্যা সাজানো ও বোঝানো পর্যায়ে ১৪০টি গান এবং অন্যান্য পর্যায়ে আরও ২০০টি ছাপিয়ে দিয়েছেন, যা আর কোনো দিনই হারিয়ে যাবে না। কৃষ্ণ, রাধা, বসুদেব, দেবকি, ব্রহ্মা, অদ্বৈত, শ্রীহরি, চন্দ্রধর, রামকৃষ্ণ, দ্রৌপদী, নন্দ, যশোদা, চন্দ্রাবলী, রাম, সীতা, হনুমান, কংস—এঁরা সবাই আছেন। পর্ববিন্যাস ১৬ রকমের। এ আসরে যাঁরা একবার গেছেন, তাঁরা সেখানে বারবার যাবেন। কারণ, সোজা-সরল সুর, গাওয়ার ভঙ্গি সহজ এবং গল্পগুলো মনকাড়া।
‘আইলা না আইলা না প্রেমের নগরে/ মোমের দীপ জ্বালাইয়া পোহাই সারারাতিরে’। মুসলমান গীদাল লিখছেন: ‘উচাটন করে যেন আমার মনে/ আবদুল আজিজে কয় রাইত পোহাইল/ আইল না বন্ধু শ্যামরায়রে’।
বিচ্ছেদি গানের কথা বলা হয়েছে অনেক। ধামাইল বিচ্ছেদির মূল ঘাঁটি। রাধা কুঞ্জ সাজিয়ে প্রাণপুরুষ কৃষ্ণের জন্য বসে থাকেন। নাম: ‘কুঞ্জ সাজানো গান’। ‘স্বপন’ গানগুলো কৃষ্ণের স্বপনের গান। কৃষ্ণ না থাকলে কী হবে, তার স্বপ্ন আছে। ব্যাকুল রাধা চোখ বন্ধ করলেই কৃষ্ণকে দেখতে পান। স্বপনের গান কৃষ্ণকেই স্পর্শ করা। চন্দ্রার কুঞ্জ অপরূপ, যে দেখেনি সে কল্পনাও করতে পারবে না। কবি কুঞ্জ সাজিয়েছেন মনের মতো করে। চন্দ্রা রূপের বাহার দেখিয়ে, কৃষ্ণকে প্রলোভন দেখিয়ে তাঁর কুঞ্জতে আটকিয়ে রাখেন। কৃষ্ণও রাধার কুঞ্জে না গিয়ে চন্দ্রার কুঞ্জে গমন করে সময় কাটান। শুধু গান আর গান। এর পর ‘মানভঞ্জন’। চন্দ্রার কুঞ্জে রাত কাটানোর জন্য রাধা অভিমানে কৃষ্ণের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। কৃষ্ণ ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে থাকেন, এটাই ‘মানভঞ্জনের গান’। অবশেষে রাধার মান ভাঙলে রাধা-কৃষ্ণের মিলনে এর সমাপ্তি। কখনো একে বলা হয় ‘সাক্ষাৎ’, কখনো ‘মহারাস’। এর পরও আছে ‘সাক্ষাৎ ক্ষেদ’, যেখানে পাই প্রেমিকার উদ্বেলিত সংলাপ, যাতে আছে মান-অভিমান সবই। চিরতরে রাধার কাছ থেকে কৃষ্ণ বিদায় নিয়ে চলে যান মথুরায়। এ গানের নাম ‘বিদায়’।
ধামাইল গানের প্রচলিত পর্ব ছাড়াও দেখতে পাই সচেতনতামূলক গান। কখনো রাতের শেষ ভাগে ‘প্রভাতি’ ধামাইল শিল্পীরা গেয়ে থাকেন। অঞ্চলভেদে নামেরও ভেদ আছে।
সিলেটে মুসলমানরা বেশ কড়া হলে কি হবে, ধামাইল গান ও মালজুড়া গান বলতে অজ্ঞান। কারণ হলো এককালে পাত্রপাত্রীর স্বজন পরিবারে কেউ যখন ‘নাইওর’ হয়ে আসতেন, তখন সেই গ্রামে আনন্দের উপকরণের মধ্যে ছিল ধামাইল ও মালজুড়া। কবি শুভেন্দু ইমাম, সম্পাদক শাহেদ মোহাম্মদ আলী, শিক্ষক কৃষ্ণকান্ত তালুকদার, শিলচরের কবি সুব্রত পাল, সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদী বাংলাদেশের ধামাইল গান নিয়ে এনেছেন সুলিখিত প্রবন্ধ। সায়মন জাকারিয়া তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে দিয়েছেন যে আলোকচিত্রগুলো, বিশেষ করে, ধামাইল গানের পরিবেশনায় আলোকচিত্র নম্বর ১০, ১১, ১২, ১৩ এবং ১৪, যেকোনো আর্কাইভে সংরক্ষিত হওয়ার মতো।
আসামের করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, শিলচরে কয়েকবার গিয়েছি। সিলেটে এসে তাঁরা প্রথমে খোঁজ করেন ধামাইল ও মালজুড়া গানের। আমার মতে, শত-সহস্র ট্যুরিস্ট শুধু শ্রীমঙ্গলে আসবেন এই গান ও নাচ দেখতে। পৃথিবীর কোথাও এত সুন্দর নাচ ও গান দেখা যায় না। যেগুলো বানানো নয়, পল্লির আসল অন্তরের উপাদান দিয়ে প্রস্তুত।
গ্রাম সুন্দর হয় না শুধু নদীতীর দিয়ে সবুজ বনানী অথবা কলাগাছের অনন্ত সারির লাবণ্যে, সুন্দর হয় যদি সেই ছায়াঘেরা বাড়িগুলো থেকে বেরিয়ে আসে লাবণ্যময়ীরা, আর বিয়ের আসর মেতে ওঠে ধামাইল গানের হিল্লোলে ও ছন্দে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net
No comments