বহে কাল নিরবধি-মার্কিনদের ইরাক রণাঙ্গনে ফেয়ারওয়েল টু আর্মস! by এম আবদুল হাফিজ
প্রথম মহাযুদ্ধের অংশবিশেষ অবলম্বনে নির্মিত আর্নেস্ট হেমিংওয়ের Farewell to Arms ছায়াছবিটি দেখেছিলাম প্রায় ৫০ বছর আগে। মানবিক ট্র্যাজেডিতে পরিপূর্ণ সেই ছায়াছবিতে প্রদর্শিত ঘটনাপুঞ্জে সামান্য তারতম্য ঘটিয়ে মার্কিনদের ইরাক রণাঙ্গন থেকে Farewell to Arms-এর পুনরাবৃত্তি ঘটানোর কথা ভাবিনি কখনো।
দুটি বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে বেশি সময়জুড়ে এক অযাচিত যুদ্ধের ধ্বংসলীলার পর পরিস্থিতিতে এখন যে সমীকরণ দৃশ্যমান, তারই বিবেচনায় মার্কিনদের বিদায় হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। ৩১ ডিসেম্বর দখলদারি প্রত্যাহারের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইরাক আর অস্ত্রের ভাষায় কথা না বলে স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে কূটনীতির ভাষায়ই কথা বলবে। তবে তার আগে উভয় পক্ষই বাঙ্বন্দি করবে উর্দি, গুটিয়ে নেবে রণাঙ্গনের তাঁবু এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বসে যাবেন হিসাব-নিকাশে এ কথা স্থির করতে যে এই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও ব্যয় কতটা যৌক্তিক। কিন্তু এতটুকু সবাই বোঝে যে ইরাকে যুদ্ধজনিত জখমের দাগ দুই পক্ষের জন্যই অনেক গভীর। পাঁচ সপ্তাহ ধরেই দক্ষিণে কুয়েত পর্যন্ত প্রসারিত মহাসড়ক যুদ্ধফেরত মার্কিন কনভয়ে ঠাসা এবং বাগদাদের আকাশ দেশে প্রত্যাবর্তনকারী সেনাদের ঘরে ফিরিয়ে নিতে ব্যস্ত। এ জন্য নির্ধারিত সময়সীমা ৩১ ডিসেম্বরের সীমারেখা বহাল রাখতেই এ তৎপরতা। তাই গ্রিস ও ইউফ্রেটিসের মধ্যবর্তী এই প্রাচীন দেশটি থেকে বিদায় নেওয়ার দিনক্ষণ চূড়ান্ত করতে মাত্র কয়েক দিন আগেই মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাগদাদে এসেছিলেন।
২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর মার্কিনদের জন্য বিভীষিকাময় সাড়ে আট বছরের যুদ্ধাবসান এবং তা ইরাকিদের জন্য দেশকে পুনর্নির্মাণের সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার শুরু। তাদের সঙ্গে সঙ্গে উপজাতীয়, জাতিগোষ্ঠীগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগত বিভেদ ও বিরোধের অবসান ঘটানোর মোক্ষম সময়। যে দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা লক্ষ করি না কেন, মার্কিনদের কুখ্যাত ইরাক অভিযান পরবর্তী সময়ে ঔপনিবেশিক ধাঁচের দখলদারিতে পরিণত হয়। এই যুদ্ধের আয়োজনও ছিল তেমনই। এটা মার্কিনদের হেসেখেলে কোনো 'হাইতি' বা 'গ্রানাডা' আক্রমণের ব্যাপার ছিল না।
নিঃসন্দেহে আমেরিকার ইরাক যুদ্ধ ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর ওয়াশিংটনের সবচেয়ে মারাত্মক বৈদেশিক নীতিভ্রষ্টতা। এর জন্য অবশ্য এই যুদ্ধ ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্রের কু-অভিসন্ধি কম দায়ী ছিল না। দায়ী ছিল সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার মিথ সৃষ্টি।
দখলদাররা বিদায় নিলেও ইরাক যুদ্ধের দাগ কি এত সহজে মুছবে? ভেবে দেখুন, লাখ লাখ ইরাকি, যারা প্রায় এক যুগের এই যুদ্ধে নিহত হয়েছে, প্রায় একই সংখ্যার ইরাকি আহত হয়েছে, গৃহহীন হয়েছে আরো ২০ লাখ লোক। যদিও এই সংখ্যা একেবারে সঠিক নয়। মার্কিনদের হত্যা-জখম তুলনামূলক কম হলেও তারাও একেবারে অক্ষত নয়। আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার মার্কিন নিহত হলেও ৩০ হাজার আহত হয়েছে। আরো ভাবুন যে এই সংখ্যাগুলো ট্র্যাজেডির জন্য বিপুল সংখ্যার। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য যুদ্ধ-ব্যয়ের কথা কদাচিৎ উঠে আসে। কিন্তু ইরাক যুদ্ধের এ ব্যয়ও চাঞ্চল্যকর।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক পলিসির প্রভাষক লিন্ডা বিলস্ এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক জোসেফ স্টিগলিট_এই দুজনের অনুমানে এ যুদ্ধ বাবদ মার্কিন করদাতাদের সর্বমোট ছয় ট্রিলিয়ন ডলার দিতে হবে। তথ্যটি প্রকাশ পেয়েছে ২০০৮ সালের সাড়াজাগানো গ্রন্থ 'দ্য থ্রি ট্রিলিয়ন ডলার ওয়ার'-এ। প্রাথমিকভাবে যেখান থেকেই এ অর্থ নেওয়া হয়ে থাক না কেন, কর্জ করা যুদ্ধ-ব্যয়ের এই অর্থে সুদ কষলে তা আরো অনেক বেশি স্ফীত হওয়ার কথা। তার ওপর রয়েছে যুদ্ধের ভ্যাটানরানদের বাবদ খরচ, যার বোঝা সারা জীবনের জন্য রাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে তাদের অব্যাহত চিকিৎসাসেবা ও জীবনধারণের।
