সবার আঙুল প্রশাসনের দিকে by শরিফুল হাসান ও শামসুজ্জামান শামস
‘যদি ছাত্রদের নিয়ে কোনো শিক্ষক রাজনীতি না করতেন, তাহলে আজ হয়তো জুবায়েরের লাশ দেখতে হতো না। আমাদের কাউকে না কাউকে এর দায় নিতেই হবে।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এ মামুন গতকাল প্রথম আলোকে এই বক্তব্য দেন। তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্রলীগের কোন্দলের কারণে শিক্ষার্থীরা অনেক দিন ধরেই নিরাপত্তাহীনতায় আছেন।
ছাত্রলীগের একটি অংশ ক্যাম্পাসে রাজনীতি করছে, আরেকটি অংশ বাইরে আছে, এটি ঠিক নয়। ক্যাম্পাসে সব শিক্ষার্থীর সহাবস্থান নিশ্চিত করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা উপাচার্যকে অনেকবার বলেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ হত্যার পর সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক, শিক্ষক সমিতির একাধিক নেতা, ছাত্রলীগের দলীয় কোন্দলের জন্য স্থগিত করা কমিটির নেতারা মূলত সবকিছুর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই দায়ী করেছেন। তাঁরা ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছাত্রলীগের নামধারীদের ছাত্রলীগের ‘উপাচার্য গ্রুপ’ আখ্যা দিয়ে আসছেন। তবে জানতে চাইলে সরকারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, জাহাঙ্গীরনগরে যেহেতু ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই, তাই সেখানে কোনো নেতাও নেই। উপাচার্য গ্রুপ বলে কিছু আছে বলে তাঁরা শোনেননি।
তবে গতকাল ক্যাম্পাসে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা অভিযোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মদদেই এই ছাত্রলীগ নামধারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা দলীয় ও অন্য দলের প্রতিপক্ষকে ক্যাম্পাস ছাড়া করেছে। ক্যাম্পাসে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দাবিদাওয়ার আন্দোলন দমনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এদের ব্যবহার করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছে। উপাচার্য, প্রক্টরসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এসব অভিযোগ সব সময়ই অস্বীকার করে আসছেন।
বাস্তবতা কী?: গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টা। জুবায়ের হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আর ছাত্রলীগের নামে কয়েক শ ছাত্র তখন পুলিশের সামনে স্লোগান দিচ্ছিলেন, ‘উপাচার্য তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।’
ক্যাম্পাসের শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের সমর্থন নিয়েই সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ থাকার পরও ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে কিছু ছাত্র ‘রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড’ চালাচ্ছেন। গতকাল ক্যাম্পাসে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে, যাঁরা জুবায়েরের ওপর হামলা ছাড়াও একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে মারামারি, চাঁদাবাজি, ছাত্রী উত্ত্যক্ত করা, সাংবাদিক পেটানোসহ বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপনারা কিছু হলেই ছাত্রলীগকে দায়ী করেন কেন? জাহাঙ্গীরনগরে তো ছাত্রলীগের কোনো কর্মকাণ্ডই নেই। তাহলে কেন সেখানকার প্রশাসন ছাত্রলীগ নামধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না?’ তিনি বলেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সেখানে যা হচ্ছে, তা বর্তমান উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মদদেই হচ্ছে। এ কারণেই যারা ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আমরা বিষয়টি আমাদের উচ্চপর্যায়ে জানিয়েছি।’
এরা কারা: ২০১০ সালের ৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সমর্থক কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে কয়েকজনকে চারতলার ছাদ থেকে নিচে ফেলে দিয়ে নারকীয় অবস্থা সৃষ্টি করে ছাত্রলীগ। গণমাধ্যমের ব্যাপক সমালোচনার পর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের কার্যক্রম বন্ধ করে, কমিটি স্থগিত করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন স্থগিত ওই কমিটির সভাপতি রাশেদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলমসহ ২৩ নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করে। এঁদের মধ্যে ছয়জনকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের একাধিক সূত্র জানায়, এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের তত্ত্বাবধানে গোপালগঞ্জের অধিবাসী এস এম শামীম ও শরিফুল ইসলাম ছাত্রলীগের নেতা পরিচয় দিয়ে ক্যাম্পাসে সক্রিয় হন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন স্থগিত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আজগর আলী। এই তিনজনের নেতৃত্বেই ছাত্রলীগের পরিচয়ে সক্রিয় হয় কথিত ‘উপাচার্য গ্রুপ’। এদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহানুভূতি ছাড়াও উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের বাড়ি গোপালগঞ্জ হওয়ায় এই অভিধা আরও প্রচার পায়। আর এই সুযোগে এরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
