জাবিতে ছাত্রলীগ লাগামছাড়া by ইমদাদ হক
নেই কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন। কার্যক্রমও স্থগিত। কমিটির অধিকাংশ নেতাকর্মীই ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত। এরপরও থেমে নেই তাদের বিতর্কিত কার্যক্রম। সংগঠনের নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, যৌন হয়রানি, বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়ন, মুক্তমঞ্চে সাংস্কৃতিক কর্মীদের ওপর হামলা, সাংবাদিক নির্যাতন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, শিক্ষার্থীদের মাদক গ্রহণে প্ররোচনা দেওয়া, জমি দখল, চুরিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
হেন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করছে না। তাদের দুর্বৃত্তায়ন একেবারে লাগামছাড়া। বিশেষ আনুকূল্যে ছাত্রলীগ কর্মীরা এসব অপকর্ম করলেও দায়ভার নিতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কোনো পক্ষকে সমর্থন দেওয়ার কথা অস্বীকার করে উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবীর বলেছেন, সরকার সমর্থক এ ছাত্র সংগঠনের দায়-দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নেবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমদ ছাত্রলীগের 'উপাচার্য গ্রুপ' নামে পরিচিত অংশের কর্মীদের হামলায় নিহত হওয়ার পর উপাচার্য ও তার প্রশাসন ব্যাপক
সমালোচনার মুখে পড়ে। উপাচার্য মঙ্গলবার নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ছাত্রলীগে আমার কোনো গ্রুপ নেই। উপাচার্য বা প্রশাসন কখনোই ছাত্রলীগের কোনো কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত নয়। ছাত্রলীগের কোনো কর্মকাণ্ডের দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নেবে না_ এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, যারা অপরাধ করেছে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে অবশ্য মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন উপাচার্য।
এদিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ এ প্রতিবেদককে বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কোনো কমিটির কার্যক্রম চালু না থাকায় এর দায়িত্ব সংগঠন নেবে না। আমরা জানতে পেরেছি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে এসব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কেউ নিজেকে জোর করে ছাত্রলীগ দাবি করে সুবিধা নিতে চাইলে আমাদের কিছু করার নেই।
২০১০ সালের ১৯ মে রাশেদুল ইসলাম শাফিনকে সভাপতি ও নির্ঝর আলম সাম্যকে সাধারণ সম্পাদক করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের পর অভ্যন্তরীণ কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অভিযোগ ওঠে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীরের এলাকা গোপালগঞ্জের নাহিদুজ্জামান সাগর, এসএম শামিম, শেখ শরিফুল ইসলাম নতুন কমিটিতে পদবঞ্চিত হন। অবশ্য অন্য নেতা শেখ নেয়ামুল পারভেজ সহসভাপতি পদ পেলেও তুষ্ট হতে পারেননি এ ফোরামের নেতাকর্মীরা। ২০১০ সালের ৫ জুলাই অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের পর কমিটির সভাপতি- সাধারণ সম্পাদকসহ দু'শতাধিক নেতাকর্মী ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয়। এরপর ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করে কেন্দ্রীয় কমিটি। এসব নেতাকর্মীই আবার ফিরে এসে ক্যাম্পাস দাবড়ে বেড়াচ্ছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর কখনোই স্বাভাবিক থাকেনি এসব নেতাকর্মীর কার্যক্রম। গত বছর বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ২৬ জানুয়ারি মীর মশাররফ হোসেন হল ও আল-বেরুনী (বর্ধিতাংশ) হলের ছাত্রলীগ কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এরপর শহীদ সালাম বরকত হল, কামাল উদ্দিন হল ও আল-বেরুনী হলের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের নাটক চলাকালে সাংস্কৃতিক কর্মীদের ওপরও হামলা চালায়। ২০১১-এর ১ ফেব্রুয়ারি সহকারী প্রক্টর কামাল হোসেন ও সাবি্বর আলমের তত্ত্বাবধানে ৩০-৩৫ ছাত্রলীগ কর্মী সশস্ত্র অবস্থায় শেখ নেয়ামুল পারভেজ ও আজগর আলীর নেতৃত্বে প্রতিপক্ষ ছাত্রলীগ কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়ে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেয়। সারাবছরই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের কর্মীদের মারধর ও নির্যাতন করে এসব ছাত্রলীগ নেতাকর্মী।