এসবের জন্য নব্য রক্ষণশীল, রিপাবলিকান পার্টির একজন গোঁয়ার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে দোষারোপ করা যেতে পারে। অতঃপর এই দোষারোপে মার্কিন জনগণও শামিল হয়ে যায় না কি? তারাই তো বুশের মিথ্যাচারের কাছে হার মেনেছিল যে বুশ-ব্লেয়ার প্রস্তাবিত ইরাক যুদ্ধ আসলেই আবশ্যক, যদিও অন্তরালে তাঁরা সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন। যুদ্ধ যখন অতীতের বিষয়, নিউ ইয়র্ক টাইমস বা ওয়াশিংটন পোস্টের মতো মিডিয়ার বাহকগুলোকে শুধু অবজ্ঞার দৃষ্টিপাতে বিক্ষত করা যায়, তার বেশি কিছু সম্ভব নয়। এরা সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হালকা যুক্তিগুলোকে ভেদ না করে মার্কিন নেতৃত্বকে যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে অন্ধকারে রাখে। এরা পল উলফভিৎস, ডিক চেনি বা রামসফেল্ডের মতো যুদ্ধবাজদের ভণ্ডামি থেকে দেশ বা জনগণকে বাঁচাতে কোনো চেষ্টা করেনি। বরং ঘটনার গড্ডলিকা প্রবাহে যুদ্ধকে উৎসাহিতই করেছে।
বাইডেনের বাগদাদ সফর অতঃপর ইরাকের সঙ্গে মার্কিনদের নতুন সম্পর্ককে আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে থাকবে। আপাতভাবে এ সম্পর্ক হবে দুই স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের; যুদ্ধের মাধ্যমে দখলদার এবং হুকুম তামিল করার সম্পর্ক নয়।
তবু বিস্ময় লাগে, যে যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২০ লাখ মার্কিন, যারা বিগত সাড়ে আট বছরে কোনো না কোনো সময়ে ইরাক রণাঙ্গনে মোতায়েন ছিল, তাদের মধ্যে কি কোনো উঠতি লেখক ছিল না যে তাঁরা 'ইরাক উপন্যাস' নিয়েও কাজ করছিলেন, যা গুণে-মানে নরম্যান মাইলের সমকক্ষ হবেন। নরম্যান মাইল ১৯৪৮ সালে যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ একেবারে থামেনি এবং ফিলিপাইনে অভিযান চলমান, সে সময় সেনাদের কষ্ট ও যন্ত্রণা নিয়ে 'The 'Naked and dead' লিখেছিলেন। ১৯৭৭ সালে জন্মগ্রহণকারী এই লেখকের ভিয়েতনাম যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা স্মৃতিকথা যুদ্ধ সম্পর্কিত একটি ক্লাসিক এবং ক্লাসিক সাহিত্য যুদ্ধের ক্ষত থেকেই জন্ম নেয়। যেমন জন্ম নিয়েছিল হেমিংওয়ের হাতে 'এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস'।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক
বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট
২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর মার্কিনদের জন্য বিভীষিকাময় সাড়ে আট বছরের যুদ্ধাবসান এবং তা ইরাকিদের জন্য দেশকে পুনর্নির্মাণের সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার শুরু। তাদের সঙ্গে সঙ্গে উপজাতীয়, জাতিগোষ্ঠীগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগত বিভেদ ও বিরোধের অবসান ঘটানোর মোক্ষম সময়। যে দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা লক্ষ করি না কেন, মার্কিনদের কুখ্যাত ইরাক অভিযান পরবর্তী সময়ে ঔপনিবেশিক ধাঁচের দখলদারিতে পরিণত হয়। এই যুদ্ধের আয়োজনও ছিল তেমনই। এটা মার্কিনদের হেসেখেলে কোনো 'হাইতি' বা 'গ্রানাডা' আক্রমণের ব্যাপার ছিল না।
নিঃসন্দেহে আমেরিকার ইরাক যুদ্ধ ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর ওয়াশিংটনের সবচেয়ে মারাত্মক বৈদেশিক নীতিভ্রষ্টতা। এর জন্য অবশ্য এই যুদ্ধ ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্রের কু-অভিসন্ধি কম দায়ী ছিল না। দায়ী ছিল সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার মিথ সৃষ্টি।