কেন বেপরোয়া: ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন হলের বাইরে থাকার পর গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আরজু মিয়ার গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে আসেন এস এম শামীম ও শরিফুল ইসলাম। হলের সামনে আসার পর শরীফের কোমরে আগ্নেয়াস্ত্র দেখতে পান হলে থাকা স্থগিত কমিটির কর্মীরা। এ সময় তাঁরা ধাওয়া দিলে আগ্নেয়াস্ত্র ফেলেই প্রক্টরের গাড়িতে করে চলে যান শরীফ ও শামীম। পরে পুলিশ এসে অস্ত্রটি ‘পরিত্যক্ত অবস্থায়’ উদ্ধার করে। এর কয়েক দিন পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তায় হলে ওঠেন স্থগিত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আসগর আলী। আর পুলিশের সহায়তায় হলে ওঠেন শামীম ও শরীফ। তখন পত্রিকায় এ নিয়ে খবরও বের হয়। পরে এদের সঙ্গে যোগ দেন হলে থাকা স্থগিত কমিটির ২৫-৩০ জন নেতা-কর্মী।
আন্দোলন দমন: অভিযোগ আছে, ক্যাম্পাসে কোনো বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করলেই এই ‘তিন নেতা’ ও তাঁদের কর্মীরা তা দমন করেন। গত সোমবার যখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে তাঁর কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করেন, তখনো এই তিনজনের নেতৃত্বে তাঁদের অনুসারীরা তালা ভেঙে, স্লোগান দিয়ে উপাচার্যকে বের করে আনেন।
শিক্ষার্থীরা জানান, অব্যাহত লোডশেডিংয়ের পর বিদ্যুতের দাবিতে গত বছরের ১ আগস্ট রাত ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর আরজু মিয়া সেখানে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাগিবতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি সেখান থেকে চলে যাওয়ার পরপরই আসগর আলী ১৫-২০ জন কর্মী নিয়ে এসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেন। কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধরও করেন। এ নিয়েও তখন পত্রিকায় খবর বের হয়।
প্রতিপক্ষ দমন: এই তিনজন বছর খানেক ধরে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের অন্য কোনো নেতাকে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে দেন না। ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থানকারী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী প্রশাসনের কাছে বিভিন্ন সময়ে লিখিত আবেদনও করেছেন শিক্ষাকার্যক্রমে তাঁদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। প্রায় তিন বছর ধরে তাঁরা ক্যাম্পাসে আসতে পারছেন বলে দাবি করেছেন ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি জাকির হোসেন।
গত বছরের ১ জুন ছাত্রদলের কর্মী ও অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র শেখ আবদুল্লাহ ইশতিয়াক ক্যাম্পাসে এলে তাঁকে বেধড়ক পেটানো হয়। তাঁকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। এমনকি পরীক্ষা দিতে এসেও কয়েকজন ছাত্রকে ফিরতে হয়েছে প্রক্টরিয়াল বডির সহায়তা নিয়ে।
কেবল ছাত্রদল নয়, ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল হাসনাত গত বছর পরীক্ষা দিতে এলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি গেটে রড ও পাইপ দিয়ে পেটান আসগরের কর্মীরা। গত বছরের আগস্টে সাংস্কৃতিক কর্মী নাহিদ আরেফিনকে মারধর করেন ছাত্রলীগ নামধারীরা।
বহিষ্কারের নামে কৌতুক: বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়জন সাংবাদিক গত এক বছরে এদের হামলার শিকার হয়েছেন। গত বছরের মে মাসে কালের কণ্ঠ-এর প্রতিনিধি ইমন রহমানকে মারধর করেন ছাত্রলীগের কর্মী পরিচয়দানকারী এস এম মাহতাব মেহেদী। সাংবাদিকেরা ঘটনার বিচার দাবি করলে তাঁকে এক মাসের জন্য বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু যেদিন থেকে তাঁকে বহিষ্কার দেখানো হয়, সেদিন থেকে এক মাসের গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হয়।
জুবায়ের হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ ছিল: জুবায়ের হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বহিষ্কার খন্দকার আশিকুল ইসলাম, খান মো. রইস ও মো. রাশেদুল ইসলাম—তিনজনই আজগরের মূল ক্যাডার। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী প্রক্টর নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এর আগেও মারধরসহ নানা অভিযোগে আশিকের বিরুদ্ধে একটি এবং রইসের বিরুদ্ধে তিনটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