প্রতিপক্ষের ওপর হামলা
প্রতিপক্ষের প্রতি আগ্রাসী মনোভাবের কারণে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের নেতাকর্র্মীরা ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত। ছাত্রলীগের হামলা ও নির্যাতনের ভয়ে ব্যাহত হচ্ছে দু'শতাধিক ছাত্রদল কর্মীর স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন। এরপরও যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্যাম্পাসে আসেন পরীক্ষা দিতে, তারা প্রায়ই ছাত্রলীগের নির্যাতন ও হামলার শিকার হন। গত বছর প্রায় ২৫-৩০ ছাত্রদল কর্মীকে মারধর ও নির্যাতন করে ছাত্রলীগ কর্মীরা। বিভিন্ন সময় ছাত্রদল সন্দেহে বের করে দেওয়া হয় আরও অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে। তাদের নির্যাতন ও মারধরের হাত থেকে বাদ যায়নি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। গত অক্টোবরে শহীদ রফিক জব্বার হলে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রফ্রন্টের প্রথম বর্ষের দু'কর্মীকে মারধর করা হয়।
মাদক সেবন
সম্প্রতি মীর মশাররফ হোসেন হল, মওলানা ভাসানী হল, কামাল উদ্দিন হল, রফিক জব্বার হলে মাদক সেবনের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এ বিষয়টি দেখে ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগ কর্মী সম্রাট, রাজিব, মিশুক, রাহাত, চয়ন, অর্ণব, ফেরদৌস, মিঠুন। ১১ জুলাই ঘুমের ওষুধ না দেওয়ায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলের ছাত্রলীগ কর্মী অর্ণব ৫-৬ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে ওষুধের দোকানে ভাংচুর এবং দোকানিকে মারধর করে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা কিছু কর্মচারীর যোগসাজশে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
র্যাগিং
ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতে হলের নতুন শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায় সিনিয়ররা। কথা না শুনলে, মিছিলে না গেলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা শিকার হন ছাত্রলীগের নির্যাতনের। ভয় থাকে হলের সিট হারানোর। 'র্যাগিং' নামের নির্যাতনের আতঙ্কে থাকেন ক্যাম্পাসের নবীন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে গত বছর অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কাজে লাগিয়ে টাকার বিনিময়ে চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারে জোর করে সাধারণ ছাত্রদের ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ কর্মী লিটন, মইন, শরিফসহ ৪-৫ জন প্রচার কার্যক্রমে যেতে সাধারণ ছাত্রদের বাধ্য করে। নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নেওয়া এসব শিক্ষার্থী ওই এলাকার ভোটার নন। ছাত্রলীগ কর্মীরা অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে।
চাঁদার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংস্কার কাজও বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ১৩ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ টাকার সংস্কার কাজ বন্ধ করে দেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দাবি, ছাত্রলীগ নেতা আসগর আলী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স নয়ারহাট ট্রেডার্সের কাছ থেকে ২৬ হাজার চাঁদা নিয়েছে। এরপর হলের চাঁদার টাকার ভাগবঞ্চিত নেতাকর্মীরা কাজ বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলাচলকারী সুপার, হানিফ, আনন্দ সুপার, শুভযাত্রা, তিতাস পরিবহনের বাস থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করা হয় বলে জানিয়েছে ছাত্রলীগের বিশ্বস্ত একটি সূত্র। ছাত্রলীগ নেতা আসগর এসব চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে। তার ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ায় জুনিয়র নেতাকর্মীদের মধ্যে এসব চাঁদাবাজির দখল নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। যে কোনো সময় বিষয়টিকে কেন্দ্র করে আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মনমতো সংবাদ পরিবেশন না করায় গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু গণমাধ্যম কর্মীকে নির্যাতন করে ছাত্রলীগ নামধারী শিক্ষার্থীরা। গত বছরের জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ৪ সাংবাদিককে নির্যাতন করে মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগ কর্মীরা। এ ছাড়া বছরের মাঝামাঝি সময়ে ভোরের ডাক পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি নাসির উদ্দিনকে কামাল উদ্দিন হলে ছাত্রলীগ কর্মীরা মারধর করে। গত নভেম্বরে জনকণ্ঠের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আহমেদ রিয়াদকেও মারধর করে ছাত্রলীগ কর্মীরা। গতকাল মঙ্গলবার ছাত্রলীগের মিছিল চলাকালে ছবি তুলতে গেলে নিউ এজের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি নাজমুস সাকিব রাফসানকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয় ছাত্রলীগ কর্মী সুমন।
মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগ কর্মী আশরাফুজ্জামান লিটন, ভাসানী হলের মেহেদী হাসান সম্রাট, আল-বেরুনী হলের সকাল জানায়, ছাত্রত্ব শেষ হলেও শেখ শরিফুল ইসলাম, এসএস শামিম, আসগর আলীই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সরকার আসগর আলী বলেন, ছাত্রত্ব শেষ হওয়ায় আমি এখন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই। তিনি তার ব্যাপারে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
শেখ শরিফুল ইসলাম নিজেকে এমফিলের শিক্ষার্থী দাবি করে বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা জয় বাংলা স্লোগান দেয়। কর্মসূচি পালন করে। ছাত্রলীগ কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। যে কেউ এ সংক্রান্ত কর্মসূচি পালন করে। উপাচার্যের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন তারা। শামিমের ফোনে বারবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সভাপতি রাশেদুল ইসলাম শাফিন ও সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলম সাম্য বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বর্তমান উপাচার্য ছাত্রলীগের দু'শতাধিক নেতাকর্মীর শিক্ষাজীবন হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বৈরাচারী রাজত্ব কায়েম করেছেন। অবিলম্বে ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানান তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষক সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক সুভাষ চন্দ্র দাস বলেন, দলীয় মানসিকতা পরিহার করে প্রশাসকদের দায়িত্ব পালন করা উচিত। উপাচার্যের উচিত সব শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেওয়া।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কোনো পক্ষকে সমর্থন দেওয়ার কথা অস্বীকার করে উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবীর বলেছেন, সরকার সমর্থক এ ছাত্র সংগঠনের দায়-দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নেবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমদ ছাত্রলীগের 'উপাচার্য গ্রুপ' নামে পরিচিত অংশের কর্মীদের হামলায় নিহত হওয়ার পর উপাচার্য ও তার প্রশাসন ব্যাপক
সমালোচনার মুখে পড়ে। উপাচার্য মঙ্গলবার নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ছাত্রলীগে আমার কোনো গ্রুপ নেই। উপাচার্য বা প্রশাসন কখনোই ছাত্রলীগের কোনো কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত নয়। ছাত্রলীগের কোনো কর্মকাণ্ডের দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নেবে না_ এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, যারা অপরাধ করেছে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে অবশ্য মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন উপাচার্য।
এদিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ এ প্রতিবেদককে বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কোনো কমিটির কার্যক্রম চালু না থাকায় এর দায়িত্ব সংগঠন নেবে না। আমরা জানতে পেরেছি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে এসব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কেউ নিজেকে জোর করে ছাত্রলীগ দাবি করে সুবিধা নিতে চাইলে আমাদের কিছু করার নেই।