দখলদাররা বিদায় নিলেও ইরাক যুদ্ধের দাগ কি এত সহজে মুছবে? ভেবে দেখুন, লাখ লাখ ইরাকি, যারা প্রায় এক যুগের এই যুদ্ধে নিহত হয়েছে, প্রায় একই সংখ্যার ইরাকি আহত হয়েছে, গৃহহীন হয়েছে আরো ২০ লাখ লোক। যদিও এই সংখ্যা একেবারে সঠিক নয়। মার্কিনদের হত্যা-জখম তুলনামূলক কম হলেও তারাও একেবারে অক্ষত নয়। আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার মার্কিন নিহত হলেও ৩০ হাজার আহত হয়েছে। আরো ভাবুন যে এই সংখ্যাগুলো ট্র্যাজেডির জন্য বিপুল সংখ্যার। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য যুদ্ধ-ব্যয়ের কথা কদাচিৎ উঠে আসে। কিন্তু ইরাক যুদ্ধের এ ব্যয়ও চাঞ্চল্যকর।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক পলিসির প্রভাষক লিন্ডা বিলস্ এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক জোসেফ স্টিগলিট_এই দুজনের অনুমানে এ যুদ্ধ বাবদ মার্কিন করদাতাদের সর্বমোট ছয় ট্রিলিয়ন ডলার দিতে হবে। তথ্যটি প্রকাশ পেয়েছে ২০০৮ সালের সাড়াজাগানো গ্রন্থ 'দ্য থ্রি ট্রিলিয়ন ডলার ওয়ার'-এ। প্রাথমিকভাবে যেখান থেকেই এ অর্থ নেওয়া হয়ে থাক না কেন, কর্জ করা যুদ্ধ-ব্যয়ের এই অর্থে সুদ কষলে তা আরো অনেক বেশি স্ফীত হওয়ার কথা। তার ওপর রয়েছে যুদ্ধের ভ্যাটানরানদের বাবদ খরচ, যার বোঝা সারা জীবনের জন্য রাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে তাদের অব্যাহত চিকিৎসাসেবা ও জীবনধারণের।
এসবের জন্য নব্য রক্ষণশীল, রিপাবলিকান পার্টির একজন গোঁয়ার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে দোষারোপ করা যেতে পারে। অতঃপর এই দোষারোপে মার্কিন জনগণও শামিল হয়ে যায় না কি? তারাই তো বুশের মিথ্যাচারের কাছে হার মেনেছিল যে বুশ-ব্লেয়ার প্রস্তাবিত ইরাক যুদ্ধ আসলেই আবশ্যক, যদিও অন্তরালে তাঁরা সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন। যুদ্ধ যখন অতীতের বিষয়, নিউ ইয়র্ক টাইমস বা ওয়াশিংটন পোস্টের মতো মিডিয়ার বাহকগুলোকে শুধু অবজ্ঞার দৃষ্টিপাতে বিক্ষত করা যায়, তার বেশি কিছু সম্ভব নয়। এরা সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হালকা যুক্তিগুলোকে ভেদ না করে মার্কিন নেতৃত্বকে যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে অন্ধকারে রাখে। এরা পল উলফভিৎস, ডিক চেনি বা রামসফেল্ডের মতো যুদ্ধবাজদের ভণ্ডামি থেকে দেশ বা জনগণকে বাঁচাতে কোনো চেষ্টা করেনি। বরং ঘটনার গড্ডলিকা প্রবাহে যুদ্ধকে উৎসাহিতই করেছে।
বাইডেনের বাগদাদ সফর অতঃপর ইরাকের সঙ্গে মার্কিনদের নতুন সম্পর্ককে আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে থাকবে। আপাতভাবে এ সম্পর্ক হবে দুই স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের; যুদ্ধের মাধ্যমে দখলদার এবং হুকুম তামিল করার সম্পর্ক নয়।
তবু বিস্ময় লাগে, যে যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২০ লাখ মার্কিন, যারা বিগত সাড়ে আট বছরে কোনো না কোনো সময়ে ইরাক রণাঙ্গনে মোতায়েন ছিল, তাদের মধ্যে কি কোনো উঠতি লেখক ছিল না যে তাঁরা 'ইরাক উপন্যাস' নিয়েও কাজ করছিলেন, যা গুণে-মানে নরম্যান মাইলের সমকক্ষ হবেন। নরম্যান মাইল ১৯৪৮ সালে যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ একেবারে থামেনি এবং ফিলিপাইনে অভিযান চলমান, সে সময় সেনাদের কষ্ট ও যন্ত্রণা নিয়ে 'The 'Naked and dead' লিখেছিলেন। ১৯৭৭ সালে জন্মগ্রহণকারী এই লেখকের ভিয়েতনাম যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা স্মৃতিকথা যুদ্ধ সম্পর্কিত একটি ক্লাসিক এবং ক্লাসিক সাহিত্য যুদ্ধের ক্ষত থেকেই জন্ম নেয়। যেমন জন্ম নিয়েছিল হেমিংওয়ের হাতে 'এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস'।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক
বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট
No comments