বুয়েটের পরীক্ষা পেছানো-পলাশীর ঘরে ঘরে আনন্দ!’ by মুনির হাসান
না, এ পলাশীর প্রান্তরের কথা নয়। এ হলো ঢাকার পলাশীতে অবস্থিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একজন শিক্ষার্থীর ফেসবুক স্ট্যাটাস। তাঁর ঈদের কারণ, বুয়েটের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীদের চলতি সেমিস্টার পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই।
বুয়েটের পরীক্ষা পেছানো কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। সাম্প্রতিক কালে বুয়েটের কোনো পরীক্ষা নির্ধারিত সময়ে শুরু হয়েছে কি না, তা জানতে হলে হয়তো বা ঐতিহাসিকদের দ্বারস্থ হতে হবে। বুয়েট হলো সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি বিশ্বকাপ ফুটবলের জন্য বন্ধ থাকে। ২৫ জুন থেকে কয়েকটি বিভাগের এবং আগামী ২ জুলাই থেকে অপর কয়েকটি বিভাগের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা পিছিয়ে এখন এগুলোর তারিখ নির্ধারণ করেছে যথাক্রমে ২ এবং ৯ জুলাই।
নিজের অ্যালামনি এবং প্রাক্তন কর্মক্ষেত্র হিসেবে আমার বুয়েটের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। রয়েছে বলে এবার যখন শুনেছি, বিভাগগুলো সব বিভাগের পরীক্ষা একসঙ্গে না নিয়ে আলাদাভাবে নেবে, তখন খুশি হয়েছিলাম। ভেবেছি, পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলনকারীর (?) সংখ্যা হবে কম। কিন্তু আমার ধারণা সত্য হলো না।
সকালে পত্রিকায় খবরটা পড়ার পর মনের দুঃখে ফেসবুকে খবরটি শেয়ার করেছি। সেখানে এ-সংক্রান্ত আমার স্ট্যাটাসের নিচে একজন লিখেছে, ‘এটি বুয়েটের ৪০ বছরের ঐতিহ্য’!
আমার মনে পড়ছে, আশির দশকের মাঝামাঝি আমরা যখন বুয়েটে পড়তাম, তখনো এ অবস্থা ছিল। আমার মনে আছে, ভর্তি হওয়ার ১৬ মাস পর আমাদের প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছিল। কারণ, তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন লে. জে. এরশাদ। আমাদের আগের ব্যাচের পরীক্ষার দিন সকালে তিনি শিক্ষার্থীদের হোস্টেল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সে সময় ‘এরশাদ ভ্যাকেশন’ হতো রাজনৈতিক কারণে। রাজনৈতিক হট্টগোলের কারণে পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা হলে পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন শুরু হয়ে যেত।
প্রথম বর্ষে থাকার সময় একজন সিনিয়র ভাই এসে আমাকে বোঝালেন, ‘এক মাস ভালো, না এক বছর ভালো?’ তিনি বোঝালেন, এক মাস পরীক্ষা পেছালে পাস করার সম্ভাবনা বেশি। আর ফেল করলে তো এক বছর নষ্ট!
আমার মনে আছে, ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় আমাদের পরীক্ষা পেছানো হয়েছিল। শুনেছি, ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় খেলার জন্য বুয়েটের শিক্ষার্থীদের ক্লাস বন্ধের দাবিতে মিছিলের ছবি ফলাও করে সিঙ্গাপুরের একটি দৈনিকে ছাপা হয়েছিল। ক্যাপশনে বলা ছিল, খেলা দেখার জন্য আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এমন একটি দেশের, যার কিনা বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলার সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতে নেই।
সামরিক জান্তার আমলে প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্ধারিত ছুটি ছিল। কিন্তু বিগত সময়ে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এ সমস্যা কাটিয়ে উঠেছে। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় সে সময়ে সৃষ্ট সেশন জট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে সফল হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এ বছর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার কৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাদের চার বছরের স্নাতক কোর্স চার বছরের আগেই শেষ করেছে।
দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিজেদের শিক্ষাজীবন প্রলম্বিত করার কারণ কী? কেউ কি ভেবে দেখবেন না?