২০১০ সালের ১৯ মে রাশেদুল ইসলাম শাফিনকে সভাপতি ও নির্ঝর আলম সাম্যকে সাধারণ সম্পাদক করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের পর অভ্যন্তরীণ কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অভিযোগ ওঠে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীরের এলাকা গোপালগঞ্জের নাহিদুজ্জামান সাগর, এসএম শামিম, শেখ শরিফুল ইসলাম নতুন কমিটিতে পদবঞ্চিত হন। অবশ্য অন্য নেতা শেখ নেয়ামুল পারভেজ সহসভাপতি পদ পেলেও তুষ্ট হতে পারেননি এ ফোরামের নেতাকর্মীরা। ২০১০ সালের ৫ জুলাই অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের পর কমিটির সভাপতি- সাধারণ সম্পাদকসহ দু'শতাধিক নেতাকর্মী ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয়। এরপর ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করে কেন্দ্রীয় কমিটি। এসব নেতাকর্মীই আবার ফিরে এসে ক্যাম্পাস দাবড়ে বেড়াচ্ছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর কখনোই স্বাভাবিক থাকেনি এসব নেতাকর্মীর কার্যক্রম। গত বছর বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ২৬ জানুয়ারি মীর মশাররফ হোসেন হল ও আল-বেরুনী (বর্ধিতাংশ) হলের ছাত্রলীগ কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এরপর শহীদ সালাম বরকত হল, কামাল উদ্দিন হল ও আল-বেরুনী হলের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের নাটক চলাকালে সাংস্কৃতিক কর্মীদের ওপরও হামলা চালায়। ২০১১-এর ১ ফেব্রুয়ারি সহকারী প্রক্টর কামাল হোসেন ও সাবি্বর আলমের তত্ত্বাবধানে ৩০-৩৫ ছাত্রলীগ কর্মী সশস্ত্র অবস্থায় শেখ নেয়ামুল পারভেজ ও আজগর আলীর নেতৃত্বে প্রতিপক্ষ ছাত্রলীগ কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়ে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেয়। সারাবছরই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের কর্মীদের মারধর ও নির্যাতন করে এসব ছাত্রলীগ নেতাকর্মী।
প্রতিপক্ষের ওপর হামলা
প্রতিপক্ষের প্রতি আগ্রাসী মনোভাবের কারণে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের নেতাকর্র্মীরা ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত। ছাত্রলীগের হামলা ও নির্যাতনের ভয়ে ব্যাহত হচ্ছে দু'শতাধিক ছাত্রদল কর্মীর স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন। এরপরও যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্যাম্পাসে আসেন পরীক্ষা দিতে, তারা প্রায়ই ছাত্রলীগের নির্যাতন ও হামলার শিকার হন। গত বছর প্রায় ২৫-৩০ ছাত্রদল কর্মীকে মারধর ও নির্যাতন করে ছাত্রলীগ কর্মীরা। বিভিন্ন সময় ছাত্রদল সন্দেহে বের করে দেওয়া হয় আরও অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে। তাদের নির্যাতন ও মারধরের হাত থেকে বাদ যায়নি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। গত অক্টোবরে শহীদ রফিক জব্বার হলে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রফ্রন্টের প্রথম বর্ষের দু'কর্মীকে মারধর করা হয়।
মাদক সেবন
সম্প্রতি মীর মশাররফ হোসেন হল, মওলানা ভাসানী হল, কামাল উদ্দিন হল, রফিক জব্বার হলে মাদক সেবনের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এ বিষয়টি দেখে ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগ কর্মী সম্রাট, রাজিব, মিশুক, রাহাত, চয়ন, অর্ণব, ফেরদৌস, মিঠুন। ১১ জুলাই ঘুমের ওষুধ না দেওয়ায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলের ছাত্রলীগ কর্মী অর্ণব ৫-৬ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে ওষুধের দোকানে ভাংচুর এবং দোকানিকে মারধর করে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা কিছু কর্মচারীর যোগসাজশে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
র্যাগিং
ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতে হলের নতুন শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায় সিনিয়ররা। কথা না শুনলে, মিছিলে না গেলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা শিকার হন ছাত্রলীগের নির্যাতনের। ভয় থাকে হলের সিট হারানোর। 'র্যাগিং' নামের নির্যাতনের আতঙ্কে থাকেন ক্যাম্পাসের নবীন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে গত বছর অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কাজে লাগিয়ে টাকার বিনিময়ে চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারে জোর করে সাধারণ ছাত্রদের ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ কর্মী লিটন, মইন, শরিফসহ ৪-৫ জন প্রচার কার্যক্রমে যেতে সাধারণ ছাত্রদের বাধ্য করে। নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নেওয়া এসব শিক্ষার্থী ওই এলাকার ভোটার নন। ছাত্রলীগ কর্মীরা অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে।