‘তিন নেতা’র বক্তব্য: এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আজগর আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন ক্যাম্পাসের বাইরে থাকি। আমি কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত নই। তবে ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আমরা সহযোগিতা করেছি।’
এস এম শামীম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশের স্বার্থে আমরা উপাচার্যসহ প্রশাসনকে বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করেছি। যারা ভিসির বিরুদ্ধে কথা বলে, তারাই আমাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করেছে।’
শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে, সেগুলো মিথ্যা। যারা ক্যাম্পাসে আসতে পারছে না, তারাই এসব বলছে।’
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম এ বিষয়ে বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের কোনো কার্যক্রম নেই। কাজেই যারা ছাত্রলীগের নাম ভাঙাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’
প্রশাসন যা বলছে: বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই, এটি সত্যি। কিন্তু কেউ যদি এখন নিজেকে ছাত্রলীগ দাবি করে, আমি তো কিছু বলতে পারি না।’
ছাত্রলীগ নামধারীদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, ‘আমরা কাউকে মদদ দিই না। আর যেহেতু এখানে ছাত্রলীগের কোনো কার্যক্রম নেই, সেহেতু এ ব্যাপারে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।’
এর আগে অভিযোগ ওঠার পরও ছাত্রলীগের পরিচয়দানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, ‘আমার কাছ পর্যন্ত এসব অভিযোগ আসেনি। এলে ব্যবস্থা নিতাম।’ ছাত্রলীগ নামধারীরা তো সোমবার আপনাকে স্লোগান দিয়ে উদ্ধার করে এনেছে। উপাচার্য বলেন, ‘সন্ধ্যার সময় আমি বের হয়ে এসেছি। কারা এসেছিল আমি বলতে পারব না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আরজু মিয়াও তাঁর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ আগের মতো অস্বীকার করেছেন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কখনোই কাউকে মদদ দিই না। কোনো সংবাদ শুনলেই আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিই।’ বঙ্গবন্ধু হলে ছাত্রলীগ নামধারী শামীম ও শরীফকে উঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই ঘটনার সঙ্গে জুবায়েরের মৃত্যুর ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ হত্যার পর সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক, শিক্ষক সমিতির একাধিক নেতা, ছাত্রলীগের দলীয় কোন্দলের জন্য স্থগিত করা কমিটির নেতারা মূলত সবকিছুর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই দায়ী করেছেন। তাঁরা ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছাত্রলীগের নামধারীদের ছাত্রলীগের ‘উপাচার্য গ্রুপ’ আখ্যা দিয়ে আসছেন। তবে জানতে চাইলে সরকারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, জাহাঙ্গীরনগরে যেহেতু ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই, তাই সেখানে কোনো নেতাও নেই। উপাচার্য গ্রুপ বলে কিছু আছে বলে তাঁরা শোনেননি।
তবে গতকাল ক্যাম্পাসে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা অভিযোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মদদেই এই ছাত্রলীগ নামধারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা দলীয় ও অন্য দলের প্রতিপক্ষকে ক্যাম্পাস ছাড়া করেছে। ক্যাম্পাসে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দাবিদাওয়ার আন্দোলন দমনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এদের ব্যবহার করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছে। উপাচার্য, প্রক্টরসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এসব অভিযোগ সব সময়ই অস্বীকার করে আসছেন।
বাস্তবতা কী?: গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টা। জুবায়ের হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আর ছাত্রলীগের নামে কয়েক শ ছাত্র তখন পুলিশের সামনে স্লোগান দিচ্ছিলেন, ‘উপাচার্য তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।’