বুয়েটের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় আমি জেনেছি, কয়েকটি কারণে এ প্রলম্ব। এক নম্বর হলো, গৃহশিক্ষকতা ও কোচিং ব্যবসা। বুয়েটের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী নাকি কোনো না কোনো কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত। সেখান থেকে আয়-বরকতও নাকি ভালো। একজন কোচিং সেন্টারের পরিচালক বললেন, বুয়েটের একজন শিক্ষার্থী এক মাসে ৫০ হাজার টাকাও কামাতে পারেন। কোচিং সেন্টারগুলোতে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের যে চাহিদা, এর চেয়ে পাস করা প্রকৌশলীদের চাহিদা অনেক কম। ফলে পাস করার চেয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে বুয়েটের হলে থাকার আগ্রহীরা পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন করে। একইভাবে, গৃহশিক্ষকতায় বুয়েটের শিক্ষার্থীরা প্রথম পছন্দ, প্রকৌশলীরা নন। আবার পাস করার পর চাকরি বা নিজ পেশার খোঁজখবর করতে হয়। তখন কেবল কোচিং বা টিউশনি করাটা ভালো দেখায় না বলে মনে করে অনেকে।
দ্বিতীয় কারণ হলো, একটি দল নাকি শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ফলে তাদের নাকি নিয়মিত প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয় না। তাই তারা পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করার পর আন্দোলন শুরু করে।
তৃতীয় কারণটি হলো, একজন শিক্ষার্থী আমার স্ট্যাটাসে মন্তব্য আকারে লিখেছে, ‘একটা টার্মে যদি একজন শিক্ষার্থীকে ২০টির বেশি ল্যাব রিপোর্ট, দু-তিনটি টার্ম প্রজেক্ট আর ছয়-সাতটি অ্যাসনাইনমেন্ট করতে হয়, তা-ও ন্যূনতম শতাংশ নম্বরের বিনিময়ে, তাহলে ক্লাস চলাকালীন তার পড়াশোনার সুযোগ কই? কাজেই শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা পেছাতে বাধ্য তো হবেই।
হয়তো আরও কারণ থাকতে পারে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলে এ প্রবণতার মূল কারণগুলো অনুধাবন করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।
কিন্তু বছরের পর বছর একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা পেছানোর বাতিক মহামারিতে রূপ নেবে, এক ক্যালেন্ডার বছরে তারা দুটি সেমিস্টারে শেষ করতে পারবে না (প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বছরে তিনটি সেমিস্টার পরিচালনা করে), আর সে ব্যাপারে কারও কোনো মাথাব্যথা হবে না, তা কেমন কথা! শিক্ষার্থী, শিক্ষক আর প্রশাসন মিলে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না, এমনটি আমি বিশ্বাস করি না।
আমার বিশ্বাস কি টিকবে?
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।
নিজের অ্যালামনি এবং প্রাক্তন কর্মক্ষেত্র হিসেবে আমার বুয়েটের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। রয়েছে বলে এবার যখন শুনেছি, বিভাগগুলো সব বিভাগের পরীক্ষা একসঙ্গে না নিয়ে আলাদাভাবে নেবে, তখন খুশি হয়েছিলাম। ভেবেছি, পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলনকারীর (?) সংখ্যা হবে কম। কিন্তু আমার ধারণা সত্য হলো না।
সকালে পত্রিকায় খবরটা পড়ার পর মনের দুঃখে ফেসবুকে খবরটি শেয়ার করেছি। সেখানে এ-সংক্রান্ত আমার স্ট্যাটাসের নিচে একজন লিখেছে, ‘এটি বুয়েটের ৪০ বছরের ঐতিহ্য’!
আমার মনে পড়ছে, আশির দশকের মাঝামাঝি আমরা যখন বুয়েটে পড়তাম, তখনো এ অবস্থা ছিল। আমার মনে আছে, ভর্তি হওয়ার ১৬ মাস পর আমাদের প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছিল। কারণ, তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন লে. জে. এরশাদ। আমাদের আগের ব্যাচের পরীক্ষার দিন সকালে তিনি শিক্ষার্থীদের হোস্টেল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সে সময় ‘এরশাদ ভ্যাকেশন’ হতো রাজনৈতিক কারণে। রাজনৈতিক হট্টগোলের কারণে পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা হলে পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন শুরু হয়ে যেত।
প্রথম বর্ষে থাকার সময় একজন সিনিয়র ভাই এসে আমাকে বোঝালেন, ‘এক মাস ভালো, না এক বছর ভালো?’ তিনি বোঝালেন, এক মাস পরীক্ষা পেছালে পাস করার সম্ভাবনা বেশি। আর ফেল করলে তো এক বছর নষ্ট!