চাঁদার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংস্কার কাজও বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ১৩ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ টাকার সংস্কার কাজ বন্ধ করে দেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দাবি, ছাত্রলীগ নেতা আসগর আলী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স নয়ারহাট ট্রেডার্সের কাছ থেকে ২৬ হাজার চাঁদা নিয়েছে। এরপর হলের চাঁদার টাকার ভাগবঞ্চিত নেতাকর্মীরা কাজ বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলাচলকারী সুপার, হানিফ, আনন্দ সুপার, শুভযাত্রা, তিতাস পরিবহনের বাস থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করা হয় বলে জানিয়েছে ছাত্রলীগের বিশ্বস্ত একটি সূত্র। ছাত্রলীগ নেতা আসগর এসব চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে। তার ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ায় জুনিয়র নেতাকর্মীদের মধ্যে এসব চাঁদাবাজির দখল নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। যে কোনো সময় বিষয়টিকে কেন্দ্র করে আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মনমতো সংবাদ পরিবেশন না করায় গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু গণমাধ্যম কর্মীকে নির্যাতন করে ছাত্রলীগ নামধারী শিক্ষার্থীরা। গত বছরের জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ৪ সাংবাদিককে নির্যাতন করে মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগ কর্মীরা। এ ছাড়া বছরের মাঝামাঝি সময়ে ভোরের ডাক পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি নাসির উদ্দিনকে কামাল উদ্দিন হলে ছাত্রলীগ কর্মীরা মারধর করে। গত নভেম্বরে জনকণ্ঠের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আহমেদ রিয়াদকেও মারধর করে ছাত্রলীগ কর্মীরা। গতকাল মঙ্গলবার ছাত্রলীগের মিছিল চলাকালে ছবি তুলতে গেলে নিউ এজের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি নাজমুস সাকিব রাফসানকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয় ছাত্রলীগ কর্মী সুমন।
মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগ কর্মী আশরাফুজ্জামান লিটন, ভাসানী হলের মেহেদী হাসান সম্রাট, আল-বেরুনী হলের সকাল জানায়, ছাত্রত্ব শেষ হলেও শেখ শরিফুল ইসলাম, এসএস শামিম, আসগর আলীই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সরকার আসগর আলী বলেন, ছাত্রত্ব শেষ হওয়ায় আমি এখন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই। তিনি তার ব্যাপারে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
শেখ শরিফুল ইসলাম নিজেকে এমফিলের শিক্ষার্থী দাবি করে বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা জয় বাংলা স্লোগান দেয়। কর্মসূচি পালন করে। ছাত্রলীগ কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। যে কেউ এ সংক্রান্ত কর্মসূচি পালন করে। উপাচার্যের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন তারা। শামিমের ফোনে বারবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সভাপতি রাশেদুল ইসলাম শাফিন ও সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলম সাম্য বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বর্তমান উপাচার্য ছাত্রলীগের দু'শতাধিক নেতাকর্মীর শিক্ষাজীবন হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বৈরাচারী রাজত্ব কায়েম করেছেন। অবিলম্বে ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানান তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষক সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক সুভাষ চন্দ্র দাস বলেন, দলীয় মানসিকতা পরিহার করে প্রশাসকদের দায়িত্ব পালন করা উচিত। উপাচার্যের উচিত সব শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেওয়া।
No comments