ক্যাম্পাসের শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের সমর্থন নিয়েই সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ থাকার পরও ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে কিছু ছাত্র ‘রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড’ চালাচ্ছেন। গতকাল ক্যাম্পাসে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে, যাঁরা জুবায়েরের ওপর হামলা ছাড়াও একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে মারামারি, চাঁদাবাজি, ছাত্রী উত্ত্যক্ত করা, সাংবাদিক পেটানোসহ বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপনারা কিছু হলেই ছাত্রলীগকে দায়ী করেন কেন? জাহাঙ্গীরনগরে তো ছাত্রলীগের কোনো কর্মকাণ্ডই নেই। তাহলে কেন সেখানকার প্রশাসন ছাত্রলীগ নামধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না?’ তিনি বলেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সেখানে যা হচ্ছে, তা বর্তমান উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মদদেই হচ্ছে। এ কারণেই যারা ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আমরা বিষয়টি আমাদের উচ্চপর্যায়ে জানিয়েছি।’
এরা কারা: ২০১০ সালের ৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সমর্থক কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে কয়েকজনকে চারতলার ছাদ থেকে নিচে ফেলে দিয়ে নারকীয় অবস্থা সৃষ্টি করে ছাত্রলীগ। গণমাধ্যমের ব্যাপক সমালোচনার পর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের কার্যক্রম বন্ধ করে, কমিটি স্থগিত করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন স্থগিত ওই কমিটির সভাপতি রাশেদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলমসহ ২৩ নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করে। এঁদের মধ্যে ছয়জনকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের একাধিক সূত্র জানায়, এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের তত্ত্বাবধানে গোপালগঞ্জের অধিবাসী এস এম শামীম ও শরিফুল ইসলাম ছাত্রলীগের নেতা পরিচয় দিয়ে ক্যাম্পাসে সক্রিয় হন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন স্থগিত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আজগর আলী। এই তিনজনের নেতৃত্বেই ছাত্রলীগের পরিচয়ে সক্রিয় হয় কথিত ‘উপাচার্য গ্রুপ’। এদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহানুভূতি ছাড়াও উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের বাড়ি গোপালগঞ্জ হওয়ায় এই অভিধা আরও প্রচার পায়। আর এই সুযোগে এরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
কেন বেপরোয়া: ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন হলের বাইরে থাকার পর গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আরজু মিয়ার গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে আসেন এস এম শামীম ও শরিফুল ইসলাম। হলের সামনে আসার পর শরীফের কোমরে আগ্নেয়াস্ত্র দেখতে পান হলে থাকা স্থগিত কমিটির কর্মীরা। এ সময় তাঁরা ধাওয়া দিলে আগ্নেয়াস্ত্র ফেলেই প্রক্টরের গাড়িতে করে চলে যান শরীফ ও শামীম। পরে পুলিশ এসে অস্ত্রটি ‘পরিত্যক্ত অবস্থায়’ উদ্ধার করে। এর কয়েক দিন পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তায় হলে ওঠেন স্থগিত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আসগর আলী। আর পুলিশের সহায়তায় হলে ওঠেন শামীম ও শরীফ। তখন পত্রিকায় এ নিয়ে খবরও বের হয়। পরে এদের সঙ্গে যোগ দেন হলে থাকা স্থগিত কমিটির ২৫-৩০ জন নেতা-কর্মী।
আন্দোলন দমন: অভিযোগ আছে, ক্যাম্পাসে কোনো বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করলেই এই ‘তিন নেতা’ ও তাঁদের কর্মীরা তা দমন করেন। গত সোমবার যখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে তাঁর কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করেন, তখনো এই তিনজনের নেতৃত্বে তাঁদের অনুসারীরা তালা ভেঙে, স্লোগান দিয়ে উপাচার্যকে বের করে আনেন।
শিক্ষার্থীরা জানান, অব্যাহত লোডশেডিংয়ের পর বিদ্যুতের দাবিতে গত বছরের ১ আগস্ট রাত ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর আরজু মিয়া সেখানে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাগিবতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি সেখান থেকে চলে যাওয়ার পরপরই আসগর আলী ১৫-২০ জন কর্মী নিয়ে এসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেন। কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধরও করেন। এ নিয়েও তখন পত্রিকায় খবর বের হয়।