আমার মনে আছে, ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় আমাদের পরীক্ষা পেছানো হয়েছিল। শুনেছি, ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় খেলার জন্য বুয়েটের শিক্ষার্থীদের ক্লাস বন্ধের দাবিতে মিছিলের ছবি ফলাও করে সিঙ্গাপুরের একটি দৈনিকে ছাপা হয়েছিল। ক্যাপশনে বলা ছিল, খেলা দেখার জন্য আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এমন একটি দেশের, যার কিনা বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলার সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতে নেই।
সামরিক জান্তার আমলে প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্ধারিত ছুটি ছিল। কিন্তু বিগত সময়ে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এ সমস্যা কাটিয়ে উঠেছে। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় সে সময়ে সৃষ্ট সেশন জট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে সফল হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এ বছর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার কৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাদের চার বছরের স্নাতক কোর্স চার বছরের আগেই শেষ করেছে।
দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিজেদের শিক্ষাজীবন প্রলম্বিত করার কারণ কী? কেউ কি ভেবে দেখবেন না?
বুয়েটের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় আমি জেনেছি, কয়েকটি কারণে এ প্রলম্ব। এক নম্বর হলো, গৃহশিক্ষকতা ও কোচিং ব্যবসা। বুয়েটের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী নাকি কোনো না কোনো কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত। সেখান থেকে আয়-বরকতও নাকি ভালো। একজন কোচিং সেন্টারের পরিচালক বললেন, বুয়েটের একজন শিক্ষার্থী এক মাসে ৫০ হাজার টাকাও কামাতে পারেন। কোচিং সেন্টারগুলোতে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের যে চাহিদা, এর চেয়ে পাস করা প্রকৌশলীদের চাহিদা অনেক কম। ফলে পাস করার চেয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে বুয়েটের হলে থাকার আগ্রহীরা পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন করে। একইভাবে, গৃহশিক্ষকতায় বুয়েটের শিক্ষার্থীরা প্রথম পছন্দ, প্রকৌশলীরা নন। আবার পাস করার পর চাকরি বা নিজ পেশার খোঁজখবর করতে হয়। তখন কেবল কোচিং বা টিউশনি করাটা ভালো দেখায় না বলে মনে করে অনেকে।
দ্বিতীয় কারণ হলো, একটি দল নাকি শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ফলে তাদের নাকি নিয়মিত প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয় না। তাই তারা পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করার পর আন্দোলন শুরু করে।
তৃতীয় কারণটি হলো, একজন শিক্ষার্থী আমার স্ট্যাটাসে মন্তব্য আকারে লিখেছে, ‘একটা টার্মে যদি একজন শিক্ষার্থীকে ২০টির বেশি ল্যাব রিপোর্ট, দু-তিনটি টার্ম প্রজেক্ট আর ছয়-সাতটি অ্যাসনাইনমেন্ট করতে হয়, তা-ও ন্যূনতম শতাংশ নম্বরের বিনিময়ে, তাহলে ক্লাস চলাকালীন তার পড়াশোনার সুযোগ কই? কাজেই শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা পেছাতে বাধ্য তো হবেই।
হয়তো আরও কারণ থাকতে পারে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলে এ প্রবণতার মূল কারণগুলো অনুধাবন করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।
কিন্তু বছরের পর বছর একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা পেছানোর বাতিক মহামারিতে রূপ নেবে, এক ক্যালেন্ডার বছরে তারা দুটি সেমিস্টারে শেষ করতে পারবে না (প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বছরে তিনটি সেমিস্টার পরিচালনা করে), আর সে ব্যাপারে কারও কোনো মাথাব্যথা হবে না, তা কেমন কথা! শিক্ষার্থী, শিক্ষক আর প্রশাসন মিলে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না, এমনটি আমি বিশ্বাস করি না।
আমার বিশ্বাস কি টিকবে?
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।
No comments