জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রহত্যা-ছাত্রলীগের রাশ টানবে কে?
আবারও রক্তাক্ত হলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। নিজ সংগঠনের সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হলেন ছাত্রলীগ কর্মী জুবায়ের আহমেদ। একজন মায়ের বুক খালি হলো, পিতার স্বপ্নের সমাধি ঘটল, একটি পরিবার হলো শোকে মুহ্যমান। শুধু নিহতের পরিবার নয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে নাগরিকরা রীতিমতো উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত।
সবার মুখে এক প্রশ্ন, অন্তর্দলীয় কোন্দলে যে সংগঠনের কর্মীরা নিজেদের কর্মীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে, পিটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়, রক্তাক্ত করে ছাদ থেকে ফেলে দেয় তারা বিরুদ্ধ বা অন্যমতের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে? যে সংগঠনের কর্মীরা একজন সহপাঠীকে পিটিয়ে মৃত্যু ঘটাতে পারে তারা কতটা নির্মম? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করে মানুষ হওয়ার জন্য পাঠান। কিন্তু কেন, কোন পরিস্থিতিতে তারা এমন নির্মম নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়? সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হল দখল, বখরা আদায়, নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ থেকে শুরু করে হত্যার মতো অপরাধ পর্যন্ত করতে তারা পিছপা হয় না কেন? শুধু জাহাঙ্গীরনগর নয়, সারাদেশেই ছাত্রলীগ প্রতিদিন একাধিক দুঃসংবাদ তৈরি করছে। ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ভালো খবর তৈরি করতে পারছেন না। সরকার সমর্থক এ ছাত্র সংগঠনটিকে নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যকর উদ্যোগও দৃশ্যমান নয়। বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে দলীয় নেতা ও প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশ্রয়ে তাদের অপকর্মগুলো চলছে বলে অভিযোগ মিলছে। প্রশ্ন হলো, কেন এই সংগঠনটিকে বিশেষ রেয়াত দেওয়া হচ্ছে? এর মধ্য দিয়ে তো শুধু ওই ছাত্র সংগঠনটিই নয়, সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের গ্রুপিংয়ের যে সংবাদ পত্রিকায় এসেছে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার আরও কারণ রয়েছে। ২০১০ সালের ৫ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করেছে। তারপরও সংগঠনের কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তায় স্থানীয়ভাবে সংগঠিত হয়েছে। তারা হলে হলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নানা উপদ্রব করেছে। সবচেয়ে লজ্জার বিষয় হলো, বর্তমানে সংগঠনের যে অংশটির নিয়ন্ত্রণ ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত তারা 'উপাচার্য গ্রুপ' নামে পরিচিত। হত্যার অভিযোগ উঠেছে এ গ্রুপের কয়েকজন কর্মীর বিরুদ্ধে। প্রশ্ন উঠবে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যেখানে সব ছাত্রের নিরাপত্তা ও স্বার্থ দেখার কথা সেখানে একটি সংগঠনের উপদলীয় কোন্দলে যুক্ত হয়ে কী করে তারা সে উপদলকে আধিপত্য বিস্তারে সহায়তা করে? বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকরা যদি সজাগ না হন, তাহলে শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তা পাবে কোথায়? সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে স্পষ্ট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ যে বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটল তার প্রেক্ষাপট একদিনে তৈরি হয়নি। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল সুরাহার কোনো ব্যবস্থা আসলে হয়নি, সংগঠনের ভেতরে সন্ত্রাসীদের রুখবার যথাযথ ব্যবস্থাও হয়নি। কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠনটির কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও স্থানীয়ভাবে সংগঠন কাজ করেছে কিন্তু এর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা আসেনি। এমন আলামতও স্পষ্ট যে, ছাত্রলীগের উপদলগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকদের রাজনৈতিক অভীপ্সা পূরণে কাজ করেছে। যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটি খুব বেদনাদায়ক পরিস্থিতি। আমরা আশা করব, জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের পর সবার সম্বিত ফিরে আসবে। জুবায়েরের প্রাণহানির পর ভবিষ্যতে যাতে আর কোনো সন্ত্রাসের ঘটনা না ঘটে সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটানোর উদ্যোগ নেওয়া হোক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সরকারকে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে। অভিযোগ আছে, এ সংগঠনের কর্মীরা একের পর এক অপরাধ করেও রেয়াত পেয়ে যান। এটি তাদের বেপরোয়া হয়ে ওঠার পক্ষে যুক্তি তৈরি করছে। এক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনকেও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া দরকার। জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, সেটি প্রাথমিক শাস্তি, কিন্তু হত্যার দায়ে যাতে তাদের উপযুক্ত শাস্তি হয় তাও নিশ্চিত করা জরুরি। আমরা চাই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর কোনো ছাত্রের রক্তে রঞ্জিত না হোক, শিক্ষার আলো সন্ত্রাসের অন্ধকারকে দূরীভূত করুক।
No comments