প্রতিপক্ষ দমন: এই তিনজন বছর খানেক ধরে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের অন্য কোনো নেতাকে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে দেন না। ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থানকারী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী প্রশাসনের কাছে বিভিন্ন সময়ে লিখিত আবেদনও করেছেন শিক্ষাকার্যক্রমে তাঁদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। প্রায় তিন বছর ধরে তাঁরা ক্যাম্পাসে আসতে পারছেন বলে দাবি করেছেন ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি জাকির হোসেন।
গত বছরের ১ জুন ছাত্রদলের কর্মী ও অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র শেখ আবদুল্লাহ ইশতিয়াক ক্যাম্পাসে এলে তাঁকে বেধড়ক পেটানো হয়। তাঁকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। এমনকি পরীক্ষা দিতে এসেও কয়েকজন ছাত্রকে ফিরতে হয়েছে প্রক্টরিয়াল বডির সহায়তা নিয়ে।
কেবল ছাত্রদল নয়, ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল হাসনাত গত বছর পরীক্ষা দিতে এলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি গেটে রড ও পাইপ দিয়ে পেটান আসগরের কর্মীরা। গত বছরের আগস্টে সাংস্কৃতিক কর্মী নাহিদ আরেফিনকে মারধর করেন ছাত্রলীগ নামধারীরা।
বহিষ্কারের নামে কৌতুক: বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়জন সাংবাদিক গত এক বছরে এদের হামলার শিকার হয়েছেন। গত বছরের মে মাসে কালের কণ্ঠ-এর প্রতিনিধি ইমন রহমানকে মারধর করেন ছাত্রলীগের কর্মী পরিচয়দানকারী এস এম মাহতাব মেহেদী। সাংবাদিকেরা ঘটনার বিচার দাবি করলে তাঁকে এক মাসের জন্য বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু যেদিন থেকে তাঁকে বহিষ্কার দেখানো হয়, সেদিন থেকে এক মাসের গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হয়।
জুবায়ের হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ ছিল: জুবায়ের হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বহিষ্কার খন্দকার আশিকুল ইসলাম, খান মো. রইস ও মো. রাশেদুল ইসলাম—তিনজনই আজগরের মূল ক্যাডার। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী প্রক্টর নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এর আগেও মারধরসহ নানা অভিযোগে আশিকের বিরুদ্ধে একটি এবং রইসের বিরুদ্ধে তিনটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
‘তিন নেতা’র বক্তব্য: এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আজগর আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন ক্যাম্পাসের বাইরে থাকি। আমি কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত নই। তবে ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আমরা সহযোগিতা করেছি।’
এস এম শামীম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশের স্বার্থে আমরা উপাচার্যসহ প্রশাসনকে বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করেছি। যারা ভিসির বিরুদ্ধে কথা বলে, তারাই আমাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করেছে।’
শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে, সেগুলো মিথ্যা। যারা ক্যাম্পাসে আসতে পারছে না, তারাই এসব বলছে।’
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম এ বিষয়ে বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের কোনো কার্যক্রম নেই। কাজেই যারা ছাত্রলীগের নাম ভাঙাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’
প্রশাসন যা বলছে: বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই, এটি সত্যি। কিন্তু কেউ যদি এখন নিজেকে ছাত্রলীগ দাবি করে, আমি তো কিছু বলতে পারি না।’
ছাত্রলীগ নামধারীদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, ‘আমরা কাউকে মদদ দিই না। আর যেহেতু এখানে ছাত্রলীগের কোনো কার্যক্রম নেই, সেহেতু এ ব্যাপারে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।’
এর আগে অভিযোগ ওঠার পরও ছাত্রলীগের পরিচয়দানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, ‘আমার কাছ পর্যন্ত এসব অভিযোগ আসেনি। এলে ব্যবস্থা নিতাম।’ ছাত্রলীগ নামধারীরা তো সোমবার আপনাকে স্লোগান দিয়ে উদ্ধার করে এনেছে। উপাচার্য বলেন, ‘সন্ধ্যার সময় আমি বের হয়ে এসেছি। কারা এসেছিল আমি বলতে পারব না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আরজু মিয়াও তাঁর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ আগের মতো অস্বীকার করেছেন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কখনোই কাউকে মদদ দিই না। কোনো সংবাদ শুনলেই আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিই।’ বঙ্গবন্ধু হলে ছাত্রলীগ নামধারী শামীম ও শরীফকে উঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই ঘটনার সঙ্গে জুবায়েরের মৃত্যুর ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা।
No comments